কেবল জাতীয় সাংবিধানিক কমিশনের (এনসিসি) সিদ্ধান্তক্রমে রাষ্ট্রপতি জরুরি অবস্থা ঘোষণা করতে পারবেন, সংবিধান সংস্কার কমিশনের এমন সুপারিশের সঙ্গে একমত হয়নি বিএনপি। দলটি বলেছে, জরুরি অবস্থা জারির সঙ্গে সরকারের নির্বাহী কর্তৃত্বের বিষয়টি অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত বিধায় এ–সংক্রান্ত ক্ষমতা সরকার ও সংসদের বাইরে অন্য কোনো কর্তৃপক্ষের কাছে থাকা সংগত নয়।

সংস্কার কমিশনের সুপারিশে আরও বলা হয়, জরুরি অবস্থার সময় নাগরিকদের কোনো অধিকার রদ বা স্থগিত করা যাবে না এবং আদালতে যাওয়ার অধিকার বন্ধ বা স্থগিত করা যাবে না। তাই সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৪১(খ) এবং অনুচ্ছেদ ১৪১(গ) বাতিল হবে। এই প্রস্তাবের সঙ্গেও একমত নয় বিএনপি। দলটির মত, নাগরিকদের কোনো অধিকার রদ বা স্থগিত না করে জরুরি অবস্থা জারির কী উদ্দেশ্য থাকতে পারে, প্রস্তাবিত সুপারিশে তা বোধগম্য নয়।

গত রোববার জাতীয় ঐকমত্য কমিশনে জমা দেওয়া সংবিধান সংস্কার কমিশনের সুপারিশের ওপর বিএনপি এই মতামত তুলে ধরেছে। সেখানে বিএনপির দেওয়া মতামতগুলো পর্যালোচনা করে এসব তথ্য জানা গেছে। ওই দিন বিএনপি সংবিধানসহ পাঁচ সংস্কার কমিশনের সুপারিশের ওপরও বিস্তারিত মতামত জমা দেয়।

সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, সংস্কার কমিশনগুলোর সুপারিশের ওপর দেওয়া মতামতে বিএনপি জাতীয় সংসদের মেয়াদ পাঁচ বছর বহাল রাখার পক্ষে মত দিয়েছে। সংস্কার কমিশনের সংসদের মেয়াদ চার বছর করার সুপারিশের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেছে। একই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী রাজনৈতিক দলের প্রধান ও সংসদ নেতা হতে পারবেন না বলে সংস্কার কমিশন যে প্রস্তাব দিয়েছে, তার সঙ্গে ভিন্নমত জানিয়েছে বিএনপি। দলটি বলেছে, এটি সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দলের নিজস্ব সিদ্ধান্তের বিষয়।

এ বিষয়ে বিএনপির ব্যাখ্যা হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রী দলের প্রধান অথবা সংসদ নেতার পদে কোনো এক বা একাধিক ব্যক্তি অধিষ্ঠিত হবেন কি না, তা একান্তই সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দলের সিদ্ধান্ত হওয়া উচিত। এ ক্ষেত্রে সাংবিধানিকভাবে কোনো বিধিনিষেধ আরোপ সংসদীয় গণতন্ত্রের মূল চেতনার পরিপন্থী।

সংবিধান সংস্কার কমিশনের সুপারিশে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মেয়াদ তিন মাসের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু নির্বাচন কমিশন সংস্কার কমিশন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মেয়াদ চার মাস করার প্রস্তাব করেছে। এ সময়ে জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকারের সব নির্বাচন অনুষ্ঠানের সুপারিশ করা হয়েছে।

এর সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে বিএনপি বলেছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাংলাদেশের বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে একটি ব্যতিক্রমধর্মী ব্যবস্থা। জনগণের প্রতিনিধিদের মাধ্যমে রাষ্ট্র পরিচালনা সাংবিধানিক বিধান। তাই এ ক্ষেত্রে অতীতের মতো ৯০ দিন মেয়াদেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার হওয়া বাঞ্ছনীয়। এই সরকারের প্রধান দায়িত্ব একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান করা। এই সময়ে শুধু জাতীয় সংসদ নির্বাচন করা আবশ্যক, অন্য কোনো নির্বাচন নয়। সংসদ নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের কোনো সুযোগ নেই।

সংবিধান সংস্কার কমিশনের সুপারিশের ওপর বিএনপির মতামত পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার ন্যূনতম বয়স ২১ বছর চায় না দলটি। আইনসভার নিম্নকক্ষের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের সমর্থনে প্রধানমন্ত্রী মনোনীত হওয়ার বিধানের সঙ্গেও একমত নয় তারা।

তবে সংসদের দুজন ডেপুটি স্পিকারের মধ্যে একজন বিরোধী দল থেকে মনোনীত করার প্রস্তাবের সঙ্গে বিএনপি একমত। একই সঙ্গে সংসদের উচ্চকক্ষের একমাত্র ডেপুটি স্পিকার সরকারি দলের বাইরে থেকে নির্বাচিত হোক সেটা চায় বিএনপি।
এ ছাড়া দ্বিকক্ষবিশিষ্ট একটি আইনসভার বিষয়ে নীতিগতভাবে দলটি একমত। তবে উভয় কক্ষের (উচ্চকক্ষ ও নিম্নকক্ষ) মেয়াদ চার বছর করার যে সুপারিশ করা হয়েছে, সেখানে মেয়াদ পাঁচ বছর হওয়া সমীচীন হবে মনে করে বিএনপি।

প্রস্তাবে সংবিধান সংশোধনী অংশে সংবিধানের যেকোনো সংশোধনী উভয় কক্ষের দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠের অনুমোদন এবং গণভোটে করার কথা বলা হয়েছে। এর সঙ্গে একমত নয় বিএনপি। দলটি বলেছে, সংবিধানের সকল সংশোধনী গণভোটে উপস্থাপন বাস্তবসম্মত নয়। এ ক্ষেত্রে অনুচ্ছেদ ১৪২ কে পঞ্চদশ সংশোধনীপূর্ব অবস্থায় ফিরিয়ে নেওয়াই যথেষ্ট। নিম্নকক্ষে পাস হওয়া বিল উচ্চকক্ষের সুপারিশসহ কিংবা সুপারিশ ব্যতিরেকে পুনর্বিবেচনার জন্য নিম্নকক্ষে ফেরত পাঠাতে পারবে, এরূপ বিধান করা যেতে পারে। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরে নির্বাচিত সংসদ সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে ওই সংস্কার বাস্তবায়ন করা যেতে পারে।

প্রস্তাবে রাষ্ট্রপতি অংশে বলা আছে, রাষ্ট্রপতির মেয়াদ হবে চার বছর। রাষ্ট্রপতি সর্বোচ্চ দুবারের বেশি অধিষ্ঠিত থাকবেন না। এই প্রস্তাবনার সঙ্গে একমত না হয়ে বিএনপি বলেছে, রাষ্ট্রপতির মেয়াদ পাঁচ বছর হওয়া সমীচীন হবে। বিদ্যমান সংবিধানে সর্বোচ্চ দুবারের বেশি রাষ্ট্রপতি পদে অধিষ্ঠিত না থাকার বিধান (অনুচ্ছপদ ৫০ (২)) থাকায় এ–সক্রান্ত সুপারিশ অপ্রয়োজনীয়।

প্রস্তাবে প্রধানমন্ত্রী অংশে বলা হয়েছে, আইনসভার নিম্নকক্ষের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের সমর্থনে প্রধানমন্ত্রী মনোনীত হবে। এর সঙ্গে দ্বিমত জানিয়ে বিএনপি বলেছে, প্রধানমন্ত্রী পদে কোনো নির্বাচন হয় না বিধায় মনোনয়নের প্রশ্নটি অবান্তর।

প্রধানমন্ত্রী অংশে আরও বলা হয়েছে, আইনসভার মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার পূর্বে যদি কখনো প্রধানমন্ত্রী স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেন বা আস্থা ভোটে হেরে যান কিংবা অন্য কোনো কারণে রাষ্ট্রপতিকে আইনসভা ভেঙে দেওয়ার পরামর্শ দেন, সে ক্ষেত্রে যদি রাষ্ট্রপতির নিকট এটা প্রতীয়মান হয় যে নিম্নকক্ষের অন্য কোনো সদস্য সরকার গঠনে প্রয়োজনীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ সমর্থন অর্জনে ব্যর্থ হচ্ছে, তবেই রাষ্ট্রপতি আইনসভার উভয় কক্ষ ভেঙে দেবেন। সংবিধান সংস্কার কমিশনের এই সুপারিশের সঙ্গে একমত নয় বিএনপি।

এখানে বিএনপি বলেছে, প্রস্তাবিত সুপারিশ অপ্রয়োজনীয়। সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৫৭(২) এ সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, ‘সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের সমর্থন হারাইলে প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করিবেন কিংবা সংসদ ভাঙ্গিয়া দিবার জন্য লিখিতভাবে রাষ্ট্রপতিকে পরামর্শদান করিবেন এবং তিনি অনুরূপ পরামর্শদান করিলে রাষ্ট্রপতি, অন্য কোনো সংসদ সদস্য সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের আস্থভাজন নহেন—এই মর্মে সন্তুষ্ট হইলে, সংসদ ভাঙ্গিয়া দিবেন।’

প্রস্তাবের এ অংশে আরও বলা হয়েছে, একজন ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সর্বোচ্চ দুবার দায়িত্ব পালন করতে পারবেন। তিনি একাধিক্রমে অথবা অন্য যেকোনো উপায়ে দুবারের বেশি প্রধানমন্ত্রী পদে আসীন হতে পারবেন না। এর সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে বিএনপি বলেছে, প্রধানমন্ত্রী পদের মেয়াদ–সংক্রান্ত বিষয়ে ‘কোনো ব্যক্তি একাধিক্রমে তৃতীয়বার প্রধানমন্ত্রী পদে নিয়োগ লাভের যোগ্য বলিয়া বিবেচিত হইবেন না’—এরূপ বিধান করাই যথেষ্ট।

সংবিধান সংস্কার কমিশনের সুপারিশে বিচার বিভাগের সুপ্রিম কোর্ট অংশে দেশের সব বিভাগে হাইকোর্ট বিভাগের সমান এখতিয়ারসম্পন্ন হাইকোর্টের স্থায়ী আসন প্রবর্তনের সুপারিশ করা হয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের আসন রাজধানীতেই থাকবে। সব বিভাগে হাইকোর্টের স্থায়ী আসন প্রবর্তনের বিষয়ে একমত নয় বিএনপি। দলটি বলেছে, দেশের সব বিভাগে হাইকোর্ট বিভাগের স্থায়ী আসন সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর সঙ্গে সাংঘর্ষিক বিধায় এটা করার সুযোগ নেই। বিকল্প হিসেবে ঢাকার বাইরে অনুচ্ছেদ ১০০–এর অধীনে হাইকোর্ট বিভাগের সার্কিট বেঞ্চ স্থাপন করা যেতে পারে।

সুপারিশে আপিল বিভাগের বিচারকদের মধ্য থেকে সর্বোচ্চ জ্যেষ্ঠ বিচারককে প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দেওয়াকে প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের একটি বিধান সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করার কথা বলা হয়েছে। বিএনপি এই প্রস্তাবের সঙ্গে আংশিক একমত। দলটি তাদের মতামতে বলেছে, ‘ডকট্রিন অব নেসেসিটি’ বিবেচনায় রেখে প্রবীণতম তিনজন বিচারকের মধ্য থেকে প্রধান বিচারপতি নিয়োগের বাধ্যবাধকতা আরোপ করা যেতে পারে।

স্থায়ী অ্যাটর্নি সার্ভিস অংশে সংবিধানের অধীন একটি স্থায়ী অ্যাটর্নি সার্ভিস প্রতিষ্ঠা করার সুপারিশ করা হয়েছে। এর সঙ্গে একমত নয় বিএনপি। দলটি বলেছে, স্থায়ী প্রসিকিউশন সার্ভিসের প্রয়োজনীয়তা থাকলেও তা আইনের মাধ্যমে ও পর্যায়ক্রমে হওয়া সমীচীন।

সংস্কার কমিশনের সুপারিশে সংবিধানের মূলনীতি অংশে বলা হয়েছে, কমিশন নিম্নোক্ত বিধান অন্তর্ভুক্তির সুপারিশ করছে। ‘বাংলাদেশ একটি বহুত্ববাদী, বহু-জাতি, বহুধর্মী, বহুভাষী ও বহু সংস্কৃতির দেশ, যেখানে সকল সম্প্রদায়ের সহাবস্থান ও যথাযথ মর্যাদা নিশ্চিত করা হবে।’

অন্যদিকে রাষ্ট্রের মূলনীতি অংশে সংবিধানের মূলনীতি ও রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি হিসেবে ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র ও জাতীয়তাবাদ এবং এ সংশ্লিষ্ট সংবিধানের ৮, ৯, ১০ ও ১২ অনুচ্ছেদগুলো বাদ দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। উভয় ক্ষেত্রে একমত নয় বিএনপি। দলটি দুই ক্ষেত্রেই বলেছে, অনুচ্ছেদ ৮, ৯, ১০ ও ১২-কে পঞ্চদশ সংশোধনীর আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নেওয়াই অধিকতর যুক্তিযুক্ত।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহ উদ্দিন আহমদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিএনপি দলীয়ভাবে সংবিধান নির্বাচন কমিশন জনপ্রশাসনসহ সব বিষয়ে পৃথক প্রস্তাব সংস্কার কমিশনে দিয়েছে। আমরা লক্ষ করেছি, বিএনপির অধিকাংশ প্রস্তাবই কমিশনের সুপারিশে প্রতিফলিত হয়নি। সে জন্য আমরা কমিশনের স্প্রেডশিটের পাশাপাশি সবিস্তারে মতামত জানিয়েছি এবং বিভ্রান্তি এড়াতে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ব্যাখ্যাও দিয়েছি।’
দলীয় সংস্কার প্রস্তাব তৈরির সঙ্গে যুক্ত বিএনপির এই নেতা আরও বলেন, সংবিধান সংশোধনের দায়িত্ব নির্বাচিত সরকারের। সে জন্য সংবিধান–সংক্রান্ত কোনো সংশোধন করতে হলে আগে নির্বাচন দিতে হবে। নির্বাচিত সরকার সংসদে সেই সংশোধন আনবে।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: র স প র শ কর প রস ত ব র ন ম নকক ষ র ষ ট রপত আইনসভ র অন য ক ন অন চ ছ দ ব এনপ র য় ব এনপ ক সরক র সরক র র একমত ন দ ব মত প রব ন উভয় ক অবস থ মত মত

এছাড়াও পড়ুন:

ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে ভোট, একমত ইউনূস ও তারেক

ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচনের সময় নির্ধারণ নিয়ে রাজনীতিতে টানাপোড়েন যেভাবে অনিশ্চয়তার দিকে যাচ্ছিল, লন্ডন বৈঠকে তা অনেকটা কেটেছে।

গতকাল শুক্রবার অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের এই বৈঠক হয়। বৈঠক শেষে যৌথ বিবৃতিতে ঘোষণা আসে, সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করা গেলে আগামী বছরের রমজান মাসের আগে অর্থাৎ ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে নির্বাচন হতে পারে। এর মধ্য দিয়ে লন্ডন বৈঠক নিয়ে দেশে যে কৌতূহল ও উৎকণ্ঠা ছিল, সেটার সমাপ্তি ঘটেছে।

চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দাবি জানিয়ে আসছিল বিএনপিসহ বিভিন্ন দল। এর মধ্যেই ৬ জুন ঈদুল আজহার আগের দিন জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস বলেছিলেন, জাতীয় নির্বাচন ২০২৬ সালের এপ্রিলের প্রথমার্ধে অনুষ্ঠিত হবে।

নির্বাচনের সময়সীমা নিয়ে সরকারপ্রধানের এই ঘোষণা বিএনপি মেনে নিতে পারেনি। এ নিয়ে দলটির নেতারা প্রকাশ্যেই অসন্তুষ্টির কথা জানান। অবশ্য সরকার–ঘনিষ্ঠ সূত্র থেকে জানা গেছে, ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে নির্বাচনের সময় নির্ধারণের জন্য উপদেষ্টাদের কেউ কেউ জাতির উদ্দেশে ভাষণের আগে অধ্যাপক ইউনূসকে পরামর্শ দিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি এপ্রিলকে উপযুক্ত মনে করেছিলেন।

জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণের এক সপ্তাহের মাথায় লন্ডন বৈঠকে নির্বাচনের সময়সীমা নিয়ে নতুন ঘোষণা এল। ধারণা করা হচ্ছে ফেব্রুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহে ভোট হতে পারে।

নির্বাচনের সময়সীমা নিয়ে ঐকমত্যে পৌঁছানোর ঘটনাকে বিবৃতি দিয়ে স্বাগত জানিয়েছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও জোট। দলগুলো বলেছে, এর মাধ্যমে জাতি ‘স্বস্তির বার্তা’ পেয়েছে।

এ বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল গত রাতে প্রথম আলোকে বলেন, অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ও তারেক রহমানের বৈঠক নিয়ে অনেকের দুর্ভাবনা ছিল। সেটা কেটে গেছে, গোটা জাতি স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেছে। অধ্যাপক ইউনূস দুঃসময়ে জাতির অভিভাবক হিসেবে নিজের বিশালত্ব, গভীরতা ও প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়েছেন। বিএনপি নেতা তারেক রহমানও যথোচিত সৌজন্যবোধ, পরিণত বুদ্ধি ও রাষ্ট্রনায়কসুলভ সম্ভাবনার স্বাক্ষর রেখেছেন। তিনি বলেন, বিচার বা সংস্কার বিষয়ে সরকারের সঙ্গে বিএনপির বড় ধরনের মতপার্থক্য নেই। মতপার্থক্য ছিল নির্বাচনের সময় নিয়ে। দুজনের (ইউনূস-তারেক) বৈঠকের পর এই মতপার্থক্যও অনেকটা কমে এসেছে।

যদিও লন্ডন বৈঠকে নির্বাচনের সম্ভাব্য সময় নিয়ে সরকার ও বিএনপির মধ্যে যে প্রক্রিয়ায় সমঝোতা হয়েছে এবং সেটি যেভাবে যৌথ ঘোষণার মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়েছে, তাতে সন্তুষ্ট হতে পারেনি জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন, জাতীয় নাগরিক পার্টিসহ (এনসিপি) কয়েকটি রাজনৈতিক দল। দলগুলোর নেতারা বলছেন, ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে নির্বাচনের ব্যাপারে তাঁদের ভিন্নমত নেই। দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দলের সঙ্গে এ বিষয়ে সরকারের সমঝোতায়ও তাঁরা অসন্তুষ্ট নন। তাঁদের প্রশ্ন এক জায়গায়। সেটি হচ্ছে, সরকার এভাবে একটি দলের সঙ্গে নির্বাচনের বিষয়ে যৌথ ঘোষণা দিতে পারে কি না? এটা কতটা নৈতিক।

লন্ডন বৈঠকের বিষয়ে এনসিপির আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়ায় বলা হয়, জুলাই ঘোষণাপত্র প্রণয়ন, মৌলিক সংস্কার বাস্তবায়নে জুলাই সনদ কার্যকর করা ও বিচারের রোডম্যাপ ঘোষণার পরই নির্বাচনসংক্রান্ত আলোচনা চূড়ান্ত হওয়া উচিত। এনসিপি মনে করে, নির্বাচন প্রশ্নে সরকার কেবল একটি রাজনৈতিক দলের অবস্থান ও দাবিকেই বেশি প্রাধান্য দিচ্ছে।

এ বিষয়ে জামায়াত ও ইসলামী আন্দোলন দলীয় ফোরামে আলোচনা করে আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানাবে বলে দলীয় সূত্র জানিয়েছে।

গতকাল যুক্তরাজ্যের রাজধানী লন্ডনের ডরচেস্টার হোটেলে সেখানকার সময় সকাল নয়টায় (বাংলাদেশ সময় বেলা দুইটা) অধ্যাপক ইউনূস ও তারেক রহমানের মধ্যে বৈঠক শুরু হয়। তাঁরা প্রায় দেড় ঘণ্টা কথা বলেন। এর মধ্যে বড় একটি সময় অধ্যাপক ইউনূস ও তারেক রহমান একান্তে বৈঠক করেন। পরে ওই হোটেলেই যৌথ সংবাদ সম্মেলন করেন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম ও তারেক রহমানের আন্তর্জাতিক সম্পর্কবিষয়ক উপদেষ্টা হুমায়ুন কবির। একান্ত আলোচনায় দুই নেতা ‘সন্তুষ্ট’ হয়েছেন বলে তাঁরা জানান।

সংবাদ সম্মেলনে যৌথ বিবৃতি (সরকার ও বিএনপি) পড়ে শোনান নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান। তাতে বলা হয়, অত্যন্ত সৌহার্দ্যমূলক পরিবেশে অধ্যাপক ইউনূস ও তারেক রহমানের মধ্যে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। তারেক রহমান প্রধান উপদেষ্টার কাছে আগামী বছরের রমজানের আগে নির্বাচন আয়োজনের জন্য প্রস্তাব করেন। ‌দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াও মনে করেন, ওই সময় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে ভালো হয়। প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, তিনি আগামী বছরের এপ্রিলের প্রথমার্ধের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণা দিয়েছেন। সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করা গেলে ২০২৬ সালের রমজান শুরু হওয়ার আগের সপ্তাহেও নির্বাচন আয়োজন করা যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে সেই সময়ের মধ্যে সংস্কার ও বিচারের বিষয়ে পর্যাপ্ত অগ্রগতি অর্জন করা প্রয়োজন হবে।

যৌথ বিবৃতিতে আরও বলা হয়, তারেক রহমান প্রধান উপদেষ্টার এ অবস্থানকে স্বাগত জানান এবং দলের পক্ষ থেকে তাঁকে ধন্যবাদ জানান। প্রধান উপদেষ্টাও তারেক রহমানকে ফলপ্রসূ আলোচনার জন্য ধন্যবাদ জানান।

প্রশ্নোত্তরে যা বললেন সরকার ও বিএনপির প্রতিনিধি

পরে প্রশ্নোত্তর পর্বে এক সাংবাদিক জানতে চান, তাহলে কি সরকার এপ্রিলের প্রথমার্ধে নির্বাচনের ঘোষণা থেকে সরে আসছে? জবাবে নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান বলেন, ‘যৌথ ঘোষণায় এই বিষয়টি সুস্পষ্টই বলা আছে। আপনারা শুনেছেন। যদি সব কাজ সময়মতো আমরা করতে পারি এবং বিচার ও সংস্কারের ব্যাপারে পর্যাপ্ত অগ্রগতি হয়, তাহলে নিশ্চয়ই সেটা করা যেতে পারে।’

তাহলে নির্বাচনের একটি নির্দিষ্ট তারিখ নির্ধারণে সমস্যাটা কোথায়? এমন প্রশ্নের জবাবে খলিলুর রহমান বলেন, ‘আমরা কোনো সমস্যা দেখছি না। নির্বাচন সম্পর্কে আজকে যৌথ বিবৃতিতে আমরা বলে দিয়েছি দুই পক্ষই। আমরা আশা করব, নির্বাচন কমিশন শিগগিরই একটা তারিখ ঘোষণা করবে।’

নির্বাচনের সম্ভাব্য সময়সীমা ছাড়া লন্ডন বৈঠকে আর কী কী বিষয়ে আলোচনা হয়েছে, এ ছাড়া সংস্কার, বিচার, জুলাই ঘোষণা নিয়ে কোনো সমঝোতা হয়েছে কি না, সে সম্পর্কে যৌথ বিবৃতিতে পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যায়নি।

তবে যৌথ সংবাদ সম্মেলনে এ-সংক্রান্ত এক প্রশ্নের জবাবে বিএনপি নেতা আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘সব বিষয়ে আলোচনা তো হবে, এটাই স্বাভাবিক। আমরা তো নতুন বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় নিয়ে সামনের দিকে এগোচ্ছি। আমরা সবাই চাই, দেশ গড়ার যে প্রত্যয় আমরা নিয়েছি, আমরা ঐক্যবদ্ধভাবে সেই কাজটা করব। বাংলাদেশ গড়ার যে প্রত্যয় নিয়ে আমরা সবাই ঐকমত্যে এসেছি, শুধু নির্বাচনের আগে নয়, নির্বাচনের পরও সেটা আমরা সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাব।’

অধ্যাপক ইউনূসের সঙ্গে তারেক রহমানের বৈঠকে জুলাই সনদ নিয়ে কোনো কথা হয়েছে কি না, জানতে চাইলে আমীর খসরু বলেন, ‘জুলাই সনদ নিয়ে তো ইতিমধ্যে আলোচনা চলছে দেশে। এ ব্যাপারে আমাদের মধ্যে ইতিমধ্যে সিদ্ধান্ত আছে যে ঐকমত্যের ভিত্তিতে জুলাই সনদ হবে। সংস্কারের ব্যাপারেও একই উত্তর আমাকে দিতে হয় যে ঐকমত্যের ভিত্তিতে আমরা সংস্কার ও জুলাই সনদ—দুটোই করব। সবার ঐকমত্যের পরিপ্রেক্ষিতে সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে এবং আমি নিশ্চিত, খুব কম সময়ের মধ্যে আমরা সেই সিদ্ধান্ত নিতে পারব।’

এক সাংবাদিক প্রশ্ন করেন, নতুন রাজনৈতিক দল এনসিপি নির্বাচন কমিশনের সংস্কার ছাড়া নির্বাচনে যাবে না বলে ঘোষণা করেছে। এ বিষয়ে কোনো আলোচনা হয়েছে কি না? জবাবে আমীর খসরু মাহমুদ বলেন, ‘এ ব্যাপারে এখানে আলোচনার কোনো সুযোগ আছে বলে আমি মনে করি না।’ এ প্রশ্নে নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান বলেন, ‘এটা তাদের (এনসিপি) জিজ্ঞেস করুন। প্রতিটি দলের নিজস্ব মতামত আছে। তবে আমরা সবাইকে নিয়ে নির্বাচনটা করতে চাচ্ছি।’

প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, নির্বাচনের আগেই শেখ হাসিনার হত্যাযজ্ঞের বিচারপ্রক্রিয়া তিনি শেষ করতে চান এবং পরে তাঁকে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবেন। এ ব্যাপারে বৈঠকে আলোচনা হয়েছে কি না, সেটা হয়ে থাকলে নির্বাচনের রূপরেখায় এর কোনো প্রভাব ফেলবে কি না? এমন প্রশ্নের জবাবে খলিলুর রহমান বলেন, ‘যৌথ বিবৃতিতে এর উত্তর দেওয়া আছে। সংস্কার এবং বিচার; দুই বিষয়ে পর্যাপ্ত অগ্রগতির কথা বলা হয়েছে এবং আমরা মোটামুটি কনফিডেন্ট (আত্মবিশ্বাসী) যে এই অগ্রগতি আমরা নির্বাচনের আগেই দেখতে পাব।’

তারেক রহমানের দেশে ফেরা নিয়ে বৈঠকে কোনো আলোচনা হয়েছে কি না বা তিনি কবে দেশে ফিরতে পারেন? এমন প্রশ্নের উত্তরে আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘এ ব্যাপারে আলোচনার কোনো প্রয়োজনীয়তা আছে বলে আমরা মনে করি না। তারেক রহমান সাহেব যখনই ইচ্ছা দেশে ফিরে যেতে পারবেন। সুতরাং এটার সিদ্ধান্ত তিনি নেবেন, সময়মতো।’

সংবাদ সম্মেলনে শেষ প্রশ্ন ছিল, ‘বৈঠকে আলোচনায় আপনারা কি সন্তুষ্ট?’ সমস্বরে এ প্রশ্নের জবাব দেন খলিলুর রহমান ও আমীর খসরু মাহমুদ। দুজনই বলেন, ‘নিশ্চয়ই সন্তুষ্ট।’ এর সঙ্গে আমীর খসরু বলেন, ‘আমরা তো বলছি নির্বাচনের আগে নয়, নির্বাচনের পরও নতুন বাংলাদেশ গড়ার ক্ষেত্রে আমাদের সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।’ এরপর খলিলুর রহমান বলেন, ‘সন্তুষ্ট না হলে তো যৌথ ঘোষণা আসার কথা নয়।’

‘চারদিকে যে অনিশ্চয়তা ছিল, সেটা কেটেছে’

অধ্যাপক ইউনূস ও তারেক রহমানের বৈঠকের পর ঢাকায় বিএনপির গুলশান কার্যালয়ে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর প্রতিক্রিয়া জানান। তিনি বলেন, বৈঠক সফল হয়েছে। সবকিছু যে একটা অনিশ্চিত অবস্থায় চলে গিয়েছিল, সেই অবস্থাকে কাটিয়ে জাতিকে আবার সামনে এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখিয়েছেন দুই নেতা।

মির্জা ফখরুল বলেন, লন্ডনের বৈঠকের পর তারেক রহমানের সঙ্গে তাঁর ফোনে কথা হয়েছে। এ সময় তারেক রহমান দলের নেতা–কর্মীদের অভিনন্দন ও জনগণের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান। একই সঙ্গে সঠিক দিকনির্দেশনা দেওয়ার জন্য তাঁর মা ও দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার প্রতি শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা জানান।

বিএনপির মহাসচিব দলের নেতা-কর্মীদের পক্ষ থেকে তারেক রহমান ও প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ইউনূসের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান। তিনি বলেন, অত্যন্ত বিচক্ষণতার সঙ্গে তিনি (ইউনূস) তারেক রহমানকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। সবকিছু একটা অনিশ্চিত অবস্থায় চলে গিয়েছিল, সেই অবস্থা কাটিয়ে জাতিকে আবার সামনের দিকে ও আশা নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখিয়েছেন দুই নেতা।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে ভোট, একমত ইউনূস ও তারেক