নদীমাতৃক বাংলাদেশে এখনো ‘মাছে ভাতে’ বাঙালির পরিচয়। গ্রাম থেকে নগর—সবখানেই এ দেশের মানুষের খাদ্যজাত প্রোটিনের মূল উৎস হচ্ছে মাছ।

শুধু দারিদ্র্যের সঙ্গে নিরন্তর যুদ্ধ করেই নয়, অনেক সময় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আমাদের খাবারের থালায় মাছ তুলে দেয় এই মৎস্যজীবী সম্প্রদায়।

ঝড়ঝঞ্ঝা বা অন্যান্য প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কবলে পড়ে অনেক মাছ ধরার নৌকাই আর কূলে ফেরে না। এই জেলেদের মধ্যে রয়েছে নৌকাবাসী সম্প্রদায়ও। নৌকা যাদের শুধু জীবিকার সম্বল নয়, সেই সঙ্গে তাদের আবাসস্থল ও পরিবার।

মৎস্যজীবী বা জেলে শব্দগুলো শুনলেই আমাদের কল্পনায় রোদে পোড়া কর্মঠ পুরুষের অবয়ব ভেসে উঠলেও প্রকৃত চিত্রে বিপুলসংখ্যক নারীও এই পেশায় সম্পৃক্ত।

পরিবারের পুরুষদের সঙ্গে তাঁরাও সক্রিয়ভাবে অংশ নেন মাছ ধরা থেকে শুরু করে সংরক্ষণ ও বিপণন পর্যন্ত।

আরও পড়ুননিঝুম দ্বীপে এই নৈরাজ্য বন্ধ করুন০৫ মার্চ ২০২৫

তবু সমাজের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী হিসেবে এখনো তাঁরা অনেক ধরনের অধিকার থেকে বঞ্চিত। বিশেষ করে নারীরা প্রতিনিয়ত সামাজিক প্রতিবন্ধকতা, নিরাপত্তাহীনতা এবং দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করে বেঁচে থাকেন।

তাঁদের সন্তানদের জন্যও নেই পর্যাপ্ত শিক্ষা ও চিকিৎসার সুযোগ। পেশাজীবী হিসেবে মৎস্যজীবীদের স্বীকৃতি হিসেবে বাংলাদেশ সরকার একটি বিশেষ পরিচয়পত্র বা ‘জেলে কার্ড’ প্রদান করে থাকে, যার মাধ্যমে তাঁরা সরকারি সুবিধা ও ভর্তুকি পেয়ে থাকেন।

প্রতিবছর ১ মার্চ থেকে ৩০ এপ্রিল (৬০ দিন), ২০ মে থেকে ২৩ জুলাই (৬৫ দিন), ১৩ অক্টোবর থেকে ৩ নভেম্বরসহ (২২ দিন) আরও কিছু স্বল্পকালীন সময়ব্যাপী সরকারিভাবে মাছ ধরা বন্ধ থাকে। এই সময়কালে জেলে কার্ডধারীরা সরকারি ভর্তুকি পান।

সীমিত আকারে শুরু হলেও নারী মৎস্যজীবীদের বৃহদাংশই এখনো জেলে কার্ড পাননি। তাই সরকারি কোনো ভর্তুকি বা সুবিধা তাঁরা পান না।

এ ছাড়া নৌকাবাসী সম্প্রদায় মাছ ধরা নিষিদ্ধ চলাকালীন সময়ে নিয়ম মেনে বড়শি বা মুইজাল দিয়ে ছোট মাছ ধরলেও অনেক সময়ই নানা রকম প্রশাসনিক বাধার সম্মুখীন হয়।

শুধু মাছ ধরেই যাঁদের জীবন চলে, ভর্তুকির অভাবে তাঁদের জীবনে নেমে আসে অনিশ্চয়তা।

আরও পড়ুনমাছ ধরার ওপর নিষেধাজ্ঞা১১ অক্টোবর ২০১৮

মৎস্যজীবী নারীদের এই দুর্ভোগ নিরসনে এবং তাঁদের অধিকার বাস্তবায়নের লক্ষ্যে অক্সফাম বাংলাদেশের কারিগরি সহায়তায় ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সহ-অর্থায়নে সেন্টার ফর ন্যাচারাল রিসোর্স স্টাডিজ (সিএনআরএস) ‘এমপাওয়ারিং উইমেন থ্রু সিভিল সোসাইটি অ্যাক্টরস ইন বাংলাদেশ’(ইডব্লিউসিএসএ) প্রকল্প নিয়ে কাজ করছে।

এই প্রকল্পের মাধ্যমে সংবাদকর্মী, সমাজকর্মী, তরুণ সম্প্রদায়, মৎস্যজীবী সমিতি এবং উন্নয়ন সহযোগী সংস্থাগুলোর সহযোগিতায় মৎস্যজীবী নারীদের সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে দীর্ঘমেয়াদি সমাধানের পথ নির্মাণের প্রচেষ্টা চলছে।

এই প্রকল্পের অধীন নারীদের জেলে কার্ড পাওয়ার প্রক্রিয়া সহজতর করার জন্য সরকারি বিভাগগুলোর সঙ্গে সমন্বয় করা হচ্ছে।

নারীদের জন্য বিকল্প আয়ের ব্যবস্থা গড়ে তোলার পাশাপাশি সরকারি ভর্তুকির আওতায় তাদের অন্তর্ভুক্তির বিষয়েও কাজ করা হচ্ছে।

মৎস্যজীবী সংগঠনগুলোতে নারীদের সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার পাশাপাশি তাঁদের নেতৃত্বের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্যও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।

নৌকাবাসী ও মৎস্যজীবী শিশুদের জন্য শিক্ষা কার্যক্রম সম্প্রসারণের পাশাপাশি নারীদের জন্য বিশেষ স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার বিষয়েও কার্যক্রম গ্রহণ করা হচ্ছে। জেলে সম্প্রদায়, বিশেষ করে তাদের নারীরা, সমাজের এক অবহেলিত অংশ। তাঁদের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করতে সরকারি ও বেসরকারি সহযোগিতা প্রয়োজন।

সমাজে নারীদের অধিকার ও আইনি সুরক্ষা বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রশিক্ষণ কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে, যাতে তারা নিজেদের অধিকার সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হতে পারেন এবং প্রশাসনিক হয়রানির শিকার হলে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সক্ষম হন।

নৌকাবাসী ও মৎস্যজীবী শিশুদের জন্য শিক্ষা কার্যক্রম সম্প্রসারণের পাশাপাশি নারীদের জন্য বিশেষ স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার বিষয়েও কার্যক্রম গ্রহণ করা হচ্ছে।

জেলে সম্প্রদায়, বিশেষ করে তাদের নারীরা, সমাজের এক অবহেলিত অংশ। তাঁদের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করতে সরকারি ও বেসরকারি সহযোগিতা প্রয়োজন।

ইডব্লিউসিএসএ প্রকল্পের মাধ্যমে তাঁদের জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এতে এই সম্প্রদায়ের নারীরা নিরাপদ, সম্মানজনক ও স্বাবলম্বী জীবন যাপন করতে পারেন।

অমিত মল্লিক উন্নয়নকর্মী

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ন শ চ ত কর দ র জন য প রকল প ভর ত ক সরক র সহয গ

এছাড়াও পড়ুন:

স্তম্ভিত হারমানপ্রীত, আবেগ-রোমাঞ্চ-গর্ব-ভালোবাসায় মিলেমিশে একাকার

২০০৫ ও ২০১৭, ভারতের নারী ক্রিকেট দল ওয়ানডে বিশ্বকাপের খুব কাছে গিয়েও শিরোপা জিততে পারেননি। হারমানপ্রীত কৌররা লম্বা সেই অপেক্ষা দূর করলেন দুই হাজার পঁচিশে।

মুম্বাইয়ের নাভিতে প্রায় ষাট হাজার দর্শকের সামনে উচিুঁয়ে ধরলেন ওয়ানডে বিশ্বকাপের শিরোপা। ২০১৭ সালের ফাইনালেও খেলেছিলেন হারমানপ্রীত। রানার্সআপ হয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হয় তাকে। এবার আর ভুল করলেন না। অধিনায়ক হয়ে জিতলেন শিরোপা। গড়লেন ইতিহাস। যে ইতিহাস কখনো মুছবে না। কখনো জং ধরবে না।

ঝলমলে হাসিতে হারমানপ্রীত ট্রফি হাতে নিয়ে প্রেস কনফারেন্স রুমে প্রবেশ করেন। এবার তার আবেগের ধরণ ছিল ভিন্ন, যেন স্বপ্ন পূরণের মাখামাখি। লম্বা সংবাদ সম্মেলন জুড়ে বারবার তার কণ্ঠ ধরে আসে। আবেগ, রোমাঞ্চ, গর্ব, ভালোবাসা, শ্রদ্ধা মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। তবে একটি শব্দের ওপর বারবার ফিরে আসছিলেন তিনি, তা হলো আত্মবিশ্বাস,
‘‘আমি কেবল আমার অনুভূতি প্রকাশ করার চেষ্টা করছি। আমি স্তম্ভিত, আমি বুঝতে পারছি না। আসলে, এতে উত্থান-পতন ছিল, কিন্তু দলের মধ্যে আত্মবিশ্বাস ছিল। আমি প্রথম দিন থেকেই এটা বলে আসছি। আমরা বাম বা ডানে তাকাচ্ছিলাম না। আমরা কেবল আমাদের মূল লক্ষ্যের দিকে তাকিয়েছিলাম।’’ - বলেছেন হারমানপ্রীত।

স্বপ্ন পূরণের রাতে হারমানপ্রীত কাছে পেয়েছিলেন সাবেক তিন ক্রিকেটার মিতালি রাজ, ঝুলন গোস্বামী এবং অঞ্জুম চোপড়াকে। প্রত‌্যেকেই স্বপ্ন দেখেছিলেন ভারতকে বিশ্বকাপ জেতানোর। তাদের অধরা সেই স্বপ্ন পূরণ করেছেন জেমিমা, দীপ্তি, শেফালি, স্মৃতিরা।

শিরোপা উৎসবে যোগ দেন মিতালি, ঝুলন, আঞ্জুমরা। তাদের হাতেও ট্রফি তুলে দেওয়া হয়। প্রাক্তন খেলোয়াড়দের সাথে সেই মুহূর্তটি ভাগ করে নেওয়ার অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে হারমানপ্রীত বলেন, ‘‘ঝুলন দি আমার সবচেয়ে বড় আইডল ছিলেন। যখন আমি দলে যোগ দিই, তখন তিনি নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। আমি যখন খুব কাঁচা ছিলাম এবং ক্রিকেট সম্পর্কে তেমন কিছু জানতাম না, তখনও তিনি সবসময় আমাকে সমর্থন করতেন। অঞ্জুম দি-ও তাই। এই দুজন আমার জন্য দারুণ সমর্থন ছিলেন। আমি কৃতজ্ঞ যে আমি তাদের সাথে এই বিশেষ মুহূর্তটি ভাগ করে নিতে পেরেছি। এটি খুব আবেগপূর্ণ মুহূর্ত ছিল। আমার মনে হয় আমরা সবাই এটার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। অবশেষে, আমরা এই ট্রফি স্পর্শ করতে পেরেছি।’’

তার জন‌্য বিশ্বকাপের পুরো অভিযানটিই ছিল গভীরভাবে আবেগপূর্ণ। রাউন্ড রবিন লিগে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ ম‌্যাচ হার। চোট, অফ ফর্ম, জড়তা। সব সামলে সেরা হয়েছেন। তাইতো নিজেদের নিয়ে গর্বটাও বেশি হারমানপ্রীতদের, ‘‘আমরা প্রথম বল থেকেই অনুভব করেছিলাম যে আমরা জিততে পারি, কারণ শেষ তিন ম্যাচে আমাদের দল যেভাবে খেলছিল, তাতে আমাদের জন্য অনেক কিছুর পরিবর্তন এসেছিল, বিশেষ করে আমাদের আত্মবিশ্বাস। আমরা অনেকদিন ধরেই ভালো ক্রিকেট খেলছি। আমরা জানতাম দল হিসেবে আমরা কী করতে পারি।”

"গত এক মাস খুব আকর্ষণীয় ছিল। সেই দিনটির (ইংল্যান্ডের কাছে হারের) পর আমাদের মধ্যে অনেক পরিবর্তন আসে। সেই রাত আমাদের জন্য অনেক কিছু বদলে দিয়েছিল। এটি প্রত্যেকের উপর প্রভাব ফেলেছিল। আমরা বিশ্বকাপের জন্য আরও প্রস্তুত হলাম। আমরা ভিজ্যুয়ালাইজেশন এবং মেডিটেশন শুরু করেছিলাম। আমরা বারবার বলছিলাম, যে জন‌্য আমরা এখানে এসেছি এবং এবার আমাদের এটা করতেই হবে।" - যোগ করেন হারমানপ্রীত।

প্রথম যে কোনো কিছুই আনন্দের। রোমাঞ্চের। এই অভিজ্ঞতা শব্দে বয়ান করা যায় না। বয়ান করা সম্ভব হয় না। হারমানপ্রীতও পারেন না নিজের সবটা উজার করে বলতে। তবে এই শিরোপায় তাদের নাম লিখা হবে সেই আত্মবিশ্বাস তারও ছিল, ‘‘আমরা বহু বছর ধরে এটি নিয়ে কথা বলছি—আমরা ভালো ক্রিকেট খেলছি, কিন্তু আমাদের একটি বড় শিরোপা জিততেই হতো।"

ঢাকা/ইয়াসিন

সম্পর্কিত নিবন্ধ