সংবিধান সংস্কার কমিশন রাষ্ট্রের নাম পরিবর্তনের যে সুপারিশ করেছে, তাতে আপত্তি জানিয়েছে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। তবে সংবিধানে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি থেকে জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা বাদ দিয়ে ‘সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচার, বহুত্ববাদ ও গণতন্ত্র’ অন্তর্ভুক্ত করার সুপারিশের সঙ্গে একমত পোষণ করেছে দলটি। এর পাশাপাশি বহুত্ববাদের সংজ্ঞা সুনির্দিষ্ট করার ওপর জোর দিয়েছে তারা।

সংবিধান সংস্কার কমিশনসহ পাঁচটি কমিশনের সুপারিশের ওপর এনসিপির দলীয় মতামত ২৩ মার্চ জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের কাছে লিখিতভাবে জমা দেওয়া হয়েছে। কমিশনগুলোর গুরুত্বপূর্ণ ১৬৬টি সুপারিশের মধ্যে ১১৩টিতে একমত ও ২৯টিতে আংশিক একমত হয়েছে তরুণদের দলটি।

একই দিনে বিএনপিও ঐকমত্য কমিশনের কাছে মতামত জমা দিয়েছে। বিএনপির মতামতের সঙ্গে এনসিপির মতামতের বেশ কিছু মৌলিক পার্থক্য দেখা গেছে। যেমন বিএনপি সংবিধানের মূলনীতির বদল চায় না কিন্তু এনসিপি চায়। বিএনপি সংসদের মেয়াদ পাঁচ বছর বহাল রাখার পক্ষে আর এনসিপি সংস্কার কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী চার বছর করার পক্ষে। এ ছাড়া একই ব্যক্তির রাজনৈতিক দলের প্রধান ও সংসদ নেতা না হওয়ার সুপারিশে বিএনপি ভিন্নমত জানিয়েছে। এ ক্ষেত্রে এনসিপির মত আলাদা।

সংস্কার কমিশনের অনেক সুপারিশের সঙ্গেই আমরা একমত হয়েছি। বিএনপির মতামতের সঙ্গে আমাদের বড় পার্থক্য হচ্ছে, বিএনপি মনে করছে, নির্বাচিত সংসদের কাছে সংবিধানের মৌলিক পরিবর্তনের এখতিয়ার থাকে। কিন্তু আমরা মনে করি, সংবিধানে মৌলিক পরিবর্তন আনতে হলে নির্বাচিত গণপরিষদই সব দিক থেকে যৌক্তিক পদ্ধতি।এনসিপির সংস্কার সমন্বয় কমিটির সমন্বয়ক ও দলের যুগ্ম আহ্বায়ক সারোয়ার তুষার

এনসিপি তাদের মতামতে মিশ্র নির্বাচনপদ্ধতির কথা বলেছে। নিম্নকক্ষ বা সংসদে বিদ্যমান আসনভিত্তিক পদ্ধতি এবং উচ্চকক্ষ তথা জাতীয় পরিষদে আনুপাতিক ভিত্তিতে আসনের কথা বলেছে দলটি। যেমন কোনো দল জাতীয় পর্যায়ে ৩৫ শতাংশ ভোট পেলে উচ্চকক্ষে ৩৫টি আসন পাবে। ভোটাররা একবারই ভোট দেবেন।

স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের সব নির্বাচন সরাসরি নির্বাচন কমিশনের তত্ত্বাবধানে অনুষ্ঠান এবং একজন প্রধান স্থানীয় সরকার কমিশনার ও চারজন কমিশনার নিয়ে স্থানীয় সরকার কমিশন প্রতিষ্ঠার সুপারিশ করেছে সংবিধান সংস্কার কমিশন। এই দুটি বিষয় বাদে বাকি সব বিধান হয় গণপরিষদ নির্বাচন অথবা গণপরিষদ কাম সংসদ তথা নির্বাচিত গণপরিষদের (যা সংবিধান প্রণয়ন শেষে স্বয়ংক্রিয়ভাবে আইনসভায় রূপ নেবে) মাধ্যমে বাস্তবায়নের পক্ষে মত দিয়েছে এনসিপি।

জানতে চাইলে এনসিপির সংস্কার সমন্বয় কমিটির সমন্বয়ক ও দলের যুগ্ম আহ্বায়ক সারোয়ার তুষার গতকাল বৃহস্পতিবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘সংস্কার কমিশনের অনেক সুপারিশের সঙ্গেই আমরা একমত হয়েছি। বিএনপির মতামতের সঙ্গে আমাদের বড় পার্থক্য হচ্ছে, বিএনপি মনে করছে, নির্বাচিত সংসদের কাছে সংবিধানের মৌলিক পরিবর্তনের এখতিয়ার থাকে। কিন্তু আমরা মনে করি, সংবিধানে মৌলিক পরিবর্তন আনতে হলে নির্বাচিত গণপরিষদই সব দিক থেকে যৌক্তিক পদ্ধতি।’

সংবিধানের মূলনীতি ও রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি হিসেবে ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র ও জাতীয়তাবাদ এবং এ–সংশ্লিষ্ট সংবিধানের ৮, ৯, ১০ ও ১২ অনুচ্ছেদ বাদ দেওয়ার সুপারিশ করেছে সংস্কার কমিশন। এর সঙ্গেও এনসিপি একমত।যেসব সুপারিশে একমত

ঐকমত্য কমিশনে জমা দেওয়া মতামতে সংসদের মেয়াদ চার বছর করার সুপারিশের সঙ্গে একমত পোষণ করেছে এনসিপি। সংস্কার কমিশনের সুপারিশে সংবিধানের মূলনীতি হিসেবে ‘সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচার, বহুত্ববাদ ও গণতন্ত্র’ অন্তর্ভুক্ত করার যে সুপারিশ করা হয়েছে, তার সঙ্গে এনসিপি একমত। ওই সুপারিশে বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশ একটি বহুত্ববাদী, বহুজাতি, বহুধর্মী, বহুভাষী ও বহুসংস্কৃতির দেশ, যেখানে সব সম্প্রদায়ের সহাবস্থান ও যথাযথ মর্যাদা নিশ্চিত করা হবে।’ এনসিপি এর সঙ্গে সহমত জানিয়ে এভাবে লেখার প্রস্তাব দিয়েছে, ‘বহুত্ববাদের অর্থ হবে বহুজাতি, বহুধর্মী, বহুভাষী ও বহুসংস্কৃতির দেশ।’ অর্থাৎ তারা বহুত্ববাদের সংজ্ঞা সুনির্দিষ্ট করার ওপর জোর দিচ্ছে।

সংবিধানের মূলনীতি ও রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি হিসেবে ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র ও জাতীয়তাবাদ এবং এ–সংশ্লিষ্ট সংবিধানের ৮, ৯, ১০ ও ১২ অনুচ্ছেদ বাদ দেওয়ার সুপারিশ করেছে সংস্কার কমিশন। এর সঙ্গেও এনসিপি একমত।

কমিশন সুপারিশ করেছে, সংসদের নিম্নকক্ষে একজন সংসদ সদস্য একই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী, সংসদ নেতা ও রাজনৈতিক দলের প্রধান—এগুলোর যেকোনো একটির বেশি পদে অধিষ্ঠিত হবেন না। এ বিষয়ে এনসিপির মত হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা একই ব্যক্তি হতে পারেন; তবে এ ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী মন্ত্রিপরিষদের প্রধান নন, মন্ত্রিদের মধ্যে ‘ফার্স্ট অ্যামং দ্য ইকুয়ালস’ হিসেবে বিবেচিত হবেন।

রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রীসহ রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল বা এনসিসি নামে একটি জাতীয় প্রতিষ্ঠানের সুপারিশ করেছে সংস্কার কমিশন। সুপারিশ অনুযায়ী, সংসদ ভেঙে গেলেও অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা শপথ না নেওয়া পর্যন্ত এনসিসি সদস্যরা বহাল থাকবেন। এই দুই প্রস্তাবের সঙ্গে একমত পোষণ করলেও প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ সাংবিধানিক পদগুলোতে নিয়োগের জন্য এনসিসির মাধ্যমে রাষ্ট্রপতির কাছে নাম পাঠানোর সুপারিশের বিষয়ে এনসিপি একটি মন্তব্য যুক্ত করেছে। তারা বলেছে, এনসিসির সদস্যদের দুই-তৃতীয়াংশের ভোটে এসব নিয়োগ দিতে হবে।

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রস্তাবের সঙ্গে একমত হয়ে এনসিপি মন্তব্য করেছে, এনসিসি নির্বাচনকালীন সরকার হিসেবে ভূমিকা রাখতে পারে। রাষ্ট্রপতি ও আগের সরকারের প্রধানমন্ত্রী ছাড়া এনসিসির অন্য সদস্যদের থেকে একজনকে প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগ করা যেতে পারে। এই সরকারের মেয়াদ ৭০ থেকে ৭৫ দিন হওয়া যথেষ্ট। এ ছাড়া রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ক্ষেত্রে জেলা সমন্বয় কাউন্সিলের সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে মনোনয়ন দেওয়ার পক্ষে মত দিয়েছে এনসিপি।

এনসিপি তরুণ-তরুণী বিবেচিত হওয়ার সর্বোচ্চ বয়সসীমা ৩৫ করার কথা বলেছে। আর প্রার্থিতার ন্যূনতম বয়স ২৩ এবং ভোটাধিকারের বয়স ১৬ বছর করার পক্ষে মত দিয়েছে।দ্বিমত যেসব প্রস্তাবে

সংবিধানের প্রযোজ্য সব ক্ষেত্রে ‘প্রজাতন্ত্র’ ও ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ শব্দগুলোর পরিবর্তে ‘নাগরিকতন্ত্র’ ও ‘জনগণতন্ত্রী বাংলাদেশ’ শব্দগুলো ব্যবহারের সুপারিশ করেছে সংস্কার কমিশন। তবে এনসিপি ‘প্রজাতন্ত্র’ ও ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ বহাল রাখার পক্ষে।

কমিশনের প্রস্তাব, রাজনৈতিক দলগুলো সংসদের নিম্নকক্ষের মোট আসনের ন্যূনতম ১০ শতাংশ আসনে তরুণ-তরুণীদের মধ্য থেকে প্রার্থী মনোনীত করবে এবং সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার বয়স কমে হবে ২১ বছর।

এনসিপি তরুণ-তরুণী বিবেচিত হওয়ার সর্বোচ্চ বয়সসীমা ৩৫ করার কথা বলেছে। আর প্রার্থিতার ন্যূনতম বয়স ২৩ এবং ভোটাধিকারের বয়স ১৬ বছর করার পক্ষে মত দিয়েছে।

এনসিসির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী একজন গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিকে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা করার কথা বলেছে সংবিধান সংস্কার কমিশন। এটি সম্ভব না হলে সাবেক প্রধান বিচারপতি ও বিচারকদের মধ্য থেকে প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগ বা রাষ্ট্রপতির প্রধান উপদেষ্টা পদে অতিরিক্ত দায়িত্ব নেওয়া এবং অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি বা আপিল বিভাগের বিচারকদের মধ্য থেকে প্রধান উপদেষ্টা হওয়ার সুপারিশ করেছে কমিশন। এই সুপারিশের সঙ্গে দ্বিমত জানিয়ে এনসিপি বলেছে, সে ক্ষেত্রে এনসিসি নির্বাচনকালীন অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নিতে পারে।

আছে সম্পূরক প্রস্তাবও

সংস্কার কমিশন সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল বহাল রাখার পক্ষে মত দিয়েছে। তদন্ত ও অনুসন্ধানের জন্য অভিযোগ সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলে পাঠানোর ক্ষমতা রাষ্ট্রপ্রধানের পাশাপাশি এনসিসির থাকবে। এর সঙ্গে একমত হয়ে এনসিপি বলেছে, এনসিসির বিরুদ্ধেও প্রয়োজন অনুযায়ী তদন্ত ও অনুসন্ধান করতে পারবে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল।

সংস্কার কমিশনের সুপারিশ, কেবল এনসিসির সিদ্ধান্তে রাষ্ট্রপতি জরুরি অবস্থা ঘোষণা করতে পারবেন। তবে জরুরি অবস্থার সময় নাগরিকদের কোনো অধিকার রদ বা স্থগিত করা ও আদালতে যাওয়ার অধিকার বন্ধ বা স্থগিত করা যাবে না। এই সুপারিশের সঙ্গে আংশিক একমত হয়ে এনসিপি বলেছে, সংসদ চলাকালে উভয় কক্ষের সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছাড়া জরুরি অবস্থা জারি করা যাবে না। অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদে জরুরি অবস্থা জারি করা যাবে না।

সংস্কার কমিশন সুপারিশ করেছে, বিশেষ কার্যাবলি কিংবা সংবিধানে উল্লেখিত বিষয় ছাড়া অন্য সব বিষয়ে রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শে কাজ করবেন। এনসিপির মতামত হচ্ছে, রাষ্ট্রপতিকে দেওয়া প্রধানমন্ত্রীর এই পরামর্শ হবে নন-বাইন্ডিং (বাধ্যতামূলক নয়)। এনসিপির বক্তব্য হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রী ও দলের প্রধান একই ব্যক্তি হতে পারবেন না। প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা একই ব্যক্তি হতে পারবেন, যদি প্রধানমন্ত্রী মন্ত্রিসভার ‘ফার্স্ট অ্যামং দ্য ইকুয়ালস’ হন।

অর্থবিল ছাড়া নিম্নকক্ষের সদস্যদের তাঁদের মনোনয়নকারী দলের বিপক্ষে ভোট দেওয়ার পূর্ণ ক্ষমতা থাকবে বলে সুপারিশ করেছে সংস্কার কমিশন। এনসিপি অর্থবিলের পাশাপাশি দলের বিরুদ্ধে অনাস্থা ভোটের ক্ষেত্রেও বিধিনিষেধ থাকা প্রয়োজন বলে মত দিয়েছে।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: র স প র শ কর ছ প র মত মত র সরক র র প র ষ ট রপত এনস প র ম ন ম নকক ষ বছর কর র মত দ য় ছ প রস ত ব র এনস প হওয় র স এনস স র মন ত র অন য য় সদস য ব এনপ অবস থ

এছাড়াও পড়ুন:

ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে ভোট, একমত ইউনূস ও তারেক

ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচনের সময় নির্ধারণ নিয়ে রাজনীতিতে টানাপোড়েন যেভাবে অনিশ্চয়তার দিকে যাচ্ছিল, লন্ডন বৈঠকে তা অনেকটা কেটেছে।

গতকাল শুক্রবার অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের এই বৈঠক হয়। বৈঠক শেষে যৌথ বিবৃতিতে ঘোষণা আসে, সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করা গেলে আগামী বছরের রমজান মাসের আগে অর্থাৎ ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে নির্বাচন হতে পারে। এর মধ্য দিয়ে লন্ডন বৈঠক নিয়ে দেশে যে কৌতূহল ও উৎকণ্ঠা ছিল, সেটার সমাপ্তি ঘটেছে।

চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দাবি জানিয়ে আসছিল বিএনপিসহ বিভিন্ন দল। এর মধ্যেই ৬ জুন ঈদুল আজহার আগের দিন জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস বলেছিলেন, জাতীয় নির্বাচন ২০২৬ সালের এপ্রিলের প্রথমার্ধে অনুষ্ঠিত হবে।

নির্বাচনের সময়সীমা নিয়ে সরকারপ্রধানের এই ঘোষণা বিএনপি মেনে নিতে পারেনি। এ নিয়ে দলটির নেতারা প্রকাশ্যেই অসন্তুষ্টির কথা জানান। অবশ্য সরকার–ঘনিষ্ঠ সূত্র থেকে জানা গেছে, ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে নির্বাচনের সময় নির্ধারণের জন্য উপদেষ্টাদের কেউ কেউ জাতির উদ্দেশে ভাষণের আগে অধ্যাপক ইউনূসকে পরামর্শ দিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি এপ্রিলকে উপযুক্ত মনে করেছিলেন।

জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণের এক সপ্তাহের মাথায় লন্ডন বৈঠকে নির্বাচনের সময়সীমা নিয়ে নতুন ঘোষণা এল। ধারণা করা হচ্ছে ফেব্রুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহে ভোট হতে পারে।

নির্বাচনের সময়সীমা নিয়ে ঐকমত্যে পৌঁছানোর ঘটনাকে বিবৃতি দিয়ে স্বাগত জানিয়েছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও জোট। দলগুলো বলেছে, এর মাধ্যমে জাতি ‘স্বস্তির বার্তা’ পেয়েছে।

এ বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল গত রাতে প্রথম আলোকে বলেন, অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ও তারেক রহমানের বৈঠক নিয়ে অনেকের দুর্ভাবনা ছিল। সেটা কেটে গেছে, গোটা জাতি স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেছে। অধ্যাপক ইউনূস দুঃসময়ে জাতির অভিভাবক হিসেবে নিজের বিশালত্ব, গভীরতা ও প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়েছেন। বিএনপি নেতা তারেক রহমানও যথোচিত সৌজন্যবোধ, পরিণত বুদ্ধি ও রাষ্ট্রনায়কসুলভ সম্ভাবনার স্বাক্ষর রেখেছেন। তিনি বলেন, বিচার বা সংস্কার বিষয়ে সরকারের সঙ্গে বিএনপির বড় ধরনের মতপার্থক্য নেই। মতপার্থক্য ছিল নির্বাচনের সময় নিয়ে। দুজনের (ইউনূস-তারেক) বৈঠকের পর এই মতপার্থক্যও অনেকটা কমে এসেছে।

যদিও লন্ডন বৈঠকে নির্বাচনের সম্ভাব্য সময় নিয়ে সরকার ও বিএনপির মধ্যে যে প্রক্রিয়ায় সমঝোতা হয়েছে এবং সেটি যেভাবে যৌথ ঘোষণার মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়েছে, তাতে সন্তুষ্ট হতে পারেনি জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন, জাতীয় নাগরিক পার্টিসহ (এনসিপি) কয়েকটি রাজনৈতিক দল। দলগুলোর নেতারা বলছেন, ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে নির্বাচনের ব্যাপারে তাঁদের ভিন্নমত নেই। দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দলের সঙ্গে এ বিষয়ে সরকারের সমঝোতায়ও তাঁরা অসন্তুষ্ট নন। তাঁদের প্রশ্ন এক জায়গায়। সেটি হচ্ছে, সরকার এভাবে একটি দলের সঙ্গে নির্বাচনের বিষয়ে যৌথ ঘোষণা দিতে পারে কি না? এটা কতটা নৈতিক।

লন্ডন বৈঠকের বিষয়ে এনসিপির আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়ায় বলা হয়, জুলাই ঘোষণাপত্র প্রণয়ন, মৌলিক সংস্কার বাস্তবায়নে জুলাই সনদ কার্যকর করা ও বিচারের রোডম্যাপ ঘোষণার পরই নির্বাচনসংক্রান্ত আলোচনা চূড়ান্ত হওয়া উচিত। এনসিপি মনে করে, নির্বাচন প্রশ্নে সরকার কেবল একটি রাজনৈতিক দলের অবস্থান ও দাবিকেই বেশি প্রাধান্য দিচ্ছে।

এ বিষয়ে জামায়াত ও ইসলামী আন্দোলন দলীয় ফোরামে আলোচনা করে আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানাবে বলে দলীয় সূত্র জানিয়েছে।

গতকাল যুক্তরাজ্যের রাজধানী লন্ডনের ডরচেস্টার হোটেলে সেখানকার সময় সকাল নয়টায় (বাংলাদেশ সময় বেলা দুইটা) অধ্যাপক ইউনূস ও তারেক রহমানের মধ্যে বৈঠক শুরু হয়। তাঁরা প্রায় দেড় ঘণ্টা কথা বলেন। এর মধ্যে বড় একটি সময় অধ্যাপক ইউনূস ও তারেক রহমান একান্তে বৈঠক করেন। পরে ওই হোটেলেই যৌথ সংবাদ সম্মেলন করেন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম ও তারেক রহমানের আন্তর্জাতিক সম্পর্কবিষয়ক উপদেষ্টা হুমায়ুন কবির। একান্ত আলোচনায় দুই নেতা ‘সন্তুষ্ট’ হয়েছেন বলে তাঁরা জানান।

সংবাদ সম্মেলনে যৌথ বিবৃতি (সরকার ও বিএনপি) পড়ে শোনান নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান। তাতে বলা হয়, অত্যন্ত সৌহার্দ্যমূলক পরিবেশে অধ্যাপক ইউনূস ও তারেক রহমানের মধ্যে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। তারেক রহমান প্রধান উপদেষ্টার কাছে আগামী বছরের রমজানের আগে নির্বাচন আয়োজনের জন্য প্রস্তাব করেন। ‌দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াও মনে করেন, ওই সময় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে ভালো হয়। প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, তিনি আগামী বছরের এপ্রিলের প্রথমার্ধের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণা দিয়েছেন। সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করা গেলে ২০২৬ সালের রমজান শুরু হওয়ার আগের সপ্তাহেও নির্বাচন আয়োজন করা যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে সেই সময়ের মধ্যে সংস্কার ও বিচারের বিষয়ে পর্যাপ্ত অগ্রগতি অর্জন করা প্রয়োজন হবে।

যৌথ বিবৃতিতে আরও বলা হয়, তারেক রহমান প্রধান উপদেষ্টার এ অবস্থানকে স্বাগত জানান এবং দলের পক্ষ থেকে তাঁকে ধন্যবাদ জানান। প্রধান উপদেষ্টাও তারেক রহমানকে ফলপ্রসূ আলোচনার জন্য ধন্যবাদ জানান।

প্রশ্নোত্তরে যা বললেন সরকার ও বিএনপির প্রতিনিধি

পরে প্রশ্নোত্তর পর্বে এক সাংবাদিক জানতে চান, তাহলে কি সরকার এপ্রিলের প্রথমার্ধে নির্বাচনের ঘোষণা থেকে সরে আসছে? জবাবে নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান বলেন, ‘যৌথ ঘোষণায় এই বিষয়টি সুস্পষ্টই বলা আছে। আপনারা শুনেছেন। যদি সব কাজ সময়মতো আমরা করতে পারি এবং বিচার ও সংস্কারের ব্যাপারে পর্যাপ্ত অগ্রগতি হয়, তাহলে নিশ্চয়ই সেটা করা যেতে পারে।’

তাহলে নির্বাচনের একটি নির্দিষ্ট তারিখ নির্ধারণে সমস্যাটা কোথায়? এমন প্রশ্নের জবাবে খলিলুর রহমান বলেন, ‘আমরা কোনো সমস্যা দেখছি না। নির্বাচন সম্পর্কে আজকে যৌথ বিবৃতিতে আমরা বলে দিয়েছি দুই পক্ষই। আমরা আশা করব, নির্বাচন কমিশন শিগগিরই একটা তারিখ ঘোষণা করবে।’

নির্বাচনের সম্ভাব্য সময়সীমা ছাড়া লন্ডন বৈঠকে আর কী কী বিষয়ে আলোচনা হয়েছে, এ ছাড়া সংস্কার, বিচার, জুলাই ঘোষণা নিয়ে কোনো সমঝোতা হয়েছে কি না, সে সম্পর্কে যৌথ বিবৃতিতে পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যায়নি।

তবে যৌথ সংবাদ সম্মেলনে এ-সংক্রান্ত এক প্রশ্নের জবাবে বিএনপি নেতা আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘সব বিষয়ে আলোচনা তো হবে, এটাই স্বাভাবিক। আমরা তো নতুন বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় নিয়ে সামনের দিকে এগোচ্ছি। আমরা সবাই চাই, দেশ গড়ার যে প্রত্যয় আমরা নিয়েছি, আমরা ঐক্যবদ্ধভাবে সেই কাজটা করব। বাংলাদেশ গড়ার যে প্রত্যয় নিয়ে আমরা সবাই ঐকমত্যে এসেছি, শুধু নির্বাচনের আগে নয়, নির্বাচনের পরও সেটা আমরা সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাব।’

অধ্যাপক ইউনূসের সঙ্গে তারেক রহমানের বৈঠকে জুলাই সনদ নিয়ে কোনো কথা হয়েছে কি না, জানতে চাইলে আমীর খসরু বলেন, ‘জুলাই সনদ নিয়ে তো ইতিমধ্যে আলোচনা চলছে দেশে। এ ব্যাপারে আমাদের মধ্যে ইতিমধ্যে সিদ্ধান্ত আছে যে ঐকমত্যের ভিত্তিতে জুলাই সনদ হবে। সংস্কারের ব্যাপারেও একই উত্তর আমাকে দিতে হয় যে ঐকমত্যের ভিত্তিতে আমরা সংস্কার ও জুলাই সনদ—দুটোই করব। সবার ঐকমত্যের পরিপ্রেক্ষিতে সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে এবং আমি নিশ্চিত, খুব কম সময়ের মধ্যে আমরা সেই সিদ্ধান্ত নিতে পারব।’

এক সাংবাদিক প্রশ্ন করেন, নতুন রাজনৈতিক দল এনসিপি নির্বাচন কমিশনের সংস্কার ছাড়া নির্বাচনে যাবে না বলে ঘোষণা করেছে। এ বিষয়ে কোনো আলোচনা হয়েছে কি না? জবাবে আমীর খসরু মাহমুদ বলেন, ‘এ ব্যাপারে এখানে আলোচনার কোনো সুযোগ আছে বলে আমি মনে করি না।’ এ প্রশ্নে নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান বলেন, ‘এটা তাদের (এনসিপি) জিজ্ঞেস করুন। প্রতিটি দলের নিজস্ব মতামত আছে। তবে আমরা সবাইকে নিয়ে নির্বাচনটা করতে চাচ্ছি।’

প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, নির্বাচনের আগেই শেখ হাসিনার হত্যাযজ্ঞের বিচারপ্রক্রিয়া তিনি শেষ করতে চান এবং পরে তাঁকে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবেন। এ ব্যাপারে বৈঠকে আলোচনা হয়েছে কি না, সেটা হয়ে থাকলে নির্বাচনের রূপরেখায় এর কোনো প্রভাব ফেলবে কি না? এমন প্রশ্নের জবাবে খলিলুর রহমান বলেন, ‘যৌথ বিবৃতিতে এর উত্তর দেওয়া আছে। সংস্কার এবং বিচার; দুই বিষয়ে পর্যাপ্ত অগ্রগতির কথা বলা হয়েছে এবং আমরা মোটামুটি কনফিডেন্ট (আত্মবিশ্বাসী) যে এই অগ্রগতি আমরা নির্বাচনের আগেই দেখতে পাব।’

তারেক রহমানের দেশে ফেরা নিয়ে বৈঠকে কোনো আলোচনা হয়েছে কি না বা তিনি কবে দেশে ফিরতে পারেন? এমন প্রশ্নের উত্তরে আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘এ ব্যাপারে আলোচনার কোনো প্রয়োজনীয়তা আছে বলে আমরা মনে করি না। তারেক রহমান সাহেব যখনই ইচ্ছা দেশে ফিরে যেতে পারবেন। সুতরাং এটার সিদ্ধান্ত তিনি নেবেন, সময়মতো।’

সংবাদ সম্মেলনে শেষ প্রশ্ন ছিল, ‘বৈঠকে আলোচনায় আপনারা কি সন্তুষ্ট?’ সমস্বরে এ প্রশ্নের জবাব দেন খলিলুর রহমান ও আমীর খসরু মাহমুদ। দুজনই বলেন, ‘নিশ্চয়ই সন্তুষ্ট।’ এর সঙ্গে আমীর খসরু বলেন, ‘আমরা তো বলছি নির্বাচনের আগে নয়, নির্বাচনের পরও নতুন বাংলাদেশ গড়ার ক্ষেত্রে আমাদের সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।’ এরপর খলিলুর রহমান বলেন, ‘সন্তুষ্ট না হলে তো যৌথ ঘোষণা আসার কথা নয়।’

‘চারদিকে যে অনিশ্চয়তা ছিল, সেটা কেটেছে’

অধ্যাপক ইউনূস ও তারেক রহমানের বৈঠকের পর ঢাকায় বিএনপির গুলশান কার্যালয়ে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর প্রতিক্রিয়া জানান। তিনি বলেন, বৈঠক সফল হয়েছে। সবকিছু যে একটা অনিশ্চিত অবস্থায় চলে গিয়েছিল, সেই অবস্থাকে কাটিয়ে জাতিকে আবার সামনে এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখিয়েছেন দুই নেতা।

মির্জা ফখরুল বলেন, লন্ডনের বৈঠকের পর তারেক রহমানের সঙ্গে তাঁর ফোনে কথা হয়েছে। এ সময় তারেক রহমান দলের নেতা–কর্মীদের অভিনন্দন ও জনগণের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান। একই সঙ্গে সঠিক দিকনির্দেশনা দেওয়ার জন্য তাঁর মা ও দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার প্রতি শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা জানান।

বিএনপির মহাসচিব দলের নেতা-কর্মীদের পক্ষ থেকে তারেক রহমান ও প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ইউনূসের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান। তিনি বলেন, অত্যন্ত বিচক্ষণতার সঙ্গে তিনি (ইউনূস) তারেক রহমানকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। সবকিছু একটা অনিশ্চিত অবস্থায় চলে গিয়েছিল, সেই অবস্থা কাটিয়ে জাতিকে আবার সামনের দিকে ও আশা নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখিয়েছেন দুই নেতা।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে ভোট, একমত ইউনূস ও তারেক