রমজানের শেষ। আমাদের সবচেয়ে বড় উৎসব ঈদ উদ্‌যাপনের জন্য মানুষ বাড়ি যাচ্ছে। তাতে চেনা শহরটার চেহারা পাল্টে গেল। কেমন অচেনা মনে হচ্ছে। শনিবার বেলা সাড়ে ১১টায় নন্দনকানন থেকে রিকশায় প্রবর্তক মোড় পর্যন্ত আসতে এক সেকেন্ডের জন্য কোথাও দাঁড়াতে হয়নি। ১২ মিনিটে পৌঁছে গেলাম। চারদিক কেমন শান্ত ও নির্জন। কোথাও যানজট নেই। গাড়ির হর্ন নেই। মানুষের চিৎকার–চেঁচামেচি নেই। হঠাৎ করে যেন গত শতকের সত্তর কিংবা আশির দশকের চট্টগ্রামে ফিরে গেলাম। ঈদ এলে প্রায় সব পত্রিকায় একটি কমন শিরোনাম থাকে, নাড়ির টানে ফিরছে মানুষ। কেবল কি নাড়ির টানে মানুষ শহর ছাড়ে?

দুই ঈদ কিংবা একটু লম্বা ছুটি পেলে মানুষ কেন ছুটে যায়, কেন পালায় শহর থেকে? মা, বাবা, দাদা কিংবা দাদিসহ পূর্বপুরুষকে শ্রদ্ধা জানাতে? তাঁদের কবর জিয়ারত করতে, তাঁদের স্মৃতিবিজড়িত ভূমিতে পা রেখে মনের শান্তি পেতে? এটা হয়তো ঠিক। কিন্তু সবচেয়ে বড় সত্য কিংবা বাস্তবতা হলো, মানুষ নাগরিক যন্ত্রণা থেকে মুক্তি চায়। নগর মানুষকে জীবিকা দিয়েছে, চাকরি, ব্যবসা দিয়েছে; শিক্ষা, চিকিৎসাসহ নানা সুবিধা দিয়েছে, কিন্তু এর বিনিময়ে তার ভেতর থেকে প্রশান্তিটুকু কেড়ে নিয়েছে। আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশের নগরগুলো উন্নত দেশের নগরগুলোর মতো পরিকল্পিতভাবে বেড়ে ওঠে না। এ কারণে নগরের পরিধি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এখানে মানুষের ভোগান্তি বাড়তে শুরু করে।

আমাদের চট্টগ্রাম ছিল একসময় অরণ্যসংকুল জীববৈচিত্র্যে ভরা একটি পার্বত্য শহর। ঢাকা ও কলকাতা থেকেও প্রাচীন এই বন্দরনগরীর বয়স দেড় হাজার বছরের মতো। এই নগরে সুলতানি ও মোগল আমলের ঐশ্বর্যের চিহ্ন যেমন আছে, তেমনি আছে ব্রিটিশ শাসনামলের নানা নিদর্শন। প্রকৃতি যেমন চট্টগ্রামের প্রতি উদারহস্ত, তেমন ঐতিহ্যের দিক থেকেও ছিল সমৃদ্ধ। ঐতিহাসিক, বাণিজ্যিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে সব সময় এই নগর খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এই গুরুত্ব দিন দিন বেড়েছে। ফলে সব ক্ষেত্রের মানুষের একটা আকর্ষণ ছিল কর্ণফুলীর তীরের এই জনপদের প্রতি। তাই দিন দিন এর সীমা বড় হয়েছে, পরিধি বিস্তৃতি লাভ করেছে।

বিশেষ করে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের আবির্ভাবের পর দেশের একমাত্র সমুদ্রবন্দরের ওপর নির্ভরতা বাড়ার পর এখানকার কর্মযজ্ঞ দিন দিন বাড়তেই থাকে। তা ছাড়া দিন দিন শহরের ওপর মানুষের নির্ভরতা বাড়তে থাকায় মানুষ ক্রমে শহরমুখী হতে থাকে। ফলে নগরে মানুষের সংখ্যা ক্রমে বাড়তে থাকে। ১৮৬৩ সালে চট্টগ্রাম মিউনিসিপ্যালটির যাত্রা শুরুর কালে এখানে ওয়ার্ড ছিল চারটি। এখন সিটি করপোরেশনের ৪১টি ওয়ার্ড। ওই সময় শহরের আয়তন ছিল চার বর্গমাইল। আর এখন সিটি করপোরেশনের আয়তন ১৫৫ বর্গকিলোমিটার। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০২২ সালের হিসাব অনুযায়ী, চট্টগ্রাম শহরে ৩৫ লাখ মানুষের বাস। কিন্তু চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মতে, চট্টগ্রাম নগরে ৬০ লাখ মানুষের বসবাস।

এই যে জনসংখ্যার বিরাট উল্লম্ফন এবং নগরের বিস্তার, এটা সুষ্ঠু পরিকল্পনায় যথাযথভাবে হয়নি। নগর বেড়েছে, কিন্তু প্রাকৃতিক সম্পদ কমেছে। পরিধি বিস্তৃত হয়েছে; কিন্তু খাল নদী, জলাশয় সংকুচিত হয়েছে। পরিবেশের ক্ষতি করতে করতে, প্রাকৃতিক সম্পদ বিনষ্ট করতে করতে আমাদের চট্টগ্রাম মিউনিসিপ্যাল থেকে সিটি করপোরেশনে উন্নত হয়েছে, কিন্তু বাসযোগ্যতা হারিয়ে একটা ধূলিধূসর দূষিত শহরে পরিণত হয়েছে।

দিন যতই এগোচ্ছে, শহরের ওপর মানুষের নির্ভরতা বাড়ছে। মানুষের একটু সামর্থ্য হলেই শহরে চলে আসছে। গ্রামের প্রশস্ত উঠান, পুকুর, দিঘিসহ শুদ্ধ আলো–হাওয়ার বাড়ি ছেড়ে প্রয়োজনের তাগিদে শহরে গলিঘুপচির মধ্যে খাঁচার মতো ঘরে বাস করছে। এখানে সারা দিন কর্মব্যস্ত থাকে তারা। যানজট, জলজট, ধোঁয়া, ধুলা, হাওয়াহীন দমবন্ধ পরিবেশে থেকে থেকে মানুষ তাই আজকাল একটু ছুটি পেলে গ্রামে ফিরে গিয়ে প্রাণের শক্তি নিয়ে আসে, বেঁচে থাকার প্রেরণা নিয়ে আসে। আর কয়েকটি দিন শহরও যেন মানুষের ভারমুক্ত থাকে, যানবাহনের শব্দদূষণ আর ধোঁয়ার দূষণ থেকে বাঁচে। নগরও যেন বিশ্রাম নেয়, নিশ্বাস ফেলে।

কিন্তু শেষ পর্যন্ত বছরের এই কয়েকটি ছুটির দিনই কি আমাদের নাগরিক সমস্যা থেকে মুক্তির একমাত্র সমাধান? এর কী কোনো বিকল্প নেই? চট্টগ্রাম শহরকে কি পরিবেশের বিপর্যয় থেকে রক্ষা করা যাবে না? এই প্রশ্নের উত্তরে হ্যাঁ বলা সত্যিই কঠিন।  কারণ, যে পাহাড় আমরা হত্যা করেছি, যে জলাশয়গুলো আমরা ভূমিতল থেকে মুছে দিয়েছি, যে খালগুলো হারিয়ে গেছে, যে বৃক্ষ উজাড় হয়েছে এবং তার বদলে গড়ে উঠেছে বড় বড় দালান; সেগুলো পূর্বাবস্থায় ফিরে যাওয়া অসম্ভব। তাই অতীতের জন্য আমাদের হাহাকার ছাড়া কিছু নেই। কিন্তু ভবিষ্যৎকে বর্তমান থেকে আরও আরামদায়ক কিংবা অধিক বাসযোগ্য করতে পারি।

এর জন্য দরকার যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত এবং তার বাস্তবায়ন। আজকের ছুটির দিনগুলোর মতো শান্ত, দূষণহীন দিন হয়তো পাওয়া যাবে না। কিন্তু পরিকল্পনা করে একটি নগরকে সুন্দর ও মানুষের বসবাসযোগ্য করা যায়। নগরের ওপর থেকে মানুষের চাপ কমিয়ে আনতে হবে। কর্ণফুলী নদীর ওপারে তীরবর্তী গ্রামগুলোতে শহরের সুযোগ-সুবিধা রাখলে, শহরের সঙ্গে সময়ের দূরত্ব কমিয়ে আনতে পারলে মানুষ কেন থাকবে গলির অন্ধকারে। গ্রাম থেকে শহরে এসে দিনের কাজ সেরে সন্ধ্যায় ফিরে যাবে নিজের শান্তির ঘরে। তার জন্য নতুন কালুরঘাট সেতুসহ অন্তত আরও দুটি সেতু নির্মাণ প্রয়োজন।

চট্টগ্রাম শহরের পরিধি বেড়ে যাওয়ায় কিছু কিছু ভারী শিল্পাঞ্চল এখন নগরের মধ্যে ঢুকে পড়েছে। একটা নগরের ভেতরে এ রকম ভারী শিল্পকারখানা থাকা সমীচীন নয়। কালুরঘাট ও নাসিরাবাদে বহু বড় কারখানা রয়েছে, যেগুলো এই শহরের পরিবেশকে বিনষ্ট করছে। একটা কারখানা ঘিরে বহু রকমের কর্মকাণ্ড হয়, যেগুলো একটি মানববান্ধব নগরের পরিপন্থী। পক্ষান্তরে এসব কারখানা আমাদের জাতীয় অর্থনীতিতে বিরাট অবদান রাখছে। মানুষের কর্মসংস্থান থেকে শুরু করে পণ্য উৎপাদনসহ নানামুখী উপকার করছে এসব শিল্পপ্রতিষ্ঠান। তাই সরকারি সহায়তায় এসব শিল্পপ্রতিষ্ঠানকে নগর থেকে দূরে স্থানান্তর করতে পারলে চট্টগ্রাম শহর বড় ধরনের দূষণ থেকে রক্ষা পাবে।

এ ছাড়া সামাজিক বনায়ন, পাহাড় কর্তনকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ, হারিয়ে যাওয়া খাল উদ্ধার, কারখানা সরিয়ে খালি জায়গা তৈরি, মানুষের লোভ–লালসা থেকে ফুটপাত, বিদ্যমান খাল, পুকুর, মাঠ, সড়ক, সরকারি জায়গাকে দূরে রাখতে পারলে চট্টগ্রাম নগর ধীরে ধীরে তার হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্য ফিরে পাবে। আর এর জন্য দরকার সংশ্লিষ্ট সবার অকৃত্রিম আন্তরিক প্রচেষ্টা। ভোট আর ক্ষমতার রাজনীতির বাইরে এসে চট্টগ্রাম শহরকে বাঁচাতে সবাই এক জোট হবেন, এটাই এই ঈদে আমাদের প্রত্যাশা।

ওমর কায়সার প্রথম আলোর চট্টগ্রাম অফিসের বার্তা সম্পাদক

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ত হয় ছ পর ব শ আম দ র র জন য নগর র র ওপর শহর র

এছাড়াও পড়ুন:

রাখাইনে করিডোর কি রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে আশার আলো দেখাবে

রোহিঙ্গা সংকট ঘিরে নতুন আলোচনা ও বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। এর সূত্রপাত হয় সম্প্রতি মিয়ানমার সীমান্তে হিউম্যানিটারিয়ান বা মানবিক করিডর গড়ে তুলতে অন্তর্বর্তী সরকারের পররাষ্ট্র উপদেষ্টার মন্তব্যের মাধ্যমে, যেখানে তিনি বলেন, বাংলাদেশ এ বিষয়ে একটি নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। 

গত দুই মাসে রোহিঙ্গা সংকটকে ঘিরে ক্রমাগত নানা আলোচনা ও সমালোচনা চলমান। রোহিঙ্গা সংকটকে ঘিরে সাম্প্রতিক সময়ে প্রথম ইতিবাচক আলোচনা শুরু হয় মার্চ মাসে, যখন জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বাংলাদেশ ভ্রমণ করেন এবং বাংলাদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গা শরণার্থীশিবিরে পবিত্র রোজার মাসে তাদের সঙ্গে ইফতার করেন।

এ সময় অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস তাদের মেহমান উল্লেখ করে বলেন, তিনি প্রত্যাশা করেন আগামী রোজা রোহিঙ্গারা নিজ দেশে করতে পারবেন। 

পরবর্তী সময়ে ষষ্ঠ বিমসটেক সম্মেলনে যোগ দিতে গিয়ে একটি পার্শ্ব আলোচনার পর মিয়ানমারের পক্ষ থেকে বলা হয়, তারা প্রাথমিকভাবে ১ লাখ ৮০ হাজার রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে মিয়ানমারে ফিরিয়ে নিতে নীতিগতভাবে সম্মত।

এ নিয়েও জনসাধারণের মধ্যে একধরনের ধোঁয়াশা কাজ করে। কেননা, আরাকান আর্মিকে উপেক্ষা করে এ ধরনের মন্তব্য রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে খুব বেশি আশার আলো দেখাবে না। এর বেশ কিছুদিন পরে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা উল্লেখ করেন, সাম্প্রতিক সময়ে আরাকান আর্মি ও মিয়ানমারের সঙ্গে যে সহিংস দ্বন্দ্ব চলমান, সে প্রেক্ষাপটে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন এখনই সম্ভব নয়। 

এই চলমান আলোচনায় নতুন বিতর্ক তৈরি হয় রাখাইনে মানবিক করিডর গড়ে তোলার আলোচনার মাধ্যমে, যদিও এরপর অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব বলেছেন, এ বিষয়ে জাতিসংঘ বা অন্য কারও সঙ্গে তাঁদের এখনো কোনো আলোচনা হয়নি। এমন নানামুখী আলোচনায় জনমনে বিভ্রান্তি আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে। রাখাইনে মানবিক করিডর গড়ে তোলার প্রধান যুক্তি হলো, এতে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে মিয়ানমারে অবস্থানরত জনগোষ্ঠীর সাহায্যার্থে ত্রাণ এবং অন্যান্য প্রয়োজনের সামগ্রী পাঠানো সম্ভব হবে। 

মানবিক করিডর ও রোহিঙ্গা সংকটের বিষয়ে আলোচনার আগে একটু দেখে নেওয়া যাক মানবিক করিডর বলতে আসলে কী বোঝায়। 

জাতিসংঘের ব্যাখ্যা অনুযায়ী সশস্ত্র সংঘাতপূর্ণ এলাকায় সংঘাত বা যুদ্ধ পরিস্থিতির সাময়িক বিরতির জন্য অনেক ধরনের পন্থা অবলম্বন করা হয়, তার মধ্যে একটি হলো মানবিক করিডরের প্রস্তাব।

এই মানবিক করিডরের মধ্যে একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য এমন একটি জায়গা নির্ধারণ করা হয়, যেখানে সশস্ত্র সংঘাত যেন না ঘটে। সে বিষয়ে দুই পক্ষ জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে একমত হয়। মানবিক করিডরের পরবর্তী ধাপে সেই ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলের অধিবাসীদের একটি নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা করা হয় অথবা সেখানে খাদ্য, ওষুধ ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় সেবার ব্যবস্থা হয়। 

এ ধরনের মানবিক করিডরের উদাহরণ আমরা ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ে সংঘাতপূর্ণ বিভিন্ন দেশের প্রেক্ষাপটে দেখতে পাই। এখানে সামগ্রিক কর্মকাণ্ড জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে হবে, সেটাই প্রত্যাশা করা হয়। বিভিন্ন দেশের প্রেক্ষাপট থেকে আমরা দেখতে পাই, জাতিসংঘের ত্রাণবিষয়ক প্রতিষ্ঠান রেডক্রস এখানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ঘটনাবলির মধ্যে অন্যতম হলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে ইহুদি শিশুদের যুক্তরাজ্যে স্থানান্তর, নব্বইয়ের দশকে সারায়েভো সংকট, ২০১৮ সালে সিরিয়ার জনগোষ্ঠীকে নিরাপদ স্থানে স্থানান্তর করা এবং সর্বশেষ দেখতে পাই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ক্ষেত্রে।

যদি আরও রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিতে হয়, তাহলে তাদের দায়দায়িত্ব নিতে বাংলাদেশ কতটা প্রস্তুত, সেটা ভেবে দেখা জরুরি। কেননা, এখনই এক মিলিয়নের ওপর রোহিঙ্গা বিভিন্ন শরণার্থীশিবিরে মানবেতর জীবন যাপন করছে। এর সঙ্গে রয়েছে তাদের সামগ্রিক ব্যবস্থাপনার জন্য আন্তর্জাতিক মহলের অর্থনৈতিক সাহায্য কমিয়ে দেওয়া, যা বাংলাদেশের জন্য এক বড় অর্থনৈতিক বোঝা। 

রাখাইনকে ঘিরে মানবিক করিডর গড়ে তোলার এই নীতিগত সিদ্ধান্তের প্রেক্ষাপটে গবেষক, রাজনীতিবিদ, নীতিনির্ধারক ও সাধারণ জনগণের মধ্যে বেশ কিছু প্রশ্ন, আশঙ্কা ও দ্বিধা তৈরি হয়েছে।

তবে শঙ্কার পাশাপাশি কোনো কোনো গবেষক মনে করছেন, মানবিক করিডরের প্রস্তাব মেনে নেওয়ার মাধ্যমে রোহিঙ্গা সংকট মোকাবিলার চলমান সংলাপ আরও জোরদার হবে, যা ভবিষ্যতে এই সংকট মোকাবিলায়, বিশেষ করে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। 

তবে এই ইতিবাচক প্রত্যাশা ছাপিয়ে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনকে কেন্দ্র করে যে দ্বিধা রয়েছে, সেটি হলো এই মানবিক করিডরের মাধ্যমে ভবিষ্যতে কি রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন ত্বরান্বিত হবে, নাকি আরও বিলম্বিত হবে, নাকি আরও বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করার সুযোগ পাবে। 

ইতিমধ্যে আমরা দেখেছি, এক লাখের ওপরে রোহিঙ্গা শরণার্থী আবারও বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী জেলা কক্সবাজারে প্রবেশ করতে বাধ্য হয়েছে। মানবিক কারণে বাংলাদেশ এই দায় যেমন এড়িয়ে যেতে পারছে না, তেমনি রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ব্যবস্থাপনার ভারও বহন করতেও হিমশিম খাচ্ছে। এ অবস্থায় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনসহ তাদের অন্যান্য সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে মানবিক করিডর কতটা বাস্তবসম্মত হবে, সেটা একটা বড় প্রশ্ন। কেননা, কোনো বিস্তারিত দিকনির্দেশনা আমাদের সামনে নেই। 

অতীতের বিভিন্ন ঘটনার প্রেক্ষাপট থেকে আমরা দেখতে পাই, মানবিক করিডরের অন্যতম প্রধান ব্যবহার হচ্ছে ঝুঁকিপূর্ণ জাতিগোষ্ঠীকে সংঘাতপূর্ণ স্থান থেকে নিরাপদ স্থানে স্থানান্তর করা। যেখানে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বাংলাদেশে চলমান অনুপ্রবেশ কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না, সেখানে মানবিক করিডরের মাধ্যমে আরও বৃহৎ অংশের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকায় নিরাপত্তার স্বার্থে স্থানান্তর করার প্রক্রিয়ায় শুরু অস্বাভাবিক নয়। 

এ প্রেক্ষাপটে যদি আরও রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিতে হয়, তাহলে তাদের দায়দায়িত্ব নিতে বাংলাদেশ কতটা প্রস্তুত, সেটা ভেবে দেখা জরুরি। কেননা, এখনই এক মিলিয়নের ওপর রোহিঙ্গা বিভিন্ন শরণার্থীশিবিরে মানবেতর জীবন যাপন করছে। এর সঙ্গে রয়েছে তাদের সামগ্রিক ব্যবস্থাপনার জন্য আন্তর্জাতিক মহলের অর্থনৈতিক সাহায্য কমিয়ে দেওয়া, যা বাংলাদেশের জন্য এক বড় অর্থনৈতিক বোঝা। 

এর বাইরে আরেকটি চিন্তার জায়গা হলো সীমান্ত এলাকা বাংলাদেশ কতটা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবে, সেটি। সাম্প্রতিক ঘটনাবলি দেখলে বোঝা যায়, সীমান্ত প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রে আমাদের বর্তমান প্রচেষ্টা খুব যে সুখকর, সেটি বলা যাবে না।

এ ছাড়া এই অঞ্চল বিভিন্ন কারণে মাদক ব্যবসা, মানব পাচার, সহিংসতা ও অন্যান্য নিরাপত্তাঝুঁকির জন্য একটি অন্যতম হটস্পট, যা নিয়ন্ত্রণ করতে আমাদের নানাভাবে হিমশিম খেতে হচ্ছে।

এমন পরিস্থিতিতে সীমান্ত এলাকার নিয়ন্ত্রণ আরও ঝুঁকিপূর্ণ হয় কি না, সেটা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। মানবিক করিডরের মাধ্যমে বাংলাদেশ কীভাবে লাভবান হতে পারে, সে বিষয়েও যথাযথ পরিষ্কার ধারণা থাকতে হবে এবং নিজেদের স্বার্থেই আমাদের স্বচ্ছ থাকতে হবে। 

এর সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোসহ অন্য অংশীজনের সঙ্গে পরামর্শ করারও বিশেষ প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। কেননা, এর পরবর্তী পরিণতি ও ব্যবস্থাপনার দায়দায়িত্ব ভবিষ্যতের নির্বাচিত সরকারকেই গ্রহণ ও বহন করতে হবে। যদিও জাতিসংঘের মানবিক করিডরের প্রস্তাব বেশ পুরোনো, কিন্তু তড়িঘড়ি করে এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হিতে বিপরীত হতে পারে। শরণার্থী বিষয়ে একটি টেকসই রূপরেখা এবং পরিকল্পনানীতি না থাকার কারণে সরকারকে অ্যাডহক প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নিতে হয়, যা অনেক ক্ষেত্রেই সমস্যাজনক হয়। 

এসব বিবেচনায় নিয়ে একজন গবেষক হিসেবে আমি বিভিন্ন সময় রোহিঙ্গাবিষয়ক একটি জাতীয় রোডম্যাপ বা রূপরেখা এবং শরণার্থীবিষয়ক নীতি প্রণয়ন করার পক্ষে কথা বলে আসছি। আমাদের সে ধরনের কোনো দৃশ্যমান পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি বিগত সময়ে ছিল না। বিশেষ করে যদি প্রত্যাবাসন ব্যর্থ হয় এবং জাতিসংঘের প্রস্তাবিত মানবিক করিডর আমাদের প্রত্যাশামতো কাজ না করে, তাহলে বিকল্প কী হবে, সে বিষয়ে বিস্তারিত পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি আমাদের থাকা উচিত। সেটি না হলে রোহিঙ্গা সংকট আরও জটিল আকার ধারণ করবে এবং তাদের নিজ দেশে স্বেচ্ছায় ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসন একটি ‘মিথ’ হিসেবে থেকে যাবে, যা আমাদের ও রোহিঙ্গা উভয়ের জন্যই হতাশার একটি বিষয় হবে। 

বুলবুল সিদ্দিকী সহযোগী অধ্যাপক, রাজনীতি ও সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়

সম্পর্কিত নিবন্ধ