মার্চে ৩২৯ কোটি ডলারের রেকর্ড রেমিট্যান্স
Published: 6th, April 2025 GMT
প্রথমবারের মতো একক মাসে তিন বিলিয়ন ডলারের বেশি রেমিট্যান্স এসেছে। রমজান ও ঈদের মাস গত মার্চে প্রবাসীরা রেকর্ড ৩২৯ কোটি ডলার দেশে পাঠিয়েছেন। এর আগে এক মাসে সর্বোচ্চ ২৬৪ কোটি ডলার রেমিট্যান্সের রেকর্ড ছিল গত বছরের ডিসেম্বরে। গত বছরের মার্চে এসেছিল ২০০ কোটি ডলারের কম। রেকর্ড রেমিট্যান্সের পাশাপাশি রপ্তানিতে ভালো প্রবৃদ্ধির ফলে রিজার্ভ বেড়ে ২০ দশমিক ৪৬ বিলিয়ন ডলারে উঠেছে।
শুধু যে ঈদের মাস মার্চে ভালো রেমিট্যান্স এসেছে, তেমন নয়। গত আগস্টে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর থেকে প্রতি মাসেই আগের বছরের একই মাসের তুলনায় রেমিট্যান্স বেড়েছে। সব মিলিয়ে চলতি অর্থবছরের জুলাই-মার্চ সময়ে মোট ২ হাজার ১৭৭ কোটি ডলার দেশে পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। আগের অর্থবছরের একই সময়ে এসেছিল যেখানে মাত্র ১ হাজার ৭০৭ কোটি ডলার। অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে রেমিট্যান্সে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২৭ দশমিক ৫৫ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত মার্চের এ রেমিট্যান্স আগের বছরের একই মাসের তুলনায় ১২৯ কোটি ডলার বা ৬৪ দশমিক ৭৪ শতাংশ বেশি। আর আগের মাস ফেব্রুয়ারির তুলনায় বেড়েছে ৭৬ কোটি ডলার বা ৩০ দশমিক ২৬ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইতে শুধু আগের অর্থবছরের একই মাসের তুলনায় রেমিট্যান্স কমেছিল। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মধ্যে ওই মাসে প্রবাসীরা মাত্র ১৯১ কোটি ডলার দেশে পাঠান। আগের অর্থবছরের একই মাসে আসে ১৯৭ কোটি ডলার। সরকার পতনের পর কোনো মাসে রেমিট্যান্স ২ বিলিয়ন ডলারের নিচে নামেনি। মূলত অর্থ পাচার কমে যাওয়ায় এভাবে রেমিট্যান্স বাড়ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড.
ব্যাংকাররা জানান, বিগত সরকারের সময় দেশের অর্থনীতিতে সবচেয়ে বড় ক্ষত তৈরি করেছে অর্থ পাচার। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় কয়েকটি ব্যাংক দখল করে বিপুল অর্থ বের করে বাইরে নেওয়া হয়েছে। দুর্নীতি, রাজস্ব ফাঁকি, অনিয়ম-জালিয়াতির মাধ্যমে অর্জিত অর্থ হুন্ডি করে বিদেশে নেওয়া হয়েছে। যে কারণে নানা প্রণোদনার পরও রেমিট্যান্স কমছিল। এখন অর্থ পাচার অনেক ক্ষেত্রে বন্ধ হয়েছে। বরং আগে বিভিন্ন সময় পাচার করা অর্থ ফেরত আনতে কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সিঙ্গাপুর, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশের সঙ্গে যোগাযোগ করা হচ্ছে। আন্তর্জাতিক আইনজীবী নিয়োগের সিদ্ধান্ত হয়েছে। এ ছাড়া অনিয়ম-দুর্নীতিতে আলোচনার শীর্ষে থাকা ১০ ব্যবসায়ী গ্রুপ এবং শেখ হাসিনা পরিবারের বিরুদ্ধে তদন্তের জন্য চার সরকারি সংস্থার সমন্বয়ে ১১টি যৌথ টিম গঠন করা হয়েছে। এসব উদ্যোগের মধ্যে রেমিট্যান্স বাড়ছে।
প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, গত মার্চে সর্বোচ্চ ব্যবধানে নতুন রেকর্ড হয়েছে। গত ডিসেম্বরের তুলনায় ৬৫ কোটি ডলার বা ২৪ দশমিক ৬৭ শতাংশ বেশি রেমিট্যান্স এসেছে। এর আগে সর্বোচ্চ রেমিট্যান্স আহরণে এক মাস থেকে আরেক মাসের ব্যবধান ছিল সামান্য। দেশের ইতিহাসে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ২৬৩ কোটি ৮৮ লাখ ডলার এসেছিল গত ডিসেম্বরেই। তৃতীয় সর্বোচ্চ ২৫৯ কোটি ৮২ লাখ ডলার আসে ২০২০ সালের মার্চে। চতুর্থ সর্বোচ্চ ২৫৩ কোটি ৮৬ লাখ ডলারের রেকর্ড ছিল গত বছরের জুনে। আর পঞ্চম সর্বোচ্চ ২৫২ কোটি ৭৬ লাখ ডলার এসেছে গত ফেব্রুয়ারিতে। এর পরের অবস্থানে গত বছরের সেপ্টেম্বরে এসেছিল ২৪০ কোটি ডলার।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক আরিফ হোসেন খান সমকালকে বলেন, মার্চে এভাবে রেমিট্যান্স বৃদ্ধির একটি কারণ রমজান ও ঈদ। সাম্প্রতিক সময়ে রেমিট্যান্স বাড়ার প্রধান কারণ অর্থ পাচার ঠেকাতে সম্মিলিত প্রচেষ্টা। আবার আগে কখনও ব্যাংকিং চ্যানেলে অর্থ পাঠাননি– এমন অনেকেই আগস্ট-পরবর্তী দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে পাঠাচ্ছেন। তাদের কাছে দর কোনো বিষয় নয়। আবার আমদানি দায় মেটানোর জন্য ব্যাংকগুলোকেই অর্থ জোগাড় করতে বলা হয়েছে। যে কারণে ব্যাংকগুলো নিজেদের তাগাদা থেকে বিদেশি এক্সচেঞ্জ হাউস থেকে ডলার নিয়ে আসছে। সব মিলিয়ে রেমিট্যান্স এভাবে বাড়ছে।
বিগত সরকারের সর্বশেষ মুদ্রানীতি ঘোষণা হয় গত বছরের জুনে। সেখানে বাংলাদেশ ব্যাংক অর্থনীতির জন্য তিনটি চ্যালেঞ্জের কথা উল্লেখ করে। এই তিন চ্যালেঞ্জ হলো– মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ও ডলার দরে স্থিতিশীলতা ফেরানো এবং সুদহারে স্থিতিশীলতা ফেরানো। সরকার পতনের পর এই তিন ক্ষেত্রেই স্থিতিশীলতা এসেছে। এরই মধ্যে মূল্যস্ফীতি কমতে শুরু করেছে। গত ফেব্রুয়ারিতে মূল্যস্ফীতি নেমেছে ৯ দশমিক ৩৪ শতাংশে। গত ২৩ মাসের মধ্যে যা সর্বনিম্ন। আবার ২০২২ সালের আগস্টে ডলারের দর ছিল ৮৪ টাকা। সেখান থেকে বাড়তে বাড়তে গত সরকারের সময়ে ১২৭ টাকা পর্যন্ত ওঠে। আগস্ট-পরবর্তী ডলারের দর ১২২ থেকে ১২৩ টাকায় রয়েছে।
২০২২ সালের আগস্টে ৪৮ বিলিয়ন ডলারের ঘর পেরোনো রিজার্ভ গত জুলাইতে ২০ বিলিয়ন ডলারে নামে। ওই সময়ে প্রতি মাসে গড়ে রিজার্ভ কমছিল ৮০ কোটি ডলারের মতো। সরকার পতনের পর থেকে রিজার্ভ ২০ বিলিয়ন ডলারের ঘরেই রয়েছে। গতকাল দিন শেষে রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ২০ দশমিক ৪৬ বিলিয়ন ডলার। কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভ থেকে এখন আর কোনো ডলার বিক্রি করছে না। বরং বাজার ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে বিগত সরকারের রেখে যাওয়া মেয়াদোত্তীর্ণ বকেয়া ৩৭০ কোটি ডলার পরিশোধ করা হয়েছে। এসব সম্ভব হয়েছে মূলত রেমিট্যান্স উচ্চ প্রবৃদ্ধির পাশাপাশি ভালো রপ্তানি আয়ের কারণে। গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৯ শতাংশের বেশি। সব মিলিয়ে আমদানিতে সাড়ে ৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধির পরও ডলার বাজারে কোনো হাহাকার নেই। এরই মধ্যে আমদানির ওপর থেকে বেশির ভাগ বিধিনিষেধ তুলে নেওয়া হয়েছে।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: বছর র একই ম স গত সরক র র গত বছর র প রব দ ধ র কর ড এস ছ ল দশম ক আগস ট
এছাড়াও পড়ুন:
সুদ পরিশোধে ব্যয় বাড়ছে
সুদ পরিশোধে সরকারের ব্যয় বাড়ছে। এ ব্যয় বহন করতে রীতিমত হিমশিম খেতে হচ্ছে। বাজেটে সরকারের সুদ পরিশোধ সংক্রান্ত পূর্বাভাসে দেখা যাচ্ছে, আগামী বছরগুলোতে সুদ ব্যয় ক্রমাগত বৃদ্ধি পাবে।
পরিচালন ও উন্নয়ন বাজেটের প্রায় ১৫ ভাগ অর্থই সুদ খাতে খরচ করতে হচ্ছে এখন। এ পরিস্থিতিতে আগামী তিন অর্থবছরে সুদ খাতেই ব্যয় করতে হবে চার লাখ ১০ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। পাঁচ অর্থবছরের ব্যবধানে সুদ ব্যয় বাড়ছে ৩৩ শতাংশ। এর মধ্যে শতাংশের হিসাবে বৈদেশিক ঋণের সুদ ব্যয় সবচেয়ে বেশি বাড়বে।
অর্থ বিভাগের করা ‘মধ্যমেয়াদি সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতি বিবৃতি-২০২৫-২০২৬ থেকে ২০২৭-২০২৮’ এ তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে।
পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে সুদ খাতে ব্যয় হয়েছিল এক লাখ ১৪ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে অভ্যন্তরীণ খাতে সুদ ব্যয় ছিল ৯৯ হাজার ৬০০ কোটি টাকা এবং বিদেশি ঋণের সুদ ব্যয় গেছে ১৫ হাজার ১০০ কোটি টাকা।
চলতি ২০২৪-২০২৫ অর্থবছরে (যা চলতি জুনের ৩০ তারিখে শেষ হয়ে যাবে) মূল বাজেটে সুদ খাতে ব্যয় বরাদ্দ ছিল এক লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু বছর শেষে এই সীমায় সুদ ব্যয় ধরে রাখা সম্ভব হয়নি। ফলে সংশোধিত বাজেটে এ খাতে ব্যয় বাড়িয়ে ধরা হয়েছে এক লাখ ২১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। এ হিসাবের মধ্যে ছিল অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদ ব্যয় ৯৯ হাজার ৫০০ কোটি টাকা এবং বিদেশী ঋণের ২২ হাজার কোটি টাকা।
একইভাবে আগামী তিন অর্থবছরে সুদ খাতে ব্যয়েরও একটি প্রক্ষেপণ করেছে অর্থ বিভাগ। এই হিসেবে দেখা যায় আগামী ১ জুলাই থেকে শুরু হওয়া ২০২৫-২০২৬ অর্থবছরে সুদ খাতে ব্যয় হবে এক লাখ ২২ হাজার কোটি টাকা (অভ্যন্তরীণ এক লাখ কোটি টাকা , বিদেশি ঋণের সুদ ব্যয় ২২ হাজার কোটি টাকা)। একইভাবে এর পরের অর্থবছর ২০২৬-২০২৭ অর্থবছরে একলাখ ৩৬ হাজার ২০০ কোটি টাকা(অভ্যন্তরীণ এক লাখ ১২ হাজার কোটি টাকা এবং বিদেশি ঋণের ২৪ হাজার ২০০ কোটি টাকা) এবং ২০২৭-২০২৮ অর্থবছরে সুদ খাতে ব্যয়ের প্রক্ষেপণ করা হয়েছে ১ লাখ ৫২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা।
অর্থ বিভাগ থেকে বলা হয়েছে, মোট সুদ ব্যয়ের সিংহভাগই অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদ পরিশোধ। অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদ পরিশোধ ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে ৯৯ হাজার ৬০০ কোটি টাকা থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ২০২৭-২০২৮ অর্থবছরে এক লাখ ২৫ হাজার ৫০০ কোটি টাকা গিয়ে পৌঁছাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। কিন্তু মোট বাজেটের অনুপাতে অভ্যন্তরীণ সুদ পরিশোধের হার ২০২৩ -২০২৪ অর্থবছরে ১৬ দশমিক ২৯ শতাংশ থেকে কমে ২০২৭-২০২৮ অর্থবছরে ১২ দশমিক ৭৫ শতাংশে হ্রাস পাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। যদিও বৈদেশিক ঋণের সুদ পরিশোধ মোট সুদ ব্যয়ের তুলনায় কম, তবে এটি উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পাবে বলে অনুমান করা হচ্ছে। ফলে এটি ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে ১৫ হাজার ১০০ কোটি টাকা থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ২০২৭-২০২৮ অর্থবছরে ২৭ হাজার ১০০ কোটি টাকায় উন্নীত হতে পারে। মোট বাজেটের অনুপাতে বৈদেশিক ঋণের সুদ পরিশোধ এ সময়কালে ২ দশমিক ৪৭ শতাংশ থেকে বেড়ে ২ দশমিক ৭৬ শতাংশে উন্নীত হতে পারে।
বিদেশি ঋণের সুদ ব্যয় নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে অর্থ বিভাগ থেকে বলা হয়েছে, বৈদেশিক ঋণের সুদ পরিশোধের কার্যকর ব্যবস্থাপনা শুধু আর্থিক শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্যই নয়, বরং এটি সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ রক্ষা, টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করা, আন্তর্জাতিক ঋণমান বজায় রাখা এবং ভবিষ্যতের উন্নয়ন সম্ভাবনা সুরক্ষিত রাখার জন্য অপরিহার্য।