প্রথমবারের মতো একক মাসে তিন বিলিয়ন ডলারের বেশি রেমিট্যান্স এসেছে। রমজান ও ঈদের মাস গত মার্চে প্রবাসীরা রেকর্ড ৩২৯ কোটি ডলার দেশে পাঠিয়েছেন। এর আগে এক মাসে সর্বোচ্চ ২৬৪ কোটি ডলার রেমিট্যান্সের রেকর্ড ছিল গত বছরের ডিসেম্বরে। গত বছরের মার্চে এসেছিল ২০০ কোটি ডলারের কম। রেকর্ড রেমিট্যান্সের পাশাপাশি রপ্তানিতে ভালো প্রবৃদ্ধির ফলে রিজার্ভ বেড়ে ২০ দশমিক ৪৬ বিলিয়ন ডলারে উঠেছে।

শুধু যে ঈদের মাস মার্চে ভালো রেমিট্যান্স এসেছে, তেমন নয়। গত আগস্টে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর থেকে প্রতি মাসেই আগের বছরের একই মাসের তুলনায় রেমিট্যান্স বেড়েছে। সব মিলিয়ে চলতি অর্থবছরের জুলাই-মার্চ সময়ে মোট ২ হাজার ১৭৭ কোটি ডলার দেশে পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। আগের অর্থবছরের একই সময়ে এসেছিল যেখানে মাত্র ১ হাজার ৭০৭ কোটি ডলার। অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে রেমিট্যান্সে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২৭ দশমিক ৫৫ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত মার্চের এ রেমিট্যান্স আগের বছরের একই মাসের তুলনায় ১২৯ কোটি ডলার বা ৬৪ দশমিক ৭৪ শতাংশ বেশি। আর আগের মাস ফেব্রুয়ারির তুলনায় বেড়েছে ৭৬ কোটি ডলার বা ৩০ দশমিক ২৬ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইতে শুধু আগের অর্থবছরের একই মাসের তুলনায় রেমিট্যান্স কমেছিল। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মধ্যে ওই মাসে প্রবাসীরা মাত্র ১৯১ কোটি ডলার দেশে পাঠান। আগের অর্থবছরের একই মাসে আসে ১৯৭ কোটি ডলার। সরকার পতনের পর কোনো মাসে রেমিট্যান্স ২ বিলিয়ন ডলারের নিচে নামেনি। মূলত অর্থ পাচার কমে যাওয়ায় এভাবে রেমিট্যান্স বাড়ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড.

আহসান এইচ মনসুর সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বলেন, রেমিট্যান্স বাড়ার মূল কারণ অর্থ পাচার রোধে কঠোরতা। ভালো রেমিট্যান্সের কারণে ডলারের দর এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ স্থিতিশীল হয়ে এসেছে। অর্থ পাচারের বিরুদ্ধে আগামীতেও কঠোরতা অব্যাহত থাকবে। তিনি বলেন, ইতোমধ্যে দেশ থেকে পাচার করে নেওয়া অর্থ ফেরত আনার বিষয়ে এরই মধ্যে বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
ব্যাংকাররা জানান, বিগত সরকারের সময় দেশের অর্থনীতিতে সবচেয়ে বড় ক্ষত তৈরি করেছে অর্থ পাচার। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় কয়েকটি ব্যাংক দখল করে বিপুল অর্থ বের করে বাইরে নেওয়া হয়েছে। দুর্নীতি, রাজস্ব ফাঁকি, অনিয়ম-জালিয়াতির মাধ্যমে অর্জিত অর্থ হুন্ডি করে বিদেশে নেওয়া হয়েছে। যে কারণে নানা প্রণোদনার পরও রেমিট্যান্স কমছিল। এখন অর্থ পাচার অনেক ক্ষেত্রে বন্ধ হয়েছে। বরং আগে বিভিন্ন সময় পাচার করা অর্থ ফেরত আনতে কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সিঙ্গাপুর, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশের সঙ্গে যোগাযোগ করা হচ্ছে। আন্তর্জাতিক আইনজীবী নিয়োগের সিদ্ধান্ত হয়েছে। এ ছাড়া অনিয়ম-দুর্নীতিতে আলোচনার শীর্ষে থাকা ১০ ব্যবসায়ী গ্রুপ এবং শেখ হাসিনা পরিবারের বিরুদ্ধে তদন্তের জন্য চার সরকারি সংস্থার সমন্বয়ে ১১টি যৌথ টিম গঠন করা হয়েছে। এসব উদ্যোগের মধ্যে রেমিট্যান্স বাড়ছে।

প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, গত মার্চে সর্বোচ্চ ব্যবধানে নতুন রেকর্ড হয়েছে। গত ডিসেম্বরের তুলনায় ৬৫ কোটি ডলার বা ২৪ দশমিক ৬৭ শতাংশ বেশি রেমিট্যান্স এসেছে। এর আগে সর্বোচ্চ রেমিট্যান্স আহরণে এক মাস থেকে আরেক মাসের ব্যবধান ছিল সামান্য। দেশের ইতিহাসে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ২৬৩ কোটি ৮৮ লাখ ডলার এসেছিল গত ডিসেম্বরেই। তৃতীয় সর্বোচ্চ ২৫৯ কোটি ৮২ লাখ ডলার আসে ২০২০ সালের মার্চে। চতুর্থ সর্বোচ্চ ২৫৩ কোটি ৮৬ লাখ ডলারের রেকর্ড ছিল গত বছরের জুনে। আর পঞ্চম সর্বোচ্চ ২৫২ কোটি ৭৬ লাখ ডলার এসেছে গত ফেব্রুয়ারিতে। এর পরের অবস্থানে গত বছরের সেপ্টেম্বরে এসেছিল ২৪০ কোটি ডলার।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক আরিফ হোসেন খান সমকালকে বলেন, মার্চে এভাবে রেমিট্যান্স বৃদ্ধির একটি কারণ রমজান ও ঈদ। সাম্প্রতিক সময়ে রেমিট্যান্স বাড়ার প্রধান কারণ অর্থ পাচার ঠেকাতে সম্মিলিত প্রচেষ্টা। আবার আগে কখনও ব্যাংকিং চ্যানেলে অর্থ পাঠাননি– এমন অনেকেই আগস্ট-পরবর্তী দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে পাঠাচ্ছেন। তাদের কাছে দর কোনো বিষয় নয়। আবার আমদানি দায় মেটানোর জন্য ব্যাংকগুলোকেই অর্থ জোগাড় করতে বলা হয়েছে। যে কারণে ব্যাংকগুলো নিজেদের তাগাদা থেকে বিদেশি এক্সচেঞ্জ হাউস থেকে ডলার নিয়ে আসছে। সব মিলিয়ে রেমিট্যান্স এভাবে বাড়ছে।

বিগত সরকারের সর্বশেষ মুদ্রানীতি ঘোষণা হয় গত বছরের জুনে। সেখানে বাংলাদেশ ব্যাংক অর্থনীতির জন্য তিনটি চ্যালেঞ্জের কথা উল্লেখ করে। এই তিন চ্যালেঞ্জ হলো– মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ও ডলার দরে স্থিতিশীলতা ফেরানো এবং সুদহারে স্থিতিশীলতা ফেরানো। সরকার পতনের পর এই তিন ক্ষেত্রেই স্থিতিশীলতা এসেছে। এরই মধ্যে মূল্যস্ফীতি কমতে শুরু করেছে। গত ফেব্রুয়ারিতে মূল্যস্ফীতি নেমেছে ৯ দশমিক ৩৪ শতাংশে। গত ২৩ মাসের মধ্যে যা সর্বনিম্ন। আবার ২০২২ সালের আগস্টে ডলারের দর ছিল ৮৪ টাকা। সেখান থেকে বাড়তে বাড়তে গত সরকারের সময়ে ১২৭ টাকা পর্যন্ত ওঠে। আগস্ট-পরবর্তী ডলারের দর ১২২ থেকে ১২৩ টাকায় রয়েছে।
২০২২ সালের আগস্টে ৪৮ বিলিয়ন ডলারের ঘর পেরোনো রিজার্ভ গত জুলাইতে ২০ বিলিয়ন ডলারে নামে। ওই সময়ে প্রতি মাসে গড়ে রিজার্ভ কমছিল ৮০ কোটি ডলারের মতো। সরকার পতনের পর থেকে রিজার্ভ ২০ বিলিয়ন ডলারের ঘরেই রয়েছে। গতকাল দিন শেষে রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ২০ দশমিক ৪৬ বিলিয়ন ডলার। কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভ থেকে এখন আর কোনো ডলার বিক্রি করছে না। বরং বাজার ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে বিগত সরকারের রেখে যাওয়া মেয়াদোত্তীর্ণ বকেয়া ৩৭০ কোটি ডলার পরিশোধ করা হয়েছে। এসব সম্ভব হয়েছে মূলত রেমিট্যান্স উচ্চ প্রবৃদ্ধির পাশাপাশি ভালো রপ্তানি আয়ের কারণে। গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৯ শতাংশের বেশি। সব মিলিয়ে আমদানিতে সাড়ে ৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধির পরও ডলার বাজারে কোনো হাহাকার নেই। এরই মধ্যে আমদানির ওপর থেকে বেশির ভাগ বিধিনিষেধ তুলে নেওয়া হয়েছে।

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: বছর র একই ম স গত সরক র র গত বছর র প রব দ ধ র কর ড এস ছ ল দশম ক আগস ট

এছাড়াও পড়ুন:

৪ কোম্পানির আর্থিক প্রতিবেদনে অনিয়ম: ৭ অডিটর নিষিদ্ধ

‎পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত চারটি কোম্পানির সমাপ্ত অর্থবছরের আর্থিক প্রতিবেদনে গুরুতর আর্থিক অনিয়ম ও আইনের লঙ্ঘন থাকা সত্ত্বেও তা নিরীক্ষা প্রতিবেদনে উত্থাপন না করায় সাত নিরীক্ষক (অডিটর) প্রতিষ্ঠানকে পাঁচ বছরের জন্য অডিট এবং অ্যাসিউর‍্যান্স কার্যক্রমে অংশগ্রহণের উপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটি এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)।

সেইসঙ্গে ওই নিরীক্ষা ফার্ম এবং নিরীক্ষকদের কেন অযোগ্য ঘোষণা করা হবে না, সেই মর্মে ব্যাখ্যা তলব করে তাদের শুনানিতে ডাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কমিশন।

আরো পড়ুন:

সোনালী পেপারের শেয়ার কারসাজি: ১১ কোটি ৮২ লাখ টাকা জরিমানা

পুঁজিবাজার উন্নয়নে ডিএসই ও ডিসিসিআইয়ের যৌথ সভা

‎গত মঙ্গলবার (১৬ সেপ্টেম্বর) বিএসইসির চেয়ারম্যান খন্দকার রাশেদ মাকসুদের সভাপতিত্বে ৯৭৩তম কমিশন সভায় এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ‎বুধবার (১৭ সেপ্টেম্বর) বিএসইসির পরিচালক ও মুখপাত্র আবুল কালাম স্বাক্ষরিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।

‎সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়, সুহৃদ ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের ৩০ জুন, ২০১৯ সমাপ্ত অর্থবছরের নিরীক্ষা ফার্ম ও নিরীক্ষক এ হক অ্যান্ড কোং চার্টার্ড এ্যকাউন্ট্যান্টস; রিংসাইন টেক্সটাইল লিমিটেডের ৩০ জুন, ২০১৭, ২০১৮, ২০১৯ এবং ২০২০ সমাপ্ত অর্থবছরের নিরীক্ষা ফার্ম ও নিরীক্ষক যথাক্রমে: আহমেদ অ্যান্ড আক্তার, মাহফেল হক অ্যান্ড কোং, আতা খান অ্যান্ড কোং এবং সিরাজ খান বসাক অ্যান্ড কোং চার্টার্ড এ্যকাউন্ট্যান্টস; আমান কটন ফাইব্রাস লিমিটেডের ৩০ জুন, ২০২০ সমাপ্ত অর্থবছরের নিরীক্ষা ফার্ম ও নিরীক্ষক ইসলাম কাজী শফিক অ্যান্ড কোং চার্টার্ড এ্যকাউন্ট্যান্টস এবং ফারইষ্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেডের ৩০ জুন, ২০১৮ ও ২০১৯ সমাপ্ত অর্থবছরের নিরীক্ষা ফার্ম ও নিরীক্ষক মাহফেল হক অ্যান্ড কোং চার্টার্ড এ্যকাউন্ট্যান্টস আর্থিক প্রতিবেদনে গুরুতর আর্থিক অনিয়ম ও সিকিউরিটিজ আইনের লঙ্ঘন থাকা সত্ত্বেও নিরীক্ষা প্রতিবেদনে উত্থাপন করেনি। 

এ সকল নিরীক্ষা ফার্ম এবং নিরীক্ষককে পুঁজিবাজারের তালিকাভুক্ত সকল কোম্পানি, সকল ধরনের বিনিয়োগ স্কিম (যথা- মিউচ্যুয়াল ফান্ড, অল্টারনেটিভ ইনভেস্টমেন্ট ফান্ড ও এক্সচেঞ্জ ট্রেডেড ফান্ড) এবং পুঁজিবাজারে মধ্যস্থতাকারী সকল প্রতিষ্ঠানের অডিট ও অ্যাসিউর‍্যান্স কার্যক্রম পরিচালনার উপর নিষেধাজ্ঞা তথা পাঁচ বছরের জন্য অডিট ও অ্যাসিউর‍্যান্স কার্যক্রমে অংশগ্রহণে কেন অযোগ্য ঘোষণা করা হবে না এই মর্মে ব্যাখ্যা তলব করে শুনানি করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। 

‎ঢাকা/এনটি/বকুল 

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ৪ কোম্পানির আর্থিক প্রতিবেদনে অনিয়ম: ৭ অডিটর নিষিদ্ধ
  • সেপ্টেম্বরের ১৬ দিনে রেমিট্যান্স এসেছে ২০ হাজার কোটি টাকা
  • বাংলাদেশ ব্যাংক এক দিনে ২৬ ব্যাংক থেকে ৩৫ কোটি ডলার কিনল কেন