প্রথমবারের মতো স্প্রিং স্কুলের আয়োজন করেছে ঢাবি
Published: 8th, April 2025 GMT
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) সেন্টার অন বাজেট অ্যান্ড পলিসির (সিবিপি) আয়োজনে ‘স্প্রিং স্কুল অন বিজনেস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস’ শীর্ষক কর্মশালা শুরু হয়েছে।
সোমবার (৭ এপ্রিল) কুমিল্লার পল্লী উন্নয়ন একাডেমি (বার্ড) মিলনায়তনে পাঁচ দিনব্যাপী এ কর্মশালার উদ্বোধন করেন ঢাবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. নিয়াজ আহমদ খান।
জার্মান উন্নয়ন সংস্থা জিআইজেড, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও), বাংলাদেশের ডেনমার্ক দূতাবাস এবং সুইডিশ সরকার ও ইনিশিয়েটিভ ফর গ্লোবাল সলিডারিটি (আইজেএস) এর সহযোগিতায় এ কর্মশালার আয়োজন করা হয়েছে।
আরো পড়ুন:
ফিলিস্তিনের জন্য বৃহৎ কর্মসূচি ঘোষণা করবে বিএনপি: সালাউদ্দিন
ইসরায়েলি গণহত্যা বন্ধে শিবির ও ছাত্রদলে পৃথক কর্মসূচি
প্রধান অতিথির বক্তব্যে উপাচার্য অধ্যাপক ড.
তিনি বলেন, “বাংলাদেশের সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য দায়িত্বশীল ব্যবসায়িক পরিবেশ থাকা প্রয়োজন। এ বিষয়ে শিল্পখাত সংশ্লিষ্টদের প্রশিক্ষণ জরুরি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার অন বাজেট অ্যান্ড পলিসি সামগ্রিকভাবে দেশের কর্মক্ষেত্রে পরিবেশ উন্নয়নের লক্ষ্যে প্রথমবারের মতো এই স্প্রিং স্কুলের আয়োজন করেছে। এ স্কুলের কার্যক্রমের সঙ্গে বিভিন্ন দাতা সহযোগী যুক্ত আছেন বলে শিক্ষার্থীরা আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা লাভের সুযোগ পাচ্ছে।”
এ সময় অন্যদের মাঝে বক্তব্য দেন, আইএলও বিশেষজ্ঞ জোসি লাপোর্তে, টেকনিক্যাল কর্মকর্তা চয়নিচ থাম্পারিপাত্রা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. কাজী মারুফুল ইসলাম এবং কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক ড. কৃষ্ণ কুমার সাহা।
এ প্রশিক্ষণ কর্মশালাটি আগামী ১১ এপ্রিল শেষ হবে। এতে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও সংস্থার ৩০ জন পেশাজীবী অংশগ্রহণ করেছেন।
ঢাকা/সৌরভ/মেহেদী
উৎস: Risingbd
এছাড়াও পড়ুন:
আপেল মাহমুদ অথবা রবিঠাকুরের কাদম্বিনীর গল্প
সম্প্রতি বীর মুক্তিযোদ্ধা ও বিশিষ্ট সংগীতশিল্পী আপেল মাহমুদকে তাঁর মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতি ধরে রাখতে যা করতে হলো, তাকে অনেকেই রবিঠাকুরের ‘জীবন ও মৃত্যু’ গল্পের সেই কাদম্বিনীর পরিণতির সঙ্গে তুলনা করেছেন। এটি সত্য, নিজেকে জীবিত প্রমাণে কাদম্বিনীকে শেষ পর্যন্ত আত্মহত্যা করতে হলেও আপেল মাহমুদকে তেমন কিছু করতে হয়নি। কিন্তু জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল-জামুকার কর্মকর্তাদের সামনে এই অত্যন্ত সুপরিচিত মুক্তিযোদ্ধাকে বৃদ্ধ বয়সে যেভাবে দলিল-দস্তাবেজ ও সাক্ষী হাজির করতে হয়েছে, তার ভোগান্তি মৃত্যুর চেয়ে কমও নয়।
আপেল মাহমুদকে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার কিছু নেই। মুক্তিযুদ্ধের সময় যাদের বয়স দশ বছরের ওপরে, তাদের নিশ্চয়ই তাঁর কথা মনে আছে– যাঁর কণ্ঠে দেশাত্মবোধক গান শুনে রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধারা অনুপ্রাণিত হতেন, বুকে সাহসের সঞ্চার হতো। সেই সময়ে রেকর্ড করা তাঁর কণ্ঠের গান ‘একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি’, ‘তীরহারা এ ঢেউয়ের সাগর পাড়ি দিবো রে’, আজও মানুষকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করে। আমার সৌভাগ্য হয়েছে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাতের। শুধু সাক্ষাৎ নয়, একই মঞ্চে আমরা বক্তব্যও রেখেছি, খুব কাছ থেকে তাঁর গান শুনেছি।
গত ৩ জুনের দৈনিক পত্রিকাগুলোতে প্রকাশিত খবর অনুসারে, স্বাধীন বাংলা বেতার কর্মী পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মনোয়ার হোসেন জামুকায় গত বছর ৫ আগস্টের পর অভিযোগ করেন যে, স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রের শিল্পী আপেল মাহমুদ মুক্তিযোদ্ধা নন। তখন জামুকার নোটিশ পেয়ে গত ২ জুন তাঁকে দলিলাদি নিয়ে কুমিল্লা সার্কিট হাউসে ছুটে যেতে হয়। সেখানে দীর্ঘ শুনানির মাধ্যমে তাঁকে প্রমাণ করতে হয় যে শুধু স্বাধীন বাংলা বেতারেরই কর্মী ছিলেন না তিনি, বিভিন্ন রণাঙ্গনে সরাসরি যুদ্ধেও অংশ নিয়েছিলেন। সেই বীর মুক্তিযোদ্ধাকে স্বাধীনতার চুয়ান্ন বছর পরে এসে শুনানিতে অংশ নিয়ে আত্মপক্ষ সমর্থন করে প্রমাণ করতে হলো তিনি মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন।
শুনানি শেষে জামুকার মহাপরিচালক শাহিনা খাতুন জানান, ‘আপেল মাহমুদ নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা প্রমাণ করতে পেরেছেন।’ এ জীবন্ত কিংবদিন্তকে হয়তো শাহিনা খাতুনের কাছ থেকে নতুন করে এ প্রত্যয়ন নিতে হতো না যদি মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা অন্তর্বর্তী সরকার নতুন করে নির্ধারণ না করত। সম্প্রতি সরকার বিধান জারি করেছে, ১৯৭১ সালে এ দেশের জন্মযুদ্ধে শরিক সবাই বীর মুক্তিযোদ্ধা নন, তাদের কেউ হবেন ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা’ এবং কেউ হবেন ‘সহযোগী মুক্তিযোদ্ধা’। এ সংজ্ঞা অনুসারে, আবিষ্কৃত হয়েছে, তারই গোলকধাঁধায় পড়েছিলেন আপেল মাহমুদ। তাদের দেওয়া সংজ্ঞা অনুসারে, শুধু সম্মুখ সমরে অস্ত্র হাতে যারা যুদ্ধ করেছেন তারাই বীর মুক্তিযোদ্ধা বলে পরিচিত হবেন, অন্য সবাই সহযোগী মুক্তিযোদ্ধা। আপেল মাহমুদ যদি শুধু স্বাধীন বাংলা বেতারের কর্মী হতেন, তাহলে তিনি ‘সহযোগী মুক্তিযোদ্ধা’র খেতাব পেতেন। এখন কাগজপত্রে যেহেতু তিনি প্রমাণ করেছেন, তিনি সম্মুখ যোদ্ধাও ছিলেন, তাই তিন বীর মুক্তিযোদ্ধা। অথচ একটি দেশের মুক্তি বা স্বাধীনতার পক্ষে জনযুদ্ধে যারা যেভাবেই অংশ নেন, তারা সবাই মুক্তিযোদ্ধা হিসেবেই স্বীকৃত হন।
এ প্রসঙ্গে প্রখ্যাত কবি ও সাংবাদিক ফয়েজ আহমদের অভিজ্ঞতা প্রণিধানযোগ্য। একাত্তরের ২৫ মার্চ রাতে হানাদার বাহিনীর গোলায় আহত হয়ে তিনি প্রথমে বিক্রমপুরের গ্রামের বাড়িতে, পরে আগরতলা হয়ে কলকাতায় যান। তরুণ এই বামপন্থি সাংবাদিকের ইচ্ছা তিনি অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করবেন। কিন্তু চীনপন্থি রাজনৈতিক কর্মী পরিচয় তাঁর সে ইচ্ছাপূরণে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। তিনি চলে যান জলপাইগুড়িতে। সেখানে তিনি অবস্থান করতে থাকেন তাঁর পূর্বপরিচিত ডাক্তার মন্মথনাথ নন্দীর (এমএন নন্দী) বাড়িতে। একদিন প্রবাসী সরকারের পক্ষ থেকে টেলিগ্রাম পান দ্রুত কলকাতায় যাওয়ার জন্য। ফয়েজ আহমদ কলকাতায় গিয়ে দেখা করেন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে। তাজউদ্দীন তাঁকে বলেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে যোগ দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে। ফয়েজ আহমদ প্রধানমন্ত্রীকে জানান, তাঁর ইচ্ছা অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করার। তখন তাজউদ্দীন আহমদ তাঁকে বলেন, ‘যুদ্ধের সময় আপনি যে সেক্টরেই অংশ নেবেন আপনি মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃত হবেন। অস্ত্রধারী মুক্তিযোদ্ধা ও কলমযোদ্ধার মধ্যে কোনো ব্যবধান নেই।’ ফয়েজ আহমদ তাঁর ‘মধ্যরাতের অশ্বারোহী’ গ্রন্থে এসব কথা লিখে রেখে গেছেন। ভাগ্যিস, ফয়েজ আহমদ বহু আগেই মারা গেছেন, নইলে তাঁকে খেতাবের এ অবনমন দেখেই মরতে হতো।
আজ যারা মুক্তিযুদ্ধকালীন মুজিবনগর সরকারের কর্মকর্তা-কর্মচারী, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পী-কলাকুশলীদের ‘সহযোগী মুক্তিযোদ্ধা’ হিসেবে আখ্যায়িত করে প্রকারান্তরে হেয়প্রতিপন্ন করছেন, তারা তখন ফয়েজ আহমদদের যন্ত্রণা উপলব্ধি করতেন কিনা জানি না। তবে মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী বীরদের মধ্যে এমন অনভিপ্রেত বিভাজন সৃষ্টি কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না। যিনি অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছেন আর যিনি নানাভাবে সেই যুদ্ধের জন্য মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেছেন, এর পক্ষে জনমত তৈরি করেছেন, তাদের সবাই ওই যুদ্ধজয়ের জন্য অপরিহার্য ছিল।
উল্লেখ্য, স্বাধীনতার পর আপেল মাহমুদ বাংলাদেশ বেতারে যোগ দেন। অবসর নেন উপমহাপরিচালক (ডিডিজি) হিসেবে। দীর্ঘ এ চাকরিজীবনে কখনোই তাঁর মুক্তিযোদ্ধাসত্তা নিয়ে কেউ প্রশ্ন তোলেনি। মুক্তিযুদ্ধ ও জাতীয় ক্ষেত্রে অনন্য অবদানের স্বীকৃতস্বরূপ আপেল মাহমুদ ২০০৫ সালে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ জাতীয় সম্মাননা– একুশে পদকে ভূষিত হয়েছেন। জামুকা ইচ্ছে করলে আপেল মাহমুদকে না ডেকেই অভিযোগটির নিষ্পত্তি করতে পারত। আমাদেরও শুনানি শেষে আপেল মাহমুদ আক্ষেপভরা কণ্ঠে যা বলেছেন তা শুনতে হতো না। তিনি বলেছেন, ‘আমি যে আপেল মাহমুদ, তা জীবিত থেকেই প্রমাণ করতে হলো।’ তিনিও যেন সেই কাদম্বিনীর ভয়ংকর পরিণতির দিকেই ইঙ্গিত করলেন।
পত্রিকায় আপেল মাহমুদের এ দুর্ভোগের কথা পড়ে আরেকজন বীর মুক্তিযোদ্ধা উষ্মা প্রকাশ করে বললেন, “কপাল ভালো, জামুকা আপেল মাহমুদকে বলেনি, ‘রাইফেল চালিয়ে প্রমাণ দিন আপনি মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন’।’’
মহিউদ্দিন খান মোহন: সাংবাদিক
ও রাজনীতি বিশ্লেষক