যে গল্প-উপন্যাস আমাকে টানে না; তা আমি পড়ি না, পড়তে পারি না। যা একনাগাড়ে পড়া যায়; সেই সাহিত্যকর্মের আমি সমঝদার। নবীন কথাসাহিত্যিক সেঁজুতি মাসুদের ‘নৈঃশব্দ্যের চার অধ্যায়’ আমি বিরতিহীনভাবে পড়েছি। ভালো লেগেছে। কিছু বিষয় মুগ্ধ করেছে। ভাবিয়েছেও।
‘নৈঃশব্দ্যের চার অধ্যায়’ সেঁজুতি মাসুদের প্রথম গল্পগ্রন্থ। ১০২ পৃষ্ঠার এই বইটিতে রয়েছে ১৯টি গল্প। এতে জীবন জিজ্ঞাসা আছে, নতুন ভাবনা আছে; আছে মাটি, মানুষ ও প্রকৃতির প্রতি অকৃত্রিম দরদ।
দু’চারটি গল্পে চোখ বুলানো যাক। সময়ের সঙ্গে বদলে যায় পুরোনো জীবনাচার, প্রশ্নবিদ্ধ হয় প্রচলিত বিশ্বাস ও মূল্যবোধ। নতুন ও পুরোনোর দ্বন্দ্ব নানাভাবে বাঙ্ময় হয়েছে সেঁজুতি মাসুদের গল্পে।
প্রথম গল্প ‘দূরের তারায়’ কোনো এক বিমানবন্দরে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের দুই নিকট-বন্ধু অনন্যা ও শিহাবের দেখা হয়। দু’জন দুই পথের যাত্রী। ক্ষণিকের সাক্ষাতে তাদের মধ্যে পুরোনো স্মৃতি উঁকি দেয়। তারা পেছনে ফিরে যায়। কথাবার্তায় স্পষ্ট হয়, বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যয়নকালে পরস্পরের প্রতি দুর্বলতা ছিল, ভালো লাগা ছিল। কিন্তু অনন্যা তখন এক শিক্ষকের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে। অকস্মাৎ ব্রেকআপে সে শিক্ষাঙ্গন থেকে ছিটকে পড়ে। তারপর তার ভিন্ন এক জীবনসংগ্রাম।
বিমানবন্দরের আড্ডায় শিহাবের কাছে জীবনের পরবর্তী অধ্যায় এড়িয়ে যায়। তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবনে ফিরে যায়। কত কথা, কত স্মৃতি যেন শেষ হয় না। বিদায় নেওয়ার পালা এসে যায়। শিহাব চাইলেও অনন্যা যোগাযোগ রাখতে রাজি নয়। নিঃসংকোচে বলে, ‘ধরে নে কেউ না। এইমাত্রই আমাদের দেখা হলো। কিছুটা সময় কাটালাম একসঙ্গে। জীবনের পুরো ব্যাপারটাই তো তাই, সময়টা কাটিয়ে দেওয়া। কথা শেষ করে, একমুহূর্তে নিশ্চল থেকে আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিল অনন্যা। হাই আয়াম অনন্যা।’ কারণ, তার সেই স্বপ্নিল চোখ নেই। এখন তাতে অভিজ্ঞতার ছাপ।
লেখকের দ্বিতীয় গল্প ‘বারান্দা-সখী’। নগরজীবন-যন্ত্রণায় বিদ্ধ দুই শিশু– মিনি ও বাবলি। দুই ফ্ল্যাটবাড়িতে আটক এই দুই ‘মানব ছানা’র বন্ধুত্ব। অথচ এখানে ছিল শিমুলের বাগান, খেলার মাঠ, ঝোপঝাড়, পানাপুকুর। যৌথ পরিবার ছিল। ছিল মুক্ত হাওয়ায় শিশুর বিচরণ। সবই বদলে গেছে। যৌথ পরিবার বদলে একক পরিবার, ফ্ল্যাটবাড়ি, শিশুর জন্য বিচ্ছিন্ন জীবন। এ গল্পে যন্ত্রণাক্লিষ্ট শিশুমনের অভিব্যক্তির প্রকাশ তাৎপর্যপূর্ণ– ‘জন্মদিনের কেকের ওপরের মোমবাতিটায় ফুঁ দিয়ে তাড়াতাড়ি বড় হতে চায় মিনি। আর মনে মনে ভাবে, সে কখনও কোনো শিশুকে পৃথিবীতে এনে এভাবে বন্দি করবে না।’
লেখকের দৃষ্টি প্রসারিত। মানবমনের অনূভূতি চিত্রায়ণে উদার ও মানবিক। ‘লাভ ট্রায়াঙ্গল’ গল্প থাইল্যান্ডে অনুষ্ঠিত ডিজিটাল মার্কেটিং ও ই-কমার্সবিষয়ক কোর্স ঘিরে। যেখানে নানা দেশের অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে বাংলাদেশ বা উপমহাদেশীয় নারী ঝিলমও রয়েছে। সে-ই গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র। ‘ঝিলম টের পায় যে, সে না চাইলেও তার চোখ ও মন দুই-ই নিকোলাসকে খুঁজতে শুরু করেছে। কিন্তু নিকোলাসের কাছে তার সেই রকম কোনো অ্যাপিল আছে কিনা। সেটা শত চেষ্টা করে গত ছয় মাসে ধরতে পারেনি ঝিলম।’ ছয় মাস পর কোর্সের সমাপনী পর্বে যখন ধুমধাম করে কালচারাল নাইট শুরু হয়, সেদিন ঝিলম নিকোলাসের মধ্যে প্রতিহিংসার আগুন জ্বালাতে অপর অংশগ্রহণকারী রবার্টের ঘনিষ্ঠ হয়। অনুষ্ঠানে অন্যদের মধ্যে ঝিলম, রবার্ট ও নিকোলাস নানা পারফর্ম করে। ঝিলমের কবিতা শুনে পুরো ক্যাফে করতালিতে ফেটে পড়ে। ঝিলম যখন নিককে (নিকোলাস) খুঁজছিল। সে আবিষ্কার করল– ‘এতক্ষণ তার টেবিলের দিকে তাকিয়ে রবার্টকেই দেখছিল নিক। ঝিলম জানতে পারল না সেই মুহূর্তটা ছিল তাদের তিনজনের একত্রে প্রেমে পড়ার মুহূর্ত। যখন নিকের গাওয়া গানের একটি লাইন মনে মনে গাইতে গাইতে ঝিলম নিকের প্রেমে পড়েছিল, রবার্ট শুধু একজন রূপসীর নয় বরং ঝিলমের ভেতরের মানুষটার প্রেমে পড়েছিল, আর সারাজীবন সমলিঙ্গকে ভালোবাসা নিক প্রেমে পড়েছিল রবার্টের।’
বইয়ের শেষ গল্প ‘যোদ্ধার স্ত্রী’। সামরিক কর্মকর্তার স্ত্রী রিয়া স্বাভাবিক চাওয়া-পাওয়া থেকে বঞ্চিত হয়, বিয়ের পাঁচ বছর পূর্তির অনুষ্ঠানের ছোট্ট পরিকল্পনাও বাতিল হয়ে যায়। করোনা আক্রান্তদের সেবায়, ত্রাণ বিতরণে নিয়োজিত কর্তব্যপরায়ণ সামরিক অফিসার আবির। কর্তব্যবোধের কাছে দম্পতির নিজস্ব মুহূর্তগুলো হারিয়ে যায়।
রিয়ার চাচা মুক্তিযুদ্ধে শহীদ। বাবাও মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযুদ্ধের গল্প শুনতে শুনতে বড় হওয়া রিয়া চারদিকে দেখেছে নিরীহ ও ভীতু প্রজন্ম। একমাত্র ব্যতিক্রম, সাহসী ও সংবেদনশীল আবির। তাই আবিরের সঙ্গে তার প্রেম ও সংসার। ‘নিজের দেশের পতাকা আকাশে উড়িয়ে যখন স্যালুট দেয় আবির, তখন গর্বে রিয়ার বুকের ছাতি ফাটে। ভালোবাসার সঙ্গে দেশপ্রেম সেখানে গভীরভাবে মিশে যায়।’ এর পরও বিশেষ মুহূর্তে স্বামীর অনুপস্থিতি তাকে ব্যথিত করে। ‘দীর্ঘশ্বাস চাপতে রিয়া তার ভদ্রলোককে মনে মনে ঘরে ডাকে। ইউনিফর্মের ভেতরের মানুষটা কেমন আছে, জানতে ইচ্ছে করে। কল্পনায়, ইউনিফর্মের একেকটা বোতাম তার নরম আঙুলে চেপে খুলে ফেলে রিয়া। পরিয়ে দেয় নরম পাঞ্জাবি।’
সবকিছু ছাপিয়ে রিয়া একজন নারী। জীবনসঙ্গীকে কাছে না পাওয়ার বেদনায় বিদীর্ণ রিয়ার মন। লেখক বেশ মুনশিয়ানায় মানবী রিয়ার সেই অনুভূতির চিত্রায়ণ করে; যা মুগ্ধকর। ভাবতে ইচ্ছে করে– এ কি এক দক্ষ শিল্পীর আগমনী বার্তা!
পরিশেষে সেঁজুতি মাসুদের কাছে প্রত্যাশা, কলম যেন না থামে। v
উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
মহানবী (সা.)–এর ইন্তেকালের পরে শাসন নিয়ে যা ঘটেছে
মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর সিরাত বা জীবনী শুধু ইসলামের ইতিহাসের একটি অধ্যায় নয়, বরং এটি একটি স্বতন্ত্র জ্ঞানশাখা, যার কেন্দ্রে রয়েছেন তিনি এবং তাঁর যুগের ঘটনাবলি, মূল্যবোধ, নীতি, মুজিজা এবং সম্পর্ক।
নবীজির সিরাত প্রতিষ্ঠিত কোরআন, হাদিস এবং সাহাবিদের জীবনাচরণের আলোকে। তবে এই জীবনী নিয়ে বিভিন্ন সময়ে ভ্রান্ত ব্যাখ্যা এবং তথ্য বিকৃতির ঘটনা ঘটেছে, যা ইসলামের প্রকৃত চিত্রকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।
প্রামাণিক উৎসমহানবী (সা.)–এর জীবন সম্পর্কে অধ্যয়নের সবচেয়ে প্রামাণিক উৎস হলো কোরআন মাজিদ। কোরআনে তাঁর জীবনের বিভিন্ন পর্যায়, তাঁর রিসালাত, হিজরত, যুদ্ধ এবং তাঁর মানবিক গুণাবলি সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, সুরা মুহাম্মদে তাঁর নাম উল্লেখ করা হয়েছে (আয়াত: ২)।
সুরা আলে ইমরানেও এসেছে (আয়াত: ১৪৪), সুরা আহজাবে তাঁকে ‘খাতামুন নাবিয়্যিন’ বা নবীদের সিলমোহর (মানে শেষ নবী) বলা হয়ে (আয়াত: ৪০) এবং সুরা ফাতহে তাঁকে বলা হয়েছে ‘আল্লাহর রাসুল’ (আয়াত: ২৯)।
মহানবীর সিরাত নিয়ে কিছু ব্যাখ্যা ও রচনা ঐতিহাসিক সত্য থেকে বিচ্যুত হয়েছে, যা ইসলামের প্রকৃত চিত্রকে বিকৃত করেছে। এই বিকৃতিগুলো ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় হয়েছে, কখনো অতিরঞ্জিত বর্ণনা বা ভুল ব্যাখ্যার মাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে।এ ছাড়া চরিত্র, কাজ, অবস্থান সম্পর্কে বহু আয়াত আছে কোরআনে।
হাদিস গ্রন্থগুলোও সিরাতের একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস। ইমাম মালিকের মুয়াত্তা, সহিহ বুখারি, সহিহ মুসলিম, সুনানে আবু দাউদ, সুনানে ইবনে মাজা, সুনানে তিরমিজি এবং সুনানে নাসাইতে তাঁর বাণী, কাজ ও সম্মতির বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে এবং সিরাতের বিভিন্ন দিক তুলে ধরা হয়েছে।
এই গ্রন্থগুলোর সনদ (বর্ণনা পরম্পরা ও বিষয়বস্তু যাচাইয়ের জন্য মুহাদ্দিসগণ কঠোর মানদণ্ড প্রয়োগ করেছেন, যা ‘জার্হ ও তাদিল’ নামে পরিচিত।
এ ছাড়া ইবনে ইসহাকের সিরাতু রাসুলিল্লাহ সিরাতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থগুলোর একটি, ইবনে হিশাম, যার একটি সংক্ষিপ্ত সংস্করণ প্রকাশ করেছেন এবং আস-সুহাইলি তা নিয়ে আর-রওদুল উনুফ নামে একটি ব্যাখ্যা রচনা করেছেন।
এ ছাড়া ইবনে শিহাব জুহরি ও মুসা ইবনে উকবার মাগাজি মহানবী (সা.) রাসুলুল্লাহর নির্ভরযোগ্য জীবনীগ্রন্থ। কাজি ইয়াজের আশ-শিফা বি তা’রিফ হুকুকিল মুস্তফা তাঁর গুণাবলি ও অধিকারের ওপর বিশদ আলোচনা করেছে, যা পূর্ব ও পশ্চিমের পণ্ডিতদের কাছে ব্যাপকভাবে সমাদৃত।
আরও পড়ুনমহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)–এর জীবনী রচনার হাজার বছর১১ নভেম্বর ২০২০ভ্রান্ত ব্যাখ্যা ও তথ্য বিকৃতিমহানবীর সিরাত নিয়ে কিছু ব্যাখ্যা ও রচনা ঐতিহাসিক সত্য থেকে বিচ্যুত হয়েছে, যা ইসলামের প্রকৃত চিত্রকে বিকৃত করেছে। এই বিকৃতিগুলো ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় হয়েছে, কখনো অতিরঞ্জিত বর্ণনা বা ভুল ব্যাখ্যার মাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে।
মহানবীর মৃত্যুর পূর্বে তাঁর অসুস্থতার লক্ষণ প্রকাশ পায় হজ্জাতুল বিদা বা বিদায় হজের সময়। তিনি আরাফাতে দাঁড়িয়ে বলেন, ‘আমার কাছ থেকে তোমাদের হজের রীতি গ্রহণ করো। কারণ, এ বছরের পর আমি হয়তো আর হজ করতে পারব না।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১,২৯৭)
সুরা নাসর অবতীর্ণ হলে তিনি বলেন, ‘এটি আমার মৃত্যুর ঘোষণা।’ (ইবনে কাসির, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ৫/২০৮, দারুল ফিকর, বৈরুত, ১৯৮৮)
আমি এখনো খায়বারে খাওয়া বিষাক্ত খাবারের যন্ত্রণা অনুভব করছি, এখন এর সময় এসেছে যে আমার শিরা ছিঁড়ে যাবে।সহিহ বুখারি, হাদিস: ৪৪২৮রাসুল (সা.) মসজিদে দাঁড়িয়ে বলেন, ‘আল্লাহ তাঁর একজন বান্দাকে দুনিয়া ও আল্লাহর নৈকট্যের মধ্যে পছন্দ করতে বলেছেন, আর সেই বান্দা আল্লাহর নৈকট্য পছন্দ করেছেন।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৬,৫০৪)
তাঁর অসুস্থতার সময় তিনি আয়েশা (রা.)-এর ঘরে থাকতে পছন্দ করেন। আয়েশা বলেন, ‘তিনি জান্নাতুল বাকি (কবরস্থান) থেকে ফিরে এসে আমাকে মাথাব্যথায় কাতর দেখে বললেন, “বরং আমি বলি, হায় আমার মাথা”!’ (মুহাম্মদ ইবনে ইসহাক, সিরাতু রাসুলিল্লাহ, পৃ. ৬৭৮, দারুল মা’রিফা, বৈরুত, ১৯৭৮)
তিনি তীব্র জ্বরে ভুগছিলেন এবং বলেন, ‘আমি এখনো খায়বারে খাওয়া বিষাক্ত খাবারের যন্ত্রণা অনুভব করছি, এখন এর সময় এসেছে যে আমার শ ছিঁড়ে যাবে’ (সহিহ আল-বুখারি, হাদিস: ৪৪২৮)। তিনি নির্দেশ দেন সাতটি মশকের পানি তাঁর ওপর ঢালার জন্য, যা তাঁর জ্বর কমাতে সাহায্য করে। (ইবনে হিশাম, সিরাতুন নবী, ২/৬৪২, দারুল কুতুবিল ইলমিয়া, বৈরুত, ১৯৯৮)
১১ হিজরির ১২ রবিউল আউয়াল, সোমবার (৭ জুন, ৬৩২ খ্রিষ্টাব্দ) তিনি মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর পূর্বে তিনি আয়েশা (রা.)–এর ঘর থেকে মসজিদে উঁকি দিয়ে মুসল্লিদের দিকে তাকিয়ে হাসেন এবং বলেন, ‘হে আল্লাহ, আমাকে মৃত্যুর যন্ত্রণায় সাহায্য করো।’ (আবু বকর আল-বাইহাকি, দালাইলুন নুবুওয়া, ৭/২৪৪, দারুল কুতুবিল ইলমিয়া, বৈরুত, ১৯৮৫)
তাঁর মৃত্যুর পর আবু বকর (রা.) ঘোষণা দেন, ‘যে মুহাম্মদের ইবাদত করত, সে জানুক, মুহাম্মদ মারা গেছেন। আর যে আল্লাহর ইবাদত করে, সে জানুক আল্লাহ চিরজীবী, তিনি মরেন না।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ১২৪১)
আরও পড়ুননবীজি (সা.)–র কোন জীবনী পড়বেন২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫খিলাফতের প্রতিষ্ঠা: সাকিফা বনু সায়েদামহানবী (সা.)–এর মৃত্যুর পর ‘সাকিফা বনু সায়েদা’য় সাহাবিরা খিলাফত নির্বাচনের জন্য সমবেত হন। আনসাররা সাদ ইবন উবাদার নেতৃত্বে দাবি করেন যে তারা ইসলামের প্রথম দিন থেকে রাসুলকে সমর্থন করেছেন, তাই তাদের মধ্য থেকে আমির নির্বাচিত হওয়া উচিত।
আবু বকর (রা.) মুহাজিরদের পক্ষে বলেন, ‘কুরাইশরা ইসলামে প্রথম ইমান এনেছে এবং তারা আরবের মধ্যে সবচেয়ে সম্মানিত গোত্র। আমি তোমাদের জন্য উমর বা আবু উবাইদাহর মধ্যে একজনকে প্রস্তাব করছি।’ (ইবনে হিশাম, সিরাতুন নবী, ২/৫৬, দারুল কুতুবিল ইলমিয়া, বৈরুত, ১৯৯৮)
আনসাররা প্রস্তাব করেন, ‘একজন আমির মুহাজিরদের থেকে এবং একজন আনসারদের থেকে হবে।’ তবে এই প্রস্তাব ঐক্য রক্ষার জন্য প্রত্যাখ্যাত হয়। উমর ইবনে খাত্তাব আবু বকরের হাত ধরে বায়আত করেন এবং আনসাররাও তাঁকে সমর্থন দেন। (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৬,৮৩০)
আমি তোমাদের নেতা নির্বাচিত হয়েছি, কিন্তু আমি তোমাদের মধ্যে সর্বোৎকৃষ্ট নই। যদি ভালো করি, আমাকে সাহায্য করো; আর যদি ভুল করি, আমাকে সংশোধন করো।হজরত আবু বকর (রা.)পরদিন মসজিদে সাধারণ বায়আত অনুষ্ঠিত হয়। আবু বকর (রা.) বলেন, ‘আমি তোমাদের নেতা নির্বাচিত হয়েছি, কিন্তু আমি তোমাদের মধ্যে সর্বোৎকৃষ্ট নই। আমি যদি ভালো করি, আমাকে সাহায্য করো; আর যদি ভুল করি, আমাকে সংশোধন করো।’ (ইবনে হিশাম, সিরাতুন নবী, ২/৬৫৮, দারুল কুতুবিল ইলমিয়া, বৈরুত, ১৯৯৮)
কয়েকজন সাহাবি, যেমন আলী (রা.) এবং জুবাইর ইবন আওয়াম, ফাতিমা (রা.)-এর ঘরে মহানবীর দাফনের প্রস্তুতি নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন, তাই সাকিফায় উপস্থিত ছিলেন না। কেউ কেউ মনে করেন, খিলাফতের জন্য আলী (রা.) বা আব্বাস ইবন আবদুল মুত্তালিব উপযুক্ত ছিলেন।
তবে মহানবী কাউকে স্পষ্টভাবে খলিফা মনোনয়ন করেননি। তিনি বলেছিলেন, ‘আমাকে কাগজ দাও, আমি তোমাদের জন্য এমন কিছু লিখে দেব, যার পর তোমরা পথভ্রষ্ট হবে না।’ কিন্তু উমর বলেন, ‘নবীজি এখন প্রবল যন্ত্রণায় ভুগছেন, (তাকে বিরক্ত করব না) আমাদের জন্য কোরআনই যথেষ্ট।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ১১৪)।
রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় মহানবীর ভূমিকা‘আবু বকর (রা.) ইসলামি রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন’ বলে হালা ওয়ার্দি যে দাবি করেছেন, তা ঐতিহাসিক তথ্যের সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ।
মহানবী (সা.) নিজেই ইসলামি রাষ্ট্রের ভিত্তি স্থাপন করেন। তিনি মদিনায় একটি জাতি গঠন করেন, যারা কোরআনের নির্দেশনা অনুসরণ করে ঐক্যবদ্ধ হয়। কোরআনে বলা হয়েছে, ‘তোমরা সবাই আল্লাহর রজ্জুকে দৃঢ়ভাবে ধরো এবং বিচ্ছিন্ন হোয়ো না।’ (সুরা আলে ইমরান, আয়াত: ১০৩)
তিনি মদিনা সনদ প্রণয়ন করেন, যা মুসলিম ও অমুসলিমদের মধ্যে সম্পর্ক ব্যাখ্যা করে। (ইবনে হিশাম, সিরাতুন নবী, ১/৫০১, দারুল কুতুবিল ইলমিয়া, বৈরুত, ১৯৯৮)
তিনি বিভিন্ন গোত্রের সঙ্গে চুক্তি, যুদ্ধে নেতৃত্ব এবং রাষ্ট্রদূত প্রেরণের মাধ্যমে রাষ্ট্রের কাঠামো গড়ে তোলেন। যেমন রোমের সম্রাট হেরাক্লিয়াস, পারস্যের কিসরা এবং মিসরের মুকাউকিসের কাছে পত্র প্রেরণ করেন, যা তাঁর রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের প্রতীক। (ইবনে কাসির, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ৪/২৬৯, দারুল ফিকর, বৈরুত, ১৯৮৮)
তিনি রাষ্ট্র পরিচালনায় ন্যায়বিচার ও শুরার নীতি প্রয়োগ করেন। কোরআনে বলা হয়েছে, ‘মানুষের মধ্যে ন্যায়বিচারের সঙ্গে রায় দাও।’ (সুরা সাদ, আয়াত: ২৬)
মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘যদি ফাতিমা বিনতে মুহাম্মদ চুরি করত, আমি তার হাত কেটে দিতাম।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৬,৭৮৭)।
তিনি শুরার বাস্তবায়ন করেন, কেননা কোরআন বলেছে, ‘তাদের সঙ্গে পরামর্শ করো।’ (সুরা আলে ইমরান, আয়াত: ১৫৯)
তিনি বলেন, ‘আমি একজন মানুষ। ধর্মীয় বিষয়ে আমার নির্দেশ গ্রহণ করো, কিন্তু পার্থিব বিষয়ে তোমরা আমার চেয়ে বেশি জানো।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২,৩৬৩)
হালা ওয়ার্দির গ্রন্থের মতো অনেক গ্রন্থ বাজারে পাওয়া যায়, যা ঐতিহাসিক তথ্যের অপব্যাখ্যা করে এবং তাঁর মৃত্যু ও খিলাফত নিয়ে ভ্রান্ত ধারণা প্রচার করে।শেষ কথামহানবীর ‘সিরাত’ ইসলামের ইতিহাস ও মূল্যবোধের একটি জীবন্ত দলিল। কোরআন, হাদিস এবং প্রামাণিক সিরাত গ্রন্থগুলো তাঁর জীবনের সঠিক চিত্র তুলে ধরেছে। তবে হালা ওয়ার্দির গ্রন্থের মতো অনেক গ্রন্থ বাজারে পাওয়া যায়, যা ঐতিহাসিক তথ্যের অপব্যাখ্যা করে এবং তাঁর মৃত্যু ও খিলাফত নিয়ে ভ্রান্ত ধারণা প্রচার করে।
মহানবী (সা.) ইসলামি রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন, যিনি ন্যায়বিচার, শুরা এবং ঐক্যের ভিত্তিতে এটি গড়ে তুলেছিলেন। তাঁর মৃত্যু ও খিলাফত নির্বাচনের ঘটনাগুলো তাঁর প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রের ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করেছে। এই সিরাত আমাদের শিক্ষা দেয় যে সত্য ও ন্যায়ের পথে অবিচল থাকা এবং ঐক্যের মাধ্যমে সমাজ গঠন করা সম্ভব।
সূত্র: আল-মালুম আন আল-জাদওয়াল আত-তারিখি লি-সিরাতির রাসুল
আরও পড়ুনমহানবী (সা.)–এর জন্মকালের অলৌকিক ঘটনাবলি১৯ ঘণ্টা আগে