যে গল্প-উপন্যাস আমাকে টানে না; তা আমি পড়ি না, পড়তে পারি না। যা একনাগাড়ে পড়া যায়; সেই সাহিত্যকর্মের আমি সমঝদার। নবীন কথাসাহিত্যিক সেঁজুতি মাসুদের ‘নৈঃশব্দ্যের চার অধ্যায়’ আমি বিরতিহীনভাবে পড়েছি। ভালো লেগেছে। কিছু বিষয় মুগ্ধ করেছে। ভাবিয়েছেও।
‘নৈঃশব্দ্যের চার অধ্যায়’ সেঁজুতি মাসুদের প্রথম গল্পগ্রন্থ। ১০২ পৃষ্ঠার এই বইটিতে রয়েছে ১৯টি গল্প। এতে জীবন জিজ্ঞাসা আছে, নতুন ভাবনা আছে; আছে মাটি, মানুষ ও প্রকৃতির প্রতি অকৃত্রিম দরদ।
দু’চারটি গল্পে চোখ বুলানো যাক। সময়ের সঙ্গে বদলে যায় পুরোনো জীবনাচার, প্রশ্নবিদ্ধ হয় প্রচলিত বিশ্বাস ও মূল্যবোধ। নতুন ও পুরোনোর দ্বন্দ্ব নানাভাবে বাঙ্ময় হয়েছে সেঁজুতি মাসুদের গল্পে।
প্রথম গল্প ‘দূরের তারায়’ কোনো এক বিমানবন্দরে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের দুই নিকট-বন্ধু অনন্যা ও শিহাবের দেখা হয়। দু’জন দুই পথের যাত্রী। ক্ষণিকের সাক্ষাতে তাদের মধ্যে পুরোনো স্মৃতি উঁকি দেয়। তারা পেছনে ফিরে যায়। কথাবার্তায় স্পষ্ট হয়, বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যয়নকালে পরস্পরের প্রতি দুর্বলতা ছিল, ভালো লাগা ছিল। কিন্তু অনন্যা তখন এক শিক্ষকের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে। অকস্মাৎ ব্রেকআপে সে শিক্ষাঙ্গন থেকে ছিটকে পড়ে। তারপর তার ভিন্ন এক জীবনসংগ্রাম।
বিমানবন্দরের আড্ডায় শিহাবের কাছে জীবনের পরবর্তী অধ্যায় এড়িয়ে যায়। তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবনে ফিরে যায়। কত কথা, কত স্মৃতি যেন শেষ হয় না। বিদায় নেওয়ার পালা এসে যায়। শিহাব চাইলেও অনন্যা যোগাযোগ রাখতে রাজি নয়। নিঃসংকোচে বলে, ‘ধরে নে কেউ না। এইমাত্রই আমাদের দেখা হলো। কিছুটা সময় কাটালাম একসঙ্গে। জীবনের পুরো ব্যাপারটাই তো তাই, সময়টা কাটিয়ে দেওয়া। কথা শেষ করে, একমুহূর্তে নিশ্চল থেকে আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিল অনন্যা। হাই আয়াম অনন্যা।’ কারণ, তার সেই স্বপ্নিল চোখ নেই। এখন তাতে অভিজ্ঞতার ছাপ।
লেখকের দ্বিতীয় গল্প ‘বারান্দা-সখী’। নগরজীবন-যন্ত্রণায় বিদ্ধ দুই শিশু– মিনি ও বাবলি। দুই ফ্ল্যাটবাড়িতে আটক এই দুই ‘মানব ছানা’র বন্ধুত্ব। অথচ এখানে ছিল শিমুলের বাগান, খেলার মাঠ, ঝোপঝাড়, পানাপুকুর। যৌথ পরিবার ছিল। ছিল মুক্ত হাওয়ায় শিশুর বিচরণ। সবই বদলে গেছে। যৌথ পরিবার বদলে একক পরিবার, ফ্ল্যাটবাড়ি, শিশুর জন্য বিচ্ছিন্ন জীবন। এ গল্পে যন্ত্রণাক্লিষ্ট শিশুমনের অভিব্যক্তির প্রকাশ তাৎপর্যপূর্ণ– ‘জন্মদিনের কেকের ওপরের মোমবাতিটায় ফুঁ দিয়ে তাড়াতাড়ি বড় হতে চায় মিনি। আর মনে মনে ভাবে, সে কখনও কোনো শিশুকে পৃথিবীতে এনে এভাবে বন্দি করবে না।’
লেখকের দৃষ্টি প্রসারিত। মানবমনের অনূভূতি চিত্রায়ণে উদার ও মানবিক। ‘লাভ ট্রায়াঙ্গল’ গল্প থাইল্যান্ডে অনুষ্ঠিত ডিজিটাল মার্কেটিং ও ই-কমার্সবিষয়ক কোর্স ঘিরে। যেখানে নানা দেশের অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে বাংলাদেশ বা উপমহাদেশীয় নারী ঝিলমও রয়েছে। সে-ই গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র। ‘ঝিলম টের পায় যে, সে না চাইলেও তার চোখ ও মন দুই-ই নিকোলাসকে খুঁজতে শুরু করেছে। কিন্তু নিকোলাসের কাছে তার সেই রকম কোনো অ্যাপিল আছে কিনা। সেটা শত চেষ্টা করে গত ছয় মাসে ধরতে পারেনি ঝিলম।’ ছয় মাস পর কোর্সের সমাপনী পর্বে যখন ধুমধাম করে কালচারাল নাইট শুরু হয়, সেদিন ঝিলম নিকোলাসের মধ্যে প্রতিহিংসার আগুন জ্বালাতে অপর অংশগ্রহণকারী রবার্টের ঘনিষ্ঠ হয়। অনুষ্ঠানে অন্যদের মধ্যে ঝিলম, রবার্ট ও নিকোলাস নানা পারফর্ম করে। ঝিলমের কবিতা শুনে পুরো ক্যাফে করতালিতে ফেটে পড়ে। ঝিলম যখন নিককে (নিকোলাস) খুঁজছিল। সে আবিষ্কার করল– ‘এতক্ষণ তার টেবিলের দিকে তাকিয়ে রবার্টকেই দেখছিল নিক। ঝিলম জানতে পারল না সেই মুহূর্তটা ছিল তাদের তিনজনের একত্রে প্রেমে পড়ার মুহূর্ত। যখন নিকের গাওয়া গানের একটি লাইন মনে মনে গাইতে গাইতে ঝিলম নিকের প্রেমে পড়েছিল, রবার্ট শুধু একজন রূপসীর নয় বরং ঝিলমের ভেতরের মানুষটার প্রেমে পড়েছিল, আর সারাজীবন সমলিঙ্গকে ভালোবাসা নিক প্রেমে পড়েছিল রবার্টের।’
বইয়ের শেষ গল্প ‘যোদ্ধার স্ত্রী’। সামরিক কর্মকর্তার স্ত্রী রিয়া স্বাভাবিক চাওয়া-পাওয়া থেকে বঞ্চিত হয়, বিয়ের পাঁচ বছর পূর্তির অনুষ্ঠানের ছোট্ট পরিকল্পনাও বাতিল হয়ে যায়। করোনা আক্রান্তদের সেবায়, ত্রাণ বিতরণে নিয়োজিত কর্তব্যপরায়ণ সামরিক অফিসার আবির। কর্তব্যবোধের কাছে দম্পতির নিজস্ব মুহূর্তগুলো হারিয়ে যায়।
রিয়ার চাচা মুক্তিযুদ্ধে শহীদ। বাবাও মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযুদ্ধের গল্প শুনতে শুনতে বড় হওয়া রিয়া চারদিকে দেখেছে নিরীহ ও ভীতু প্রজন্ম। একমাত্র ব্যতিক্রম, সাহসী ও সংবেদনশীল আবির। তাই আবিরের সঙ্গে তার প্রেম ও সংসার। ‘নিজের দেশের পতাকা আকাশে উড়িয়ে যখন স্যালুট দেয় আবির, তখন গর্বে রিয়ার বুকের ছাতি ফাটে। ভালোবাসার সঙ্গে দেশপ্রেম সেখানে গভীরভাবে মিশে যায়।’ এর পরও বিশেষ মুহূর্তে স্বামীর অনুপস্থিতি তাকে ব্যথিত করে। ‘দীর্ঘশ্বাস চাপতে রিয়া তার ভদ্রলোককে মনে মনে ঘরে ডাকে। ইউনিফর্মের ভেতরের মানুষটা কেমন আছে, জানতে ইচ্ছে করে। কল্পনায়, ইউনিফর্মের একেকটা বোতাম তার নরম আঙুলে চেপে খুলে ফেলে রিয়া। পরিয়ে দেয় নরম পাঞ্জাবি।’
সবকিছু ছাপিয়ে রিয়া একজন নারী। জীবনসঙ্গীকে কাছে না পাওয়ার বেদনায় বিদীর্ণ রিয়ার মন। লেখক বেশ মুনশিয়ানায় মানবী রিয়ার সেই অনুভূতির চিত্রায়ণ করে; যা মুগ্ধকর। ভাবতে ইচ্ছে করে– এ কি এক দক্ষ শিল্পীর আগমনী বার্তা!
পরিশেষে সেঁজুতি মাসুদের কাছে প্রত্যাশা, কলম যেন না থামে। v
উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
সেলফি’র ধাক্কায় গণস্বাস্থ্যের কর্মীর মৃত্যু, ৬ বাস আটক
সাভারে সেলফি পরিবহনের একটি চলন্ত বাসের ধাক্কায় গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের একজন সাবেক নিরাপত্তাকর্মীর মৃত্যু হয়েছে। এ ঘটনায় ঘাতক বাস ও বাসের চালককে আটক করে স্থানীয়রা। পরে সেলফি পরিবহনের আরও পাঁচটি বাস আটক করে গণস্বাস্থ্য মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থী ও গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের কর্মচারীরা।
বুধবার (৩০ এপ্রিল) সকাল ১০টা ২০ এর দিকে সাভারের আশুলিয়া এলাকার ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের কাছে ঢাকা মুখী লেনে এই দুর্ঘটনা ঘটে।
নিহত ব্যক্তি হলেন, চাঁদপুর জেলার মতলব থানার লোকমান মোল্লার ছেলে শামসুল মোল্লা (৭০)। তিনি গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের শ্রীপুর(গাজীপুর) উপকেন্দ্রের নিরাপত্তাকর্মী হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
আটককৃত বাসের চালক হলেন, ঢাকার ধামরাই উপজেলার রোয়াইল ইউনিয়নের আব্দুল মবেদের ছেলে আব্দুল করিম (৪৫)।
গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, অল্প কিছুদিন আগেই তিনি চাকরি থেকে অব্যাহতি নিয়েছিলেন। তার পাওনাদি নেওয়ার জন্যেই তিনি আজ গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে এসেছিলেন।
সাভার হাইওয়ে থানার ট্রাফিক ইন্সপেক্টর (টিআই) বিষ্ণু পদশর্মা বলেন, “সড়ক দুর্ঘটনায় একজন নিহত হয়েছেন। ঘটনাস্থলে আমরা এসেছি। আইনগত প্রক্রিয়া চলমান।”
ঢাকা/সাব্বির/এস