যুক্তরাষ্ট্রের কারণে এখন আন্তর্জাতিক রাজনীতির এক আলোচিত শব্দ হয়ে উঠেছে ‘শুল্ক’।

হোয়াইট হাউস একের পর এক ঘোষণা দিয়ে যাচ্ছে। সব আমদানি করা স্টিল ও অ্যালুমিনিয়ামের ওপর ২৫ শতাংশ শুল্ক, চীনা পণ্যের ওপর বাড়তি শুল্ক আর সারা বিশ্বের বাণিজ্য অংশীদারদের ওপর পাল্টা শুল্ক বসানোর হুমকি।

এই সিদ্ধান্তগুলো আন্তর্জাতিক মহলে সঙ্গে সঙ্গে প্রতিক্রিয়া তৈরি করেছে। প্রায় সব দেশই এ সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছে। কেউ কেউ পাল্টা ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলছে। কিন্তু এ নীতির পেছনে যুক্তরাষ্ট্র আসলে কী চায়, তা নিয়ে সবাই দ্বিধায়।

আরও অবাক করার বিষয় হলো, এই কঠিন সিদ্ধান্তগুলোর সবচেয়ে বড় ধাক্কা খেয়েছে যুক্তরাষ্ট্রেরই সবচেয়ে কাছের দুই প্রতিবেশী—কানাডা ও মেক্সিকো। তাদের ওপরও ২৫ শতাংশ শুল্ক বসানো হয়েছে, তা–ও কোনো ছাড় ব্যতিরেকেই।

প্রশ্ন ওঠে, দীর্ঘদিনের প্রতিবেশী সহযোগিতার সম্পর্ক গেল কোথায় এবং রাজনীতিবিদেরা যেভাবে বলছেন, এই শুল্ক কি সত্যিই যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ রক্ষা করছে?

সোজা কথায় উত্তর, একেবারেই না।

তিন দেশ মিলে গড়া অংশীদারত্ব ভেঙে পড়ছে

কয়েক দশক ধরে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও মেক্সিকোর মধ্যে গড়ে উঠেছিল শক্তিশালী এক ত্রিপক্ষীয় অংশীদারত্ব। এর মধ্য দিয়ে তিন দেশের অর্থনীতি এমনভাবে জড়িয়ে গিয়েছিল যে একসঙ্গে তারা টেকসই উন্নয়ন আর প্রবৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাচ্ছিল।

এর সপক্ষে কিছু প্রমাণ দেখা যাক। ২০২৪ সালে মেক্সিকোর রপ্তানির ৮০ শতাংশই গেছে যুক্তরাষ্ট্রে। শুধু বছরের প্রথম তিন প্রান্তিকে যুক্তরাষ্ট্র ও মেক্সিকোর মধ্যে বাণিজ্যের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৬৩০ বিলিয়ন ডলার, যা ছিল আমেরিকার মোট বৈদেশিক বাণিজ্যের ১৫ দশমিক ৯ শতাংশ—একটি রেকর্ড।

কানাডার ক্ষেত্রেও চিত্রটা প্রায় একই। তাদের ৭৫ শতাংশ রপ্তানি গেছে দক্ষিণে—যুক্তরাষ্ট্রে। যার বড় অংশ ছিল তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাস। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের রপ্তানির ১৮ শতাংশ গেছে কানাডায়।

এই আন্তনির্ভরশীলতার সবচেয়ে বড় উদাহরণ হচ্ছে গাড়িশিল্প। এটি প্রথমে গড়ে ওঠে নর্থ আমেরিকান ফ্রি ট্রেড অ্যাগ্রিমেন্টের (নাফটা) মাধ্যমে। পরে আরও গভীর হয় ইউএসএমসিএ চুক্তির আওতায়। তিন দেশের এই গাড়িশিল্প এমনভাবে একে অপরের সঙ্গে যুক্ত যে একটি গাড়ির যন্ত্রাংশ একাধিকবার সীমানা পেরিয়ে যায় চূড়ান্তভাবে তৈরি হওয়ার আগে।

সরকারি তথ্য বলছে, ২০২৪ সালে মেক্সিকো রেকর্ড ৪০ লাখ হালকা যানবাহন তৈরি করেছে। এর বেশির ভাগই গেছে যুক্তরাষ্ট্রে। শুধু জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত সময়ে যুক্তরাষ্ট্র মেক্সিকো থেকে ৮৭ বিলিয়ন ডলারের গাড়ি ও ৬৪ বিলিয়ন ডলারের যন্ত্রাংশ আমদানি করেছে। একই বছরে কানাডা যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ৯০ বিলিয়ন ডলারের গাড়ির যন্ত্রাংশ রপ্তানি করেছে।

সহজভাবে বললে, কানাডার প্রাকৃতিক সম্পদ, মেক্সিকোর শ্রম এবং আমেরিকার পুঁজি ও প্রযুক্তি সমান সমান উত্তর আমেরিকার সাফল্যের অর্থনৈতিক সূত্র।

‘শুধুই আমেরিকা’

এই পারস্পরিক উপকারিতার সম্পর্কে যেসব পক্ষের লাভ হয়, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তা সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্র মনে হচ্ছে এই সম্পর্কগুলো ভাঙতে চায়। না হলে আমেরিকা কেন এখন ‘আমাদের টাকা ফিরিয়ে আনব’ নামে জনতুষ্টিবাদ স্লোগান দিচ্ছে?

তবে এটি বাস্তবিকভাবে ভুল এবং নৈতিকভাবেও প্রশ্নবিদ্ধ। কানাডার একটি থিঙ্কট্যাংক প্রতিষ্ঠান জানিয়েছে, ২৫ শতাংশ শুল্কের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের কানাডায় রপ্তানি ৫-৮ শতাংশ কমে যেতে পারে। আর কানাডার যুক্তরাষ্ট্রের রপ্তানি ১০-১৫ শতাংশ হ্রাস পেতে পারে। যদিও এই সংখ্যাগুলো কিন্তু নিছক কিছু হিসাবমাত্র নয়। এর বাস্তব প্রভাব সরাসরি সাধারণ মানুষের ওপর পড়ে। সীমান্তপারের বাণিজ্যের ওপর নির্ভরশীল কারখানাগুলো যখন অর্ডার কম পায়, তখন কর্মী ছাঁটাই শুরু হয়।

চলমান শুল্ক বিরোধের প্রভাব শুধু উত্তর আমেরিকাতেই সীমাবদ্ধ নয়। সরাসরি ক্ষতি তো এতে হবেই। সেই সঙ্গে শুল্ক আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক পূর্বানুমানযোগ্যতাকে দুর্বল করে দেয়। দীর্ঘমেয়াদি প্রতিযোগিতামূলকতা ঝুঁকির মধ্যে পড়ে।

উত্তর আমেরিকায় তিনটি দেশের মধ্যে ৩০ বছরের পরিশ্রমে গড়ে উঠেছিল একটি বাণিজ্যিক সম্পর্ক। সেই সম্পর্ক একটি নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে ভেঙে গেল। তাহলে যুক্তরাষ্ট্রের অন্যান্য দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় বাণিজ্যিক প্রতিশ্রুতির কী হবে? যুক্তরাষ্ট্রকে কি আর নির্ভরযোগ্য অর্থনৈতিক অংশীদার হিসেবে বিশ্বাস করা যাবে। পৃথিবী কি এখন ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ আর ‘শুধুই আমেরিকা’ নীতির বাস্তবায়ন দেখতে হাত–পা গুটিয়ে বসে থাকবে?

বিশ্ব তাকিয়ে আছে

আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এখন যুক্তরাষ্ট্রের নতুন বাণিজ্যনীতিগুলোর দিকে খুব মনোযোগ দিয়ে দেখছে। বোঝার চেষ্টা করছে, আমেরিকার প্রকৃত উদ্দেশ্য কী। আমেরিকার প্রতিটি শুল্ক বৃদ্ধির মাধ্যমে আসলে একটি বিপরীত বাস্তবতা প্রকাশ পাচ্ছে। আমেরিকা যত এই শুল্ক বাড়ানোর মতো হাতিয়ার ব্যবহার বাড়াচ্ছে, ততই সে দুনিয়াজুড়ে তার সঙ্গে কারবার করা দেশগুলোর আস্থা কমিয়ে দিচ্ছে। এই আস্থা ছাড়া অর্থপূর্ণ বহুপক্ষীয় কোনো সম্পর্ক গড়ে তোলা যায় না। কোনো সমস্যার সমাধানও করা যায় না।

আমেরিকা এক আত্মঘাতী চক্রে পড়তে যাচ্ছে। সাময়িক এই শুল্ক বাড়ানোর কৌশল আমেরিকার দীর্ঘমেয়াদি বিশ্বাসযোগ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে। ফলে আমেরিকার মিত্রসহ অন্যান্য দেশ প্রশ্ন করতে শুরু করছে, আমেরিকা কি তাহলে সুদূরপ্রসারী আন্তর্জাতিকতার বদলে সংকীর্ণ ‘আমিই আগে’ নীতি বেছে নিল?

যখন বিশ্বের সবচেয়ে বড় অর্থনীতি তার নিজস্ব স্বার্থকে সাধারণ কল্যাণের ওপর অগ্রাধিকার দেয়, তখন তার প্রভাব সীমান্ত ও প্রজন্ম পার হয়ে চলে যায়। এই কারণেই পৃথিবীজুড়ে দেশগুলো উত্তর আমেরিকার বাণিজ্যবিরোধগুলো পর্যবেক্ষণ করছে। আজকের বিশ্ব খুব ঘনিষ্ঠভাবে একে অপরের সঙ্গে যুক্ত। টেকসই সমৃদ্ধি অর্জন করতে হলে শুধু জাতীয়তাবাদী চিন্তাভাবনা দিয়ে হবে না। এর জন্য দরকার আরও ব্যাপক কিছু।

‘তোমার প্রতিবেশীকে নিজের মতো ভালোবাসো’, এই প্রাচীন আপ্তবাক্য অর্থনৈতিক বাস্তবতার জন্যও সমান গুরুত্বপূর্ণ এক সত্য।

শিন পিং চীনা সাংবাদিক

পিপলস ডেইলি অনলাইন থেকে নেওয়া ইংরজির অনুবাদ

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: আম র ক র র ওপর সবচ য়

এছাড়াও পড়ুন:

ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ইসরায়েলের হামলা

রবিবার বিকেল থেকে ইরানজুড়ে নতুন করে ব্যাপক বিমান হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল। সামরিক স্থাপনার পাশাপাশি ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কেও লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছে।

রবিবার রাতে ইরানের উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী সাইদ খাতিবজাদেহ ইসরায়েলি হামলার তথ্য নিশ্চিত করেছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্স-এ একটি পোস্টে তিনি জানান, রবিবার রাজধানী তেহরানে ইসরায়েলি হামলায় ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। খবর তুরস্কের বার্তা সংস্থা আনাদোলুর।

এক্স-পোস্টে সাইদ বলেছেন, “ইসরায়েলের অপরাধী শাসকগোষ্ঠী রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক গবেষণা ইনস্টিটিউটের ঠিক বিপরীতে অবস্থিত ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি ভবনে ইচ্ছাকৃত এবং নির্মম হামলা চালিয়েছে।”

আরো পড়ুন:

ইসরায়েলের নতুন হামলায় ইরানের আইআরজিসির গোয়েন্দা প্রধান নিহত

ইসরায়েলে ৫০টি ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ল ইরান, তেল আবিব ও হাইফাতে সরাসরি আঘাত

উপ-মন্ত্রী আরো বলেন, “এই হামলায় বেশ কয়েকজন বেসামরিক ব্যক্তি আহত হয়েছেন, আমার বেশ কয়েকজন সহকর্মীও আহত হয়েছেন, যাদের চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে।”

সাইদ বলেন, “এটি আরো একটি স্পষ্ট যুদ্ধাপরাধ, ইরানের বিরুদ্ধে ইসরায়েলি শাসকগোষ্ঠীর চলমান ও নিয়মতান্ত্রিক আগ্রাসন অভিযানের অংশ।”

এর আগে শনিবার ইরানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সদর দপ্তরে হামলা চালিয়েছিল ইসরায়েল।

ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, তারা তেহরানের অস্ত্র উৎপাদন ক্ষমতা ধ্বংস করার লক্ষ্যে ইরানের আইআরজিসি ও সামরিক লক্ষ্যবস্তুতে রবিবার নতুন করে ব্যাপক বিমান হামলা চালিয়েছে।

বিবৃতিতে  বলা হয়, এই হামলায় ইসলামিক রেভোলিউশনারি গার্ড কর্পস (আইআরজিসি), গার্ডস কুদস ফোর্স এবং ইরানের সশস্ত্র বাহিনীর অবকাঠামো লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছে।

ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী আরো জানিয়েছে, ইরানজুড়ে অসংখ্য অস্ত্র উৎপাদন কেন্দ্রে হামলা চালানো হয়েছে। 

ইরানি বার্তাসংস্থা তাসনিম নিউজ জানিয়েছে, ইসরায়েলের এই হামলায় আইআরজিসিরি গোয়েন্দা প্রধান মোহাম্মদ কাজেমি এবং তার সহকারী হাসান মোহাকিক নিহত হয়েছেন। এছাড়া মোহসেন বাঘারি নামে আইআরজিসির আরো একজন জেনারেল নিহত হয়েছেন। এর প্রতিশোধ নিতে রবিবার রাতে ইসরায়েলে ৫০টি ব্যালেস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ও শতাধিক ড্রোন ছুড়েছে ইরান।

ইসরায়েলের ফায়ার ও রেসকিউ সার্ভিসের বরাত দিয়ে টাইমস অব ইসরায়েল জানিয়েছে, উত্তর ইসরায়েলে দুটি এবং হাইফায় একটি আবাসিক ভবনে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র সরাসরি আঘাত হানার খবর পেয়েছে তারা।

ইসরায়েলি জাতীয় জরুরি সেবা সংস্থা জানিয়েছে, হাইফায় ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে সাতজন আহত হয়েছেন। এছাড়া কিরিয়াত গাটের কাছে দক্ষিণাঞ্চলীয় একটি শহরে একজন আহত হয়েছেন।

এ ঘটনায় ইসরায়েলি সেনাপ্রধান ইয়াল জামির ইরানের ওপর আক্রমণ আরো তীব্র করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। একটি বিবৃতি জারি করে ইসরায়েরি সেনাপ্রধান বলেছেন, “আমরা আমাদের অভিযান তীব্রতর করে যাব এবং এটি করে, আগামী বছরগুলোতে আমাদের নিরাপত্তা জোরদার করব। আমরা জানতাম এর একটি মূল্য দিতে হবে এবং এটিই বোঝায় যে, আমরা কেন এখনই পদক্ষেপ নিয়েছি, তা অনেক দেরি হওয়ার আগেই।”

ইরানের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, শুক্রবার থেকে ইসরায়েলি হামলায় ২২৪ জন নিহত এবং ৯০০ জন আহত হয়েছেন।

ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় কমপক্ষে ১৩ জন নিহত এবং ৩৭০ জনেরও বেশি আহত হয়েছেন।

ঢাকা/ফিরোজ

সম্পর্কিত নিবন্ধ