যখন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প শেষ পর্যন্ত তাঁর বহু আগে থেকেই হুমকি দিয়ে আসা শুল্ক আরোপের সিদ্ধান্ত কার্যকর করলেন, তখন তার মাত্রা ও বিস্তৃতি বেশির ভাগ দেশের আশঙ্কার চেয়েও খারাপ ছিল। চীন সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে, এটি অনুমিতই ছিল। কিন্তু বেশির ভাগ এশীয় দেশের ওপর যে কঠোর শুল্ক চাপানো হলো, তা ছিল এক গভীর ধাক্কা।

সৌভাগ্যবশত অর্থবাজারে ব্যাপক অস্থিরতা শুরু হলে শুল্ক কার্যকর হওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ট্রাম্প ঘোষণা দেন, এসব ‘পারস্পরিক’ শুল্ক ৯০ দিনের জন্য স্থগিত থাকবে। এই সাময়িক বিরতিতে সুবিধাপ্রাপ্ত এশীয় সরকারগুলোর উচিত এখন আরও ঐক্যবদ্ধ প্রতিক্রিয়া গড়ে তোলা এবং সাহসী পদক্ষেপ নেওয়া, যা কিনা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তাদের দর-কষাকষিতে বাড়তি প্রভাব সৃষ্টি করবে।

উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, আমার নিজের দেশ শ্রীলঙ্কার ওপর শুরুতে যে শুল্ক আরোপ করা হয়, তা ছিল ৪৪ শতাংশ। এটি একটি বিশাল হার। অথচ যখন এই শুল্ক চাপানো হয়, তখনই শ্রীলঙ্কা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে এক কঠিন সময় পার করছিল। এমনকি সে সময়ের প্রেসিডেন্টও দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন এবং পুরো দেশ একরকম দেউলিয়া হয়ে পড়ার পথে ছিল।

এ পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্র (যা শ্রীলঙ্কার সবচেয়ে বড় রপ্তানি গন্তব্য) যদি ওই শুল্ক আরোপ করে, তাহলে তা শ্রীলঙ্কার ঘুরে দাঁড়ানোর বা পুনরুদ্ধারের চেষ্টাকে একটি মারাত্মক ধাক্কা দেবে। অর্থাৎ এই শুল্ক শ্রীলঙ্কার অর্থনীতিকে আরও দুর্বল করে দিতে পারে। কারণ, রপ্তানি থেকে যে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হয়, তা দেশের অর্থনীতির জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। যদি যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি করা কঠিন হয়ে পড়ে, তাহলে শ্রীলঙ্কার অর্থনীতিতে আবারও বড় সংকট দেখা দিতে পারে।

অন্য এশীয় দেশগুলোর অবস্থাও খুব একটা ভালো নয়, বরং কয়েকটি দেশ আরও বেশি শুল্কের শিকার হয়েছে। যেমন কম্বোডিয়ার ওপর ৪৯ শতাংশ, লাওসের ওপর ৪৮ শতাংশ এবং ভিয়েতনামের ওপর ৪৬ শতাংশ হারে শুল্ক ধার্য করা হয়েছে।

এই প্রস্তাবিত শুল্ক এতটাই কঠিন যে কেউ কেউ ভাবতেই পারেন, ভিয়েতনাম যুদ্ধে সামরিক দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়ার প্রতিশোধ নিতে ট্রাম্প এখন ইন্দোচীনের ওই দেশগুলোর ওপর অর্থনৈতিক যুদ্ধ চাপিয়ে দিচ্ছেন। এখন যখন ভিয়েতনাম সরকার দ্রুত ‘সাদা পতাকা’ তুলে যুক্তরাষ্ট্রের সব পণ্যের ওপর শুল্ক বাতিলের প্রস্তাব দিয়েছে এবং আলোচনার জন্য সম্মত হয়েছে, তখন ট্রাম্প হয়তো মনে করছেন, তিনি ইতিমধ্যেই জয়ী হয়ে গেছেন।

বর্তমান আসিয়ান চেয়ার মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম এখনো আসিয়ান জোটের পূর্ণ শক্তিকে কাজে লাগিয়ে একটি ঐক্যবদ্ধ অবস্থান উপস্থাপন করতে পারেন এবং এমন কিছু নীতিমালা প্রণয়নের উদ্যোগ নিতে পারেন, যা ট্রাম্পের শুল্ক আরোপের ফলে সৃষ্ট অর্থনৈতিক ধাক্কা থেকে সদস্যদেশগুলোকে কিছুটা সুরক্ষা দিতে পারে। এটি আনোয়ারের আসিয়ান চেয়ার হিসেবে গৃহীত সেই উদ্যোগের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ, যেখানে তিনি আসিয়ানের অভ্যন্তরে অর্থনৈতিক সংহতি আরও গভীর করার পাশাপাশি উপসাগরীয় সহযোগিতা পরিষদ (জিসিসি) এবং অন্য এশীয় অর্থনীতিগুলোর সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক জোরদার করার চেষ্টা করছেন।

আনোয়ার মে মাসে যে আসিয়ান সম্মেলন আয়োজন করছেন, সেটি এই লক্ষ্যকে সামনে এগিয়ে নেওয়ার একটি সুযোগ করে দেবে। সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী নেতারা সম্ভবত বাণিজ্যিক অংশীদারত্বকে বহুমুখীকরণের বিষয়ে আলোচনা করবেন, যা এমন চাপের মুখে থাকা যেকোনো দেশ বা অঞ্চলের জন্য একটি ভালো পদক্ষেপ। তবে তাদের উচিত এই সম্মেলনে আঞ্চলিক সহযোগিতা জোরদার করার এবং নিজেদের অর্থনীতিকে আরও সহনশীল করার অন্যান্য উপায় খোঁজা।

আসিয়ান ইতিমধ্যেই তিমুর-লেস্তের সঙ্গে সদস্যপদ নিয়ে আলোচনা শুরু করেছে। অনেকের মতে, এ দেশটি যদি আসিয়ানে যুক্ত হয়, তাহলে এটি হবে এখন পর্যন্ত জোটের সবচেয়ে দরিদ্র সদস্য। তবে সদস্যপদ পেলে তিমুর-লেস্তে তার অর্থনীতি বৈচিত্র্যময় করতে পারবে এবং নতুন অংশীদারের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ পাবে। এটি একই সঙ্গে ইন্দোনেশিয়ার সঙ্গে দেশটির দীর্ঘদিনের বৈরিতা হ্রাস করতে সহায়ক হবে—যা পর্তুগাল থেকে স্বাধীনতার পর ২০ বছরের বেশি সময় ধরে ইন্দোনেশিয়ার দখলে ছিল।

ট্রাম্পের মতো কোনো ক্ষমতাধর রাষ্ট্রের দমননীতির মোকাবিলা করতে হলে শক্ত অবস্থান থেকে এগিয়ে আসা জরুরি। আসিয়ানের সম্প্রসারণ-তিমোর-লেস্তেকে দ্রুত অন্তর্ভুক্ত করা এবং শ্রীলঙ্কার সঙ্গে আলোচনার সূচনা করা—এই লক্ষ্য অর্জনে সাহায্য করবে। ট্রাম্প একবার ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির সঙ্গে ওভাল অফিসে আলোচনায় বলেছিলেন, ‘তোমার হাতে তেমন কোনো শক্তি নেই।’

কিন্তু আসিয়ানের হাতে শক্তি আছে, বিশেষ করে যদি তারা ঐক্যবদ্ধ থাকে। আর জোট সম্প্রসারিত হলে সেই শক্তি আরও বাড়বে।

 ● আর এম মনিভান্নান সুপ্রিম গ্লোবাল হোল্ডিংসের চেয়ারম্যান

স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্ত আকারে অনূদিত

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: শ ল ক আর প র জন য র ওপর সদস য

এছাড়াও পড়ুন:

ভোগবাদী যুগে ইসলামে সুখের খোঁজ

আপনার বাড়িতে কি অপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের স্তূপ জমে আছে? জানেন কি, এর থেকে মুক্তির পথ আছে ইসলামের সরল জীবনধারায়? আধুনিক বিশ্বে ভোগবাদের তীব্র ঝড়ে আমরা প্রায়ই নিজেদের দেখি অপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রে ঠাসা ঘরে।

নতুন ফ্যাশনের পোশাক, সর্বশেষ প্রযুক্তির গ্যাজেট বা মধ্যরাতে এক ক্লিকে কেনা অপ্রয়োজনীয় পণ্য—এসব আমাদের জীবনের অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু ইসলাম আমাদের ন্যূনতম একটি সরল জীবনধারার পথ দেখায়, যা পার্থিব লোভ থেকে মুক্ত করে আমাদের আল্লাহর পথে নিবেদিত হতে উৎসাহিত করে।

আয়েশা, তুমি যদি আমার সঙ্গে মিলিত হতে চাও, তবে এই দুনিয়া থেকে একজন পথিকের প্রয়োজনীয় জিনিসের মতো সামান্য গ্রহণ করো।সুনানে তিরমিজি, হাদিস: ১৭,৮০০সংযম কেন জরুরি

মিনিমালিজম বা ন্যূনতাবাদ এমন একটি জীবনধারা, যেখানে আমরা শুধু প্রয়োজনীয় জিনিসের ওপর নির্ভর করব এবং অতিরিক্ত ভোগবিলাস থেকে দূরে থাকব। ক্রমাগত কেনাকাটার দিকে প্রলুব্ধ না হয়ে শুধু যেটুকু না হলেই জীবন চলে না, সেটুকু নিজের কাছে রাখব।

আল্লাহ তাআলা বলেছেন, ‘হে আদম সন্তান, প্রত্যেক নামাজের সময় বেশভূষা সৌন্দর্য গ্রহণ করো, খাও এবং পান করো, কিন্তু অপচয় কোরো না। নিশ্চয়ই তিনি অপচয়কারীদের পছন্দ করেন না।’ (সুরা আ’রাফ, আয়াত: ৩১)।

এই আয়াত আমাদের জীবনে সংযম ও সরলতার গুরুত্ব মনে করিয়ে দেয়।

আরও পড়ুনদুনিয়ার ভোগ–বিলাস নিয়ে সুরা তাকাসুরের সতর্কতা১০ এপ্রিল ২০২৩

বিজ্ঞাপনের প্রলোভন আজকাল আমাদের অপ্রয়োজনীয় কেনাকাটার দিকে ঠেলে দেয়। প্রায়ই এমন জিনিস কিনে ফেলি, যেমন একটি ইউএসবি মগ হিটার বা জামাকাপড়, যা তারপর বছরের পর বছর অব্যবহৃত পড়ে থাকে।

বাড়িতে জমে থাকে প্যাকেট না খোলা গ্লাস–বক্স, অপঠিত বইয়ের স্তূপ। প্রশ্ন করে দেখি তো, আমাদের আসলেই কি এগুলো প্রয়োজন ছিল?

মহানবী (সা.)-এর সাদাসিধা জীবন

মহানবীজি (সা.) এবং তাঁর সাহাবারা সরল জীবনযাপনের উজ্জ্বল উদাহরণ। হজরত আয়েশা (রা.)-কে নবীজি বলেছিলেন, ‘হে আয়েশা, তুমি যদি আমার সঙ্গে মিলিত হতে চাও, তবে এই দুনিয়া থেকে একজন পথিকের প্রয়োজনীয় জিনিসের মতো সামান্য গ্রহণ করো। ধনীদের সঙ্গে মেলামেশা থেকে সাবধান থাকো এবং কোনো পোশাককে তখনই জীর্ণ হয়ে গেছে মনে করো, যখন তুমি তাতে প্যাঁচ লাগিয়েছ (মানে যখন পুরোনো হয়ে যাওয়ার কারণে পেঁচিয়ে যায়)।’ (সুনানে তিরমিজি, হাদিস: ১৭,৮০০)।

এই হাদিসে নবীজি (সা.) স্পষ্টভাবে সরল জীবনযাপন এবং অতিরিক্ত সম্পদ সঞ্চয় থেকে দূরে থাকার পরামর্শ দিয়েছেন।

উপহারের পরিবর্তে আমরা দাতব্য সংস্থায় দানের জন্য অনুরোধ করতে পারি। এমনকি আমাদের একটি অনলাইন সাবস্ক্রিপশন বাতিল করে সেই অর্থ স্থানীয় মসজিদে দান করতে পারি।

ইসলাম আমাদের শেখায় যে পার্থিব সম্পদ ক্ষণস্থায়ী এবং এটি আমাদের চিরস্থায়ী জীবনের জন্য প্রস্তুতির পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। নবীজি (সা.) কখনো অপ্রয়োজনীয় সম্পদ সঞ্চয় করেননি এবং সব সময় দানশীলতার মাধ্যমে আল্লাহর পথে ব্যয় করতে উৎসাহিত করেছেন।

দানের সংস্কৃতি

আজকের বিশ্বে ভোগবাদী সংস্কৃতি আমাদের জীবনকে জটিল করে তুলেছে। ক্রেডিট কার্ড, সহজলভ্য ঋণ এবং ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মগুলো আমাদের ক্রমাগত কেনাকাটার দিকে প্রলুব্ধ করে। আমাদের পূর্ববর্তী প্রজন্ম, যেমন আমাদের দাদা-দাদিরা, সীমিত সম্পদের মধ্যে সরল জীবন যাপন করতেন। কিন্তু গত কয়েক দশকে বিশ্বব্যাপী মধ্যবিত্ত শ্রেণির উত্থান এবং সহজে ঋণ পাওয়ার সুযোগ আমাদের ভোগবাদী প্রবৃত্তিকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।

আরও পড়ুনখাদ্যনিরাপত্তা নিয়ে ইসলামের নির্দেশনা০৯ জুন ২০২৫

কিন্তু ইসলাম আমাদের শেখায়, প্রয়োজনের বাইরে অতিরিক্ত সম্পদ সঞ্চয় করা লোভ ও কৃপণতার দিকে নিয়ে যায়, যা একজন মুমিনের বৈশিষ্ট্য নয়।

ইসলাম আমাদের জীবনকে সরল করার পাশাপাশি আল্লাহর পথে ব্যয় করতে উৎসাহিত করে। আমরা চাইলে মাসিক বাজেটের একটি অংশ দানের জন্য বরাদ্দ করতে পারি।

যে ব্যক্তি নিজের সম্পদে সংযমী হয় এবং আল্লাহর পথে ব্যয় করে, তার জন্য জান্নাতের দরজা খুলে যায়।সহিহ মুসলিম, হাদিস: ৯৯৪

বিয়ের মতো উৎসবে আমরা বিলাসবহুল আয়োজনের পরিবর্তে সরলতা বেছে নিতে পারি। উপহারের পরিবর্তে আমরা দাতব্য সংস্থায় দানের জন্য অনুরোধ করতে পারি। এমনকি আমাদের একটি অনলাইন সাবস্ক্রিপশন বাতিল করে সেই অর্থ স্থানীয় মসজিদে দান করতে পারি।

নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি নিজের সম্পদে সংযমী হয় এবং আল্লাহর পথে ব্যয় করে, তার জন্য জান্নাতের দরজা খুলে যায়।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ৯৯৪)।

আমাদের ভালো কাজ এবং দানশীলতা পরকালে যেমন উপকারে আসবে, তেমনি সমাজের জন্যও হবে কল্যাণকর। অপ্রয়োজনীয় খরচ কমিয়ে দানশীলতার দিকে মনোযোগ দিলে সমাজের দরিদ্র ও অভাবী মানুষের জীবন উন্নত হবে।

ভোগবাদী জীবন মানুষকে অস্থির করে তোলে এবং ন্যূনতম খরচের জীবনধারা মানুষকে তৃপ্তির জীবন উপহার দেয়। এটি একই সঙ্গে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনেরও একটি পথ।

আমরা যদি আমাদের অপ্রয়োজনীয় খরচ কমিয়ে আল্লাহর পথে ব্যয় করি, তবে তা আমাদের ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনকে সমৃদ্ধ করবে। ন্যূনতমবাদ আমাদের মনে করিয়ে দেয়, আমাদের প্রকৃত সুখ পার্থিব সম্পদে নয়, বরং আল্লাহর সন্তুষ্টি ও পরকালের প্রস্তুতিতে নিহিত।

আরও পড়ুনআধুনিক এই প্রবণতার শিকড় ইসলামে২০ মে ২০২৫

সম্পর্কিত নিবন্ধ