পোর্ট রোডে অবস্থিত বরিশাল নগরের প্রধান মাছের মোকামটি। এ মোকামের ভেতর ও বাইরের সড়কের পাশে খুচরা বিক্রেতারা প্রতিদিন বিক্রি করছেন দুই-তিন ইঞ্চি আকারের বাচ্চা ইলিশ। কেজিপ্রতি দাম পড়ে ২০০-২৫০ টাকা। এক কেজিতে ওঠে চাপিলা আকারের প্রায় ১০০টি মাছ।

জাটকা নামে পরিচিত এই আকারের ইলিশ আহরণ, কেনাবেচা আইনত নিষিদ্ধ। অথচ পোর্ট রোড, তালতলীসহ বরিশালের হাট-বাজার ও সড়কের সব জায়গায়ই প্রকাশ্যে বিক্রি হচ্ছে এই জাটকা। এমনকি দক্ষিণাঞ্চল থেকে শত শত মণ জাটকা সড়ক ও নৌপথে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় সরবরাহ চলছে।

জাটকা শিকার-বিক্রির আইনবহির্ভূত কাজের দায় কেউ স্বীকার করেননি। বরঞ্চ জাটকা নিধন হচ্ছে স্বীকার করে অন্যকে অভিযুক্ত করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। জানা গেছে, ১০ ইঞ্চির কম আকারের ইলিশ মৎস্য অধিদপ্তরের সংজ্ঞায় ‘জাটকা’। এ মাছের প্রধান ক্ষেত্র হলো ভোলা এবং বরিশালের হিজলা ও মেহেন্দীগঞ্জ উপজেলাসংলগ্ন মেঘনা ও তেঁতুলিয়া নদী।

মৎস্য অধিদপ্তর সূত্র জানায়, ইলিশে পরিণত হওয়ার সুযোগ দিতে প্রতিবছরের ১ নভেম্বর থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত ৮ মাস জাটকা আহরণ ও কেনাবেচা নিষিদ্ধ। একই উদ্দেশ্যে দক্ষিণাঞ্চলের ৩৯২ কিলোমিটার নদীতে ১ মার্চ থেকে ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত দুই মাস সব ধরনের ইলিশ আহরণ নিষিদ্ধ। দুটি নিষেধাজ্ঞা চলার মধ্যেই এসব এলাকায় নিয়ন্ত্রণহীনভাবে জাটকা নিধন চলছে। 

মৎস্য অধিদপ্তরের বিভাগীয় কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ১ নভেম্বর থেকে গতকাল বুধবার পর্যন্ত জাটকা নিধন বন্ধে অভিযান পরিচালিত হয়েছে ৩ হাজার ৪০১টি। মামলা হয়েছে ৫০১টি। কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে ৬১ জনকে। এই সময়ের মধ্যে ১৯ দশমিক ৮৩ টন জাটকা জব্দ হয়েছে। এ ছাড়া জরিমানা আদায় করা হয়েছে ১২ লাখ ৪ হাজার টাকা।

নদীর হাতবদল 

৫ আগস্ট রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর আওয়ামী লীগপন্থি মাছ ব্যবসায়ীরা আত্মগোপনে চলে যান। এখন প্রকাশ্যে ইলিশের সাম্রাজ্য দখলে নিয়েছেন বিএনপিপন্থি ব্যবসায়ীরা। তাদের ছত্রছায়ায় নিষিদ্ধ জাল দিয়ে জাটকা নিধনে মেতে উঠেছেন জেলেরা।

হিজলা উপজেলার হরিনাথপুর, গঙ্গাপুর, আবুপুর, ভাঙ্গা, সুলতানপুর, কৃষ্ণপুর, সাতপাড়াসংলগ্ন মেঘনা নদীতে লাল-সবুজ পতাকাবাহী একটি জেলে নৌকায় কয়েক সপ্তাহ ধরে জাটকা নিধন করতে দেখা গেছে। পতাকার নিচে খালেক মাঝি ও তাঁর মোবাইল ফোন নম্বর লেখা। হরিনাথপুর ইউনিয়ন বিএনপি সাবেক সাধারণ সম্পাদক খালেক মাঝি। পুরোনো এই মৎস্য ব্যবসায়ী আওয়ামী লীগের পতনের পর মেঘনার একাংশ নিয়ন্ত্রণে নিয়েছেন।

তাঁর নামাঙ্কিত পতাকাবাহী নৌকার জেলে ফরিদ খানের ভাষ্য, পতাকা দেখে অভিযান পরিচালনাকারীরা বুঝতে পারেন, এটি খালেক মাঝির নৌকা। আর প্রশাসনের বড় মাপের অভিযানের খবর আগেই পেয়ে যান।

খালেক মাঝির দাবি, ‘গত ১৭ বছর ব্যবসা করতে পারিনি। এখন ব্যবসায় নেমেছি। কিন্তু দলের মধ্যেই ষড়যন্ত্রের শিকার হচ্ছি।’ তাঁর নামসংবলিত পতাকাবাহী নৌকায় ইলিশ নিধনের বিষয়ে বলেন, ‘আমার অজান্তে জেলে নদীতে গিয়েছে। এ জন্য তাকে জুতাপেটা করেছি।’

খালেক মাঝি পাল্টা অভিযোগ করেন, শরীয়তপুরের বাদল গাজী মেঘনার বড় অংশ নিয়ন্ত্রণ করে জাটকা নিধন করছেন। এ বিষয়ে বাদল গাজীর দাবি, তাঁর এলাকার মেঘনা বরিশালের সীমানায় পড়েছে। বিএনপির ব্যবসায়ীরা সব দখল করেছেন। গত ৮ মাস নদীর তীরেই যাননি তিনি।

হিজলা উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক গাফফার তালুকদারও প্রভাবশালী মাছ ব্যবসায়ী। তাঁর বিরুদ্ধেও জাটকা নিধনকারী জেলেদের প্রশ্রয় দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। অস্বীকার করে গাফফার তালুকদার বলেন, মেহেন্দীগঞ্জের বাগরজায় সবচেয়ে বেশি জাটকা নিধন হয়।  

মেহেন্দীগঞ্জের মেঘনায় জাটকা নিধনের পেছনে রয়েছেন ভাসানচর ইউপির ৯ নম্বর ওয়ার্ড সদস্য কবির বাগ। এসব এলাকায় অভিযানকারী দলের ওপর পর পর দুটি হামলার ঘটনায় মামলা হয়। এসব মামলায় তিনি হুকুমের আসামি। কবির বাগের ভাষ্য, আরও অনেক ব্যবসায়ীর জেলেই ইলিশ ধরছেন। মৎস্য অধিদপ্তর সেদিকে তাকায় না। তাঁকে অযথা আসামি করা হয়েছে।

মেঘনার সঙ্গে যুক্ত তেঁতুলিয়া নদী জাটকার আরেকটি বড় বিচরণ ক্ষেত্র। ভোলা ও পটুয়াখালীর বাউফল উপজেলা দিয়ে প্রবাহিত এ নদী থেকেও অবাধে জাটকা নিধন চলছে। তেঁতুলিয়ার নিমদিরচর, চরমোমিনপুর, মঠবাড়ী, চরওয়াডেল, বাঁশবাড়িয়া, শৌলারচর ও কালামিয়ার বাজার নিয়ন্ত্রণ এখন ইলিশ ব্যবসায়ী ও বাউফলের কেশবপুর ইউপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মো.

শাহজাহানের। চন্দ্রদ্বীপ ইউনিয়ন বিএনপির আহ্বায়ক বেলাল মিয়ার ইশারায় চলে চরমিজান, চরব্যারেট ও শৌলারচর এলাকা।

ইউপি চেয়ারম্যান মো. শাহজাহান ও বিএনপি নেতা বেল্লাল মিয়া অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, তেঁতুলিয়ায় জাটকা নিধন হয় না। শাহজাহানের দাবি, তিনি বর্ষা মৌসুমে বড় ইলিশের ব্যবসা করেন। বেলালের ভাষ্য, সাগরের মাছ নিয়েই তাঁর কারবার। যদিও ২০-২২ দিন আগে কিছু জেলে তেঁতুলিয়ায় জাটকা নিধন করেছিল বলে তিনি স্বীকার করেন। 

মৎস্য কর্মকর্তার সংযোগ

বাউফল উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা মাহবুব আলম ঝাণ্টা তালুকদার একই উপজেলার কেশবপুর ইউনিয়নের বাসিন্দা। স্থানীয় সূত্রগুলো জানায়, একই উপজেলায় তিনি প্রায় এক যুগ ধরে আছেন। যে কারণে মৎস্য ব্যবসায়ী ও জেলেদের সঙ্গে গড়ে উঠেছে সখ্য। এ সুযোগে নিধন হচ্ছে জাটকা। যদিও এই মৎস্য কর্মকর্তা তেঁতুলিয়ায় জাটকা নিধন হচ্ছে না বলে দাবি করেন। তাঁর ভাষ্য, তেঁতুলিয়ায় জাটকা নিধনবিরোধী অভিযান চলছে।

মোহনায়ও বিএনপি নেতারা

ভোলার চরফ্যাসন-মনপুরা ঘেঁষে ঢালচরে গিয়ে বঙ্গোপসাগরে পড়েছে মেঘনা। এ নদী ঘিরে ঢালচর, সমারাজঘাট বকশী, গাছিরখান, কচ্ছপিয়ায় ইলিশের বড় মোকাম গড়ে উঠেছে। অভিযোগ রয়েছে, মোকামগুলো এখন বিএনপি নেতাদের নিয়ন্ত্রণে। তাদের ছত্রছায়ায় জাটকা ও ইলিশ নিধন হচ্ছে। ঢালচর মাছঘাটের নিয়ন্ত্রক ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি জাহাঙ্গীর মাতবর। তিনিও জাটকা নিধনের অভিযোগ অস্বীকার করেন। চরফ্যাসনের অন্য মাছঘাটের দিকে আঙুল তুলে বলেন, সেখান থেকে প্রতিদিন শত শত মণ জাটকা সারাদেশে পাচার হচ্ছে। 

তবু সাফল্য দাবি কর্মকর্তাদের

জাটকা বিক্রি বন্ধে পদক্ষেপের বিষয়ে জানতে চাইলে মৎস্য অধিদপ্তরের বরিশাল বিভাগীয় জ্যেষ্ঠ সহকারী পরিচালক মো. আনিসুজ্জামান পাল্টা বিক্রির জায়গা সম্পর্কে জানতে চান। তাঁকে নগরের সব বাজার ও সড়কে প্রকাশ্যে বিক্রির বিষয়ে জানানো হলে তিনি বলেন, জেলা ও সদর উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তাকে ব্যবস্থা নিতে বলবেন।

ইলিশ সম্পদ ও উন্নয়ন ব্যবস্থাপনা প্রকল্প পরিচালক মোল্লা এমদাদুল্লাহ বলেন, গত সেপ্টেম্বর-অক্টোবর প্রজনন মৌসুমে জন্মানো ইলিশের আকার এখন ১০ সেন্টিমিটারের (প্রায় ৪ ইঞ্চি) বেশি। এ আকারের মোট জাটকার ৮০ ভাগ চাঁদপুরের হাইমচর ও বরিশালের হিজলা উপজেলা মেঘনার এবং মেহেন্দীগঞ্জের গজারিয়া কালবদর নদীতে বিচরণ করছে। অবশিষ্ট জাটকা তেঁতুলিয়ায়। জাটকা নিধনকারী জেলেদের নিয়ন্ত্রণে ৬০ ভাগের বেশি সাফল্য দাবি করেন মোল্লা এমদাদুল্লাহ। এর পরও চাপিলার মতো জাটকা ব্যাপক সংখ্যায় কীভাবে বাজারে আসছে– এর সদুত্তর দিতে পারেননি তিনি। 

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: বর শ ল ত ল য় য় জ টক স ব ক র কর ব যবস য় র বর শ ল র ন ব এনপ ব এনপ র ম ঘন র পর চ ল উপজ ল

এছাড়াও পড়ুন:

কুমিল্লায় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে ৩৫ কিলোমিটারজুটে যানজট

ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুমিল্লার নিমশার থেকে দাউদকান্দি পর্যন্ত প্রায় ৩৫ কিলোমিটারজুড়ে যানজট দেখা দিয়েছে। এতে ভোগান্তিতে পড়েছেন মহাসড়কে চলাচলকারী যাত্রী ও চালকেরা। নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে একটি কাভার্ড ভ্যান উল্টে যাওয়ায় আজ বৃহস্পতিবার ভোর থেকে এ যানজট দেখা দেয়। 

হাইওয়ে পুলিশ  জানায়, বৃহস্পতিবার ভোরে মহাসড়কে কুমিল্লার চান্দিনা উপজেলার নূরীতলা এলাকায় একটি কাভার্ড ভ্যান নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে উল্টে যায়। ফেনী থেকে রেকার এনে কাভার্ড ভ্যানটি উদ্ধারের কাজ শুরু করে পুলিশ। 

সকাল সাড়ে ১০টায় এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত মহাসড়কে যানজট দেখা গেছে। 

ঢাকাগামী রয়েল পরিবহনের চালক রমিজ উদ্দিন বলেন, সকাল সাড়ে ৮টায় ঢাকার উদ্দেশে রওয়ানা করে বুড়িচংয়ের নিমশার বাজারে যানজটে এক ঘণ্টা বসে থাকতে হয়েছে। ৫ মিনিট গাড়ি চললে ২০ মিনিট বসে থাকতে হয়। এভাবে ১০টা ৪০ মিনিটে চান্দিনায় পৌঁছেছি। এ সময়ে ঢাকার কাছাকাছি থাকার কথা ছিল। 

নিমশার বাজারে আটকে থাকা প্রাইভেট কারের যাত্রী তৌহিদুল ইসলাম বলেন, ভোর থেকে যানজট অথচ সড়কে হাইওয়ে পুলিশ দেখছি না। 

ইলিয়টগঞ্জ হাইওয়ে পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. রুহুল আমিন বলেন, মহাসড়কের নূরীতলা এলাকায় উল্টে কাভার্ড ভ্যানটি আড়াআড়িভাবে পড়ে ছিল। পরে ঢাকামুখী লেনের বেশ কিছু গাড়ি উল্টো পথে ঢোকায় যানজটের সৃষ্টি হয়েছে। ফেনী থেকে ক্রেন এনে গাড়িটি উদ্ধার করা হয়েছে। যান চলাচল স্বাভাবিক করার চেষ্টা চলছে। 

হাইওয়ে কুমিল্লা রিজিওনের পুলিশ সুপার অতিরিক্ত ডিআইজি মো. খাইরুল আলম সমকালকে বলেন, দুর্ঘটনার কারণেই যানজট দেখা দিয়েছে। দুর্ঘটনা কবলিত কাভার্ড ভ্যানটি উদ্ধার করা হয়েছে। যান চলাচল স্বাভাবিক হচ্ছে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ