দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) বর্তমান চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুল মোমেনের সঙ্গে পরিচয় লেখালেখির সূত্রে। বর্তমান দায়িত্বে আসার আগে নিয়মিত পত্রিকায় লিখতেন। পেশাগত কাজে সপ্তাহে অন্তত একবার তাঁর সঙ্গে ফোনালাপ হতো। একদিন বললেন, লেখা মেইল করার পরে আমরা যে ফোনালাপ করছি, এটা সংলাপ। আর লেখার টেবিলে একা-একা নিজের সঙ্গে যে কথা, সেটি হচ্ছে স্বগতোক্তি। সংলাপ হচ্ছে দ্বিপক্ষীয়। স্বগতোক্তি হচ্ছে নিজের সঙ্গে আলাপ। সংলাপ ফলপ্রসূ হওয়ার জন্য আলোচনায় অংশ নেওয়া উভয়ের আন্তরিকতা জরুরি। বিপরীতে স্বগতোক্তি সফলতা বা ব্যর্থতা দিয়ে নির্ণয়ের মতো বিষয় নয়। ব্যর্থ সংলাপের চেয়ে নিজের সঙ্গে বোঝাপড়া ভালো। 

পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ সূত্রে জানা যাচ্ছে, বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশের অন্যতম দুই রাজনৈতিক দল বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষ নেতাদের মধ্যে সাক্ষাৎ ও বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। যুক্তরাজ্যের লন্ডনে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া এবং ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা.

শফিকুর রহমান ও নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের। এ বৈঠক এমন সময়ে অনুষ্ঠিত হলো যখন বাংলাদেশে দুই দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা এবং তৃণমূল কর্মীদের মধ্যে বিভিন্ন ইস্যুতে পরস্পরবিরোধী অবস্থান ও বাগ্‌যুদ্ধ দেখা যাচ্ছে। ৫ আগস্টের পট পরিবর্তনের পর চিকিৎসার জন্য চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে লন্ডনে অবস্থান করছেন খালেদা জিয়া। দেশের রাজনীতিতে আলোচিত এক-এগারোর পট পরিবর্তনের পর থেকেই লন্ডনে রয়েছেন তারেক রহমান। চলতি এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে ইউরোপ সফরে যান জামায়াতের আমির ও নায়েবে আমির। সেখান থেকে লন্ডনে যান জামায়াতের এ দুই শীর্ষ নেতা। 

আওয়ামী লীগের দীর্ঘ শাসনামলে বিএনপি ও জামায়াত ক্ষমতার বাইরে থেকে লড়াই করেছে। শেখ হাসিনার ক্ষমতার শেষ মেয়াদে বিএনপি জোরালো আন্দোলনে মাঠে থাকলেও জামায়াতকে সেভাবে মাঠে সোচ্চার দেখা যায়নি। কিন্তু ৫ আগস্টের পট পরিবর্তনের পর দলটি বেশ তোড়জোড় করে মাঠে নামে। এই সময়ে বিএনপি ও জামায়াত নেতাদের পাল্টাপাল্টি বক্তব্যে রাজনীতির মাঠ উত্তপ্ত ছিল। অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর দুই দলের মধ্যে নির্বাচনের সময়সূচি এবং আরও কিছু নীতিগত বিষয়ে বেশ মতভিন্নতার খবর প্রকাশ্যে এসেছে। বিশেষ করে সামাজিক মাধ্যমে দুই দলের নেতাকর্মী ও সমর্থকদের পাল্টাপাল্টি অবস্থানকে সাইবার যুদ্ধের সঙ্গে তুলনা করা যায়। এমন পরিস্থিতিতে লন্ডনে দুই দলের শীর্ষ পর্যায়ের দেখাসাক্ষাৎ স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন তৈরি করেছে– বিএনপি এবং জামায়াত আবার কাছাকাছি আসবে কিনা। 

কয়েকটি বিষয় সামনে এলেই বিএনপি ও জামায়াতের লন্ডনের বৈঠক কী বার্তা দিল, ধারণা পাওয়া যেতে পারে। শুরু থেকেই ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন আয়োজনের দাবি করে আসছে বিএনপি। চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যেই জাতীয় নির্বাচন চায় তারা। বিএনপির এই দাবির পক্ষে রয়েছে আরও কয়েকটি রাজনৈতিক দল ও জোট। অন্যদিকে জামায়াতের দাবি ছিল, সংস্কার শেষে যৌক্তিক সময়ে নির্বাচন। এমনকি জামায়াতে ইসলামীর নেতারা একাধিকবার বলেছেন, রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ খাতে প্রয়োজনীয় সংস্কার করে স্থানীয় সরকার নির্বাচন, তারপর জাতীয় সংসদ নির্বাচন। কিন্তু লন্ডন বৈঠকের পর আগামী রমজানের আগেই সংসদ নির্বাচন চাইছেন জামায়াত নেতারা। এ বক্তব্যের মধ্য দিয়ে অবশেষে জামায়াতে ইসলামীর অবস্থান পরিবর্তন হয়েছে, দেখা যাচ্ছে। এখন নির্বাচন ইস্যুতে বিএনপির অবস্থানের প্রায় কাছাকাছি পর্যায়ে চলে এসেছে জামায়াত। ৫ আগস্টের পর সংস্কার ও নির্বাচন ইস্যুতে জামায়াতের অবস্থান ছিল বিএনপির বিপরীতমুখী। এখন জামায়াতে ইসলামীর আমির আগামী রমজানের আগেই সংসদ নির্বাচন হওয়া দরকার মর্মে যে বক্তব্য দিয়েছেন, সেটি বড় ধরনের পরিবর্তন। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, জামায়াতের আমিরের বক্তব্যের পেছনে লন্ডনের প্রভাব আছে। লন্ডনে বৈঠকে বরফ তো গলেছেই; দেখা গেল ঢাকায় বৃষ্টিও শুরু হয়েছে। 

ঢাকায় বৃষ্টির ধারা বিএনপি ও জামায়াতকে একই স্রোতে এনে দাঁড় করাবে কিনা– এমন প্রশ্ন যখন তৈরি হয়েছে তখন সম্পূরক প্রশ্ন হতে পারে, দুই দলের আবার ঐক্য হলে কারা লাভবান হবে? তারেক রহমানের নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ বিএনপি অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে এখন শক্তিশালী, এটা বিএনপির শত্রুও মেনে নেবেন। এই বিএনপির আগামী নির্বাচনে জামায়াতের সঙ্গে জোটবদ্ধ হওয়ার দরকার আছে কি? কিংবা স্বাধীন বাংলাদেশে নির্বাচনের ইতিহাস বিশ্লেষণ করে জামায়াতের প্রাপ্ত ভোটবাক্সের দিকে চোখ রাখলে জামায়াতকে ঠিক কত বড় দল হিসেবে গণ্য করা যায়? বর্তমান পরিস্থিতিতে বিএনপি নেতৃত্ব চেষ্টা করছেন গণতন্ত্রকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য, যাতে রাজনৈতিক দলগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করে নির্বাচনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়। জামায়াতের নির্বাচন নিয়ে বক্তব্য এবং মাঠের চিত্র কিন্তু উল্টো কথা বলছে। এটা আশা করি, বিএনপি এবং জামায়াত উভয় দলের নেতারাই স্বীকার করবেন। 

স্মরণ রাখতে হবে– রাষ্ট্রের মালিক জনগণ। জনগণের রায় বা মতামত নেওয়ার একমাত্র উপায় নির্বাচন। এখন পর্যন্ত এটিই সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য উপায়। বর্তমান সরকারের দায়িত্ব হলো রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে নির্বাচনে বিষয়ে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য রূপরেখা হাজির করা। নির্বাচন প্রশ্নে সরকার নিরপেক্ষ থাকবে, সেটাই রাজনৈতিক দল ও নাগরিকদের প্রত্যাশা। সে ক্ষেত্রে সরকারের দায়িত্ব নির্বাচন ও সংস্কার প্রশ্নে অর্থবহ সংলাপের পরিবেশ সৃষ্টি করা। বিএনপি এবং জামায়াত বর্তমান পরিস্থিতিতে বড় রাজনৈতিক শক্তি। এ দুটি দলের মধ্যে যে আলোচনা শুরুর ক্ষেত্রে তৈরি হতে দেখা গেল, তা রাজনীতিতে শুভকর হবে এমনটা আশা করা যায়। বিশেষত যখন নির্বাচনের সময় নিয়ে নানা অনৈক্য ও বিপরীতমুখী অবস্থানের খবরাখবর পাওয়া যাচ্ছে, তখন দুটি দল কাছাকাছি সময়ে নির্বাচনের দাবি জানানোর ঘটনা বর্তমান সরকারের জন্যও সহায়ক হবে। সরকারের পক্ষ থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে, ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন করার প্রস্তুতি তাদের আছে। এখন রাজনৈতিক দলগুলোকেই মোটাদাগে কতগুলো বিষয়ে একমত হতে হবে। বিএনপি এবং জামায়াত ছাড়াও অন্য রাজনৈতিক দলের এমন অবস্থান নেওয়া ঠিক হবে না, যাতে পুরো উদ্যোগই ভেস্তে যায়। 

দীর্ঘ আওয়ামী আমলে নির্বাচন ব্যবস্থা ধ্বংস হওয়ার পরে এখন একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য দেশবাসী অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন। নির্বাচন আয়োজনের বিষয়ে সমঝোতা হলে রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে যেসব অস্থিরতা আছে, সেগুলোও ধীরে ধীরে কেটে যাবে আশা করা যায়। সব রাজনৈতিক দলেরই লক্ষ্য থাকে রাষ্ট্রক্ষমতায় যাওয়া। সে ক্ষেত্রে নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার সাহস নিয়ে ঢাকার বৃষ্টিপাতে সদ্যসৃস্ট স্রোতে সাঁতার দিতে দেশের সব রাজনৈতিক দলের এগিয়ে আসা উচিত। 

এহ্‌সান মাহমুদ: সহকারী সম্পাদক, সমকাল; কথাসাহিত্যিক  

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: ব এনপ দ ই দল র সরক র র ইসল ম র ব এনপ র অবস থ ন র আম র র জন য রহম ন হওয় র

এছাড়াও পড়ুন:

জব্দ করা জাটকা এতিমখানায় বিতরণ, সেই মাছ লুট করলেন আড়তদারেরা

চাঁদপুরের মতলব উত্তর উপজেলায় জব্দ করা ৭০ কেজি জাটকা দুটি মাদ্রাসা ও এতিমখানায় বিতরণ করা হয়েছিল। তবে সেই মাছ লুট করে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে কয়েকজন আড়তদারের বিরুদ্ধে। গতকাল বুধবার সন্ধ্যায় উপজেলার আমিরাবাদ এলাকায় এ ঘটনা ঘটে।

উপজেলা মৎস্য কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, গতকাল বিকেলে মৎস্য কার্যালয়ের উদ্যোগে পরিচালিত জাটকা রক্ষার অভিযানে আমিরাবাদ ও দশানী বাজার থেকে ৭০ কেজি জাটকা জব্দ করা হয়। অভিযান পরিচালনা করেন মৎস্য কর্মকর্তা বিজয় কুমার দাস। পরে আমিরাবাদ এলাকায় জব্দ করা জাটকা উপজেলার হাজীপুর ও ফরাজীকান্দি মাদ্রাসা ও এতিমখানার শিক্ষক ও ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্যদের হাতে তুলে দেওয়া হয়। স্থানীয় কিছু দুস্থ মানুষকেও কিছু জাটকা দেওয়া হয়।

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, ওই জাটকা নিয়ে ওই দুই মাদ্রাসার শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও কমিটির লোকজন সন্ধ্যায় আমিরাবাদের বেড়িবাঁধ এলাকায় পৌঁছান। তখন আমিরাবাদ বাজারের মাছের আড়তদার আবুল প্রধান, আরিফ গাজী, সেরু প্রধানিয়া, দেলু বেপারীসহ আরও কয়েকজন তাঁদের পথরোধ করেন এবং জাটকাগুলো লুট করে নিয়ে যান।

হাজীপুর মাদ্রাসার ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি জাহাঙ্গীর আলম ও ফরাজীকান্দি মাদ্রাসার শিক্ষক মো. আল আমিন অভিযোগ করেন, মাছের ওই আড়তদারেরা তাঁদের নানাভাবে ভয়ভীতি ও হুমকি দিয়ে তাঁদের কাছ থেকে জাটকা লুট করে নিয়ে যান। বাধা দিয়েও কাজ হয়নি। বিষয়টি মৎস্য কর্মকর্তা ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে (ইউএনও) জানিয়েছেন।

এ অভিযোগের বিষয়ে আবুল প্রধান, আরিফ গাজী ও সেরু প্রধানিয়ার মুঠোফোন নম্বরে যোগাযোগ করা হলে সংযোগ বন্ধ পাওয়া যায়। তবে দেলু ব্যাপারী মুঠোফোনে বলেন, জাটকা লুট করা তাঁদের উচিত হয়নি। ওই জাটকা আজ (বৃহস্পতিবার) তাঁরা ফেরত দেবেন। এটি তাঁদের বড় ভুল হয়েছে।

উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা বিজয় কুমার দাস বলেন, বিষয়টি জানার পর ঘটনাস্থলে গিয়েছেন। জাটকা উদ্ধারে ব্যবস্থাপনা নেওয়া হচ্ছে।

ইউএনও মাহমুদা কুলসুম মনি বলেন, অভিযোগ পাওয়ার পর জাটকা উদ্ধারে তিনি থানার ওসি ও মৎস্য কর্মকর্তাকে নির্দেশ দিয়েছেন। বিষয়টির তদন্ত চলছে। এ ব্যাপারে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এতিমদের জাটকা লুট হওয়ার বিষয়টি খুব দুঃখজনক।

সম্পর্কিত নিবন্ধ