অবিশ্বাস্য যে মাত্র পাঁচ বছর বয়সে মাকে গ্রামে রেখে আমি ঢাকায় চলে আসি বাবার হাত ধরে, ১৯৬৪ সালে। এরপর ১৯৬৭ পর্যন্ত আমার শৈশবের আবাস ছিল আবদুল গণি রোডের রেল কলোনির বাসা। এই চার বছরের কত যে স্মৃতির মণিমুক্তা এখনো মানসপটে ঝলমলিয়ে ওঠে। এখন যেখানে একটি কালো স্টিম ইঞ্জিন অ্যান্টিক হিসেবে স্থাপন করা আছে, ঠিক সেখানটায় ছিল আমাদের বাসা। বিশাল আকৃতির এক বাংলো ছিল এটি, আর ছিল লাল মাটিতে বাগান করার সুপ্রশস্ত জমি।
প্রতিবারই বাজিতপুরের সরারচর স্টেশন থেকে ট্রেনে উঠে ঢাকার ফুলবাড়িয়ায় নেমে সামান্য পথ অতিক্রম করে আসতাম ট্যাক্সিতে। প্রথমে এই রোডের নাম ‘আবদুল গণি রোড’ শুনে বিস্ময় জেগেছিল। কারণ, আমার বাবার নামও ছিল তা-ই। আমাদের চার বোনের বিয়ে হয়ে যাওয়ায় পরের তিন বোন (হুসনা, জ্যোৎস্না, আসমা) এবং চার ভাই (আমি ছাড়া মহিউদ্দিন, নূরুদ্দিন, মঈনউদ্দিন) বাবার অবসর গ্রহণ পর্যন্ত এ বাসাতেই ছিলাম।
আমার চেয়ে আড়াই বছরের ছোট ভাই মহিউদ্দিনকে নিয়ে রেল কর্মচারী আবদুল আলীর হাত ধরে ওসমানী উদ্যানের ভেতর দিয়ে আমরা যেতাম স্কুলে। রেলের এ স্কুলের নাম ইমতিয়াজ আকবর প্রাইমারি স্কুল। যা এখন আর নেই, যেমন নেই পুরো কলোনি।
পরীক্ষায় প্রথম হওয়ায় আমি হয়ে যাই ক্লাস ক্যাপ্টেন, আর ছিল আমার বন্ধু রুকুন। আমরা ক্লাসের হইচই থামানোর জন্য শিক্ষকদের নির্দেশনায় বেত ও কাঠের স্কেল দেখিয়ে সহপাঠীদের চুপ করাতাম। আমাদের ফরসা ও ভরাট কণ্ঠের বড় আপা ছিলেন খুবই কড়া। একদিন অনুমতি না নিয়ে চলে যাওয়ায় কাউকে কাউকে বাসা থেকে ডেকে এনে হাতের তালুতে তিনি বেত্রাঘাত করেছিলেন। আমার সুন্দরী সহপাঠী নাজমার হাতের রক্তিম তালু দেখে তখন কান্না পেয়েছিল।
বাসাটির এক পাশের সবজি ও ফুলের বিশাল বাগানে একবার নিজ হাতে আমরা আখ ফলিয়েছিলাম। রেলের মালিরা তাতে বপন ও রোপণ করতেন ভুট্টা, বিট, কপি, গাজর, শালগম, মুলা, টমেটো, মেস্তা ও পালংশাক। শীতকালে ডালিয়া, কসমস ও দোপাটি ফুলের ওপর জমে থাকা শিশির দেখে আমার চোখে মায়া জাগত। আমাদের পাচক বিদ্বানের আনা ডিমওয়ালা ইলিশ মাছ এ বাগানের কাঁচকলা দিয়েই রান্না হতো। কীটপতঙ্গ ও বিষাক্ত পোকা পরিবেষ্টিত হয়েই এ বাসায় আমাদের বসবাস ছিল। গেটের মধুমঞ্জরি ফুলের ঝোপের একেকটি পোকা মাটিতে নেমে যেভাবে কিলবিল করে হাঁটত, তা দেখেই ভয়ে আড়ষ্ট হতাম। অ্যালার্জির কারণে আমাদের কোনো কোনো ভাইবোনের মুখমণ্ডল ফুলে গেলে আমরা লাল পিঁপড়ার মাটি ডলে দিতাম।
আবাসের দেয়ালের বাইরের ল্যাট্রিনটি ছিল নিচের দিকে খোলা। তাতে বড় কড়াইয়ের মতো একটি পাত্র রাখা থাকত। ওই পাত্রে জমে থাকা বর্জ্য দু-এক দিন পরপর ধাঙড়রা এসে নিয়ে যেত। সারা দিনই বাসার বাইরে আইসক্রিমওয়ালাসহ শত ফেরিওয়ালার কণ্ঠস্বর শুনতাম। আর শুনতাম চামড়ার থলেতে পানি বিক্রি করা ভিস্তিওয়ালাদের হাঁকাহাঁকি-ভিস্তি.
আব্বা ছিলেন রেলের আইওডব্লিউ পদে। রাস্তায় বের হলে লোকজন সমীহ করে কথা বলতেন। আমরা বাসার পাশের ফুটপাত ধরে বাবার সঙ্গে যেতাম সচিবালয়-সংলগ্ন বিহারিদের সেলুনগুলোতে চুল কাটাতে। তখন সচিবালয় ও বিদ্যুৎ ভবনের মাঝখানের রাস্তাটি ছিল এক বিরাট নর্দমা। সেটির পূর্ব পাশেই পাটাতনের ওপর ছিল অবাঙালিদের সেলুনগুলো। কখনো বিকেল বা সন্ধ্যায় এই ফুটপাত দিয়ে হেঁটে যেতে দেখতাম চীনাদের। বাবা বলতেন, এরা তো কাঠি দিয়ে ভাত খায়। তখন আমাদের বিস্ময়ের অন্ত ছিল না। বাবার হাত ধরে বা বেবিট্যাক্সিতে করে আমরা যেতাম নিউমার্কেট, ঘোড়দৌড়ের রেসকোর্স, রমনা পার্ক, চিড়িয়াখানা (বর্তমান ঈদগাহ)। আর যেতাম গভর্নর হাউসের (বর্তমান বঙ্গভবন) হাতি দেখতে। মোনায়েম খানের আবাস ওই হাউসের নিরাপত্তা প্রহরী আমাদের চিনতেন। মিল্কশেক খেতে যাওয়া হতো ঝলমলে বায়তুল মোকাররমে। তখন জিন্নাহ অ্যাভিনিউতে জিপিওর ভেতরটা ছিল একেবারেই ঝকঝকে তকতকে। আমি মাতামহ আবদুর রশিদের হাত ধরে নিমতলীর জাদুঘরে গিয়ে ট্যাক্সিডার্মি (Taxidermy) করা বাঘ দেখে ভয়ে আঁতকে উঠেছিলাম।
সে সময়কার রাজনৈতিক পরিস্থিতি মোটেও স্বাভাবিক ছিল না। আমার স্মৃতিতে আছে, ১৯৬৪ সালের দাঙ্গার ভীতি, ভয়জাগানিয়া ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ, বাসার সামনে ট্রেন্স (পরিখা) খনন, রাতের ব্ল্যাকআউট ও সাইরেন। আর মনে আছে প্রেসিডেনশিয়াল ইলেকশন, ১৯৬৬ সালের আন্দোলন, শিক্ষা ভবন ঘেরাও এবং আইয়ুব খানের ছবিতে আলকাতরা লেপন। অসুখবিসুখে দাগ দেওয়া বোতলের লাল মিক্সচারের তিক্ত স্বাদ ও ফোড়া হলে নিতম্বে ইনজেকশন পুশ করার কষ্টকর স্মৃতিও মনে পড়ে।
সবই একে একে মনে পড়ে যায় এখনো দাঁড়িয়ে থাকা কালো ইঞ্জিনটা দেখলে।
গোলাম শফিক, সিদ্ধেশ্বরী রোড, ঢাকা
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: আম দ র
এছাড়াও পড়ুন:
দুনিয়ায় প্রত্যেক মুসলিমকে যেসব পরীক্ষার মধ্য দিয়ে যেতে হবে
জীবন একটি পরীক্ষার ময়দান, যেখানে আমরা বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ ও কষ্টের মুখোমুখি হই। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘আমি অবশ্যই তোমাদের পরীক্ষা করব কিছু ভয়, ক্ষুধা, সম্পদের ক্ষতি, জীবন ও ফসলের ক্ষতি দিয়ে। আর যারা ধৈর্য ধরে, তাদের সুসংবাদ দাও।’ (সুরা বাকারা, আয়াত: ১৫৫)
এই পরীক্ষাগুলো প্রায়ই আমাদের হতাশ বা বিমর্ষ করে তুলতে পারে, কিন্তু ইসলাম আমাদের শেখায় যে এই কষ্টগুলো আল্লাহর নৈকট্য লাভের মাধ্যম এবং পরকালে চিরস্থায়ী সুখের পথ প্রশস্ত করে। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘এই দুনিয়ার জীবন তো কেবল ক্ষণস্থায়ী ভোগ, আর পরকালই হলো চিরস্থায়ী আবাস।’ (সুরা গাফির, আয়াত: ৩৯)
পরীক্ষার উদ্দেশ্যইসলামে পরীক্ষা বা কষ্টকে আল্লাহর রহমতের অংশ হিসেবে দেখা হয়। এগুলো আমাদের পাপ থেকে মুক্তি, আল্লাহর ওপর নির্ভরতা বৃদ্ধি, নিজেকে নম্র করা এবং তাঁর নৈকট্য লাভের মাধ্যম।
আমি অবশ্যই তোমাদের পরীক্ষা করব কিছু ভয়, ক্ষুধা, সম্পদের ক্ষতি, জীবন ও ফসলের ক্ষতি দিয়ে। আর যারা ধৈর্য ধরে, তাদের সুসংবাদ দাও।সুরা বাকারা, আয়াত: ১৫৫পরীক্ষা আমাদের ধৈর্য ও বিশ্বাস যাচাই করে এবং এর মাধ্যমে আমরা আল্লাহর কাছে উচ্চ মর্যাদা লাভ করতে পারি। নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘যখনই তুমি আল্লাহর জন্য কিছু ত্যাগ করবে, আল্লাহ তা তোমার জন্য আরও উত্তম কিছু দিয়ে প্রতিস্থাপন করবেন।’ (মুসনাদে আহমদ, হাদিস: ২৩,০৭৪)
আরও পড়ুনযে ৪টি পরীক্ষা নবীজি (সা.)–এর জীবনকে দৃঢ়তা দিয়েছে২২ জুলাই ২০২৫পরীক্ষার মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্যদুনিয়ার জীবন সাময়িক এবং এর কষ্টগুলো ক্ষণস্থায়ী। আমরা প্রায়ই দুনিয়ার সমস্যায়, যেমন অর্থনৈতিক সংকট, সম্পর্কের জটিলতা বা সামাজিক চাপ, এতটাই মগ্ন হয়ে পড়ি যে আমাদের মূল উদ্দেশ্য ভুলে যাই। পবিত্র কোরআন আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়, ‘কিন্তু যে ব্যক্তি তার প্রভুর সামনে দাঁড়ানোর ভয় করেছে এবং নিজের নফসকে অবৈধ কামনা থেকে বিরত রেখেছে, তার জন্য জান্নাতই হবে আশ্রয়।’ (সুরা নাজিয়াত, আয়াত: ৪০–৪১)
ইবন কাইয়্যিম (রহ.) বলেছেন, ‘যদি আল্লাহ তাঁর বান্দার জন্য পর্দা তুলে দিতেন এবং তাকে দেখাতেন, কীভাবে তিনি তার জন্য সবকিছু পরিচালনা করেন, তবে তার হৃদয় আল্লাহর প্রতি ভালোবাসায় গলে যেত এবং কৃতজ্ঞতায় টুকরা টুকরা হয়ে যেত। তাই যদি দুনিয়ার কষ্ট তোমাকে ক্লান্ত করে, তবে দুঃখ করো না। হয়তো আল্লাহ তোমার দোয়ার কণ্ঠ শুনতে চান।’ (ইবন কাইয়্যিম, আল–ফাওয়ায়িদ, পৃষ্ঠা ১২৮, বৈরুত: দারুল কুতুব আল–ইলমিয়্যাহ, ১৯৯৬)
পরীক্ষা আমাদের ধৈর্য ও বিশ্বাস যাচাই করে এবং এর মাধ্যমে আমরা আল্লাহর কাছে উচ্চ মর্যাদা লাভ করতে পারি।পরীক্ষা আমাদের আল্লাহর কাছাকাছি নিয়ে যায়। এটি আমাদের নম্র করে, আমাদের পাপমুক্তি ঘটায় এবং আল্লাহর ওপর নির্ভরতা বাড়ায়। নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘দুনিয়ায় যে ব্যক্তি সবচেয়ে বেশি কষ্ট ও পরীক্ষার মধ্য দিয়ে গেছে, তাকে জান্নাতে একবার ডুবিয়ে দেওয়া হবে এবং জিজ্ঞাসা করা হবে, ‘হে আদম সন্তান, তুমি কি কখনো কোনো কষ্ট দেখেছিলে? তুমি কি কখনো দুঃখ অনুভব করেছিলে?’ সে বলবে, ‘না, হে আমার রব! আমি কখনো কোনো কষ্ট দেখিনি, কখনো কোনো দুঃখ অনুভব করিনি।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস নম্বর–২৮০৭)
আরও পড়ুনবালকের ঈমানের পরীক্ষা ও বাদশাহের নির্মম পরিণতি০৪ মে ২০২৪আল্লাহর পরিকল্পনায় ভরসাপরীক্ষার সময় মনে রাখতে হবে যে আল্লাহর পরিকল্পনা আমাদের পরিকল্পনার চেয়ে উত্তম। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘হয়তো তোমরা এমন কিছু অপছন্দ করো, যা তোমাদের জন্য কল্যাণকর। আর এমন কিছু পছন্দ করো, যা তোমাদের জন্য ক্ষতিকর। আল্লাহ জানেন, আর তোমরা জানো না।’ (সুরা বাকারা, আয়াত: ২১৬)
এই আয়াত আমাদের শেখায় যে কষ্টের পেছনে আল্লাহর একটি বৃহত্তর উদ্দেশ্য রয়েছে।
হয়তো তোমরা এমন কিছু অপছন্দ করো, যা তোমাদের জন্য কল্যাণকর। আর এমন কিছু পছন্দ করো, যা তোমাদের জন্য ক্ষতিকর। আল্লাহ জানেন, আর তোমরা জানো না।সুরা বাকারা, আয়াত: ২১৬আরেকটি হাদিসে বলা হয়েছে, ‘যে ব্যক্তি পরকালের জন্য চিন্তিত থাকে, আল্লাহ তার বিষয়গুলো সহজ করে দেবেন, তার হৃদয়ে তৃপ্তি দেবেন এবং দুনিয়া তার কাছে আসবে, যদিও সে তা অপছন্দ করে।’ (ইবন মাজাহ, হাদিস: ৪১০৫)
পরীক্ষায় ধৈর্য ও দোয়াপরীক্ষার সময় ধৈর্য ধরা এবং আল্লাহর কাছে দোয়া করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর ওপর ভরসা করে, তিনি তার জন্য যথেষ্ট।’ (সুরা তালাক, আয়াত: ৩) দোয়ার মাধ্যমে আমরা আমাদের হৃদয়ের কথা আল্লাহর কাছে প্রকাশ করি এবং তাঁর রহমতের জন্য আশ্রয় প্রার্থনা করি।
ইবন কাইয়্যিম (রহ.) বলেছেন, ‘যদি দুনিয়ার কষ্ট তোমাকে ক্লান্ত করে, তবে সিজদায় তোমার আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করো এবং জেনে রাখো, আল্লাহ কখনো ভোলেন না।’ (আল–ফাওয়ায়িদ, পৃষ্ঠা ১৩০, বৈরুত: দারুল কুতুব আল–ইলমিয়্যাহ, ১৯৯৬)
আমরা যদি আল্লাহকে আমাদের হৃদয়ের কেন্দ্রে রাখি, তবে কোনো পরীক্ষাই আমাদের ভেঙে দিতে পারবে না।জীবনের পরীক্ষাগুলো আমাদের আল্লাহর কাছাকাছি নিয়ে যায়, আমাদের হৃদয়কে বিশুদ্ধ করে এবং পরকালে জান্নাত লাভের পথ প্রশস্ত করে। দুনিয়ার কষ্ট ক্ষণস্থায়ী, কিন্তু আল্লাহর ভালোবাসা ও রহমত চিরস্থায়ী।
আমরা যদি আল্লাহকে আমাদের হৃদয়ের কেন্দ্রে রাখি, তবে কোনো পরীক্ষাই আমাদের ভেঙে দিতে পারবে না; বরং নবীজি (সা.)–এর শিক্ষা ও ধৈর্য, দোয়া এবং আল্লাহর ওপর ভরসার মাধ্যমে আমরা জীবনের প্রতিটি পরীক্ষায় বিজয়ী হতে পারব।
আরও পড়ুনত্যাগের পরীক্ষা, সফলতার উদ্যাপন০১ আগস্ট ২০২০