Prothomalo:
2025-05-01@00:04:41 GMT

রেল কলোনির স্মৃতি

Published: 19th, April 2025 GMT

অবিশ্বাস্য যে মাত্র পাঁচ বছর বয়সে মাকে গ্রামে রেখে আমি ঢাকায় চলে আসি বাবার হাত ধরে, ১৯৬৪ সালে। এরপর ১৯৬৭ পর্যন্ত আমার শৈশবের আবাস ছিল আবদুল গণি রোডের রেল কলোনির বাসা। এই চার বছরের কত যে স্মৃতির মণিমুক্তা এখনো মানসপটে ঝলমলিয়ে ওঠে। এখন যেখানে একটি কালো স্টিম ইঞ্জিন অ্যান্টিক হিসেবে স্থাপন করা আছে, ঠিক সেখানটায় ছিল আমাদের বাসা। বিশাল আকৃতির এক বাংলো ছিল এটি, আর ছিল লাল মাটিতে বাগান করার সুপ্রশস্ত জমি।

প্রতিবারই বাজিতপুরের সরারচর স্টেশন থেকে ট্রেনে উঠে ঢাকার ফুলবাড়িয়ায় নেমে সামান্য পথ অতিক্রম করে আসতাম ট্যাক্সিতে। প্রথমে এই রোডের নাম ‘আবদুল গণি রোড’ শুনে বিস্ময় জেগেছিল। কারণ, আমার বাবার নামও ছিল তা-ই। আমাদের চার বোনের বিয়ে হয়ে যাওয়ায় পরের তিন বোন (হুসনা, জ্যোৎস্না, আসমা) এবং চার ভাই (আমি ছাড়া মহিউদ্দিন, নূরুদ্দিন, মঈনউদ্দিন) বাবার অবসর গ্রহণ পর্যন্ত এ বাসাতেই ছিলাম।

আমার চেয়ে আড়াই বছরের ছোট ভাই মহিউদ্দিনকে নিয়ে রেল কর্মচারী আবদুল আলীর হাত ধরে ওসমানী উদ্যানের ভেতর দিয়ে আমরা যেতাম স্কুলে। রেলের এ স্কুলের নাম ইমতিয়াজ আকবর প্রাইমারি স্কুল। যা এখন আর নেই, যেমন নেই পুরো কলোনি।

পরীক্ষায় প্রথম হওয়ায় আমি হয়ে যাই ক্লাস ক্যাপ্টেন, আর ছিল আমার বন্ধু রুকুন। আমরা ক্লাসের হইচই থামানোর জন্য শিক্ষকদের নির্দেশনায় বেত ও কাঠের স্কেল দেখিয়ে সহপাঠীদের চুপ করাতাম। আমাদের ফরসা ও ভরাট কণ্ঠের বড় আপা ছিলেন খুবই কড়া। একদিন অনুমতি না নিয়ে চলে যাওয়ায় কাউকে কাউকে বাসা থেকে ডেকে এনে হাতের তালুতে তিনি বেত্রাঘাত করেছিলেন। আমার সুন্দরী সহপাঠী নাজমার হাতের রক্তিম তালু দেখে তখন কান্না পেয়েছিল।

বাসাটির এক পাশের সবজি ও ফুলের বিশাল বাগানে একবার নিজ হাতে আমরা আখ ফলিয়েছিলাম। রেলের মালিরা তাতে বপন ও রোপণ করতেন ভুট্টা, বিট, কপি, গাজর, শালগম, মুলা, টমেটো, মেস্তা ও পালংশাক। শীতকালে ডালিয়া, কসমস ও দোপাটি ফুলের ওপর জমে থাকা শিশির দেখে আমার চোখে মায়া জাগত। আমাদের পাচক বিদ্বানের আনা ডিমওয়ালা ইলিশ মাছ এ বাগানের কাঁচকলা দিয়েই রান্না হতো। কীটপতঙ্গ ও বিষাক্ত পোকা পরিবেষ্টিত হয়েই এ বাসায় আমাদের বসবাস ছিল। গেটের মধুমঞ্জরি ফুলের ঝোপের একেকটি পোকা মাটিতে নেমে যেভাবে কিলবিল করে হাঁটত, তা দেখেই ভয়ে আড়ষ্ট হতাম। অ্যালার্জির কারণে আমাদের কোনো কোনো ভাইবোনের মুখমণ্ডল ফুলে গেলে আমরা লাল পিঁপড়ার মাটি ডলে দিতাম।

আবাসের দেয়ালের বাইরের ল্যাট্রিনটি ছিল নিচের দিকে খোলা। তাতে বড় কড়াইয়ের মতো একটি পাত্র রাখা থাকত। ওই পাত্রে জমে থাকা বর্জ্য দু-এক দিন পরপর ধাঙড়রা এসে নিয়ে যেত। সারা দিনই বাসার বাইরে আইসক্রিমওয়ালাসহ শত ফেরিওয়ালার কণ্ঠস্বর শুনতাম। আর শুনতাম চামড়ার থলেতে পানি বিক্রি করা ভিস্তিওয়ালাদের হাঁকাহাঁকি-ভিস্তি.

..আবে...ভিস্তি...।

আব্বা ছিলেন রেলের আইওডব্লিউ পদে। রাস্তায় বের হলে লোকজন সমীহ করে কথা বলতেন। আমরা বাসার পাশের ফুটপাত ধরে বাবার সঙ্গে যেতাম সচিবালয়-সংলগ্ন বিহারিদের সেলুনগুলোতে চুল কাটাতে। তখন সচিবালয় ও বিদ্যুৎ ভবনের মাঝখানের রাস্তাটি ছিল এক বিরাট নর্দমা। সেটির পূর্ব পাশেই পাটাতনের ওপর ছিল অবাঙালিদের সেলুনগুলো। কখনো বিকেল বা সন্ধ্যায় এই ফুটপাত দিয়ে হেঁটে যেতে দেখতাম চীনাদের। বাবা বলতেন, এরা তো কাঠি দিয়ে ভাত খায়। তখন আমাদের বিস্ময়ের অন্ত ছিল না। বাবার হাত ধরে বা বেবিট্যাক্সিতে করে আমরা যেতাম নিউমার্কেট, ঘোড়দৌড়ের রেসকোর্স, রমনা পার্ক, চিড়িয়াখানা (বর্তমান ঈদগাহ)। আর যেতাম গভর্নর হাউসের (বর্তমান বঙ্গভবন) হাতি দেখতে। মোনায়েম খানের আবাস ওই হাউসের নিরাপত্তা প্রহরী আমাদের চিনতেন। মিল্কশেক খেতে যাওয়া হতো ঝলমলে বায়তুল মোকাররমে। তখন জিন্নাহ অ্যাভিনিউতে জিপিওর ভেতরটা ছিল একেবারেই ঝকঝকে তকতকে। আমি মাতামহ আবদুর রশিদের হাত ধরে নিমতলীর জাদুঘরে গিয়ে ট্যাক্সিডার্মি (Taxidermy) করা বাঘ দেখে ভয়ে আঁতকে উঠেছিলাম।

সে সময়কার রাজনৈতিক পরিস্থিতি মোটেও স্বাভাবিক ছিল না। আমার স্মৃতিতে আছে, ১৯৬৪ সালের দাঙ্গার ভীতি, ভয়জাগানিয়া ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ, বাসার সামনে ট্রেন্স (পরিখা) খনন, রাতের ব্ল্যাকআউট ও সাইরেন। আর মনে আছে প্রেসিডেনশিয়াল ইলেকশন, ১৯৬৬ সালের আন্দোলন, শিক্ষা ভবন ঘেরাও এবং আইয়ুব খানের ছবিতে আলকাতরা লেপন। অসুখবিসুখে দাগ দেওয়া বোতলের লাল মিক্সচারের তিক্ত স্বাদ ও ফোড়া হলে নিতম্বে ইনজেকশন পুশ করার কষ্টকর স্মৃতিও মনে পড়ে।

সবই একে একে মনে পড়ে যায় এখনো দাঁড়িয়ে থাকা কালো ইঞ্জিনটা দেখলে।

গোলাম শফিক, সিদ্ধেশ্বরী রোড, ঢাকা

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: আম দ র

এছাড়াও পড়ুন:

রঙিন ঝলমলে আকাশ থেকে নিভে যাচ্ছে তারার আলো

অস্থির সময় পার করছে মিডিয়াঙ্গন। যেসব শিল্পী এক সময় টেলিভিশন পর্দা, সিনেমা হল কিংবা মঞ্চ মাতিয়ে রেখেছেন, আজ তাদের অনেকেই আড়ালে। অনেকে রাজনীতির মারপ্যাচে আটকেছেন, মামলায় জড়িয়েছেন, কেউ পারিবারিক টানাপোড়েন, কেউ আবার সংসারে জড়িয়ে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছেন আলো ঝলমলে জগৎ থেকে। ফলে বিনোদন জগৎ এখন অনেকটাই নিষ্প্রভ। 
রাজনৈতিক মামলা-হামলা ও হয়রানি: সৃজনশীলতার মৃত্যু?

অভিনয়শিল্পী সমাজের আয়না। কিন্তু যখন তাদের উপর রাজনৈতিক চাপ সৃষ্টি হয় এবং সেই আয়নায় দাগ পড়ে তখন শিল্পী কার্যত থেমে যান। গত কিছু বছরে আমাদের দেশে বহু নামকরা শিল্পী রাজনৈতিক মামলায় জড়িয়েছেন। কেউ সরকারবিরোধী মন্তব্য করে বিপাকে পড়েছেন, কেউ আবার দলের কোন্দলে পড়ার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। এই পরিস্থিতি তাদের ক্যারিয়ার এবং মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলেছে।

সম্প্রতি দেশের ১৭ জন খ্যাতনামা অভিনয়শিল্পীর বিরুদ্ধে হত্যাচেষ্টা মামলার অভিযোগ গৃহীত হয়েছে। তাদের মধ্যে রয়েছেন সুবর্ণা মুস্তাফা, মেহের আফরোজ শাওন, নুসরাত ফারিয়া, জায়েদ খান, অপু বিশ্বাস,আশনা হাবিব ভাবনা, আজিজুল হাকিম, নিপুণ, শাহনূর, জ্যোতিকা জ্যোতি, সোহানা সাবা, ঊর্মিলা শ্রাবন্তী কর, তানভিন সুইটি, জাকিয়া মুন, সাইমন সাদিক, রোকেয়া প্রাচী, তারিন জাহানসহ ১৭জন। এই ঘটনায় মিডিয়াঙ্গনে তৈরি হয়েছে চরম উদ্বেগ। অভিনেতা সিদ্দিকের ওপর হামলা এবং পরে তাকে থানায় সোপর্দ করার ঘটনা গোটা মিডিয়াকে নাড়িয়ে দিয়েছে। প্রতিবাদ করে ফেসবুকে পোস্টে করেছেন অনেকেই। বিষয়টি নিয়ে গণমাধ্যমে অভিনয়শিল্পী সংঘের সভাপতি আজাদ আবুল কালাম বলেন, “এভাবে মামলা দেওয়ার প্রবণতার বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলা প্রয়োজন। সরকারের, বিশেষ করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উচিত হবে এ ধরনের হয়রানি প্রতিরোধে কার্যকর ভূমিকা রাখা।”

এর আগে শাহরিয়ার নাজিম জয় ও জায়েদ খানের নামে মামলা করা হয়। এসব শিল্পীর মধ্যে কেউ কেউ অতিকথনের কারণে আবার কেউ রাজনৈতিক দল সমর্থন করার কারণে মামলা-হামলার শিকার হচ্ছেন। এর উল্টোটাও ঘটছে। মনির খান, আসিফ আকবর, কনকচাঁপা, বেবি নাজনিনসহ বেশ কিছু শিল্পী দীর্ঘদিন ধরে কোনঠাসা হয়ে ছিলেন। কালো তালিকা করে রাখা হয়েছিলো একঝাঁক তারকাদের। শিল্প-সংস্কৃতি অঙ্গনে এসব কখনও কাম্য নয়। 

রাজনৈতিক মামলা ছাড়াও ব্যক্তিগত ইস্যু ঘিরেও মামলা-মোকদ্দমায় জড়িয়েছেন অনেকে। পরীমণি, মাহিয়া মাহি প্রমুখ তারকা নিজেদের ব্যক্তিগত জীবনের নানা জটিলতা নিয়ে আদালত পর্যন্ত যেতে বাধ্য হয়েছেন। এতে তাদের পেশাগত ব্যস্ততা ব্যাহত হওয়ার পাশাপাশি শিল্পীদের সম্পর্কে মানুষের মনে নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়েছে। 

এই পরিস্থিতি এক ভয়ানক ট্রেন্ডের দিকে ইঙ্গিত করে—‘ভয়ের সংস্কৃতি’। যেখানে একজন শিল্পী স্বাধীনভাবে মত প্রকাশ করতে ভয় পান, কারণ তিনি জানেন, পরদিন হয়তো তাকে আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে। যা সৃষ্টিশীলতার জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর।

এভাবে একে একে নিভে যাচ্ছে তারার আলো। রাজনৈতিক চাপ, সামাজিক হয়রানি, এবং ব্যক্তিগত দুর্ভোগ মিলে আজকের অনেক শিল্পী মিডিয়া থেকে দূরে সরে যাচ্ছেন। নাটক কিংবা সিনেমায় এখন শিল্পী খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। হঠাৎ করে নতুন শিল্পীও তৈরি করা সম্ভব নয়। এভাবে চলতে থাকলে দেশীয় সংস্কৃতি অঙ্গন তারকা শূন্য হয়ে পরবে।   

স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় অপরাধীর বিচার চাওয়ার পাশাপাশি সাংস্কৃতিক সংহতি, আইনি সহায়তা, এবং সামাজিক সমর্থনের মাধ্যমে নিরাপরাধ তারকাদের ফিরে আসার পথ সুগম করলে সাংস্কৃতিক অঙ্গন ঘুরে দাঁড়াবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।  

ব্যক্তিগত জীবনের সংকট: স্ক্যান্ডেল, বিচ্ছেদ, সামাজিক লজ্জা

মিডিয়া সবসময়ই তারকাদের ব্যক্তিগত জীবনে উঁকি দিতে ভালোবাসে। সম্পর্কের টানাপোড়েন, বিচ্ছেদ, অতীত প্রেম, এমনকি ব্যক্তিগত ছবি, ভিডিও ফাঁস হয়ে যাওয়ার মতো ঘটনায় একজন শিল্পী সহজেই হয়ে উঠতে পারেন ‘ভুলে যাওয়া নাম’। অনেকে এই কারণেই স্বেচ্ছা নির্বাসনে চলে যান। 

সংসার জীবন: ক্যারিয়ার বনাম পরিবার

অনেক প্রতিভাবান নারী শিল্পী বিশেষ করে সংসার জীবনে ঢুকে পড়ার পর মিডিয়া থেকে সরে দাঁড়ান। মাতৃত্ব, দায়িত্ব, পারিবারিক সীমাবদ্ধতা— এসব তাদের আবার পর্দায় ফেরার পথ কঠিন করে তোলে। এই তালিকায় রয়েছেন মৌসুমী, শাবনূর, পূর্ণিমা, অপু বিশ্বাস, মাহি, পরীসহ অনেকেই। পুরুষ তারকার ক্ষেত্রেও সংসারের দায়িত্ব, জীবিকা নির্বাহের বাস্তবতা তাদের পেছনে টেনে রাখে।

ফিরে আসা কি সম্ভব?

শিল্পী কখনোই পুরোপুরি হারিয়ে যান না। সুযোগ, সময় আর সঠিক প্ল্যাটফর্ম পেলে তারা আবার ফিরতে পারেন। কিছু কিছু উদাহরণ আছে যেখানে শিল্পীরা দীর্ঘদিন পর আবার ফিরেছেন, এবং দারুণভাবে সফলও হয়েছেন। এই ‘নিভে যাওয়া তারা’রা হারিয়ে যাননি, শুধু সময় আর সমাজ তাদের আলো কেড়ে নিয়েছে। সহানুভূতি এবং একটা ভালো গল্প বলার সুযোগ পেলে অনেক তারকাই ফিরে আসবেন। 

ঢাকা/তারা

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • রঙিন ঝলমলে আকাশ থেকে নিভে যাচ্ছে তারার আলো