হবিগঞ্জ জেলার হাওর, বিল ও নদীসহ প্রাকৃতিক জলাশয়ে কমেছে মাছের পরিমাণ। আগে হাওরে ১৫০ প্রজাতির মাছ পাওয়া গেলেও এখন পাওয়া যাচ্ছে মাত্র ২০ থেকে ২৫ প্রজাতির। এ কারণে কমে গেছে শুঁটকির উৎপাদন। ফলে শুঁটকি পল্লীগুলোতে দেখা দিয়েছে স্থবিরতা। দুশ্চিন্তায় রয়েছেন এ পেশার সঙ্গে জড়িতরা।
জেলার আজমিরীগঞ্জ, বানিয়াচং, লাখাই, বাহুবল, হবিগঞ্জ সদর ও নবীগঞ্জ উপজেলার ৫ শতাধিক পরিবার শুঁটকি উৎপাদনের পেশায় এখনো জড়িত। পেশা টিকিয়ে রাখতে তারা সরকারি সহায়তা চেয়েছেন। হাওর এলাকার বাঘহাতা, গাজীপুর, শান্তিপুর, ভাটিপাড়া, সুনারু, নাগুরা, নোয়াগাঁও, নোয়াগড়, বিরাট, কোদালিয়া, বদলপুর, উমেদনগরসহ বিভিন্নস্থানে রয়েছে শুঁটকি প্রক্রিয়াজাতকরণের অসংখ্য মাচা।
মাচায় দেশি প্রজাতির পুঁটি, চিংড়ি, কাকিয়া, শইল, গজার, টাকি, বাইম, আইড়, মলা, টেংরাসহ বিভিন্ন প্রজাতি মাছের শুঁটকি উৎপাদন করা হয়। উৎপাদিত শুঁটকি প্রতি মণ ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকায় পাইকারি বাজারে বিক্রি হচ্ছে। আড়তদাররা ২৫ থেকে ২৮ হাজার টাকা মণ হিসেবে বিক্রি করছেন শুঁটকি। খুচরা বাজারে শুঁটকি প্রতিকেজি ৭০০ থেকে ১৫০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
আরো পড়ুন:
কিশোরগঞ্জের হাওরে দর্শনার্থীদের উপচেপড়া ভিড়
হাওরে কাঁচা মরিচ চাষে লোকসানের মুখে চাষিরা
জেলা মৎস্য বিভাগ জানায়, গত অর্থবছরে হবিগঞ্জ সদর উপজেলায় ২৪০ টন, বানিয়াচংয়ে ৫৭৫ টন, নবীগঞ্জে ২৭ টন, বাহুবলে ২১২ টন, লাখাইয়ে ২৩১ টন এবং আজমিরীগঞ্জ উপজেলায় ৩৪২ টন শুঁটকি উৎপাদন হয়েছিল। যা এর আগের অর্থবছরের তুলনায় ৫ শতাংশ কম। এ মৌসুমে আরো কম উৎপাদন হয়েছে শুঁটকি।
মাধবী রানী নামে এক শুঁটকি উৎপাদনকারী বলেন, “বাজার থেকে অনেক বেশি দাম দিয়ে শইল, বাইম, পুটি, টেংরাসহ নানা প্রজাতির মাছ কিনে এনে শুঁটকি তৈরি করা হয়। হাওর, বিল ও নদীতে পানি কমে যাওয়ায় চাহিদামতো মাছ পাওয়া যাচ্ছে না। চাহিদা সম্পন্ন মাছের দামও অনেক বেশি। আগে জেলা শহরের উমেদনগরে মাসে আটটি পাইকারি শুঁটকির হাট বসত, এখন বসছে মাত্র চারটি।”
পারুল রানী দাশ নামে অপর একজন বলেন, “ভোর ৬টা থেকে শুরু হয় শুঁটকি তৈরির কাজ। প্রতিদিন ৫ ঘণ্টা কাজ করতে হয়। মাসে ১০ হাজার টাকা মজুরি পাওয়া যায়। বর্তমানে শুঁটকির উৎপাদন কমে যাওয়ায় এ পেশায় কাজ করে খাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। এজন্য অন্য পেশায় যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি।”
সরেজমিন উমেদনগর হাটে গিয়ে দেয়া যায়, টাঙ্গাইল, সিরাজগঞ্জ ও মানিকগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে পাইকারি ক্রেতারা শুঁটকি কিনতে এসেছেন। চাহিদা অনুযায়ী শুঁটকি না পাওয়ায় হতাশ হয়েছেন তারা।
সিরাজগঞ্জ থেকে পাইকারি দামে শুঁটকি কিনতে আসা ব্যবসায়ী মাসুদুর রহমান জানান, আগে তিনি প্রতিমাসে ৭ থেকে ৮ বার হবিগঞ্জে আসতেন শুঁটকি কিনতে। এখন মাসে দুই থেকে তিনবার আসেন। দাম বেড়ে যাওয়া এবং চাহিদামতো শুঁটকি না পাওয়ায় হবিগঞ্জে কম আসেন বলেও জানান তিনি।
উমেদনগর হাটে শুঁটকির আড়তদার কামরুল ইসলাম বলেন, “আগে এই হাটে নানা রকমের শুঁটকি বিক্রি হত। দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে ক্রেতারা আসতেন শুঁটকি কিনতে। হবিগঞ্জে উৎপাদিত শুঁটকির কদর আলাদা। বর্তমানে হাওর, বিল ও নদীতে মাছ কমায় শুঁটকির উৎপাদন হ্রাস পেয়েছে।”
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) হবিগঞ্জ জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক তোফাজ্জল সোহেল বলেন, “এ জেলায় অনেক নদী, বিল, হাওরসহ বিস্তীর্ণ জলাশয় রয়েছে। নানা শিল্প প্রতিষ্ঠানের দূষিত কালো পানি প্রাকৃতিক জলাশয়ে প্রবেশ করছে। জমিতে অধিক পরিমাণে কীটনাশক প্রয়োগ করা হচ্ছে। জলাশয় ভরাট হয়ে যাচ্ছে। এসব কারণে বর্তমানে প্রাকৃতিক জলাশয়ে মাছের পরিমাণ কমেছে। তার সঙ্গে কমেছে শুঁটকি উৎপাদন।”
তিনি আরো বলেন, “এখনই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে দায়িত্বশীল ভূমিকা নিতে হবে, না হলে প্রাকৃতিক জলাশয় থেকে পর্যায়ক্রমে দেশীয় প্রজাতির মাছ হারিয়ে যাবে। বন্ধ হয়ে যাবে শুঁটকি উৎপাদনও।”
হবিগঞ্জ জেলা মৎস কর্মকর্তা মোহাম্মদ ওয়াহিদুর রহমান মজুমদার বলেন, “দিন দিন হবিগঞ্জে শুঁটকির উৎপাদন কমে যাচ্ছে। অনেকে এই পেশার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন। আমরা মাছের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য হাওরে নানা ধরনের কার্যক্রম পরিচালনা করছি, বিশেষ করে পোনা মাছ সংরক্ষণের জন্য। যদি পোনা মাছ সংরক্ষণ করা সম্ভব হয়, তাহলে মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে।”
তিনি আরো বলেন, “চায়না দুয়ারী ও কারেন্ট জালের বিরুদ্ধে আমাদের অভিযান অব্যাহত আছে। দেশি মাছ রক্ষা পেলে শুঁটকির উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে।”
ঢাকা/মাসুদ
.উৎস: Risingbd
এছাড়াও পড়ুন:
দেশে পাঙাশের বৃহত্তম আড়ত দ্বীপনগর, পাওয়া যায় দেশি-বিদেশি অনেক মাছ
রাজধানীর গাবতলী–মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধের পাশে বিজিবি মার্কেটে গড়ে ওঠা দ্বীপনগর মাছের আড়ত প্রতিদিন সকাল ৬টা থেকে ৯টা পর্যন্ত বেশ জমজমাট থাকে। এই তিন ঘণ্টায় বিক্রি হয় দুই থেকে আড়াই কোটি টাকার মাছ। দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে আসে এসব নানা জাতের দেশি-বিদেশি মাছ।
এ আড়তে গরিবের মাছখ্যাত পাঙাশ থেকে শুরু করে রুই, কাতলা, মৃগেল, তেলাপিয়া, কই, শিং, টাকি, মাগুর, পুঁটি, বাইম, চিংড়িসহ বিভিন্ন ধরনের দেশি ও চাষের মাছ পাওয়া যায়। নদীর পাশাপাশি সাগরের বাইলা, চাপিলা, সুরমা, পোয়া, রিঠা, লইট্টা, টুনা প্রভৃতি মাছ পাওয়া যায়। ওমান, চীন ও ভারত থেকে আমদানি করা মাছ সরাসরি এখানে আসে বলে দাবি ব্যবসায়ীদের।
আড়তদারদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ২০০৬ সালে প্রথমে বিজিবি মার্কেটে মাছ বিক্রি শুরু হয়। তবে ২০০৯ সালে এ বাজারে দ্বীপনগর আড়তের যাত্রা শুরু হলেও বাজার জমে ওঠে ২০১৫ সালের পর থেকে। পরে পাঁচটি হিমাগার ও একটি বরফকল নিয়ে এটি এখন একটি পূর্ণাঙ্গ মৎস্য আড়তে পরিণত হয়, যেখানে ছোট–বড় প্রায় ৪০০ পাইকারি দোকান রয়েছে।
আড়তদার ও বিভিন্ন জায়গা থেকে আসা ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলাপকালে জানা যায়, দ্বীপনগর আড়তে জ্যান্ত মাছের পাইকারদের বিনা মূল্যে পানি সরবরাহ করায় তাঁদের প্রত্যেকের প্রায় ৫০০ টাকা করে সাশ্রয় হয়। তার ওপর যাতায়াতের সুবিধা ভালো, ওজনে কেউ মাছ কম দেয় না, চুরিও হয় না এবং সবচেয়ে বড় কথা হলো, এখানে চাঁদাবাজিমুক্ত পরিবেশে বেচাকেনা করা যায়। এসব কারণে এটি এরই মধ্যে ঢাকার অন্যতম বৃহৎ ও জনপ্রিয় আড়তে পরিণত হয়েছে। ফলে এখানে দিন দিন পাইকার বাড়ছে এবং মোকামও আশপাশে বিস্তৃত হচ্ছে।
দ্বীপনগর আড়তের ‘অটুট বন্ধন মৎস্য ব্যবসায়ী সমিতি’র সভাপতি মো. ইনসার প্রথম আলোকে বলেন, ‘এখানে দৈনিক প্রায় ৪০ হাজার কেজি পাঙাশ বিক্রি হয়, যা কারওয়ান বাজারেও হয় না। সব ধরনের মাছ মিলিয়ে দৈনিক দুই থেকে আড়াই কোটি টাকার মাছ বিক্রি হয়।’
* দ্বীপনগর আড়তে পাঙাশ, রুই, কাতলা, মৃগেল, তেলাপিয়া, কই, শিং, টাকি, মাগুর, পুঁটি, বাইম, চিংড়িসহ বিভিন্ন ধরনের দেশি ও চাষের মাছ পাওয়া যায়।* নদী ও সাগরের বাইলা, চাপিলা, সুরমা, পোয়া, রিঠা, লইট্টা, টুনা প্রভৃতি মাছও বিক্রি হয়।
* প্রতিবেশী ভারত থেকে শুরু করে ওমান, সুদান, জর্ডান, চীন ও জাপান থেকে আমদানি করা মাছ এখানে বিক্রি হয়।
আড়তদার ও পাইকারদের দাবি, এটি দেশে পাঙাশ মাছের সবচেয়ে বড় আড়ত। এখানে দিনে ৩৫ থেকে ৪০ ট্রাক পাঙাশ মাছ আসে। এসব ট্রাকে ৩০ থেকে ৪০টি করে পাঙাশের ড্রাম থাকে। এর একেকটিতে ৪০ কেজি মাছ থাকে। গড়ে ৩৫টি ট্রাকে ৩৫টি করে ড্রাম এবং প্রতি ড্রামে ৪০ কেজি ধরে হিসাব করলে দেখা যায়, এখানে দৈনিক ৪৯ হাজার কেজি পাঙাশ মাছ বিক্রি হয়, যার দাম ৬৩ লাখ ৭০ হাজার টাকা।
বিশেষ করে রাজধানীর মিরপুর, মোহাম্মদপুর, ধানমন্ডি, শ্যামলী, গাবতলী, সাভার, উত্তরা এবং আবদুল্লাহপুর এলাকার পাইকারেরা দ্বীপনগর আড়তে মাছ কিনতে আসেন। অটুট বন্ধন মৎস্য ব্যবসায়ী সমিতির সাবেক সভাপতি মনির হোসেন বলেন, কম দামে পাওয়া যায় বলে পাইকারেরা এখানে মাছ কিনতে আসেন। তাঁর নিজস্ব বরফকল রয়েছে। ৯০ থেকে ১০০ টাকায় বরফের পাটা বিক্রি করেন। তাই বাইরে থেকে বরফ আনতে হয় না।
সম্প্রতি সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, ভোরের আলো ফোটার আগেই বিভিন্ন এলাকার পাইকারেরা মাছ কিনতে দ্বীপনগর আড়তে চলে আসেন। সকাল ৬টা থেকে ৯টা পর্যন্ত নিলামের হাঁকডাকে সরগরম হয়ে ওঠে পুরো আড়ত। দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা তাজা ও হিমায়িত মাছের পাশাপাশি বিদেশ থেকে আনা মাছের বেচাবিক্রি শেষ হয়ে যায়। ৯টার পরপরই সব ব্যস্ততা শেষে ধোয়ামোছার কাজ শুরু হয়ে যায়।
সাভার নবীনগর থেকে আসা পাইকার ফরিদুল ইসলাম জানান, তিনি এখান থেকে দৈনিক ১৫০–২০০ কেজি সাগরের মাছ নিয়ে এলাকার বাজারে বিক্রি করেন।
আড়তদারেরা জানান, দেশের সিলেট, চট্টগ্রাম, চাঁদপুর, নওগাঁ, গোপালগঞ্জ, ফরিদপুর, টেকেরহাট, খুলনা, রাজশাহী, মোংলা, সাতক্ষীরাসহ সব অঞ্চল থেকেই মিঠাপানি এবং নদী ও সাগরের মাছ আসে দ্বীপনগর আড়তে। ওমান, সুদান, জর্ডান, জাপান, চীন এবং ভারত থেকেও সামুদ্রিক মাছ আনা হয়।
মেসার্স ঢাকা গাবতলী ফিশ আড়তের স্বত্বাধিকারী মো. আবদুল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের দৈনিক ৫ টনের মতো মাছ বিক্রি হয়, যার দাম ৫ থেকে ৭ লাখ টাকার মতো।’ তাঁদের হিমাগারে মাইনাস ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় ২ মাস পর্যন্ত মাছ ঠিক থাকে। প্রয়োজনে তাপমাত্রা আরও কমানো যায় বলে জানান তিনি। তবে আড়তদারদের হিসাবে এসব হিমাগার থেকে দৈনিক ১০ থেকে ১৫ লাখ টাকার মাছ বিক্রি হয়।
৫৫০ টাকা করে বাইম মাছ কেনার পর আদাবর বাজারের একজন পাইকার প্রথম আলোকে জানান, তিনি এই মাছ বিক্রি করবেন ৬০০ থেকে ৬৫০ টাকায়। পোয়া মাছ কিনেছেন ৩৩০ টাকা কেজি দরে, বেচবেন ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকায়। ওই পাইকার আরও জানান, আগে কারওয়ান বাজার থেকে মাছ কিনলেও এখন সুবিধা থাকায় দ্বীপনগরে আসেন। প্রতিদিন পাঙাশ, তেলাপিয়া, রুই মাছসহ বিভিন্ন প্রজাতির ৫০ থেকে ৭০ কেজি মাছ কেনেন।