মৌলভীবাজারে হাফিজা খাতুন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের নিরীক্ষা (অডিট)-কেন্দ্রিক শিক্ষা কার্যক্রম বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। বিদ্যালয়টির প্রধান শিক্ষক কমিটিকে আয়-ব্যয়ের হিসাব নেওয়ার সুযোগ না দিয়ে আদালতে মামলা করেছেন। অন্যদিকে এই শিক্ষকের বিরুদ্ধেও রয়েছে অনিয়ম, অর্থ আত্মসাৎ ও স্বেচ্ছাচারিতার বিস্তর অভিযোগ।

বিদ্যালয়টির একাধিক শিক্ষক ও কর্মচারী এবং অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ২০১৫ সালে হাফিজা খাতুন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব নেন রাশেদা বেগম। অভিযোগ রয়েছে, বিগত সরকারের সময় ক্ষমতাসীন দলের পৌর মেয়রের প্রত্যক্ষ প্রশ্রয়ে অল্প সময়ের মধ্যেই বেপরোয়া হয়ে ওঠেন তিনি। দুর্নীতি ও অনিয়মে অনেকাংশেই ভেঙে পড়ে প্রতিষ্ঠানটির স্বাভাবিক কার্যক্রম। ২০১৮ সাল থেকে বিদ্যালয়টির কোনো ধরনের নিরীক্ষণ হয় না।

ধারণা করা হয়, ক্ষমতাসীনদের প্রভাবেই সেখানে অডিট কার্যক্রম স্থগিত ছিল। যার কারণে অনিয়মে কোনো পরোয়া ছিল না প্রধান শিক্ষক রাশেদা বেগমের।

লভীবাজার পৌরসভার সাবেক মেয়র, জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ফজলুর রহমান প্রতিষ্ঠানটির ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি হওয়ার পর অডিটের বিষয়ে শিক্ষক প্রতিনিধিসহ সংশ্লিষ্ট কেউ কথা বলতে পারেননি। বিদ্যালয়ের স্থায়ী আমানত (এফডিআর হিসাবে) ৩৭ লাখ ৭২ হাজার ২৬৬ টাকা থাকলেও এখন স্থিতি রয়েছে ১২ লাখ টাকা। বাকি টাকা কোন খাতে কীভাবে খরচ করা হয়েছে, তার কোনো ব্যাখ্যা নেই। একাধিক শিক্ষক জানান, স্থায়ী আমানতের মোটা অঙ্ক আত্মসাৎ করেছেন প্রধান শিক্ষক নিজেই।

২০১৭ সালের অডিট প্রতিবেদনে তাঁর বিরুদ্ধে ৬৫ লাখ ১ হাজার টাকার হিসাবে গরমিলের কথা উল্লেখ রয়েছে। তৎকালীন মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসের প্রতিনিধি মুহিবুল হাসানের প্রতিবেদনে এ তথ্য উল্লেখ রয়েছে। তবে ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী নেতার প্রভাবে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি ওই প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে।

নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে তাঁর বিরুদ্ধে নিজস্ব লোকজনকে খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে নিয়োগের অভিযোগও রয়েছে। এ ছাড়া বিধি ভঙ্গ করে শিক্ষকদের প্রভিডেন্ট ফান্ড থেকে বঞ্চিত করার অভিযোগও রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে। প্রতিষ্ঠানটির নতুন শিক্ষকরা বাড়ি ভাড়ার ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার হলেও এ ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছেন না প্রধান শিক্ষক। অনলাইনে বেতন ও ভর্তি ফি নেওয়ার কথা থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। রসিদ-ভাউচার ছাড়া এসব টাকা আদায় করা হচ্ছে।

চলতি বছরের শুরুতে বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কমিটির আহ্বায়ক হাফিজা খাতুন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় পরিদর্শন করে আয়-ব্যয়ের হিসাবে অসংগতি ও সুষ্ঠু নিয়মে কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে না জানিয়েছেন। এতে প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক বাজেট প্রণয়ন করতে জটিলতা দেখা দেয়। পরে তিনি প্রধান শিক্ষককে বিদ্যালয়ের আয়-ব্যয়ের হিসাব ঠিক করতে এক মাস সময় বেঁধে দেন।

এ ঘটনায় জেলা সমাজসেবা কর্মকর্তাকে প্রধান করে পাঁচ সদস্যের অডিট কমিটি গঠন করে এক নোটিশে চলতি বছরের ১৯ ফেব্রুয়ারি নিরীক্ষার দিন ধার্য করে দেন। জানা গেছে, প্রধান শিক্ষক প্রায় আট বছরের আয়-ব্যয় নিরীক্ষার সুযোগ দেননি কমিটিকে। এ বিষয়টি জেনে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (আইসিটি ও শিক্ষা) ওই প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে কেন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া যাবে না, তা জানতে চেয়ে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেন। এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে প্রধান শিক্ষক বিদ্যালয়ের সভাপতি জেলা প্রশাসক, তাঁর প্রতিনিধি অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইটিসি)-সহ অডিট কমিটির পাঁচ সদস্যকে বিবাদী করে নিষেধাজ্ঞা চেয়ে সিনিয়র সহকারী জজ সদর আদালতে মামলা করেছেন। এতে বিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এসব নিশ্চিত করেছেন বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মিফতাহুজ্জামান সাজু, শ্যামলী রানী চন্দসহ অনেকে।

অভিযোগ সম্পর্কে প্রধান শিক্ষক রাশেদা বেগম বলেন, শিক্ষার্থীদের শ্রেণিকক্ষের সংকট নিরসনে বিদ্যালয়ের উত্তরপাশে দ্বিতল ভবনের তিনতলায় টিনশেড একটি বিল্ডিং নির্মাণ করার জন্য ২২ লাখ টাকা এফডিআর ভাঙা হয়েছে। ম্যানেজিং কমিটির তৎকালীন সভাপতি, সাবেক পৌর মেয়র ফজলুর রহমানের অনুমতি নিয়ে তা করা হয়েছে। তিনি আরও জানান, বিদ্যালয়ের আয় কম হওয়ায় শিক্ষকদের প্রভিডেন্ট ফান্ডে পরিপত্র অনুযায়ী টাকা দেওয়া সম্ভব হয় না। মামলা দায়ের ও অডিট করতে বাধা সৃষ্টি সম্পর্কে তিনি বলেন, তাঁকে চাকরি থেকে সরিয়ে দেওয়ার কৌশল প্রতিহত করার জন্য আদালতের আশ্রয় নিয়েছেন।

অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) মেহনাজ ফেরদৌস সমকালকে বলেন, হাফিজা খাতুন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের বার্ষিক বাজেট প্রণয়ন করতে গিয়ে আয়-ব্যয়ের হিসাবে অসংগতি ধরা পড়ে। এতে প্রধান শিক্ষককে হিসাব ঠিক করে নিরীক্ষণের নির্দেশ দেওয়া হয়। তিনি অডিট কমিটিকে নিরীক্ষণের সুযোগ না দেওয়ায় তাঁকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়। এরপর তিনি আদালতে গিয়েছেন। আইনিভাবে বিষয়টি মোকাবিলা করা হবে।

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: কম ট র কর ছ ন

এছাড়াও পড়ুন:

আজও আছে পরতে পরতে সৌন্দর্য

কারুকার্যখচিত বিশাল ভবন। দেয়ালের পরতে পরতে মনোহর সৌন্দর্য। মনোরম পরিবেশে ভবনের চারপাশে দাঁড়িয়ে সুন্দরী পরীর আবক্ষ মূর্তি। ছবির মতো সাজানো ‘পাকুটিয়া জমিদারবাড়ি’ এখন কালের সাক্ষী।

মানিকগঞ্জের সাটুরিয়া থেকে ১২ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে টাঙ্গাইলের নাগরপুরের কলমাই নদীতীরে ১৫ একর জমিতে জমিদারবাড়িটি। ঢুকতেই চোখে পড়ে পুরোনো মন্দির। লোকমুখে প্রচলিত, শরতের দিনে দেবী দুর্গার প্রতিমা তৈরিতে এখানে ব্যস্ত থাকতেন ভারতবর্ষের নামকরা কারিগররা। কালের বিবর্তনে স্থানটি এখন নির্জন। নেই আগের গৌরব-আভিজাত্যের ছাপ, এমনকি প্রতিমা তৈরির ব্যস্ততাও।

মন্দির ঘুরে দেখা যায়, এর কোথাও কোথাও ইট খসে পড়েছে। পুরোনো দিনের নকশা হারাচ্ছে তার সৌন্দর্য। মন্দিরের পেছনে বিশাল তিনটি মহল, যা সেকালে তিন তরফ নামে পরিচিত ছিল। মহলগুলোর আলাদা কোনো নাম পাওয়া যায়নি। সবচেয়ে বড় মহলে বর্তমান পাকুটিয়া বিসিআরজি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ পরিচালিত হচ্ছে।

দোতলা ভবনের নির্মাণশৈলী মুগ্ধ করবে সবাইকে। যদিও সংস্কারের অভাবে ভবনটিতে ফাটল দেখা দিয়েছে। পাশেই অপূর্ব লতাপাতার কারুকার্যখচিত বিশাল আরেকটি ভবন, যার মাথায় ময়ূরের মূর্তি। এ ছাড়া কিছু নারী মূর্তিরও দেখা মেলে। জমিদার আমলের টিনের চৌচালা ঘরে অস্থায়ীভাবে সরকারি তহশিল অফিস স্থানান্তর হলেও, সেটি এখন স্থায়িত্ব পেয়েছে।

লতাপতায় আচ্ছন্ন ভবনের একাংশ বর্তমানে উপস্বাস্থ্যকেন্দ্র এবং আরেকাংশে একটি বেসরকারি দাতব্য সেবা সংস্থা কার্যক্রম চালাচ্ছে। ভবনটির পিলারের মাথায় এবং দেয়ালেও অসাধারণ নকশা মুগ্ধ করে।

দোতল আরেকটি মহল, যার সামনে বিশাল শান বাঁধানো সিঁড়ি। অন্য সব ভবনের সঙ্গে এটির নকশার যথেষ্ট মিল খুঁজে পাওয়া যায়। ভবনটির বারান্দা ও পুরোনো কাঠের দরজা সৌন্দর্য বাড়িয়ে তুলেছে কয়েক গুণ। ভবনটির মাথায় ময়ূরের সঙ্গে দুই পাশে দুই নারী মূর্তির দেখা মেলে। সিঁড়ি বেয়ে ছাদে গেলে গাছগাছালির সবুজে ঘেরা পুরো জমিদারবাড়ির সৌন্দর্য বিমোহিত করতে বাধ্য। যদিও ভবনের ভিন্ন অংশ খসে পড়ছে, হারাচ্ছে রূপ-লাবণ্য।

জমিদারবাড়ির পেছনে রয়েছে দীঘি ও দুটি পরিত্যক্ত কূপ। এ ছাড়া জমিদারবাড়ির বিশাল মাঠের এক কোণে নাটমন্দির। জানা যায়, নাগরপুরের সঙ্গে কলকাতার একটি বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এর পরিপ্রেক্ষিতে পশ্চিমবঙ্গের কলকাতা থেকে আসেন ধনাঢ্য ব্যক্তি রামকৃষ্ণ সাহা মণ্ডল। তিনিই ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরুতে ব্রিটিশদের কাছ থেকে বিপুল অর্থের বিনিময়ে জমি কিনে জমিদারি শুরু করেন।

রামকৃষ্ণ সাহার দুই ছেলে বৃন্দাবন ও রাধাগোবিন্দ। রাধা নিঃসন্তান। তবে বৃন্দাবনের তিন ছেলে– ব্রজেন্দ্র মোহন, উপেন্দ্র মোহন ও যোগেন্দ্র মোহন দীর্ঘকাল রাজত্ব করেন। এভাবে পাকুটিয়া জমিদারবাড়ি তিন ভাইয়ের তরফে বিভক্ত থাকলেও, জমিদাররা সবাই ছিলেন প্রজানন্দিত। বৃন্দাবনের মেজ ছেলে উপেন্দ্রকে কাকা রাধাগোবিন্দ দত্তক নেন। ফলে উপেন্দ্র কাকার জমিদারির পুরো সম্পত্তি লাভ করেন।

দৃষ্টিনন্দন পাকুটিয়া জমিদারবাড়িতে প্রতিনিয়ত পর্যটকের ভিড় বাড়ছে। ইতিহাসের সাক্ষী বাড়িটি সংস্কার না হওয়ায় একদিকে যেমন সৌন্দর্য হারাচ্ছে, অন্যদিকে তরুণ প্রজন্মের কাছে অজানা থেকে যাচ্ছে ইতিহাস। জমিদারবাড়িটি পুরাকীর্তি হিসেবে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের অধীনে নিয়ে সংস্কার ও সংরক্ষণের দাবি জোরালো হচ্ছে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ