পোপ ফ্রান্সিসকে ধরা হয় ক্যাথলিক চার্চের মহান সংস্কারক হিসেবে। সহনশীলতা ও ভালোবাসার বার্তা ছড়িয়ে দিয়েছেন সারা বিশ্বে। ক্যাথলিক চার্চের বহু বছরের পুরোনো নিয়ম, প্রথা, আচার—সবকিছুতেই আধুনিকতার ছোঁয়া এনেছেন। পোপের জন্য নির্ধারিত বাসস্থানে থাকতেন না, থাকতেন দুই বেডরুমের ছোট্ট একটি বাসায়। খাওয়ার সময় ডেকে নিতেন কর্মচারীদের। নিজে শরণার্থীদের পা ধুয়ে দিয়েছেন, সারা বিশ্বে পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন শান্তির বাণী। এমনকি মৃত্যুর আগের দিনও দুই হাতে প্রার্থনা করেছেন গাজাবাসীর জন্য, আহ্বান জানিয়েছেন যুদ্ধবিরতির। শেষকৃত্যেও তার ব্যতিক্রম ঘটছে না। তাঁকে সমাহিত করা হবে কয়েক শতাব্দীর প্রথা ভেঙে।

পোপ ফ্রান্সিসের মৃত্যুর খবর ঘোষণা করা হয় ভ্যাটিকান সিটির সেন্ট পিটার্স ব্যাসেলিকা গির্জার ঘণ্টা বাজিয়ে। সঙ্গে সঙ্গে নিয়ম অনুযায়ী কাজ শুরু করে দেন কার্ডিনালরা। প্রথমে সিলগালা করে দেওয়া হয় তাঁর বাসস্থান। যাতে তাঁর রেখে যাওয়া কোনো কাগজপত্র কিংবা কাজে কেউ কোনো পরিবর্তন আনতে না পারেন। অতঃপর তাঁকে পোপের সাজে সাজিয়ে রাখা হয় কফিনে। পোপের ইচ্ছানুযায়ী তাঁর খোলা কফিন রাখা হয়েছে ভ্যাটিকান সিটির কাসা সান্তা মার্তার চ্যাপেলে। সঙ্গে সঙ্গে ভেঙে ফেলা হবে তার ‘ফিশারম্যানস রিং’। ডাকটিকিট চল হওয়ার আগে এই সিল দিয়ে যেকোনো নথি স্বাক্ষর করতেন পোপরা। এখন মূলত পোপের প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করা হয় আংটি। এর মধ্যেই চলবে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার কাজ। আগামীকাল ২৬ এপ্রিল অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার আগপর্যন্ত চ্যাপেলে থাকবে তাঁর মরদেহ।

পোপদের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার জন্য সাধারণত তিনটি কফিন প্রস্তুত করা হয়। এটি মূলত করা হয় পোপের পবিত্রতা রক্ষা ও বিশেষ সম্মানার্থে। প্রতিটি কফিনের আছে আলাদা তাৎপর্য।

কিউপ্রেসাস কাঠের তৈরি প্রথম কফিন

প্রথম কফিন তৈরি করা হয় কিউপ্রেসাস কাঠ দিয়ে। এই কফিনে শোয়ানো থাকে পোপের দেহ। সঙ্গে তাঁকে নিবেদিত লেখা শংসাবচন। এই কফিনে আরও থাকবে সোনা, রুপা ও তামার তিন ব্যাগ মুদ্রা। যে কয় বছর তিনি পোপের দায়িত্ব পালন করেছেন, ঠিক ততগুলো মুদ্রা থাকবে ব্যাগে। পোপ ফ্রান্সিসের জন্য তিনটি ব্যাগের প্রতিটিতে থাকবে ১২টি করে মুদ্রা। কিউপ্রেসাস কাঠকে ধরা হয় সবচেয়ে সাধারণ কাঠ। সেই রোমান সাম্রাজ্যের সময় থেকে এখন পর্যন্ত ইতালির মাঠেঘাটে অহরহ দেখা যায় কিউপ্রেসাস গাছ। এর কাঠের কফিন প্রমাণ করে পোপ আর দশজনের মতো সাধারণ মানুষ ছিলেন। তাঁর মৃত্যুও সাধারণ মানুষের মতো হয়েছে। তিনটি সিল্ক রিবন দিয়ে বেঁধে সিল করা হয় কফিন। অতঃপর পোপের মৃতদেহ প্রবেশ করানো হয় দ্বিতীয় কফিনে।

সিসার তৈরি দ্বিতীয় কফিন

দ্বিতীয় কফিনটি তৈরি করা হয় সিসা দিয়ে। এই কফিনে লেখা থাকে পোপের পুরো নাম, পোপ হিসেবে তাঁর সময়কাল এবং কফিনে আঁকা হয় স্কাল ও ক্রসবোনের তৈরি প্রাচীন লাতিন একটি চিহ্ন ‘মেমেনতো মোরি’। যার অর্থ ‘মনে রেখো তোমারও মৃত্যু হবে’। সিসার কফিনে আরও থাকে দায়িত্বে থাকাকালে পোপের স্বাক্ষরিত কিছু গুরুত্বপূর্ণ নথি ও তাঁর কার্যালয়ের সিলমোহর। এই কফিন মরণশীল মানুষকে যেন মৃত্যুর কথা আরেকবার মনে করিয়ে দেয়। আর এই কফিন সিলগালা করে প্রবেশ করানো হয়ে তৃতীয় কফিনে।

এল্ম কাঠের তৈরি তৃতীয় কফিন

তৃতীয় কফিন তৈরি করা হয় রোমের সবচেয়ে দামি এল্ম কাঠ দিয়ে। এল্ম কাঠকে ধরা হতো রোমান সাম্রাজ্যের সবচেয়ে সৌন্দর্যের প্রতীক হিসেবে। পোপের মাহাত্ম্য ও সৌন্দর্য বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দিতে ব্যবহার করা হয় এল্ম কাঠের কফিন। স্বর্ণের পেরেক ঠোকা হয় এই কফিনে। সিলগালা করার আগে একজন বিশপ পোপের অর্জনগুলো পড়ে শোনান। তারপর সেটিকে একটি তামার পাত্রে বদ্ধ করে রেখে দেওয়া হয় কফিনের মধ্যে।

তারপর সেন্ট পিটার্স ব্যাসেলিকায় সমাহিত করা হয় পোপের দেহ। পোপের তিনটি কফিন শুধু পোপের মাহাত্ম্য, অর্জন ও জনপ্রিয়তার সাক্ষী নয়; বরং ভবিষ্যতের জন্য একটি টাইম ক্যাপসুলও বটে। যাতে আজ থেকে হাজার বছর পরও পোপের অর্জন, গুণাবলি ও জীবনযাত্রা সম্পর্কে মানুষ অবহিত হয়।

আরও পড়ুনপোপ ফ্রান্সিস সম্পর্কে কিছু অজানা চমকপ্রদ তথ্য২১ এপ্রিল ২০২৫পোপ ফ্রান্সিসের কফিন কেমন হবে

পোপ ফ্রান্সিসের জন্য তিনটি কফিন তৈরি হচ্ছে না। গত বছর শেষকৃত্যের কিছু প্রথায় পরিবর্তন আনেন তিনি। সেখানে তাঁর শেষকৃত্যের জন্য একটি কফিন তৈরির নির্দেশ দিয়ে গেছেন। সে অনুযায়ী প্রস্তুত করা হয়েছে সাধারণ কাঠের তৈরি একটি কফিন। এই কফিন সিলগালা করার ব্যবহার করা হবে দস্তার প্রলেপ। তাঁর কফিনটিও একেবারে আগাগোড়া সমান হবে না। মাথার দিকটা হবে তুলনামূলক চওড়া এবং পায়ের দিকটা চাপা। তবে বাকি সব প্রথা একই রকম থাকছে। কফিনে তাঁর মৃতদেহের সঙ্গে থাকবে ১২টি সোনা, রুপা ও তামার মুদ্রা। লেখা থাকবে তঁর নাম, সময়কাল ও অর্জনের কথা।

পোপ ফ্রান্সিস চেয়েছিলেন তাঁর বিদায় হবে সাধারণ মানুষের মতো। যেভাবে যিশুখ্রিষ্ট পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছিলেন একজন কাঠমিস্ত্রি হিসেবে, ঠিক সেভাবে কোন জাঁকজমক ছাড়া নীরবে চিরনিদ্রায় শায়িত হবেন নিজের প্রিয় গির্জায়। যে কারণে সেন্ট পিটার্স ব্যাসেলিকায় সমাহিত করা হচ্ছে না তাঁকে। তিনি থাকবেন রোমের ব্যাসিলিকা অব সেন্ট মেরি মেজরে। যেখানে জীবনের বড় একটা সময় কাটিয়েছেন তিনি। শনিবার বাংলাদেশ সময় বেলা ২টায় শুরু হবে তাঁর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার আনুষ্ঠানিকতা।

সূত্র: ইউএসএ টুডে ও মিডিয়াম

আরও পড়ুনপ্রেমিকাকে না পেয়ে যেভাবে পোপ হয়েছিলেন ফ্রান্সিস ২১ এপ্রিল ২০২৫.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: অন ত য ষ ট ক র য় র ক উপ র স স এল ম ক ঠ র জন য

এছাড়াও পড়ুন:

‘ভোল পাল্টে’ সক্রিয় কিশোর গ্যাং, অতিষ্ঠ বাসিন্দারা

লক্ষ্মীপুরের রায়পুর উপজেলার চর আবাবিল ইউনিয়নের উদমারা এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের উৎপাতে অতিষ্ঠ বাসিন্দারা। এলাকায় নারীদের উত্ত্যক্ত করা, মাদক সেবন, মারামারি, খুনসহ বিভিন্ন ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনার অভিযোগ রয়েছে কিশোর গ্যাংয়ের এসব সদস্যদের বিরুদ্ধে।

স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন, গত বছরের ৫ আগস্টের আগে আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতার ছত্রচ্ছায়ায় কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করত। তবে এখন ভোল পাল্টে স্থানীয় বিএনপি নেতা-কর্মীদের সঙ্গে ভিড়েছে তারা।

সম্প্রতি এলাকাটিতে কিশোর গ্যাংয়ের হামলায় আহত হয়ে চিকিৎসাধীন জাহাঙ্গীর আলম (৫২) নামের এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। জাহাঙ্গীর আলম স্থানীয় মসজিদ কমিটির সভাপতি ছিলেন। মসজিদের পাশে জুয়ার আসর বসানো ও মাদক সেবনে বাধা দেওয়াকে কেন্দ্র করে তাঁর ওপর হামলার অভিযোগ রয়েছে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের বিরুদ্ধে। গত ৩ এপ্রিল তাঁর ওপর হামলা করা হয়। এরপর গত শনিবার তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।

স্থানীয় বাসিন্দা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কিশোর গ্যাংয়ের নেতৃত্বে রয়েছেন কয়েকজন স্থানীয় তরুণ। ওই তরুণেরা রাজনীতিতে যুক্ত থাকায় মিছিল-সমাবেশে কিশোরদের ব্যবহার করে আসছেন। ফলে স্থানীয় কিছু রাজনৈতিক নেতাও এসব কিশোরকে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে প্রশ্রয় দেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন স্থানীয় বাসিন্দা বলেন, আগে এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের নিয়ন্ত্রণ ছিল চর আবাবিল ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজুল ইসলাম ও ২ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিদ্দিক সর্দারের হাতে। তাঁরা এসব কিশোরকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিতেন। গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ওই কিশোরেরা ভোল পাল্টে বিএনপির কর্মসূচিতে সক্রিয় হচ্ছে। আবদুর রহিম নামে স্থানীয় এক ব্যক্তি এসব তরুণকে নতুন করে আশ্রয়–প্রশ্রয় দিচ্ছেন। রহিম ইউনিয়ন বিএনপির রাজনীতিতে সক্রিয় হলেও তাঁর পদপদবি নেই।

জাহাঙ্গীর আলম খুনের ঘটনায় আবদুর রহিমকেও আসামি করা হয়। মামলার পর তিনি আত্মগোপনে রয়েছেন। মুঠোফোনে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের আমি প্রশ্রয় দিচ্ছি—এমন অভিযোগ প্রায় করা হচ্ছে। তবে এসব অভিযোগ সত্য নয়। আমাকে হয়রানির উদ্দেশ্যে মামলায় জড়ানো হয়েছে।’

ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিদ্দিক সর্দার বলেন, ‘কিশোর গ্যাংকে আমি কখনো প্রশ্রয় দিইনি। তারা (কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা) আমার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করত।’ ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজুল ইসলাম আত্মগোপনে থাকায় তাঁর বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি।

জানতে চাইলে রায়পুর উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক জেড এম নাজমুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, বিএনপির দলীয় কোনো নেতা-কর্মী কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের প্রশ্রয় দিলে তাঁদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কোনো নেতা-কর্মীর অপকর্মের দায় দল নেবে না।

জাহাঙ্গীর আলমের ওপর হামলার ঘটনায় গত ৭ এপ্রিল লক্ষ্মীপুরের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ৯ জনের নাম উল্লেখ ও ২০ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করে মামলার আবেদন করেন তাঁর স্ত্রী রাজিয়া বেগম। আদালত রায়পুর থানাকে মামলাটি গ্রহণের নির্দেশ দেন। মামলার এজাহারে অভিযোগ করা হয়, মসজিদের আশপাশে জুয়ার আসর ও মাদক সেবন করত কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা। এসব বিষয়ের প্রতিবাদ করাকে কেন্দ্র করে সাব্বির হোসেন, জুবায়ের হোসেনসহ কয়েকজনের নেতৃত্বে ৮–১০ জন কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য জাহাঙ্গীর আলমের ওপর হামলা করেছেন। নিহত জাহাঙ্গীর আলমের মেয়ে শারমিন আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, মামলার পর আতঙ্কে দিন কাটছে তাঁর পরিবারের সদস্যদের। স্থানীয় কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা মামলা প্রত্যাহারের জন্য হুমকি দিয়ে আসছে।

জানতে চাইলে রায়পুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. নিজাম উদ্দিন ভূঁইয়া বলেন, কিশোর অপরাধীদের বিরুদ্ধে পুলিশের ধারাবাহিক অভিযান অব্যাহত রয়েছে। এরই মধ্যে বেশ কয়েকজনের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।

লক্ষ্মীপুর সরকারি ডিগ্রি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ মাঈন উদ্দিন পাঠান বলেন, কিশোর-তরুণদের খেলাধুলা, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড থেকে ফিরিয়ে আনতে হবে। তাদের ফেরাতে না পারলে অপরাধ আরও বেড়ে যাবে। কেউ যাতে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে কিশোরদের ব্যবহার করতে না পারে, সে বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ সবাইকে তৎপর থাকতে হবে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ