নোয়াখালীর চরাঞ্চলে গত চার-পাঁচ বছর ধরে সুপেয় পানির জন্য হাহাকার চলছে। বিশেষ করে জেলার সুবর্ণচরে সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে। সংকট রয়েছে জেলার সদর উপজেলায়ও। সাবমার্সিবল পাম্প (ডুবো নলকূপ) ছাড়া কোথাও মিলছে না সুপেয় পানি। বিশেষজ্ঞদের মতে, বোরো আবাদে ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার বেড়ে যাওয়াই এই সংকটের প্রধান কারণ। তাই এ ক্ষেত্রে বিকল্প উৎসের ব্যবস্থা করা না গেলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে।

সম্প্রতি সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, সুবর্ণচর উপজেলার চরবাটা ইউনিয়নের চরবাটা গ্রামের মোজাম্মেল হোসেন জামে মসজিদসংলগ্ন বাড়ির সাবমার্সিবল পাম্পের পানির কলের সামনে কলসি, বালতি, প্লাস্টিকের জার নিয়ে নারী-পুরুষের দীর্ঘ লাইন। তাঁরা জানান, এভাবে প্রতিদিন তাঁরা পানি সংগ্রহ করেন। কখনো কখনো বিদ্যুৎ না থাকায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়।

বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত চার-পাঁচ বছর ধরে শুষ্ক মৌসুম এলেই সুবর্ণচরে ভূগর্ভের পানির স্তর নিচে নেমে যায়। দিন দিন পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে। চর বাটা গ্রামের গৃহিণী নুর জাহান প্রথম আলোকে বলেন, তাঁদের বাড়িতে নলকূপ আছে। কিন্তু গত দেড় মাসের বেশি সময় ধরে পানি উঠছে না। আশপাশের বাড়িতেও একই অবস্থা। প্রত্যেক বাড়িতেই নলকূপ রয়েছে, কিন্তু পানি পাচ্ছেন না বাসিন্দারা।

আরেক গৃহবধূ শেফালি আক্তার বলেন, পাশের বাড়ির সাবমার্সিবল পাম্প এখন তাঁদের একমাত্র ভরসা, যা বিদ্যুৎ থাকলে চলে। এ অঞ্চলে বিদ্যুতের সমস্যা প্রকট। ফলে বিদ্যুৎ আসলে দিনে একবার কিংবা দুইবার পানি তোলা হয়। আর তখনই লাইন ধরে পানি নিতে আসে আশপাশের মানুষ। দীর্ঘ সময় ধরে লাইনে দাঁড়িয়ে পানি সংগ্রহ করতে হয়। বিদ্যুৎ চলে গেলে খালি হাতে ফিরতে হয়।

বাসিন্দারা জানান, মাত্র চার-পাঁচ বছর আগেও সুবর্ণচরে এমন চিত্র ছিল না। তখন এলাকায় বোরো চাষ হতো কম। বেশির ভাগ মানুষ রবি শস্য উৎপাদন করতে, তাতে ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার তেমন ছিল না। কিন্তু গেল কয়েক বছর আগে থেকে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন-বিএডিসির মাধ্যমে বেশ কয়েকটি গভীর নলকূপ স্থাপন করা হয়। অনেক কৃষকও গভীর নলকূপ স্থাপন করেছেন। এতে দিন দিন ভূগর্ভস্থ পানির ওপর চাপ বেড়েছে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, সুবর্ণচরে প্রতিবছরই বাড়ছে বোরো আবাদ। পাঁচ বছর আগে এ উপজেলায় ৮ হাজার ২০০ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ হতো। তবে চলতি বছর বোরো আবাদ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৬ হাজার ৫০০ হেক্টর জমি। মৌসুমে বৃষ্টি কম হওয়ায় চাষাবাদে ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার করা হয়।

সুবর্ণচরের স্কুলশিক্ষক কামাল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, রবি ফসল চাষে ভূগর্ভের পানির প্রয়োজন তেমন হতো হতো না। যখন বোরো আবাদ বেড়েছে, তখনই সংকট শুরু হয়েছে। বোরো আবাদ যেহেতু প্রয়োজন, তাই যে সব খাল রয়েছে সেগুলো পুনরায় খনন করতে হবে। একই সঙ্গে খননকৃত খালের মুখে স্লুইসগেট স্থাপন করে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। তাহলে ভবিষ্যতে পানির সংকট দূর হবে এবং ফসল উৎপাদনের ধারাবাহিকতা বজায় থাকবে।

অতিমাত্রায় ভূগর্ভের পানির ওপর নির্ভরশীলতা জনপদকে ঝুঁকির দিকে ঠেলে দিচ্ছে বলে মন্তব্য করেন পল্লী-কর্ম সহায়ক ফাউন্ডেশন-পিকেএসএফের কৃষিবিদ শিবব্রত ভৌমিক। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, বোরো চাষে প্রতিনিয়ত অধিক পরিমাণে ভূগর্ভের পানি তোলা হচ্ছে। ফলে পানির স্তর দিন দিন নিচে নেমে যাচ্ছে। এতে একদিকে পানির সংকট ব্যাপক হচ্ছে, আবার মাটির তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। সুতরাং পানির স্তর নিচে নামার কারণে সংকট ভয়াবহ হচ্ছে।

নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মোহাম্মদ মহিনুজ্জামান বলেন, ভূগর্ভের পানির সংকট দেখা দিলে ভবিষ্যতে পানিতে লবণাক্ততা বাড়বে। আর এসব লবণাক্ত পানি কয়েক বছর টানা ব্যবহার ও পান করলে মানবদেহে বেশ কিছু রোগ দেখা দিতে পারে। যার মধ্যে কিডনি সমস্যা ও উচ্চ রক্তচাপ অন্যতম। প্রভাব পড়তে পারে নারীদের প্রজননেও।

জেলা প্রশাসক খন্দকার ইসতিয়াক আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, সুপেয় পানির সংকট দূর করতে জরুরি ভিত্তিতে কিছু সাবমার্সিবল পাম্প বরাদ্দ পাওয়া গেছে। পানির সংকট যেসব এলাকায় বেশি সেখানে এসব পাম্প বসানোর ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি আপত্কালীন ব্যবস্থা হিসেবে এরই মধ্যে বিভিন্ন এলাকায় গাড়িতে করে খাবার পানি সরবরাহ করা হচ্ছে। জেলা প্রশাসক আরও বলেন, দীর্ঘ মেয়াদি ব্যবস্থার অংশ হিসেবে তিনি এরই মধ্যে পানি উন্নয়ন বোর্ড, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর, কৃষি বিভাগ ও বিএডিসিকে নিয়ে বৈঠক করেছেন। ওই বৈঠকে খাল খননসহ বৃষ্টির পানি সংরক্ষণে ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: প রথম আল ক ব যবস থ ব যবহ র নলক প চ বছর

এছাড়াও পড়ুন:

মিরাজে দুর্দান্ত জয় বাংলাদেশের

এমন পারফরম্যান্সই তো চাওয়ার থাকে ভালো দলের কাছে। মেহেদী হাসান মিরাজের অলরাউন্ড নৈপুণ্য, সাদমান ইসলামের সেঞ্চুরি, তাইজুল ইসলামের ৯ উইকেট শিকারে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ইনিংস ও ১০৬ রানের বিশাল জয় এনে দেয় বাংলাদেশকে। প্রথম টেস্ট হারের পর যে সমালোচনা হয়েছিল, তার জবাবটা বোধ হয় দ্বিতীয় টেস্ট তিন দিনে জিতে দিয়ে দিলেন নাজমুল হোসেন শান্তরা। ‘বাউন্স ব্যাক’ করে সিরিজ ড্র ১-১-এ।

চট্টগ্রামের বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমান স্টেডিয়ামে বীরোচিত পারফরম্যান্স ছিল টাইগারদের। এটি সম্ভব হয়েছে পছন্দের উইকেটে খেলা হওয়ায়। স্পিন ভুবনে উইকেট উৎসব করেছেন তাইজুল, মিরাজ গাঁটছড়া বেঁধে। সিরিজ নির্ধারণী টেস্টে দুটি সেঞ্চুরি দারুণ অর্জন অধারাবাহিক ব্যাটিং লাইনআপের। এই টেস্টে ওপেনিং জুটি ভালো করেছে। লম্বা সময় পর টেস্ট খেলার সুযোগ পাওয়া এনামুল হক বিজয় ভালোই সঙ্গ দেন সাদমানকে। লোয়ার মিডলঅর্ডারে মিরাজের লড়াই ছিল দেখার মতো।

টেলএন্ডারদের নিয়ে রীতিমতো বাজিমাত করেছেন তিনি। শেষ ৩ উইকেটে তৃতীয় দিন ১৫৩ রান যোগ করেন। বাংলাদেশকে পৌঁছে দেন ৪৪৪ রানে। ২১৭ রানের লিড থাকায় ইনিংস ব্যবধানে জয়ের স্বপ্ন দেখায়। মিরাজের অলরাউন্ড পারফরম্যান্সে সে স্বপ্ন পূরণ হয়। সাকিব আল হাসান ও সোহাগ গাজীর পর তৃতীয় বাংলাদেশি ক্রিকেটার হিসেবে সেঞ্চুরি ও পাঁচ উইকেট শিকার তাঁর। 

গত বছর দেশের মাটিতে টেস্টে ভালো করতে পারেনি বাংলাদেশ। শ্রীলঙ্কার পর দক্ষিণ আফ্রিকার কাছে হোয়াইটওয়াশ হয়েছে। ২০২৫ সালের শুরুটাও ভালো ছিল না। সিলেটে জিম্বাবুয়ের কাছে হেরেছে। সিরিজ বাঁচাতে চট্টগ্রামে জিততেই হতো। লক্ষ্যে পৌঁছাতে কন্ডিশনেও পরিবর্তন আনা হয়। চট্টগ্রামের উইকেটে খেলা হয় দ্বিতীয় টেস্ট। যেখানে শাসন ছিল স্পিনারদের। পছন্দের উইকেট পাওয়ায় তিন স্পিনার নিয়ে খেলে বাংলাদেশ। তিনজনই দারুণ বোলিং করেন প্রথম থেকে।

দীর্ঘ বিরতির পর টেস্ট খেলার সুযোগ পাওয়া অফস্পিনার নাঈম হাসান চ্যালেঞ্জ নিয়ে বোলিং করে গেছেন। বেশি উইকেট না পেলেও এক প্রান্তে ব্যাটারদের চাপে ফেলেছেন। যার সুফল তাইজুল ও মিরাজ পেয়েছেন অন্য প্রান্তে। প্রথম দিন শেষ সেশনে ব্রেক থ্রু দেন তিনি। বাঁহাতি স্পিনার পরে পিক করে ৬ উইকেট শিকার করেন। জিম্বাবুয়ে ৯ উইকেটে ২২৭ রানে প্রথম দিন শেষ করে। পরের দিন এক বল খেলে ওই রানেই অলআউট হয়। বাংলাদেশ ব্যাটিং শুরু করে বড় লক্ষ্য নিয়ে। সাদমান ইসলাম ও এনামুল হক বিজয় ১১৮ রানের ওপেনিং জুটি করায় প্রতিপক্ষকে ছাড়িয়ে যাওয়া সহজ হয়। সাদমানের সেঞ্চুরি ও মুমিনুল হক, মুশফিকুর রহিম কিছু রান করায় ৭ উইকেটে ২৯১ রানে দ্বিতীয় দিন শেষ করে বাংলাদেশ।

সেদিন সংবাদ সম্মেলনে সাদমান আশা প্রকাশ করেন, মিরাজ ও তাইজুল জুটি করবেন। অষ্টম উইকেটে ৬৪ রানের জুটি দু’জনের। বেশি ভালো করেছেন পেসার তানজিম হাসান সাকিব। মিরাজের সঙ্গে ১৫৬ বলে ৯৬ রানের জুটি। অভিষেক টেস্টে সাকিবের ব্যাটিং দারুণ লেগেছে অধিনায়ক শান্তর কাছে। ৮০ বলে ৪১ রান করেন তিনি। সবচেয়ে বড় কথা, মাথায় বল লাগার পরও বিচলিত হননি তিনি। মিরাজ ছাড়া চট্টগ্রাম টেস্টের প্রাপ্তি হিসেবে ওপেনিং জুটির ভালো খেলা, সাদমানের সেঞ্চুরি, তাইজুলের ৫ উইকেট শিকার ও সাকিবের রান করাকে মনে করেন শান্ত। 

শেষের তিন উইকেটে তৃতীয় দিন প্রায় দুই সেশন ব্যাট করে বাংলাদেশ। তাইজুল, সাকিব ও হাসানকে নিয়ে ১৫৩ রান যোগ করে। মিরাজ ১০৪ রান করে ওয়েলিংটন মাসাকাদজাকে উইকেট দেন। নার্ভাস নাইটির ঘরে প্রবেশ করে কিছুটা ঝুঁকির মুখে ছিলেন মিরাজ। ৯৮ রানে পৌঁছানোর পর সেঞ্চুরি ছুঁতে দুই রান নিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ফিল্ডারের কাছে বল চলে যাওয়ায় এক রানে থামতে হয়। তখন স্ট্রাইকে হাসান থাকায় দুশ্চিন্তায় পড়ে গিয়েছিল সবাই। ড্রেসিংরুমে খেলোয়াড় ও কোচিং স্টাফের সবাই দাঁড়িয়ে গিয়েছিলেন। কখন হাসান আউট হয়ে যায়, সে ভয় কাজ করছিল হয়তো। কিন্তু হাসান ছিলেন দৃঢ়চেতা। মাসাকাদজাকে ডিফেন্স করে স্বস্তি দেন।

মিরাজ স্ট্রাইকে এসে মেদেভেরের প্রথম দুই বলে ঝুঁকি নেননি। তৃতীয় বলে এক রান নিয়ে ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় টেস্ট সেঞ্চুরির স্বাদ নেন। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে সিরিজ ও দ্বিতীয় টেস্টের সেরা খেলোয়াড় মিরাজ। প্রথম ম্যাচের উভয় ইনিংসে ৫ উইকেট করে ছিল তাঁর। চট্টগ্রামে অতীতের সব পারফরম্যান্স ছাড়িয়ে গেছেন। সেঞ্চুরির সঙ্গে ৫ উইকেটপ্রাপ্তি, দুই হাজার রানের মাইলফলক পেয়েছেন। ২০২১ সালে এই চট্টগ্রামেই ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে সেঞ্চুরি করেছিলেন তিনি। ২১৭ রানে পিছিয়ে থাকা জিম্বাবুয়ে দ্বিতীয় ইনিংসে অলআউট হয় ১১১ রানে। ফ্লাডলাইটের আলো জ্বেলে নির্ধারিত সময়ের বেশি খেলান আম্পায়াররা। প্রায় সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত খেলা হয়। জিম্বাবুয়ে ক্রিকেটাররা তাতে আপত্তি করেননি। তাইজুল ৩, নাঈম ১ ও মিরাজ ৫ উইকেট নিলে ম্যাচ শেষ হয়।  

সিলেটে প্রথম টেস্ট হারের পর চট্টগ্রামে প্রভাব বিস্তার করে খেলে ম্যাচ জেতার পরও খুশি নন অধিনায়ক শান্ত, ‘আমি টেস্ট সিরিজ ড্র করে খুশি না। কারণ, প্রথম টেস্টে আমরা একেবারেই ভালো খেলিনি। এই টেস্টে একপেশে খেলে জিতলেও সিরিজে আরও ভালো খেলা উচিত ছিল। সিরিজটি জিততে হতো।’ টাইগার দলপতি জানান, এই পারফরম্যান্স শ্রীলঙ্কা সফরে কাজে দেবে। দেশের মাটিতে স্পোর্টিং উইকেট বানিয়ে বিদেশে খেলার পরিবেশ তৈরি করছিল বিসিবি। ২০২৩ সালে নিউজিল্যান্ড সিরিজ থেকে স্পোর্টিং উইকেটে খেলা হচ্ছে। কিউইদের বিপক্ষে সিলেটে ঐতিহাসিক জয় পেলেও মিরপুর থেকে হারতে শুরু করে। দেশের মাটিতে টানা ছয় হারের পর জয়ের দেখা পেল বাংলাদেশ।

সম্পর্কিত নিবন্ধ