নোয়াখালীর চরাঞ্চলে ভূগর্ভস্থ পানিতে চাষাবাদ, বাড়ছে সংকট
Published: 26th, April 2025 GMT
নোয়াখালীর চরাঞ্চলে গত চার-পাঁচ বছর ধরে সুপেয় পানির জন্য হাহাকার চলছে। বিশেষ করে জেলার সুবর্ণচরে সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে। সংকট রয়েছে জেলার সদর উপজেলায়ও। সাবমার্সিবল পাম্প (ডুবো নলকূপ) ছাড়া কোথাও মিলছে না সুপেয় পানি। বিশেষজ্ঞদের মতে, বোরো আবাদে ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার বেড়ে যাওয়াই এই সংকটের প্রধান কারণ। তাই এ ক্ষেত্রে বিকল্প উৎসের ব্যবস্থা করা না গেলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে।
সম্প্রতি সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, সুবর্ণচর উপজেলার চরবাটা ইউনিয়নের চরবাটা গ্রামের মোজাম্মেল হোসেন জামে মসজিদসংলগ্ন বাড়ির সাবমার্সিবল পাম্পের পানির কলের সামনে কলসি, বালতি, প্লাস্টিকের জার নিয়ে নারী-পুরুষের দীর্ঘ লাইন। তাঁরা জানান, এভাবে প্রতিদিন তাঁরা পানি সংগ্রহ করেন। কখনো কখনো বিদ্যুৎ না থাকায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়।
বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত চার-পাঁচ বছর ধরে শুষ্ক মৌসুম এলেই সুবর্ণচরে ভূগর্ভের পানির স্তর নিচে নেমে যায়। দিন দিন পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে। চর বাটা গ্রামের গৃহিণী নুর জাহান প্রথম আলোকে বলেন, তাঁদের বাড়িতে নলকূপ আছে। কিন্তু গত দেড় মাসের বেশি সময় ধরে পানি উঠছে না। আশপাশের বাড়িতেও একই অবস্থা। প্রত্যেক বাড়িতেই নলকূপ রয়েছে, কিন্তু পানি পাচ্ছেন না বাসিন্দারা।
আরেক গৃহবধূ শেফালি আক্তার বলেন, পাশের বাড়ির সাবমার্সিবল পাম্প এখন তাঁদের একমাত্র ভরসা, যা বিদ্যুৎ থাকলে চলে। এ অঞ্চলে বিদ্যুতের সমস্যা প্রকট। ফলে বিদ্যুৎ আসলে দিনে একবার কিংবা দুইবার পানি তোলা হয়। আর তখনই লাইন ধরে পানি নিতে আসে আশপাশের মানুষ। দীর্ঘ সময় ধরে লাইনে দাঁড়িয়ে পানি সংগ্রহ করতে হয়। বিদ্যুৎ চলে গেলে খালি হাতে ফিরতে হয়।
বাসিন্দারা জানান, মাত্র চার-পাঁচ বছর আগেও সুবর্ণচরে এমন চিত্র ছিল না। তখন এলাকায় বোরো চাষ হতো কম। বেশির ভাগ মানুষ রবি শস্য উৎপাদন করতে, তাতে ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার তেমন ছিল না। কিন্তু গেল কয়েক বছর আগে থেকে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন-বিএডিসির মাধ্যমে বেশ কয়েকটি গভীর নলকূপ স্থাপন করা হয়। অনেক কৃষকও গভীর নলকূপ স্থাপন করেছেন। এতে দিন দিন ভূগর্ভস্থ পানির ওপর চাপ বেড়েছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, সুবর্ণচরে প্রতিবছরই বাড়ছে বোরো আবাদ। পাঁচ বছর আগে এ উপজেলায় ৮ হাজার ২০০ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ হতো। তবে চলতি বছর বোরো আবাদ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৬ হাজার ৫০০ হেক্টর জমি। মৌসুমে বৃষ্টি কম হওয়ায় চাষাবাদে ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার করা হয়।
সুবর্ণচরের স্কুলশিক্ষক কামাল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, রবি ফসল চাষে ভূগর্ভের পানির প্রয়োজন তেমন হতো হতো না। যখন বোরো আবাদ বেড়েছে, তখনই সংকট শুরু হয়েছে। বোরো আবাদ যেহেতু প্রয়োজন, তাই যে সব খাল রয়েছে সেগুলো পুনরায় খনন করতে হবে। একই সঙ্গে খননকৃত খালের মুখে স্লুইসগেট স্থাপন করে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। তাহলে ভবিষ্যতে পানির সংকট দূর হবে এবং ফসল উৎপাদনের ধারাবাহিকতা বজায় থাকবে।
অতিমাত্রায় ভূগর্ভের পানির ওপর নির্ভরশীলতা জনপদকে ঝুঁকির দিকে ঠেলে দিচ্ছে বলে মন্তব্য করেন পল্লী-কর্ম সহায়ক ফাউন্ডেশন-পিকেএসএফের কৃষিবিদ শিবব্রত ভৌমিক। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, বোরো চাষে প্রতিনিয়ত অধিক পরিমাণে ভূগর্ভের পানি তোলা হচ্ছে। ফলে পানির স্তর দিন দিন নিচে নেমে যাচ্ছে। এতে একদিকে পানির সংকট ব্যাপক হচ্ছে, আবার মাটির তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। সুতরাং পানির স্তর নিচে নামার কারণে সংকট ভয়াবহ হচ্ছে।
নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মোহাম্মদ মহিনুজ্জামান বলেন, ভূগর্ভের পানির সংকট দেখা দিলে ভবিষ্যতে পানিতে লবণাক্ততা বাড়বে। আর এসব লবণাক্ত পানি কয়েক বছর টানা ব্যবহার ও পান করলে মানবদেহে বেশ কিছু রোগ দেখা দিতে পারে। যার মধ্যে কিডনি সমস্যা ও উচ্চ রক্তচাপ অন্যতম। প্রভাব পড়তে পারে নারীদের প্রজননেও।
জেলা প্রশাসক খন্দকার ইসতিয়াক আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, সুপেয় পানির সংকট দূর করতে জরুরি ভিত্তিতে কিছু সাবমার্সিবল পাম্প বরাদ্দ পাওয়া গেছে। পানির সংকট যেসব এলাকায় বেশি সেখানে এসব পাম্প বসানোর ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি আপত্কালীন ব্যবস্থা হিসেবে এরই মধ্যে বিভিন্ন এলাকায় গাড়িতে করে খাবার পানি সরবরাহ করা হচ্ছে। জেলা প্রশাসক আরও বলেন, দীর্ঘ মেয়াদি ব্যবস্থার অংশ হিসেবে তিনি এরই মধ্যে পানি উন্নয়ন বোর্ড, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর, কৃষি বিভাগ ও বিএডিসিকে নিয়ে বৈঠক করেছেন। ওই বৈঠকে খাল খননসহ বৃষ্টির পানি সংরক্ষণে ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: প রথম আল ক ব যবস থ ব যবহ র নলক প চ বছর
এছাড়াও পড়ুন:
বাণিজ্যবিরোধ: ভারত কেন ট্রাম্পের নিশানায়
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প গতকাল বৃহস্পতিবার ভারতের বাণিজ্যনীতির তীব্র সমালোচনা করেছেন। ভারতীয় পণ্যের ওপর হোয়াইট হাউসের শুল্ক বৃদ্ধির প্রস্তুতি নেওয়ার পর থেকেই এ আক্রমণের মাত্রা বেড়েছে।
ট্রাম্প জানিয়েছেন, তাঁর প্রশাসন আজ শুক্রবার (১ আগস্ট) থেকে ভারতের রপ্তানি পণ্যের ওপর ২৫ শতাংশ হারে শুল্ক আরোপ করছে এবং এর পাশাপাশি অতিরিক্ত শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ট্রাম্প যখন বিশ্বের বহু দেশের ওপর নতুন শুল্ক আরোপের পরিকল্পনা করছিলেন, তখনই ভারতকে উদ্দেশ করে তাঁর এমন কঠোর অবস্থান সামনে উঠে আসে।
হোয়াইট হাউসের অভিযোগ, ভারত মার্কিন পণ্যকে বাজারে ঠেকাতে অতিমাত্রায় শুল্ক আরোপ করছে। সম্প্রতি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ চলাকালে ভারত রুশ জ্বালানি কেনা অব্যাহত রাখায় ট্রাম্প প্রকাশ্যে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।
‘ভারতের শুল্ক বিশ্বে অন্যতম সর্বোচ্চ’, গত বুধবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এমন মন্তব্য করেন ট্রাম্প। জবাবে ভারত সরকার জানিয়েছে, তারা ট্রাম্পের বক্তব্য ‘লক্ষ্য করেছে’ এবং এর ‘প্রভাব মূল্যায়ন’ করবে।
যুক্তরাষ্ট্র-ভারত বাণিজ্যবিরোধ: পরিস্থিতি কোথায় দাঁড়িয়ে
আজ থেকে ভারতীয় পণ্যের ওপর ট্রাম্পের ধার্য করা ২৫ শতাংশ পাল্টা শুল্ক গত ২ এপ্রিল হোয়াইট হাউসের রোজ গার্ডেনে ঘোষিত সম্ভাব্য শুল্ক থেকে মাত্র ১ শতাংশ কম।
এ হার ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ও জাপানের ওপর আরোপিত ১৫ শতাংশ শুল্কের চেয়ে বেশি। তবে গত মে মাসে চীনের ওপর আরোপিত ৩০ শতাংশ শুল্কের চেয়ে কিছুটা কম।
হোয়াইট হাউসের অভিযোগ, ভারত মার্কিন পণ্যকে বাজারে ঠেকাতে অতিমাত্রায় শুল্ক আরোপ করছে। সম্প্রতি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ চলাকালে ভারত রুশ জ্বালানি কেনা অব্যাহত রাখায় ট্রাম্প প্রকাশ্যে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।এ শুল্ক ভারতের সঙ্গে চলমান বাণিজ্য আলোচনা আরও জটিল করে তুলতে পারে। একাধিক দফা আলোচনার মধ্য দিয়ে উভয় পক্ষ একটি চুক্তিতে পৌঁছানোর চেষ্টা করছে।
যুক্তরাষ্ট্রের ১২তম বৃহৎ বাণিজ্য অংশীদার ভারত। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চীন থেকে উৎপাদন সরিয়ে নেওয়া অনেক কোম্পানির নতুন গন্তব্য হয়েছে দেশটি। মে মাসে অ্যাপলের সিইও টিম কুক জানান, যুক্তরাষ্ট্রে বিক্রির জন্য আইফোন এখন ভারতে উৎপাদিত হচ্ছে; যাতে উচ্চ শুল্ক এড়ানো যায়।
যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধি কার্যালয়ের (ওটিআর) তথ্যমতে, গত বছর ভারত-যুক্তরাষ্ট্রের পণ্য বাণিজ্যের মোট পরিমাণ ছিল প্রায় ১২৯ বিলিয়ন (১২ হাজার ৯০০ কোটি) ডলার। ভারতের রপ্তানি পণ্যের মধ্যে রয়েছে পোশাক, রাসায়নিক, যন্ত্রপাতি ও কৃষিপণ্য।
ট্রাম্প কেন ভারতকে নিশানা করছেন
সম্প্রতি ট্রাম্প একাধিকবার বিভিন্ন পণ্যের ওপর ভারতের ‘অতি উচ্চ’ শুল্ক আরোপের সমালোচনা করেছেন। এর মধ্যে কৃষিপণ্য ও দুগ্ধজাত পণ্যও রয়েছে।
বুধবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ট্রাম্প লেখেন, ‘বছরের পর বছর আমরা ভারতের সঙ্গে তুলনামূলকভাবে খুব কম ব্যবসা করেছি। কারণ, তাদের শুল্ক অত্যন্ত বেশি।’
এ মুহূর্তে যখন সবাই চায় ইউক্রেনে হত্যা বন্ধ হোক, তখন ভারত চীনের সঙ্গে রাশিয়ার জ্বালানির সর্ববৃহৎ ক্রেতা।ডোনাল্ড ট্রাম্প, মার্কিন প্রেসিডেন্টদেশীয় শিল্পকে রক্ষা করতে ভারত কিছু পণ্যের ওপর ১০০ শতাংশের বেশি শুল্ক আরোপ করেছে।
ওটিআরের হিসাব অনুযায়ী, ২০২৪ সালে যুক্তরাষ্ট্র ভারতের সঙ্গে পণ্যবাণিজ্যে প্রায় ৪৫ বিলিয়ন (৪ হাজার ৫০০ কোটি) ডলারের ঘাটতি দেখেছে। এটি আগের বছরের তুলনায় ৫ দশমিক ৪ শতাংশ বেশি। তুলনামূলকভাবে গত বছর যুক্তরাষ্ট্র চীনের সঙ্গে প্রায় ২৯৫ বিলিয়ন (২৯ হাজার ৫০০ কোটি) ডলারের বাণিজ্যঘাটতিতে ছিল।
আরও পড়ুনভারতের ৬ প্রতিষ্ঠানের ওপর ট্রাম্পের নিষেধাজ্ঞা, ইরানের পণ্যের বাণিজ্যে জড়িত থাকার অভিযোগ ৩১ জুলাই ২০২৫ট্রাম্প আরও ক্ষুব্ধ যে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ চলাকালে ভারত রুশ তেল কেনা অব্যাহত রেখেছে।
‘এ মুহূর্তে যখন সবাই চায় ইউক্রেনে হত্যা বন্ধ হোক, তখন ভারত চীনের সঙ্গে রাশিয়ার জ্বালানির সর্ববৃহৎ ক্রেতা’, বুধবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লিখেছেন ট্রাম্প।
ভারতের প্রতিক্রিয়া
এ সপ্তাহে প্রকাশিত এক বিবৃতিতে ভারত সরকার ট্রাম্পের ওই বক্তব্যে তুলনামূলকভাবে মৃদু, তবে শক্ত প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে।
ভারতের ওপর ধার্য করা শুল্কহার ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ও জাপানের ওপর আরোপিত ১৫ শতাংশের চেয়ে বেশি। তবে গত মে মাসে চীনের ওপর আরোপিত ৩০ শতাংশের চেয়ে কিছুটা কম।বুধবার দেওয়া এ বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘কয়েক মাস ধরে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র একটি ন্যায্য, ভারসাম্যপূর্ণ ও পারস্পরিকভাবে লাভজনক দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য চুক্তির লক্ষ্যে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। আমরা সেই লক্ষ্য অর্জনে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’ বিবৃতিতে আরও বলা হয়, ‘সরকার জাতীয় স্বার্থ রক্ষায় প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা নেবে।’
আগস্টের শেষ দিকে দুই দেশের মধ্যে আরেক দফা বাণিজ্য আলোচনা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে।
আরও পড়ুনভারতের পণ্যে ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের ঘোষণা ট্রাম্পের, রাশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্যের জন্য আলাদা ‘দণ্ড’৩০ জুলাই ২০২৫আরও পড়ুনট্রাম্পের ২৫ শতাংশ শুল্কে ভারতের অর্থনীতি কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, কী বলছেন অর্থনীতিবিদেরা১৪ ঘণ্টা আগে