দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ গঠনের সুপারিশে একমত জামায়াতে ইসলামী। উভয় কক্ষে আসন বণ্টন চায় ভোটের অনুপাতে। সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানে নিয়োগে প্রধানমন্ত্রীর একচ্ছত্র ক্ষমতা কমাতে জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (এনসিসি) গঠনে একমত। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি ও প্রধান বিচারপতিকে চায় না। প্রধানমন্ত্রীর পদ দুই মেয়াদের সুপারিশেও একমত। গতকাল শনিবার জাতীয় সংসদে ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে সংলাপে এসব মতামত জানিয়েছে দলটি।

নির্বাচনকালীন অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের সুপারিশ করেছে কমিশন। পুরোনো তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহাল চায় জামায়াত। কমিশন সূত্র সমকালকে জানিয়েছে, নেতারা মনে করে, তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থার রূপকার জামায়াত। এ পদ্ধতিতে বিদায়ী সরকারের পছন্দের প্রধান বিচারপতিকে উপদেষ্টা বানাতে অতীতে কূটকৌশল হয়েছে। তারপরও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি থেকে সরতে চায় না জামায়াত।

সকাল সাড়ে ১০টায় শুরু হয়ে দুপুরের এক ঘণ্টা বিরতি দিয়ে বিকেল সোয়া ৫টা পর্যন্ত চলে এই সংলাপ। প্রথম দিন সংবিধান সংস্কারের অর্ধেকের বেশি সুপারিশ নিয়ে আলোচনা হয়েছে। কমিশন এবং জামায়াত সূত্র জানিয়েছে, ৬ মের পর সংবিধান সংস্কারের বাকি সুপারিশ নিয়ে বৈঠক হবে। নির্বাচন, বিচার, জনপ্রশাসন এবং দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কারের সুপারিশ নিয়েও পরে আলোচনা হবে।

প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বাধীন ঐকমত্য কমিশন ১৬৬ সুপারিশ করেছে। এতে রাজনৈতিক দলগুলোর মতামতের ওপর আলোচনা চলছে। জামায়াত ৭৭ সুপারিশে একমত, ৩৬ সুপারিশে আংশিক একমত। একমত নয় ৫৩ সুপারিশে। সংবিধান সংস্কারে ৭০ সুপারিশের ৩১টিতে একমত বলে আগেই জানিয়েছে। ১৬ সুপারিশে আংশিক একমত। বাকি ২৩ সুপারিশে একমত নয়। যেসব সুপারিশে একমত নয় এবং আংশিক একমত, সেগুলো নিয়ে আলোচনা হয়েছে গতকালের আলোচনায়।

জামায়াতের প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেওয়া নায়েবে আমির ডা.

সৈয়দ আবদুল্লাহ মো. তাহের সমকালকে জানান, কমিশনের আরও কিছু সুপারিশ জামায়াত বিবেচনা করছে। আবার জামায়াতেরও কিছু মতামত কমিশন বিবেচনা করার কথা জানিয়েছে। যেমন জামায়াত মতামত দিয়েছে, এনসিসিতে রাষ্ট্রপতি এবং প্রধান বিচারপতিকে রাখা উচিত হবে না। রাষ্ট্রপতি দেশের অভিভাবক। তাঁকে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানে আনার প্রয়োজন নেই। বিচার বিভাগকে দূরে রাখতে প্রধান বিচারপতিকেও রাখা উচিত হবে না। কমিশন জানিয়েছে, এই মতামত তারা বিবেচনা করবে। 

কমিশনের প্রস্তাব ছিল, প্রস্তাবিত দ্বিকক্ষ আইনসভার নিম্নকক্ষে বিদ্যমান পদ্ধতিতে নির্বাচন হবে। উচ্চকক্ষ আসন বণ্টন হবে নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতে।

বৈঠকের পর ডা. তাহের সাংবাদিকদের বলেছেন, জামায়াত উভয় কক্ষ আনুপাতিক ভোটে গঠন চায়। ৬০টির বেশি দেশে সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়। যে দল যত শতাংশ ভোট পাবে, সংসদে তত শতাংশ আসন পাবে। এতে বাংলাদেশের নির্বাচনে দুর্নীতি, জবরদখল ও টাকার খেলা বন্ধ হবে।

নিম্নকক্ষ আনুপাতিক পদ্ধতিতে গঠন করা হলে উচ্চকক্ষের কী প্রয়োজন– প্রশ্নে নায়েবে আমির সমকালকে বলেন, তাদের প্রধান দাবি, সংসদ নির্বাচন আনুপাতিক পদ্ধতিতে হতে হবে।

প্রধানমন্ত্রীর পদের মেয়াদে সীমাবদ্ধতার সুপারিশে জামায়াত একমত জানিয়ে ডা. তাহের ব্রিফিংয়ে বলেন, এক ব্যক্তি সর্বোচ্চ দু’বার প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন। টানা ১০ বছরের বেশি কেউ প্রধানমন্ত্রী থাকতে পারবেন না।

জামায়াত নায়েবে আমির বলেন, এনসিসি জামায়াত চায়। যখন তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হবে, সেই সময়ে এনসিসি থাকবে না। ৭০ অনুচ্ছেদ শিথিলের পক্ষে জামায়াত। তবে অর্থবিল, আস্থা প্রস্তাব এবং সংবিধান সংশোধনে দলীয় সিদ্ধান্তে ভোট দিতে হবে এমপিদের।সংবিধানের মূলনীতিতে বহুত্ববাদ যুক্ত করার প্রস্তাবে দ্বিমত জানিয়েছে জামায়াত। ডা. তাহের বলেছেন, ‘আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস’ পুনঃস্থাপনের প্রস্তাব করেছে জামায়াত। সংসদ ও রাষ্ট্রপতির মেয়াদ পাঁচ বছর বহাল রাখার প্রস্তাব করেছি।

সংস্কার সুপারিশগুলো কীভাবে বাস্তবায়ন করা হবে– এ মতামত দেয়নি জামায়াত। নায়েবে আমির বলেছেন, সুপারিশের বিষয়ে ঐকমত্য হলে জামায়াত পরে মত জানাবে কীভাবে বাস্তবায়ন করা হবে। তা জুলাই সনদে থাকতে পারে।

জামায়াতের সঙ্গে প্রথম দিনের সংলাপে সংবিধান সংস্কারের স্থানীয় সরকার এবং বিচার বিভাগ-সংক্রান্ত যেসব সুপারিশ রয়েছে, তা নিয়ে আলোচনা হয়নি কমিশনের। রাষ্ট্রের সাংবিধানিক নাম পরিবর্তনে রাজি হয়নি দলটি। তবে মৌলিক অধিকারের পরিধি বিস্তারের সুপারিশে একমত। দুদক, মানবাধিকার কমিশনকে সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেওয়ার সুপারিশেও একমত।

নিম্নকক্ষে নারীদের জন্য সরাসরি নির্বাচনে ১০০ আসন সংরক্ষিত রাখার সুপারিশে রাজি হয়নি জামায়াত। দলটি বলেছে, আনুপাতিক পদ্ধতিতে নির্বাচন হলে সরাসরি ভোটের সুযোগ নেই। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ৫০টি নারী আসন ভোটের অনুপাতে বণ্টিত হবে। 

প্রধান উপদেষ্টা আগে জানিয়েছেন ঐকমত্য কমিশনের সংলাপে যেসব প্রস্তাবে রাজনৈতিক দলগুলো একমত হবে, তা নিয়ে জুলাই সনদ হবে। এতে সব দল সই করবে। সংলাপে সভাপতিত্ব করা কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, দ্রুততার সঙ্গে জুলাই সনদ প্রণয়নের দিকে যেতে চাই। স্মরণ রাখা দরকার, আমরা এক ঐতিহাসিক মুহূর্তে আছি। শহীদদের রক্ত এই সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে, তা যেন হাতছাড়া না হয়ে যায়।

১৬ বছরের ফ্যাসিবাদী শাসনের বিরুদ্ধে জামায়াত নেতাকর্মীরা জীবনবাজি রেখে লড়াই করেছেন বলেও মন্তব্য করেন আলী রীয়াজ। তিনি বলেন, বিচারিক এবং বিচারবহির্ভূভাবে জামায়াত নেতাকর্মীদের নিপীড়ন করা হয়েছে। অত্যাচার করা হয়েছে। জামায়াত সাহসিকতার সঙ্গে তা মোকাবিলা করেছে, সংগ্রামে অংশ নিয়েছে। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনে জামায়াত ভূমিকা রাখবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।

প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দারের সঞ্চালনায় সংলাপে আরও উপস্থিত ছিলেন কমিশনের সদস্য সফর রাজ হোসেন, বিচারপতি এমদাদুল হক, ড. বদিউল আলম মজুমদার ও ড. ইফতেখারুজ্জামান।

জামায়াতের প্রতিনিধি দলে ছিলেন সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল রফিকুল ইসলাম খান, ড. হামিদুর রহমান আযাদ, এহসানুল মাহবুব জুবায়ের, আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনিরসহ জ্যেষ্ঠ নেতারা।

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: র প রস ত ব র ষ ট রপত উপদ ষ ট ঐকমত য মত জ ন মত মত সরক র এনস স

এছাড়াও পড়ুন:

জুলাই সনদের খসড়া অসম্পূর্ণ, কিছু অংশ বিপজ্জনক: জামায়াত

জুলাই সনদের খসড়াকে অসম্পূর্ণ বলেছে জামায়াতে ইসলামী। একই সঙ্গে নির্বাচিত সরকারকে দুই বছরের মধ্যে এই সনদ বাস্তবায়নের প্রস্তাবকে বিপজ্জনক বলেছে দলটি।

আজ মঙ্গলবার রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের দ্বিতীয় ধাপের ২১তম দিনের আলোচনার বিরতিতে জামায়াতের নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের এ কথা বলেন।

সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, ‘এটি অসম্পূর্ণ এবং কিছু অংশ বিপজ্জনক। আজকে তারা বলছে, এটা একটা নমুনামাত্র, ভুল হয়েছে। যদি সেটাই হয়, তাহলে মন্তব্যের দরকার নেই। তবে যদি সেটাই মূল কথা হয়, তাহলে একে গ্রহণ করা যাবে না।’

জামায়াত নিজস্ব একটি খসড়া সনদ তৈরি করছে এবং কমিশনে জমা দেবে বলে জানান তাহের। তিনি বলেন, ‘সংলাপে যেসব বিষয়ে একমত হচ্ছি, সেগুলো বাস্তবায়নের আইনি ভিত্তি থাকতে হবে।’ তিনি প্রস্তাব করেন দুটি পথ—১. অধ্যাদেশের মাধ্যমে একটি আইনি কাঠামো গঠন করে পরে নির্বাচিত পার্লামেন্টে তা অনুমোদন। ২. গণভোটের মাধ্যমে জনগণের চূড়ান্ত অনুমোদন নেওয়া।

সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, ‘আমরা যেকোনো একটি পদ্ধতিতে এই কাঠামোকে আইনগত বৈধতা দিতে চাই।’ তিনি জানান, তাঁরা ঐকমত্যের পক্ষে কিন্তু সেটা হতে হবে কার্যকর এবং আইনি কাঠামোর মধ্যে হতে হবে। অন্যথায় দেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ ‘অনিশ্চয়তার দিকে’ চলে যেতে পারে বলে তাঁরা আশঙ্কা করছেন।

জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে চলমান সংলাপে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের গঠনপ্রক্রিয়া নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা হয়েছে বলে জানান জামায়াতের এই নেতা। তিনি বলেন, ‘আমরা একমত হয়েছি যে আগামী জাতীয় নির্বাচন অবশ্যই কেয়ারটেকার সরকারের অধীনেই হতে হবে, এখানে প্রায় সবাই একমত, একমাত্র বিএনপি কিছু পর্যবেক্ষণ দিয়েছে।’

আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের জানান, প্রস্তাবিত কাঠামো অনুযায়ী পাঁচ সদস্যের একটি বাছাই কমিটি গঠিত হবে—প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতা, স্পিকার, ডেপুটি স্পিকার (বিরোধী দলের) এবং দ্বিতীয় বৃহত্তম বিরোধী দলের একজন প্রতিনিধি। এঁরা ১২ জন সম্ভাব্য প্রার্থীর মধ্য থেকে কেয়ারটেকার সরকারের প্রধান নির্বাচন করবেন।

যদি একমত না হন, তাহলে প্রথমে সর্বসম্মতভাবে, পরবর্তী সময়ে এক চয়েস ভোট, তারপর প্রয়োজনে র‍্যাংক চয়েস ভোটিং পদ্ধতির মাধ্যমে সিদ্ধান্ত হবে। এ পদ্ধতিতে ভোটার হবেন মোট সাতজন—ওপরে উল্লিখিত পাঁচ সদস্য এবং সুপ্রিম কোর্ট ও হাইকোর্টের একজন করে বিচারপতি।

জামায়াতের এ নায়েবে আমির বলেন, ‘বিচারপতি দুজন যুক্ত করা হয়েছে যেন এককভাবে তৃতীয় দল বা অন্য কেউ ডিসাইডিং ফ্যাক্টর না হয়ে যায়। আমরা আশা করি, বিচারপতিরা নিরপেক্ষ থাকবেন এবং হর্স ট্রেডিংয়ের আশঙ্কা কমবে।’ তিনি জানান, বিএনপির আপত্তি মূলত এই যে—যদি ঐকমত্য না হয় তাহলে বিষয়টি সংসদে পাঠানো হোক। তবে জামায়াতসহ বেশির ভাগ দল মনে করে সংসদে পাঠালে তা আর সিদ্ধান্তে পৌঁছাবে না।

আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, ‘সংসদে পাঁচ-ছয়টা দল আছে, অথচ এই বডিতে ৩০টির বেশি দলের প্রতিনিধিত্ব রয়েছে। এখানেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া জরুরি।’

আজকের আলোচনায় জামায়াতে ইসলামী ছাড়াও বিএনপি, এনসিপি, ইসলামী আন্দোলন, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), গণসংহতি আন্দোলনসহ ৩০টি রাজনৈতিক দল অংশ নেয়। আলোচনায় সভাপতিত্ব করেন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ। প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দারের সঞ্চালনায় আরও উপস্থিত আছেন সফর রাজ হোসেন, বিচারপতি এমদাদুল হক, ড. বদিউল আলম মজুমদার, ড. ইফতেখারুজ্জামান, ড. আইয়ুব মিয়া।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • মৌলিক সংস্কার নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর কার কী অবস্থান
  • উচ্চকক্ষে পিআর পদ্ধতিতে একমত হলেও বাস্তবায়নের সুস্পষ্ট রূপরেখা চায় এনসিপি
  • জুলাই সনদ বাস্তবায়নের মূল দায়িত্ব রাজনৈতিক দলগুলোর
  • রাজনৈতিক দলের মতের ভিত্তিতে  জুলাই সনদের খসড়ায় সংশোধনী আনা হচ্ছে: আলী রীয়াজ  
  • মৌলিক সংস্কারের সব বিষয়ে মতৈক্য হয়নি
  • জুলাই সনদ ও ঘোষণাপত্র বাস্তবায়নে আইনি ভিত্তি জরুরি: জামায়াতের নায়েবে আমির
  • জুলাই সনদের খসড়া নিয়ে ৩ দলের আপত্তি, বিএনপি মোটামুটি একমত
  • জুলাই সনদ ও ঘোষণাপত্রের সাংবিধানিক নয়, রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির পক্ষে বিএনপি
  • তত্ত্বাবধায়ক নিয়ে একমত হলেও প্রধান উপদেষ্টা মনোনয়নের প্রক্রিয়ায় মূল বিরোধ: আলী রীয়াজ
  • জুলাই সনদের খসড়া অসম্পূর্ণ, কিছু অংশ বিপজ্জনক: জামায়াত