তুচ্ছতর অভিযোগে টাঙ্গাইলের ধনবাড়ী উপজেলায় ‘অভয়ারণ্য’ পাঠাগার হইতে পাঁচ শতাধিক গ্রন্থ লুণ্ঠনের অঘটন যথেষ্ট উদ্বেগজনক। সমকালে শনিবার প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, বৃহস্পতিবার রাত্রিতে ১৫-২০ জন পাঠাগারে প্রবেশ করিয়া গ্রন্থসমূহ লইয়া যায়। পরবর্তী সময়ে পাঁচটি বস্তায় পূর্ণ করিয়া গ্রন্থসমূহ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) নিকট জমা দেওয়া হয়। উহাদের দাবি, ঐ সকল গ্রন্থ পাঠ করিয়া নাকি যুবসমাজ ‘ধর্মবিরোধী’ হইয়া উঠিতেছে। আমরা জানি, কাহারও কোনো কর্মকাণ্ডকে রাষ্ট্র ও সমাজের জন্য ক্ষতিকর মনে হইলে বিদ্যমান আইনে তাহা বন্ধ করিবার সুর্নিদিষ্ট প্রক্রিয়া রহিয়াছে। আলোচ্য ঘটনা উক্ত প্রক্রিয়ার সহিত সংগতিপূর্ণ তো নয়ই; ফৌজদারি অপরাধও বটে। পাঠাগার কর্তৃপক্ষের অভিযোগ, উক্ত নৈতিক পুলিশগিরিতে লিপ্ত যুবকেরা প্রায় দুই লক্ষ টাকার গ্রন্থ ও নথিপত্র লুণ্ঠন এবং ৫০ সহস্র টাকার আসবাব ভাঙচুর করিয়াছে। স্থানীয় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বলিয়াছেন, ‘তৌহিদি জনতা’র নাম করিয়া কয়েকজন কাহারও অনুমতি ব্যতিরেকে বস্তাবন্দি করিয়া গ্রন্থগুলি তাঁহার অফিসে লইয়া যায়। অর্থাৎ তাঁহার কথায়ও ইহা স্পষ্ট– অভিযুক্ত যুবকেরা আইন স্বীয় হস্তে তুলিয়া লইয়াছে, যাহা প্রচলিত আইনে একটি অপরাধ।

বিস্ময়কর হইলেও সত্য, যেই গ্রন্থগুলি উক্ত যুবকেরা লইয়া গিয়াছে, সেইগুলির মধ্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের গ্রন্থও রহিয়াছে। তাহাদের গ্রন্থ আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার বিভিন্ন ধাপে পাঠ্যপুস্তকরূপে অন্তর্ভুক্ত। তাই সর্বস্তরের শিক্ষার্থীদের সেইগুলি নিয়মিতই পাঠ করিতে হয়। এই প্রেক্ষাপটে বলা যায়, পাঠাগারের সভাপতি সুপ্তি মিত্র যথার্থই বলিয়াছেন, হামলা শুধু বইয়ের উপর নহে, মুক্তচিন্তা ও যুক্তিনির্ভর জ্ঞানচর্চার নিরাপদ পরিসরকে ধ্বংসের অপচেষ্টা। ইহার ফল কাহারও জন্যই শুভ হইতে পারে না। এহেন হামলা বিশেষত গত বৎসরের জুলাই-আগস্ট আন্দোলনের চেতনাবিরোধী বলিয়া আমরা মনে করি। কারণ সেই আন্দোলনের অন্যতম অঙ্গীকার ছিল, রাষ্ট্র ও সমাজকে অন্তর্ভুক্তিমূলকরূপে গড়িয়া তোলা এবং মতপ্রকাশের সংবিধানস্বীকৃত স্বাধীনতা নিশ্চিত করা। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার যেই রাষ্ট্র সংস্কার কর্মসূচি লইয়া জাতীয় ঐকমত্য গঠনের প্রয়াস চালাইতেছে, সেই সকল কর্মসূচিরও লক্ষ্য অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে, রাষ্ট্র ও সমাজে ভিন্নমতের প্রতি সহনশীলতাকে উৎসাহ প্রদান।
বস্তুত কয়েক মাস যাবৎ রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ভিন্নধর্ম ও মতের মানুষদের উপর মহলবিশেষের যে হামলা চলিয়াছে, সেই সকল ঘটনা হইতে ধনবাড়ীর ঘটনাকে পৃথক করা কঠিন। রংপুর, ময়মনসিংহ, জয়পুরহাটসহ বিভিন্ন স্থানে নারীদের ফুটবল খেলার বিরুদ্ধে ইতঃপূর্বে যাহারা অপপ্রচার চালাইয়াছেন, এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে নারীদের ফুটবল খেলা বন্ধ করিয়া দিয়াছেন, তাহারা ঐ মহলেরই অংশবিশেষ। বিভিন্ন স্থানে নাটক, কনসার্টসহ সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড উহারাই বন্ধ করিয়া দিয়াছেন। এমনকি দেশের বিভিন্ন স্থানে মাজারের উপর যাহারা হামলা ও ভাঙচুর চালাইয়াছে, তাহারাও এই একই গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত বলিয়া আশঙ্কা অমূলক হইতে পারে না। এইভাবে নিজেদের রক্ষণশীল মত অন্যদের উপর চাপাইয়া দিবার অন্যায় ও বেআইনি প্রচেষ্টাকে যদি সূচনাতেই বন্ধ করা যাইত, তাহা হইলে হয়তো আলোচ্য ঘটনাটি ঘটিত না।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা দুই পক্ষকে লইয়া বসিয়া সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করিবেন বলিয়া সমকালকে জানাইয়াছেন। আমরা ইহাকে সাধুবাদ জানাই। কিন্তু তাঁহাকে একই সঙ্গে ইহাও নিশ্চিত করিতে হইবে– পাঠাগারটি যেন যথাস্থানে পূর্বের ন্যায় কার্যক্রম চালাইয়া যাইতে পারে। এই বিষয়টি তখনই নিশ্চিত করা যাইবে যখন 
উক্ত হামলাকারীরা উপলব্ধি করিবে– তাহারা যাহা করিয়াছে তাহা অন্যের সংবিধানস্বীকৃত অধিকার লঙ্ঘন; সর্বোপরি রাষ্ট্র ও সমাজকে পশ্চাৎমুখী করিবার অপচেষ্টার সমতুল্য। পাঠাগারটি হইতে অন্যদের সহিত যেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গ্রন্থও লুণ্ঠিত হইয়াছে, তিনি অন্ধকারের যাত্রীদিগকে আলো হস্তে চলিবার মহাবৈশ্বিক প্রবণতার কথা বলিয়াছিলেন; আলোচ্য ক্ষেত্রে বিপরীতটিই ঘটিয়াছে। অন্ধকারের যাত্রীসকল আলোই নিভাইয়া দিতে উদ্যত; বিশ্বের পানে চাহিয়া নহে, নেহাত স্বীয় কূপমণ্ডূকতা প্রমাণ করিতে।

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: র গ রন থ র উপর উপজ ল

এছাড়াও পড়ুন:

ভোগবাদী যুগে ইসলামে সুখের খোঁজ

আপনার বাড়িতে কি অপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের স্তূপ জমে আছে? জানেন কি, এর থেকে মুক্তির পথ আছে ইসলামের সরল জীবনধারায়? আধুনিক বিশ্বে ভোগবাদের তীব্র ঝড়ে আমরা প্রায়ই নিজেদের দেখি অপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রে ঠাসা ঘরে।

নতুন ফ্যাশনের পোশাক, সর্বশেষ প্রযুক্তির গ্যাজেট বা মধ্যরাতে এক ক্লিকে কেনা অপ্রয়োজনীয় পণ্য—এসব আমাদের জীবনের অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু ইসলাম আমাদের ন্যূনতম একটি সরল জীবনধারার পথ দেখায়, যা পার্থিব লোভ থেকে মুক্ত করে আমাদের আল্লাহর পথে নিবেদিত হতে উৎসাহিত করে।

আয়েশা, তুমি যদি আমার সঙ্গে মিলিত হতে চাও, তবে এই দুনিয়া থেকে একজন পথিকের প্রয়োজনীয় জিনিসের মতো সামান্য গ্রহণ করো।সুনানে তিরমিজি, হাদিস: ১৭,৮০০সংযম কেন জরুরি

মিনিমালিজম বা ন্যূনতাবাদ এমন একটি জীবনধারা, যেখানে আমরা শুধু প্রয়োজনীয় জিনিসের ওপর নির্ভর করব এবং অতিরিক্ত ভোগবিলাস থেকে দূরে থাকব। ক্রমাগত কেনাকাটার দিকে প্রলুব্ধ না হয়ে শুধু যেটুকু না হলেই জীবন চলে না, সেটুকু নিজের কাছে রাখব।

আল্লাহ তাআলা বলেছেন, ‘হে আদম সন্তান, প্রত্যেক নামাজের সময় বেশভূষা সৌন্দর্য গ্রহণ করো, খাও এবং পান করো, কিন্তু অপচয় কোরো না। নিশ্চয়ই তিনি অপচয়কারীদের পছন্দ করেন না।’ (সুরা আ’রাফ, আয়াত: ৩১)।

এই আয়াত আমাদের জীবনে সংযম ও সরলতার গুরুত্ব মনে করিয়ে দেয়।

আরও পড়ুনদুনিয়ার ভোগ–বিলাস নিয়ে সুরা তাকাসুরের সতর্কতা১০ এপ্রিল ২০২৩

বিজ্ঞাপনের প্রলোভন আজকাল আমাদের অপ্রয়োজনীয় কেনাকাটার দিকে ঠেলে দেয়। প্রায়ই এমন জিনিস কিনে ফেলি, যেমন একটি ইউএসবি মগ হিটার বা জামাকাপড়, যা তারপর বছরের পর বছর অব্যবহৃত পড়ে থাকে।

বাড়িতে জমে থাকে প্যাকেট না খোলা গ্লাস–বক্স, অপঠিত বইয়ের স্তূপ। প্রশ্ন করে দেখি তো, আমাদের আসলেই কি এগুলো প্রয়োজন ছিল?

মহানবী (সা.)-এর সাদাসিধা জীবন

মহানবীজি (সা.) এবং তাঁর সাহাবারা সরল জীবনযাপনের উজ্জ্বল উদাহরণ। হজরত আয়েশা (রা.)-কে নবীজি বলেছিলেন, ‘হে আয়েশা, তুমি যদি আমার সঙ্গে মিলিত হতে চাও, তবে এই দুনিয়া থেকে একজন পথিকের প্রয়োজনীয় জিনিসের মতো সামান্য গ্রহণ করো। ধনীদের সঙ্গে মেলামেশা থেকে সাবধান থাকো এবং কোনো পোশাককে তখনই জীর্ণ হয়ে গেছে মনে করো, যখন তুমি তাতে প্যাঁচ লাগিয়েছ (মানে যখন পুরোনো হয়ে যাওয়ার কারণে পেঁচিয়ে যায়)।’ (সুনানে তিরমিজি, হাদিস: ১৭,৮০০)।

এই হাদিসে নবীজি (সা.) স্পষ্টভাবে সরল জীবনযাপন এবং অতিরিক্ত সম্পদ সঞ্চয় থেকে দূরে থাকার পরামর্শ দিয়েছেন।

উপহারের পরিবর্তে আমরা দাতব্য সংস্থায় দানের জন্য অনুরোধ করতে পারি। এমনকি আমাদের একটি অনলাইন সাবস্ক্রিপশন বাতিল করে সেই অর্থ স্থানীয় মসজিদে দান করতে পারি।

ইসলাম আমাদের শেখায় যে পার্থিব সম্পদ ক্ষণস্থায়ী এবং এটি আমাদের চিরস্থায়ী জীবনের জন্য প্রস্তুতির পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। নবীজি (সা.) কখনো অপ্রয়োজনীয় সম্পদ সঞ্চয় করেননি এবং সব সময় দানশীলতার মাধ্যমে আল্লাহর পথে ব্যয় করতে উৎসাহিত করেছেন।

দানের সংস্কৃতি

আজকের বিশ্বে ভোগবাদী সংস্কৃতি আমাদের জীবনকে জটিল করে তুলেছে। ক্রেডিট কার্ড, সহজলভ্য ঋণ এবং ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মগুলো আমাদের ক্রমাগত কেনাকাটার দিকে প্রলুব্ধ করে। আমাদের পূর্ববর্তী প্রজন্ম, যেমন আমাদের দাদা-দাদিরা, সীমিত সম্পদের মধ্যে সরল জীবন যাপন করতেন। কিন্তু গত কয়েক দশকে বিশ্বব্যাপী মধ্যবিত্ত শ্রেণির উত্থান এবং সহজে ঋণ পাওয়ার সুযোগ আমাদের ভোগবাদী প্রবৃত্তিকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।

আরও পড়ুনখাদ্যনিরাপত্তা নিয়ে ইসলামের নির্দেশনা০৯ জুন ২০২৫

কিন্তু ইসলাম আমাদের শেখায়, প্রয়োজনের বাইরে অতিরিক্ত সম্পদ সঞ্চয় করা লোভ ও কৃপণতার দিকে নিয়ে যায়, যা একজন মুমিনের বৈশিষ্ট্য নয়।

ইসলাম আমাদের জীবনকে সরল করার পাশাপাশি আল্লাহর পথে ব্যয় করতে উৎসাহিত করে। আমরা চাইলে মাসিক বাজেটের একটি অংশ দানের জন্য বরাদ্দ করতে পারি।

যে ব্যক্তি নিজের সম্পদে সংযমী হয় এবং আল্লাহর পথে ব্যয় করে, তার জন্য জান্নাতের দরজা খুলে যায়।সহিহ মুসলিম, হাদিস: ৯৯৪

বিয়ের মতো উৎসবে আমরা বিলাসবহুল আয়োজনের পরিবর্তে সরলতা বেছে নিতে পারি। উপহারের পরিবর্তে আমরা দাতব্য সংস্থায় দানের জন্য অনুরোধ করতে পারি। এমনকি আমাদের একটি অনলাইন সাবস্ক্রিপশন বাতিল করে সেই অর্থ স্থানীয় মসজিদে দান করতে পারি।

নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি নিজের সম্পদে সংযমী হয় এবং আল্লাহর পথে ব্যয় করে, তার জন্য জান্নাতের দরজা খুলে যায়।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ৯৯৪)।

আমাদের ভালো কাজ এবং দানশীলতা পরকালে যেমন উপকারে আসবে, তেমনি সমাজের জন্যও হবে কল্যাণকর। অপ্রয়োজনীয় খরচ কমিয়ে দানশীলতার দিকে মনোযোগ দিলে সমাজের দরিদ্র ও অভাবী মানুষের জীবন উন্নত হবে।

ভোগবাদী জীবন মানুষকে অস্থির করে তোলে এবং ন্যূনতম খরচের জীবনধারা মানুষকে তৃপ্তির জীবন উপহার দেয়। এটি একই সঙ্গে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনেরও একটি পথ।

আমরা যদি আমাদের অপ্রয়োজনীয় খরচ কমিয়ে আল্লাহর পথে ব্যয় করি, তবে তা আমাদের ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনকে সমৃদ্ধ করবে। ন্যূনতমবাদ আমাদের মনে করিয়ে দেয়, আমাদের প্রকৃত সুখ পার্থিব সম্পদে নয়, বরং আল্লাহর সন্তুষ্টি ও পরকালের প্রস্তুতিতে নিহিত।

আরও পড়ুনআধুনিক এই প্রবণতার শিকড় ইসলামে২০ মে ২০২৫

সম্পর্কিত নিবন্ধ