বাংলাদেশের গণমাধ্যমে পুরুষের পাশাপাশি নারীরা কাজ করছেন বহুদিন ধরেই, তবে এটা সবাই জানেন, সাংবাদিকতার সঙ্গে জড়িত নারীদের চলার পথটি মসৃণ নয়। পরিবার, সমাজ এমনকি কর্মক্ষেত্রেও নানা বাধাবিপত্তি পেরিয়ে সামনে আগাতে হয় তাদের। সাংবাদিকতা পেশাটি আর দশটি পেশার মতো নয়, এই পেশাটি চ্যালেঞ্জিং ও ঝুঁকিপূর্ণ। পেশাদারিত্ব, দায়িত্ববোধ এবং পেশার প্রতি আবেগ থাকলেই এ পেশায় টিকে থাকা সম্ভব। নারীরা যারা দীর্ঘদিন ধরে এই পেশায় আছেন তারা তাদের মেধা, দক্ষতা, যোগ্যতা, পেশাদারিত্ব এবং দায়িত্ববোধ নিয়েই টিকে আছেন। আমরা সাধারণভাবে বলতে ভালোবাসি, গত ২৫ বছরে গণমাধ্যমে নারীর উপস্থিতি বেড়েছে। এ পেশার পরিধি এখন শুধু সংবাদপত্র রেডিও ও টেলিভিশনেই সীমাবদ্ধ নেই, সেই সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অনলাইন, এফএম রেডিও এবং কমিউনিটি রেডিও। গণমাধ্যমের সংখ্যা বাড়লেও কঠিন বাস্তবতা হলো, অন্য পেশায় নারীর সংখ্যা যতটা বাড়ছে, সে তুলনায় সাংবাদিকতায় সংখ্যাগতভাবে নারীর উপস্থিতি ততটা বাড়ছে না।
বাংলাদেশের গণমাধ্যমে কত নারী কাজ করেন তার সাম্প্রতিক কোনো পরিসংখ্যান নেই। তবে কয়েকটি হিসাব দিয়ে আমরা পরিস্থিতিটা আন্দাজ করতে পারি। যেমন, জাতীয় প্রেসক্লাবের হিসাব; এখানে ১২৫২ জন স্থায়ী সদস্যের মধ্যে নারী সদস্য মাত্র ৭২ জন। ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের ছয় হাজার সদস্যের মধ্যেও নারীর সংখ্যা ১৫০ জনের বেশি নয়। রিপোটার্স ইউনিটির ১৮০০-এর বেশি সদস্যের মধ্যে নারী মাত্র ১৪০ জন। এ ছাড়াও উল্লেখ করা প্রয়োজন, সাংবাদিকতায় এখনো নেতৃত্ব পর্যায়ে নারীর উপস্থিতি হাতে গোনা মাত্র। কয়েক বছর আগে তথ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গিয়েছিল, ইংরেজি বাংলা অনলাইনসহ প্রায় ২০০ গণমাধ্যমে কর্মরত নারী সম্পাদক আছেন ৬ জন। এরা সবাই সম্পাদক হয়েছেন মালিকানা সূত্রে, সাংবাদিকতার সঙ্গে সম্পৃক্ততার কারণে নয়। টেলিভিশন চ্যানেলের মধ্যে নারী হেড অব নিউজ একজন, প্রধান বার্তা সম্পাদক একজন এবং বার্তা সম্পাদক মাত্র ২ জন নারী।
তবে গত আট মাসে অবশ্য এই সংখ্যা বদলে গেছে। এই প্রজন্মের একজন নারী সাংবাদিকের সঙ্গে আলোচনা করে জানা গেল, বেশির ভাগ টেলিভিশন চ্যানেলেই নারী সাংবাদিক বা রিপোর্টার নিয়োগে অনীহা রয়েছে। নীতি-নির্ধারণী পদে নারীর উপস্থিতি নেই বললেই চলে।
সাংবাদিক সংগঠনগুলোতেও নেতৃত্বে নারীর অংশীদারিত্ব নেই। রিপোটার্স ইউনিটির ২৫ বছরের ইতিহাসে কার্যনির্বাহী কমিটিতে সর্বোচ্চ ভাইস প্রেসিডেন্ট পদে ২০০৫ সালে একবার মাহমুদা চৌধুরী নির্বাচিত হয়েছিলেন। এছাড়া ২০১১ সালে একটি নারী বিষয়ক সম্পাদকের পদ তৈরি করা হয় যেখানে নারীরা প্রতিনিধিত্ব করেন। এই পদের বাইরে সদস্য পদে দু’এক জন নারী নির্বাচিত হন। তবে সম্প্রতি সংস্কৃতি, খেলাধুলা ও যুগ্ম-সম্পাদক পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে কয়েকজন নারী সাংবাদিক নির্বাচিত হয়েছেন। জাতীয় প্রেসক্লাবের ৬৬ বছরের ইতিহাসে প্রথম নারী সাধারণ সম্পাদক নির্বচিত হয়েছেন একজন, তিনি ফরিদা ইয়াসমিন। পরে অবশ্য তিনি সভাপতি পদেও দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়া সাংবাদিক ইউনিয়নগুলোতে নারীর অবস্থান প্রায় একই রকম।
গ্লোবাল মিডিয়া মনিটরিং প্রজেক্ট ২০১৫-এর প্রতিবেদনে বাংলাদেশের গণমাধ্যমে নারী-পুরুষের বৈষম্যের চিত্র তুলে ধরে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে সাংবাদিকদের ৮৪ শতাংশ পুরুষ, আর নারী ১৬ শতাংশ। এর মধ্যে সংবাদপত্রে ৮ শতাংশ, রেডিওতে ৩৩ শতাংশ এবং টেলিভিশনে ১৯ শতাংশ নারী সাংবাদিক কাজ করেন। তবে গণমাধ্যমে সংবাদ উপস্থাপনের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের বৈষম্য কম। যেমন, রেডিওতে ৬৭ শতাংশ ও টেলিভিশনে ৬৬ শতাংশ উপস্থাপিকা নারী। অর্থাৎ সার্বিকভাবে রেডিও ও টেলিভিশনে ৬৬ শতাংশ নারী ও ৩৪ শতাংশ পুরুষ উপস্থাপক হিসেবে কাজ করছেন। সংবাদ উপস্থাপনের ক্ষেত্রে নারীর অধিকসংখ্যক উপস্থিতির পেছনে কি মনস্তত্ব কাজ করছে তা আশাকরি কারো অজানা নয়। নারী সাংবাদিক কেন্দ্রের সভাপতি নাসিমুন আরা হক মিনু বাংলা ট্রিবিউনকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে এ প্রসঙ্গে বলেছিলেন, ‘টেলিভিশন মালিকরা বা কর্তৃৃপক্ষ মনে করেন, নারীরা দেখতে সুন্দর। তাই তাদের ‘প্রেজেন্টার’ বা উপস্থাপক পদে নিয়োগ দিচ্ছেন। কিন্তু রিপোর্টার বা নীতিনির্ধারণী পদে নারীর অংশগ্রহণ আশানুরূপভাবে বাড়ছে না। মিডিয়ার অনেক প্রতিষ্ঠানের পলিসি হচ্ছে, মেয়েদেও নেবো না, মেয়েরা পারবে না- এটা একটা পশ্চাৎপদ মানসিকতা, যেখান থেকে নিয়োগদাতারা এখনও পুরোপুরি বেরিয়ে আসতে পারেননি। কোথাও কোথাও সহযোগিতা পেলেও অনেক প্রতিষ্ঠান এখনও চায় না মেয়েদের নিয়োগ দিতে। তবে একেবারে কিছু হয়নি তা নয়, কিছু না হলে মেয়েরা এতো দূর আসতে পারতো না। তবে ছেলেদের তুলনায় গণমাধ্যমে এখনো মেয়েদের স্বীকৃতি অনেক কম।’
গণমাধ্যমে নারীর সংখ্যা না বাড়ার পেছনে অনেক কারণকেই দায়ী করা যায়, তবে বিভিন্ন সময় নারী সাংবাদিকরা নিজেরাই যেসব কারণ চিহ্নিত করেছেন, সেসবই তুলে ধরছি এই লেখায়।
অনেক নারী সাংবাদিক জানিয়েছেন, সাংবাদিকতায় পুরুষের তুলনায় নারীকে অনেক বেশি যোগ্যতার প্রমাণ রাখতে হয়। প্রথমত তাকে প্রমাণ করতে হয় যে, পুরুষ যেটা করতে পাওে সেটা করতে তিনিও সক্ষম। তারপর তাকে পুরুষ সহকর্মীর সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হয়। তাছাড়া অনেকের মধ্যেই একটা ‘মাইন্ড সেট’ কাজ কওে যে এই কাজ নারী পারবে না বা পারে না। বলাবাহুল্য, এই মাইন্ড সেট নারীকেই ভাঙতে হয়। আমি যত জায়গায় কাজ করেছি সেখানে প্রাতিষ্ঠানিক কোনো বৈষম্যের শিকার হইনি। তবে মনস্তাত্বিক বাধা এখনো প্রবল।
নারী সাংবাদিকমাত্রই জানেন কর্মক্ষেত্রে তাদের কি ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হয়। তাকে প্রতি পদে প্রমাণ করতে হয় যে সে যোগ্য। অবস্থার কিছুটা পরিবর্তন হলেও সাধারণভাবে এখনো নারীদের রাজনীতি, অপরাধ, অর্থনীতি বা কূটনীতির মতো বিষয় নিয়ে সাংবাদিকতা করাকে অনেকেই মানতে পারেন না। তাদের ধারণা, নারী সাংবাদিক মানেই হলো তারা হালকা বিষয় নিয়ে প্রতিবেদন করবেন।
এ ছাড়াও আছে পুরুষ সহকর্মীদের সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে প্রতিযেগিতা এবং অসম তুলনা। এর বাইরে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি তো আছেই। কর্মস্থলে বৈষম্য নিয়েও নারী সাংবাদিকদের অনেকেরই তিক্ত অভিজ্ঞতা রয়েছে। অনেকেই জানিয়েছেন, দৃশ্যত কর্মস্থলে বৈষম্য না থাকলেও বৈষম্যমূলক আচরণ অনেকটা নির্ভর করে যিনি সুপারভাইজ করেন, তার মানসিকতার ওপর।
সাংবাদিকতা পেশায় নারীর আসা এবং টিকে থাকার ক্ষেত্রে আরেকটা বড় চ্যালেঞ্জ পরিবারের অসহযোগিতা। পরিবারের সমর্থন কর্মজীবী নারীর জন্য একটা বড় ব্যাপার। আর নারী বিবাহিতা হলে সেটা আরো বেশি প্রয়োজন। সাংবাদিকতা ২৪ ঘণ্টার পেশা। কোনো নারী রাতেও কাজ করবেন, এটা বাংলাদেশের অনেক পরিবার ভাবতেই পারেন না। সিনিয়র অনেক সাংবাদিক এখনো মনে করেন, বাংলাদেশে সংবাদ কক্ষেও নেতৃত্বে নারীদের এগিয়ে আসার মতো পরিবেশ তেরি হয়নি।
একজন নিউজ এডিটর যদি মহিলা হন, তাকে গভীর রাত পর্যন্ত কাজ করতে হবে। আমাদেও মেয়েদের মধ্যে যোগ্যতার অভাব আছে এটা আমি বলব না, কিন্তু পরিবেশের কারণে তারা এগিয়ে আসতে পারছে না। দায়িত্ব তারা নেয়ও না, মালিক তাকে দায়িত্ব দিতেও চায় না। বলাবাহুল্য এই মানসিকতা তার একার নয়, আরো অনেকের। যদিও ব্যক্তিগতভাবে দেখেছি অনেক নারীই দায়িত্ব নিতে চান, কিন্তু নিরাপত্তা বা অন্য অজুহাত দেখিয়ে কর্তৃপক্ষ বরং তাদের নিরুৎসাহিত করেন। বিবিসির একটি রিপোর্টে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ড.
দৈনিক প্রথম আলোর একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে: ‘দেশের অর্ধেক জনগোষ্ঠী নারী, সেই হিসাবে গণমাধ্যমের অর্ধেক জায়গা নারীর জন্য বরাদ্দ রাখার কথা। কিন্তু তা হচ্ছে না। বরং নারী সাংবাদিকেরা যখন নারী ও শিশুর বিষয়ে লেখেন, তখন তাঁর কাজটাকে অবজ্ঞার চোখে দেখা হয়।’ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নারী সাংবাদিকেরা যখন ভালো কাজ করেন, তখন শুনতে হয়, মেয়ে বলে বাড়তি সুবিধা দিয়ে কাজটি আদায় করেছে। আবার কোনো কাজে কৃতকার্য হতে না পারলে শুনতে হয়- পারবে কেমনে, ও তো মেয়ে!
কাজের প্রয়োজনে সারা দিন সন্তানকে ছাড়া থাকতে হয় বলে মা হিসেবে নারী সাংবাদিকরা এক ধরনের মানসিক যন্ত্রণার মধ্যে থাকেন। কিন্তু কর্মক্ষেত্রে অনেক সময় শুনতে হয়, ও কেমন মা? সন্তানের খোঁজ রাখে না! আবার সন্তানের কথা অফিসে বললে শুনতে হয়, মেয়েরা শুধু সন্তানের অজুহাত দেয়। পুরুষ সাংবাদিকেরা যখন রাত আটটার পওে প্রেসক্লাবে আড্ডা দিতে যাচ্ছেন, তখন কিছু বলা হয় না। আর কোনো মেয়ে সেই সময় একটু তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরতে চাইলে কথা শুনতে হয়। এমনকি নারী কর্মীরা পদোন্নতি পেলেও শুনতে হয় মন্দ কথা।
রাজধানীকেন্দ্রীক দু’একটি বড় পত্রিকা ছাড়া পত্রিকা অফিসগুলোতে নারীবান্ধব কর্মপরিবেশের অভাব, শিশু দিবাযতœ কেন্দ্র না থাকা, যাতায়াতের সুব্যবস্থা না থাকা এবং পুরুষ সহকর্মীদের কাছ থেকে অবজ্ঞা, অবহেলা অনেক নারীকেই এই পেশায় দীর্ঘ সময় টিকে থাকাকে নিরুৎসাহিত করে। নারী সাংবাদিকদের কাজে ধরে রাখতে চাইলে নারীবান্ধব কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে এবং অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা দিতে হবে। গণমাধ্যমে নারীর সংখ্যা যত বাড়বে, পরিস্থিতি তত পাল্টাতে থাকবে।
আরেকটি বিষয় জরুরি, গণমাধ্যমে শুধু নারীরাই নিজেদের প্রতি বৈষম্য নিয়ে কথা বললে হবে না, বরং নারীরা যেটা চাইছে সেটা পুরুষদেরও আন্তরিকভাবে চাইতে হবে। কর্মপরিবেশ বদলাতে হলে পুরুষ সহকর্মীর সক্রিয় ও সহমর্মী সহযোগিতা দরকার। কেননা, নারীর অবস্থা পরিবর্তনের দায় শুধু নারীর নয়, পুরুষেরও। একটা দেশ বা সমাজ কতটা এগুলো তা অনেকখানিই নির্ভর করে সেই দেশ বা সমাজের নারীদের অবস্থানের উপর। যে সমাজ ও প্রতিষ্ঠানে নারীরা সমতা ও মর্যাদাপূর্ণ অবস্থানে থাকে, নারীরা তাদের ন্যায্য অধিকার পায়, সেই সমাজ ও প্রতিষ্ঠানকে ততটা উন্নত বলা হয়। সুতরাং নারীর উন্নয়ন বা নারীর মর্যাদা শুধু নারীর একার বিষয় নয়, এটা পুরো সমাজের বিষয়, পুরো প্রতিষ্ঠানের বিষয় এবং পুরো দেশের বিষয়। নারী সাংবাদিকদের সমস্যাকে তাই নারীর একার সমস্যা ভাবলে আমাদের খুব বড় ভুল হবে।
ইদানিং আরেকটি বৈষম্যমূলক সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছেন অনেক পেশাদার নারী সংবাদকর্মী। যা তাদের পেশাগত জীবনে সামনের দিকে এগুনোকে বাধাগ্রস্ত করছে। অনেক প্রবীণ নারী সাংবাদিককে বলতে শুনেছি, মিডিয়া জগতে বয়স বাড়লে পুরুষ সহকর্মীকে বলা হয় ‘অভিজ্ঞ’ আর নারী সাংবাদিককে বলা হয় ‘অযোগ্য’। এই সমাজে নারীরা নানা সামাজিক বাধা বিপত্তি মোকাবেলা করে নিজ যোগ্যতা ও দক্ষতার ভিত্তিতে পরিণত বা মধ্যবয়সে যখন একজন পরিপূর্ণ সাংবাদিক হয়ে ওঠেন, গণমাধ্যমের নীতিনির্ধারণী পদে আসীন হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেন, তখনই তাকে বাতিলের খাতায় ফেলে দেয়ার পাঁয়তারা শুরু হয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম থাকলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বয়স্ক ও অভিজ্ঞ নারী সাংবাদিকরা কাজ পান না। বয়স বাড়লে তারা কাজ হারান, চাকরিচ্যুত হন। এটি সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে ঘটছে বলে মনে করেন অনেকে।
তাছাড়া, ঢাকার বাইরে মফস্বলে যেসব নারী সাংবাদিক কাজ করেন তাদের অবস্থা আরো খারাপ। অনেক প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে তাদের টিকে থাকতে হয়। ভারতীয় নারী সাংবাদিকদের নিয়ে করা সাম্প্রতিক একটি জরিপে দেখা গেছে, অনেক সময়ই নারী সাংবাদিকরা চাকরি ক্ষেত্রে পদোন্নতি, বেতন বৃদ্ধি, এসাইনমেন্ট বিতরণ প্রভৃতি ক্ষেত্রে বৈষম্যের কবলে পড়েন। কাজের জায়গায় পুরুষ সহকর্মী বা কর্মকর্তাদের যৌন হয়রানির কবলেও পড়তে হয় অনেককে। বাংলাদেশে এখনো এ ধরনের কোনো জরিপ বা গবেষণা হয়নি, কিন্তু বাস্তবে এমন ঘটনা যে একেবারেই ঘটে না, তা কি নিশ্চিত করে বলা যাবে? পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশেও কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানির বিষয়টি একেবারে উড়িয়ে দেয়া যায় না।
শুরুতেই বলেছি, সাংবাদিকতার কোনো প্ল্যাটফর্মেই নেতৃত্ব পর্যায়ে নারীদের উপস্থিতি খুব বেশি চোখে পড়ে না। অধিকাংশ নারী সাংবাদিক মনে করেন, নারী সাংবাদিকদের বিষয়ে সাংবাদিক ইউনিয়নগুলোকে আরো সংবেদনশীল হতে হবে। কেননা, সাংবাদিক ইউনিয়ন যতক্ষণ নারীর সমস্যাকে নিজের সমস্যা না ভাববে ততদিন অবস্থার পরিবর্তন ঘটবে না। এজন্য সাংবাদিক সংগঠনগুলোতে নারীদের বেশি মাত্রায় নেতৃত্বে আসা প্রয়োজন। শুধু একটি মহিলা বিষয়ক সম্পাদিকা পদ তৈরি করে সেখানে একজন নারীকে বসিয়ে দিলাম, আর সব দায়িত্ব শেষ হয়ে গেল, তা নয়। সব পদেই নারীদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সুযোগ থাকতে হবে। নেতৃত্বে আসার ক্ষেত্রে নারীদের আগ্রহ থাকলেও দেখা গেছে, প্রকাশ্য বাধা না এলেও প্রবল মনস্তাত্বিক বাধার মুখোমুখি হন তারা। উচ্চ পদে ও শীর্ষ নেতৃত্বে এখনো নারীদের দেখতে অভ্যস্ত নয় পুরুষতান্ত্রিক সমাজ।
সংবাদপত্র কিংবা টেলিভিশনে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জায়গাগুলোতে আরো বেশিসংখ্যক মেয়ে থাকতে হবে। যেহেতু মিডিয়াজগতে মেয়েদের পদচারণা পুরুষদের চেয়ে দেরিতে শুরু হয়েছে সেহেতু সিদ্ধান্ত গ্রহণের জায়গাগুলোতে এখনো তারা খুব বেশি সংখ্যায় আসতে পারেননি। যদি বেশিসংখ্যক নারী ঊর্ধ্বতন পদগুলোতে আসেন তাহলে হয়তো অবস্থার পরিবর্তন হলেও হতে পারে। পাশাপাশি অবশ্য এটাও সত্য, আমাদের এখানে, এখনো অনেক পুরুষই নারীকে ঊর্ধ্বতন অবস্থানে মেনে নিতে পারেন না। ফলে নানারকম অসহযোগিতা করে নারী বসকে বিপদে ফেলতে পারলে তারা বিমল আনন্দ অনুভব করেন। আবার অনেক সময় উপরের পদে গেলেও নারী যে তার সহকর্মীদের প্রতি সঠিক আচরণ করতে পারেন তাও হয় না। নিজের ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার জন্য পুরুষতন্ত্রকে তুষ্ট করতে গিয়ে তিনিও পুরুষের মতেই আচরণ করতে শুরু করেন। ফলে হিতে বিপরীত হয়ে যায়। অফিসের অন্যান্য নারী সহকর্মীরা অবাক হয়ে উপলব্ধি করেন, পুরুষ বসের সঙ্গে নারী বসের আচরণগত কোনো পার্থক্য নেই। তারপরও বহুসংখ্যক মেয়ের উচ্চপদে উঠে আসা ছাড়া আপাতত নারী সাংবাদিকদের প্রতি প্রচলিত দৃষ্টিভঙ্গি বদলানোর অন্য কোনো বিকল্প চোখে পড়ছে না। যদিও আমাদের সমাজে খুব কম সময়ই মেয়েরা তাদের যোগ্যতা বা দক্ষতা অনুযায়ী নিরপেক্ষভাবে পদোন্নতি পায়। বেশির ভাগ সময় এসব ক্ষেত্রে এতো বেশি দুর্নীতি ও অস্বচ্ছতা থাকে যে যোগ্যতাসম্পন্নরা তাদের যোগ্যতা অনুযায়ী পদ পান না।
এটা ঠিক গণমাধ্যমে নারী-পুরুষ বৈষম্য একদিনে তৈরি হয়নি, ফলে রাতারাতি এটি দূর করাও সম্ভব না। তবে এটা স্বীকার করতেই হবে, আমাদের সব পুরুষ সহকর্মীই একরকম নন। অনেকেই আছেন যারা জেন্ডার সংবেদনশীল, সহমর্মী এবং সচেতন। তারা সংখ্যায় কম হলেও, আমরা আশাবাদী গণমাধ্যমে এই ধরনের সহকর্মীর সংখ্যা বাড়বে এবং একটি ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে। গণমাধ্যমে নারীর সংখ্যা বাড়াতে হলে নিয়োগকর্তাদের মানসিকতারও পরিবর্তন হওয়া দরকার। নিয়োগ নীতিমালায় স্বচ্ছতা থাকাও জরুরি। বৈষম্য কমাতে ওয়েজ বোর্ড ও সম্প্রচার নীতিমালায় নারীদের বিষয়টি বিশেষভাবে অন্তর্ভূক্ত করা প্রয়োজন বলেও মনে করেন নারী সাংবাদিকরা।
আমাদের অনেক সহকর্মী মনে করেন, আলাদা করে ‘নারী সাংবাদিক’ তকমা লাগিয়ে দেওয়াটাও একটি চ্যালেঞ্জ। আমরা ‘নারী স্পিকার’ বা ‘নারী ডিসি’ বলি না। সাংবাদিক তো সাংবাদিকই। তাকে আবার নারী বা পুরুষ বলে আলাদা করার দরকার কি? বাস্তবতা হচ্ছে, নারী সাংবাদিক পরিচয়টি নারীকে তার পুরুষ সহকর্মীর চাইতে যখন এক ধাপ নিচে নামিয়ে দেয় তখন সমাজে প্রচলিত নারীর অধস্তন ও তথাকথিত দুর্বল ভাবমূর্তিকেই সামনে তুলে আনে।
আমাদের সংবিধানে বলা হয়েছে, রাষ্ট্র ও সমাজের সকল ক্ষেত্রে নারীর অধিকতর অংশগ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি করার কথা। বলা হয়েছে, প্রশাসনিক ক্ষমতায়ন প্রশ্নে সিদ্ধান্ত গ্রহণের সকল স্তরে নারীর সম ও পূর্ণ অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার কথাও। মাঝে মাঝে মনে হয় এসব কথা কি শুধু কথার কথা, শুধু বলার জন্যই বলা? নাকি কোনো দিন এসব সত্য হবে?
সত্য হওয়ার জন্য নারী-পুরুষসহ সকলের মানসিকতা বদলানো দরকার, পুরুষ যতদিন না নারীকে নিজের সহযোগী ভাবতে শিখবে, যতদিন না নারীকে সমাজের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে ভাবতে শিখবে ততদিন এ সমস্যার সমাধান হবে না। অবস্থার পরিবর্তন হয়তো রাতারাতি সম্ভব নয়, তবে এখন যেভাবে বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা হচ্ছে, বিশ্লেষণ হচ্ছে, তাতে আশা করা যায়, মানসিকতার পরিবর্তন হয়তো হবে।
লেখক: সাংবাদিক ও কথাসাহিত্যিক
তারা//
উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর ন র র উপস থ ত প র ষ সহকর ম ব দ ক ইউন সহকর ম র ব দ কত য় অন ক প র ক জ কর ন র সমস য উপস থ প গ রহণ র র অবস থ অবস থ ন অবস থ র আম দ র র জন য য গ যত কর ম র অন ক স ত হয় ছ র র জন পর ব শ ব দ কর র অন ক পর ব র জন ন র ধরন র ণ করত দরক র সদস য
এছাড়াও পড়ুন:
সিদ্দিককে মারধর ও শিল্পীদের বিরুদ্ধে মামলা, যা বললেন অভিনয়শিল্পী সংঘের সভাপতি
শোবিজের একঝাঁক একঝাঁক অভিনয়শিল্পীকে হত্যাচেষ্টা মামলার আসামি করা হয়েছে। প্রথমে ইরেশ যাকের, তারপর সুবর্ণা মুস্তাফা, অপু বিশ্বাস, নুসরাত ফারিয়া, নিপুণসহ ১৭ অভিনয়শিল্পীর নাম প্রকাশ্যে এসেছে। এরই মধ্যে গতকাল অভিনেতা সিদ্দিককে মারধর ও লাঞ্ছিত করে রাজধানীর রমনা থানায় সোপর্দ করা হয়। এসব বিষয় নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চর্চা চলছে। এ নিয়ে অভিনয়শিল্পী সংঘের সভাপতি আজাদ আবুল কালাম নিজের অবস্থান পরিষ্কার করেছেন।
সিদ্দিকের ওপর হামলা ও লাঞ্ছনা ঘটনা নিয়ে আজাদ আবুল কালাম গণমাধ্যমে বলেন, “সিদ্দিকের সঙ্গে যা ঘটেছে, এটা তো মব। এই মব ভায়োলেন্সকে তো ঠেকাচ্ছে না। কেন যেন মনে হচ্ছে, মব ভায়োলেন্সকে নীরবে বলা হচ্ছে, করে যাও। আমাদের কিছুই করার নেই। একজনের রাজনৈতিক চিন্তাচেতনা থাকতে পারে। অভিনেতা হিসেবে সিদ্দিক সবার কাছে পরিচিত। কিছু লোক তাকে এভাবে রাস্তায় ধরে মেরে দেবে!”
প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে আজাদ আবুল কালাম বলেন, “দলবদ্ধভাবে সিদ্দিককে শারীরিকভাবে আঘাত করেছে, আক্রমণ করেছে, গায়ে থেকে জামাকাপড় খুলে ফেলেছে, এরপর থানায় সোপর্দ করেছে। থানায় যদি সোপর্দ করতেই হয়, তাহলে প্রথমে কেন আইন হাতে তুলে নিল? তাকে হেনস্তা করে আইনের হাতে তুলে দেবে— এই মব জাস্টিস, মব ভায়োলেন্স সমাজে বিশৃঙ্খলা তৈরি করছে। এটা তো একটা সময় নানা স্তরে হবে। এসব কর্মকাণ্ড সরকারকেও প্রশ্নবিদ্ধ করছে। সরকারকে পদক্ষেপ নিতে হবে, যেখানে মব ভায়োলেন্স, সেখানে কঠোর হস্তে দমন করবে।”
ঢালাওভাবে অভিনয়শিল্পীদের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের বিষয়ে বিস্মিত আবুল কালাম আজাদ। তিনি বলেন, “ঢালাওভাবে হত্যা মামলা হচ্ছে! দেখে মনে হচ্ছে, সবাইকে মামলার মধ্যে ফেলতে হবে। ৩০০-৪০০ জন মামলার আসামি, এটা অবাস্তব একটা অবস্থা। একজন সুবর্ণা মুস্তাফার মতো শিল্পী রাস্তায় গিয়ে মানুষকে গুলি করবে? যে মানুষটি মামলা করেছেন, তিনি আন্দোলনের সময় আহত হয়েছেন, গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন; তিনি মামলা করেছিলেন অনেক লোকের নামে। মামলার নথিতে শিল্পীদের অনেকের নাম দেখলাম, তারা রাস্তায় নেমে মানুষকে গুলি করবে!”
সরকারিভাবে এ ধরনের মামলাকে প্রতিরোধ করা উচিত বলে মনে করেন আজাদ আবুল কালাম। তিনি বলেন, “সরকারিভাবে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারেরও উচিত হবে এ ধরনের মামলাকে প্রতিরোধ করা। নিরুৎসাহিত করা। যে ব্যক্তি মামলা করছেন, যদি প্রমাণিত হয়, শিল্পীরা কেউই গুলি করেনি, তখন তো এটা মিথ্যা মামলা হবে। এ রকম মিথ্যা মামলার ক্ষেত্রে, যে ব্যক্তি শিল্পীদের নামে মামলা করেছেন, তার কী শাস্তি হবে, তারও বিধান থাকতে হবে।”
“কারো বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ থাকলে, তা জানানোর একটা প্রক্রিয়া আছে। শুধু শিল্পী না, একজন খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধেও যদি কোনো অভিযোগ থাকে, তাহলে আপনি তার অপরাধ প্রমাণিত হওয়ার আগপর্যন্ত তাকে অপরাধী বলতে পারেন না। তাকে সামাজিকভাবে হেয় করতে পারেন না। মামলা করে তাকে সামাজিকভাবে হেয় করা শুরু করলেন, এই প্রক্রিয়া যদি চলতে থাকে, এটাই যদি আমাদের মনস্তত্ত্ব হয়, তাহলে বিভক্তি আরো বাড়বে।” বলেন আবুল কালাম আজাদ।