বড় ক্রিকেটার হয়ে মাকে বিমানে চড়াতে চেয়েছিল রাহাত
Published: 30th, April 2025 GMT
ছয় বছর বয়স থেকে মায়ের হাত ধরে নগরের চান্দগাঁও বাসা থেকে আউটার স্টেডিয়ামে ক্রিকেট অনুশীলন করতে যেত রাহাত খান। শেষ করে আবার বাসায় ফিরত মায়ের সঙ্গে। মায়ের স্বপ্ন ছিল, ছেলে বড় ক্রিকেটার হবে। সেই পথে এগোতে থাকে ছেলেও। ঝুলিতে যুক্ত হয় অনেক পুরস্কার। বাসার শোকেসে সাজানো রয়েছে ক্রেস্ট, মেডেল ও সনদ। ক্লাবের বয়সভিত্তিক অনূর্ধ্ব–১১-১২ দলের অধিনায়কও হয়েছিল। ইচ্ছে ছিল বড় ক্রিকেটার হয়ে দেশের জন্য জয় ছিনিয়ে আনবে। বিদেশে খেলতে গেলে বিমানে মাকেও নেবে সঙ্গে। রাহাতের এসব স্বপ্নের কথাই আজ বারবার মনে পড়ছে মা রোজি আক্তারের। বিলাপ করেতে করতে সেসব কথাই বলছিলেন বারবার। তাঁর বেঁচে থাকার সবচেয়ে বড় অবলম্বনটা যে আর নেই।
আজ বৃহস্পতিবার সকালে নগরের চান্দগাঁও হামিদচর এলাকায় নদী থেকে রাহাতের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। চান্দগাঁও সানোয়ারা ইসলাম বালক উচ্চবিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিল সে। এ ছাড়া চট্টগ্রাম ব্রাদার্স ইউনিয়ন জুনিয়র ক্রিকেট দলের হয়ে খেলত এই খুদে ক্রিকেটার। পুলিশ ও নিহত কিশোরের পরিবার সূত্র জানায়, সহপাঠীরা বেড়ানোর কথা বলে নদীতে নিয়ে গিয়ে তাকে ফেলে দেয়।
ছেলে রাহাতকে হারিয়ে বারবার বিমানে চড়ার কথা বলছেন মা রোজি আক্তার। আজ বিকেলে নগরের চান্দগাঁও পূর্ব ফরিদার পাড়া এলাকার বাসায় গিয়ে দেখা যায়, ঘরভর্তি মানুষ। সবার চোখে পানি। সোফায় বসে বিলাপ করছিলেন রোজি আক্তার। তাকে সান্ত্বনা দিতে গিয়ে কাঁদছিলেন স্বজনেরাও। বিলাপ করতে করতে রোজি আক্তার বলেন, ‘ছেলে শুধু বলত, বড় ক্রিকেটার হয়ে আম্মু তোমাকে নিয়ে বিমানে চড়ব। এখন আমাকে কে বিমানে চড়াবে।’
কিছুটা শান্ত হওয়ার পর রোজি আক্তারের সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন, ‘ছেলের ছয় বছর বয়স থেকে ক্রিকেট অনুশীলনের জন্য আউটার স্টেডিয়ামে নিয়ে যেতাম। অনুশীলন শেষ হওয়ার পর আবার তাকে নিয়ে বাসায় ফিরতাম। আমার কষ্ট হতো, ছেলে তা বুঝতে পারত। এ জন্য প্রায়ই বলত, মা আমি যখন বড় ক্রিকেটার হব, তখন বিদেশে খেলতে গেলে তোমাকেও নিয়ে যাব সঙ্গে।’
এসব কথা বলতে না বলতেই অঝোরে কাঁদতে থাকেন রোজি আক্তার। তখন তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করেন কোচ মাসুমউদ্দৌলা। পরে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘রাহাত অলরাউন্ডার ছিল। বোলিং, ব্যাটিং সবই করতে। এমনকী ভালো কিপারও ছিল। গত বছর ক্লাবের অনূর্ধ্ব–১১-১২ গ্রুপের অধিনায়ক করা হয় তাকে। সীমিত ওভারের বেশ কয়েকটি খেলায় পাশাপাশি দুটি ৫০ রান ছিল তার। একবার ৪৯ রানে অপরাজিত ছিল সে। একজন সম্ভাবনাময় ক্রিকেটারকে হারিয়ে ফেললাম আমরা।’
সামাজিক অবক্ষয়ের কারণে এসব ঘটনা ঘটছে বলে মনে করেন মাসুমউদ্দৌলা। তিনি বলেন, স্কুলপড়ুয়াদের কাছে সহপাঠীরাও কেন নিরাপদ নয়? কেন স্কুলছাত্ররা সহিংস হয়ে উঠছে, এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হবে আমাদের। নয়তো রাহাতের মতো আরও কিশোরকে মূল্য দিতে হবে।
রাহাতকে নিয়মিত অনুশীলন করাতেন আরেক কোচ আবদুস সামাদ। প্রিয় ছাত্রের মৃত্যুর খবর পেয়ে বাসায় ছুটে আসেন তিনিও। আবদুস সামাদ প্রথম আলোকে বলেন, ছয় বছর বয়স থেকে মায়ের সঙ্গে ক্রিকেট অনুশীলন করতে আসে রাহাত। ও খুবই মেধাবী ছিল।
রাহাতের সঙ্গে অনুশীলন করত উমায়ের তোফায়েল। প্রিয় বন্ধুর বাসায় ছুটে আসে সে–ও। কিন্তু কান্নার জন্য কিছুই বলতে পারেনি। সঙ্গে ছিল তার মা তানিয়া আহমেদ। তিনি বলেন, রাহাত খুব অমায়িক ছেলে ছিল। স্কুলবন্ধুদের কাছে ছেলেরা নিরাপদ না হলে কোথায় নিরাপত্তা পাবে।
মা-বাবার তৃতীয় সন্তান রাহাত। তার বড় দুই ভাই রয়েছে। তবে তারা অসুস্থ। রাহাতের চাচা জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘আমার ভাইয়ের যে ছেলেটা মেধাবী ছিল, খেলাধুলায় সেরা ছিল, সেই ছেলেটাই নেই।’
সহপাঠীদের সঙ্গে রাহাতের কোনো ঝগড়া হয়েছে কি না, এ তথ্য নিশ্চিত করতে পারেননি সানোয়ারা ইসলাম বালক উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আবুল মনসুর চৌধুরী বলেন, ‘স্কুলে রাহাতের সঙ্গে বন্ধুদের ঝগড়ার বিষয়ে কোনো তথ্য আমাদের কাছে ছিল না। আমাদের কাছে কোনো অভিযোগও করা হয়নি। আমি শ্রেণিশিক্ষককে জিজ্ঞেস করেছি, তিনিও কিছুই জানেন না। রাহাতের মা আমাদের বলেছেন, ১০-১২ দিন আগে রাহাত একদিন বাসায় ফিরে তাঁকে বলেছে, কয়েকটা ছেলের সঙ্গে তার গন্ডগোল হয়েছে। তার মা এ বিষয়ে তাদের সঙ্গে ঝগড়া না করার জন্য বলেছিলেন।’ ঘটনার পর সানোয়ারা ইসলাম বালক উচ্চবিদ্যালয়ের তিন শিক্ষককে নিয়ে তদন্ত কমিটি করা হয়েছে বলে প্রধান শিক্ষক জানিয়েছেন।
নগর পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার (উত্তর) জাহাঙ্গীর আলম প্রথম আলোকে বলেন, এ ঘটনায় নিহত স্কুলছাত্রের চার সহপাঠীকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। মামলার প্রস্তুতি চলছে।
রাহাতের বাবার একটি গ্রিলের ওয়ার্কশপ রয়েছে। জানতে চাইলে তিনি বলেন, দুই মাস আগে স্কুলে বসা নিয়ে সহপাঠীদের সঙ্গে তার ছেলের কথা-কাটাকাটি হয়। সেটি মীমাংসাও হয়ে যায়। কিন্তু এই ঘটনার জেরে তার ছেলেকে বুধবার টিফিন ছুটির পর নদীর তীরে নিয়ে যায় সহপাঠীরা। তারাই মেরে নদীতে ফেলে দেয় বলে তিনি দাবি করেন।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: বড় ক র ক ট র আম দ র র জন য সহপ ঠ
এছাড়াও পড়ুন:
লবণশ্রমিকদের নিরাপত্তা ও কর্মপরিবেশের উন্নয়ন করতে হবে
দেশে প্রায় ৪০ হাজার কৃষক পরিবার এবং ৫৫ হাজার দক্ষ শ্রমিক সরাসরি লবণ উৎপাদনে যুক্ত। আরও ৫ লাখের বেশি শ্রমিক এই খাতের সঙ্গে সম্পৃক্ত। ফলে লবণ খাত দেশের গ্রামীণ অর্থনীতি ও কর্মসংস্থানে একটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। পেশাগত নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্যব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে এই খাতের কর্মপরিবেশের উন্নয়ন করতে হবে। উৎপাদনশীলতা বাড়াতে হবে। বুধবার রাজধানীর গুলশানের একটি হোটেলে আয়োজিত এক পরামর্শ সভায় এসব কথা বলেন বক্তারা।
‘দেশে লবণ খাতে কর্মপরিবেশ উন্নয়ন ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে জাতীয় পরামর্শ সভা’ শিরোনামে সভাটির আয়োজন করে আইজেক প্রকল্প। আইজেক প্রকল্পের পূর্ণ নাম হচ্ছে ইমপ্রুভিং স্কিলস অ্যান্ড ইকোনমিক অপরচুনিটিজ ফর উইমেন অ্যান্ড ইয়ুথ ইন কক্সবাজার। কানাডার গ্লোবাল অ্যাফেয়ার্সের অর্থায়নে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) নেতৃত্বে ইনোভিশন কনসালটিং প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে।
সভায় জানানো হয়, প্রকল্পের আওতায় ইতিমধ্যে ১৮৫ জন শ্রমিক ও কৃষককে পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে এবং ৪৪৪ জনকে চিকিৎসাসহায়তা দেওয়া হয়েছে। কক্সবাজারে ২টি হাসপাতাল ও ৬টি লবণ কারখানার সঙ্গে আইজেক প্রকল্পের সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে শিল্প মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. ওবায়দুর রহমান লবণকে ‘সাদা সোনা’ বলে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, ‘আমরা স্বাস্থ্য, অন্তর্ভুক্তিকরণ, ক্ষুদ্রঋণ ও আধুনিক প্রযুক্তিকে অগ্রাধিকার দিয়ে লবণ খাতকে শক্তিশালী করব।’ তিনি লবণশ্রমিকদের শ্রম অধিকার আইনের অন্তর্ভুক্ত করার প্রতিশ্রুতি দেন।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. মুনির হোসেন খান বলেন, বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে শ্রমিকদের স্বাস্থ্য ও শিক্ষায় সহায়তা দেওয়া হয়। তবে এ বিষয়ে আরও সচেতনতা এবং সরকারি-বেসরকারি সহযোগিতা প্রয়োজন।
সভায় লবণচাষি দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘আমরা পানিশূন্যতা, অপর্যাপ্ত স্যানিটেশন ও অনিশ্চিত আয়ে ভুগি। আমাদের নিয়মিত চিকিৎসা ও নিরাপত্তা প্রয়োজন।’
সভায় স্বাগত বক্তব্য দেন ইনোভিশন কনসালটিংয়ের কান্ট্রি ডিরেক্টর কাজী শহীদ হাসান ফেরদৌস। আইএলও কক্সবাজার সাব অফিসের প্রধান রুচিকা বেহল লবণ চাষ ও আইজেক প্রকল্প নিয়ে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। এ ছাড়া সভায় আরও বক্তব্য দেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মোহাম্মদ গুলজারুল আজিজ, বিসিকের লবণ বিভাগের প্রধান সরওয়ার হোসেন, ইনোভিশনের পোর্টফোলিও পরিচালক তাসমিয়া তাবাসসুম রহমান, অ্যাপেক্স ফুটওয়্যারের ব্যবসায় কৌশল ও ইএসজি প্রধান ফিরোজ আলম তালুকদার, এসিআই লিমিটেডের ব্যবসায় ব্যবস্থাপক জিসান রহমান, প্রিটি কম্পোজিট টেক্সটাইলসের নির্বাহী পরিচালক দেওয়ান মাহবুব কামরান, কক্সবাজার চেম্বার অব কমার্সের পরিচালক আবেদ আহসান সাগর, আইএলওর কারিগরি বিশেষজ্ঞ জনসন, আইএলওর ইআইএস প্রকল্পের ব্যবস্থাপক সাদ গিলানি।
বক্তারা বলেন, লবণের বিশুদ্ধতা বাড়ানো এবং লবণভিত্তিক শিল্পের আধুনিকায়ন অত্যন্ত জরুরি। কাঁচা লবণের বিশুদ্ধতা ও আর্দ্রতা সমস্যা দূর করতে কাঠামোগত অদক্ষতার সমাধান প্রয়োজন।