একাত্তরের রাজনৈতিক অবস্থান ব্যাখ্যা করে ঐক্যের আহ্বান এনসিপির
Published: 12th, May 2025 GMT
২০২৪ সালে অভ্যুত্থানের পর ছাত্রদের হাত ধরে গড়ে ওঠা জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) বলেছে, যারা ১৯৭১ সালে এই জনপদের মানুষের জনযুদ্ধের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করেছিল এবং যাদের বিরুদ্ধে গণহত্যায় সহযোগিতার অভিযোগ রয়েছে, আমরা চাই, তারা নিজেদের সুস্পষ্ট রাজনৈতিক অবস্থান জাতির সামনে ব্যাখ্যা করে জাতীয় সমঝোতা ও ঐক্যকে সুদৃঢ় করবে এবং চব্বিশের অভ্যুত্থানের জন-আকাঙ্ক্ষাকে বাস্তবায়নে সহযোগী হবে।
আজ সোমবার এনসিপির যুগ্ম সদস্যসচিব সালেহ উদ্দীন সিফাত স্বাক্ষরিত ‘সাম্প্রতিক রাজনৈতিক বিতর্কে এনসিপির অবস্থান’ শীর্ষক বিজ্ঞপ্তিতে এ কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করেন, কোনো রাজনৈতিক দল বা পক্ষের পূর্বেকার রাজনৈতিক অবস্থান বা আদর্শের কারণে ইতিপূর্বের বিভাজন ও অনৈক্যের রাজনীতির সূত্রপাত ঘটলে, তাদের দায় রয়েছে বাংলাদেশের মানুষের সামনে নিজেদের সুস্পষ্ট অবস্থান ব্যাখ্যা করে জাতীয় ঐক্যের পথে হাঁটার। বাংলাদেশের জনগণের মধ্যকার বৃহত্তর ঐক্যের মাধ্যমেই কেবল মুজিববাদকে সামগ্রিকভাবে পরাস্ত করা সম্ভব হবে বলে আমরা মনে করি।
গত শনিবার আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের পর উপদেষ্টা মাহফুজ আলম তার ফেসবুক অ্যাকাউন্টে একাত্তর ও মুজিববাদী বাম ইস্যুতে একটি স্ট্যাটাস দেন। এতে তিনি লেখেন, ‘একাত্তরের প্রশ্ন মীমাংসা করতেই হবে। যুদ্ধাপরাধের সহযোগীদের ক্ষমা চাইতে হবে। পাকিস্তান এদেশে গণহত্যা চালিয়েছে। সহযোগীদের ইনিয়ে বিনিয়ে গণহত্যার পক্ষে বয়ান উৎপাদন বন্ধ করতে হবে। জুলাইয়ের শক্তির মধ্যে ঢুকে স্যাবোটাজ করা বন্ধ করতে হবে। সাফ দিলে আসতে হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘মুজিববাদী বামদের ক্ষমা নেই। লীগের গুম-খুন আর শাপলায় মোদিবিরোধী আন্দোলনে হত্যাযজ্ঞের মস্তিষ্ক এরা। জুলাইয়ের সময়ে এরা নিকৃষ্ট দালালি করেও এখন বহাল তবিয়তে আছে।’
ফেসবুক পোস্টে একাত্তর ইস্যু টানায় ফেসবুকে মাহফুজ আলমের সমালোচনায় ফেটে পড়ে একটি দল। ফেসবুকে তার বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি কোচিংয়ের সময়ের কিছু ছবি ভাইরাল হয়। এগুলোকে তার শিবির সংশ্লিষ্ট হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করা হয়। এ নিয়ে ক্ষুব্ধ হন মাহফুজ আলম। গতকাল রোববার সন্ধ্যায় পাল্টা স্ট্যাটাস দিয়ে মুহূর্তেই আগের স্ট্যাটাসটি সরিয়ে নেন। ততক্ষণে স্ক্রিনশট ভাইরাল হয়ে যায়। সে স্ট্যাটাসে তিনি লেখেন, ‘আমাকে নিয়ে নোংরামি করতেসো, ঝামেলা নাই। ফ্যামিলি টাইনো না, যুদ্ধাপরাধের সহযোগী রাজাকারেরা। এটা লাস্ট ওয়ার্নিং।
এর মধ্যে এনসিপি এই বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে। এ ছাড়া আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের আন্দোলন চলাকালে জাতীয় সংগীত পরিবেশনে বাধা, গোলাম আজমের নামে স্লোগান দেওয়ার কয়েকটি ভিডিও সামাজিকযোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। এটি নিয়েও ফেসবুকে বিতর্ক চলছে।
এ বিষয়গুলোকে তুলে ধরে এনসিপি বিজ্ঞপ্তিতে বলেছে, বিগত ফ্যাসিবাদি জমানায় নির্যাতিত-নিপীড়িত হয়ে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক উত্তরণের পথে বাংলাদেশের নাগরিকদের পক্ষে চব্বিশের অভ্যুত্থানে যারা ভূমিকা পালন করেছেন, নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণে তাদেরকে আবশ্যিকভাবে ‘বাংলাদেশপন্থি’ ভূমিকা পালন করে যেতে হবে।
এতে আরও বলা হয়, আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী কোনো এনসিপি সদস্য কখনোই দলীয় স্লোগান কিংবা এই জনপদের ইতিহাসবিরোধী স্লোগান দেয়নি। যেসব স্লোগান নিয়ে জনমনে প্রশ্ন উঠেছে, তার দায় সংশ্লিষ্ট পক্ষেরই বহন করা উচিত।
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, এনসিপি সদস্যদের বক্তৃতা ও স্লোগানে ১৯৪৭, ১৯৭১ এবং ২০২৪ সালের ঐতিহাসিক অধ্যায়গুলোর প্রতিফলন ছিল। আন্দোলনকারীরা জাতীয় সংগীত পরিবেশন করলে একটি পক্ষ আপত্তি জানালেও তারা দৃঢ়তার সঙ্গে জাতীয় সংগীত পরিবেশন করে বলেও দাবি করা হয়।
এনসিপি মনে করে, বাংলাদেশে রাজনীতি করার পূর্বশর্ত হলো ১৯৪৭, ১৯৭১ এবং ২০২৪ সালের সংগ্রামের যথাযথ স্বীকৃতি ও মর্যাদা দেওয়া। যারা ১৯৭১ সালের গণযুদ্ধে বিরুদ্ধাচরণ করেছে এবং গণহত্যায় সহযোগিতার অভিযোগ রয়েছে, তাদের সুস্পষ্ট রাজনৈতিক অবস্থান ব্যাখ্যা করে জাতীয় ঐক্য ও সমঝোতা গড়ার আহ্বান জানানো হয়।
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: জ ত য় ন গর ক প র ট এনস প র জন ত ক অবস থ ন অবস থ ন ব গণহত য ফ সব ক এনস প সহয গ
এছাড়াও পড়ুন:
পাকিস্তান কি ভারতের সঙ্গে আরেকটা সংঘাত সামলাতে সক্ষম?
ভারত মিসাইল হামলা চালিয়েছে পাকিস্তানের ওপর। পারমাণবিক অস্ত্রের অধিকারী প্রতিবেশী পাকিস্তানের সঙ্গে তা নিয়ে উত্তেজনা আরও বেড়েছে। এখন দুই দেশের নিজেদের সীমানা নিয়ে উদ্বেগ স্বাভাবিকভাবেই বাড়বে। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ ভারতের আক্রমণকে সরাসরি ‘যুদ্ধ’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। সেই সূত্র ধরে পাকিস্তান প্রতিশোধ নেওয়ারও ঘোষণা দিয়েছে। (ইতিমধ্যে পাকিস্তানও পাল্টা হামলা চালিয়েছে।)
এই সংঘাতের নতুন করে সূত্রপাত ঘটে গত এপ্রিলে ভারতের কাশ্মীরে সন্ত্রাসী হামলার মধ্য দিয়ে। ২৬ জন সাধারণ ভারতীয় পর্যটক নিহত হওয়ার পর, আন্তর্জাতিকভাবেও প্রতিক্রিয়া হয়। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প একে ‘হতাশাজনক’ বলে আখ্যায়িত করে সমস্যার দ্রুত সমাধান আশা করেন।
পাকিস্তানের জন্য আরেকটি দীর্ঘমেয়াদি সংঘাতের অর্থনৈতিক অভিঘাত সামলানো কঠিন হবে। ভারতের তুলনায় সেই আঘাত হবে অনেক বেশি। সেই সংঘাত যত দীর্ঘ হবে, পাকিস্তানের জন্য তা হবে তত বেশি ভয়াবহ। বিনিয়োগ বিষয়ে আগাম অবস্থা জানানোর জন্য মুডিস ইনভেস্টরস সার্ভিস নামে একটি প্রতিষ্ঠান আছে। তারা এ বিষয়ে ৫ মে জানিয়েছে যে ভারতের সঙ্গে উত্তেজনা পাকিস্তানের প্রবৃদ্ধির ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলার সম্ভাবনা আছে। এতে পাকিস্তানের রাজস্ব কমবে। সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা নষ্ট হবে। আইএমএফের কাছ থেকে ৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার পেয়ে পাকিস্তানের অর্থনীতি কিছুটা সামলে আসার সম্ভাবনা ছিল। ভারতের সঙ্গে সংঘাত সেই সুযোগ লন্ডভন্ড করে দিতে পারে।
ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায় যে এ ধরনের সংঘাত পাকিস্তানকে অস্থিতিশীল করে দেয়। আফগানিস্তান যুদ্ধ পাকিস্তানের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলেছিল। দেশে দেখা দিয়েছিল সাম্প্রদায়িক সহিংসতা। অস্ত্র আর মাদক চোরাচালান সেই যে বেড়েছে, তা আজও সামলানো যায়নি। সন্ত্রাসীগোষ্ঠীগুলো এখনো খোদ পাকিস্তান রাষ্ট্রের কর্তৃত্বকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে।
বর্তমানে পাকিস্তানের অর্থনীতি অত্যন্ত নাজুক অবস্থায় রয়েছে। ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত তাদের বৈদেশিক ঋণ ১৩১ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। অথচ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ মাত্র ১০ বিলিয়ন ডলার, যা দিয়ে তিন মাসের আমদানি খরচই ঠিকমতো মেটানো যাবে না। এ অবস্থায় যুদ্ধ বা সামরিক উত্তেজনা বাড়লে বিদেশি বাজার থেকে ঋণ পাওয়া কঠিন হয়ে যাবে। ফলে ঋণ পরিশোধ আরও জটিল হয়ে উঠবে, আর রিজার্ভেও চাপ পড়বে। এমনকি আইএমএফের পুনরুদ্ধার কর্মসূচিও বাধাগ্রস্ত হতে পারে।
অবশ্য পাকিস্তানের এই দুর্বলতা আজকের নয়। ২০২১ সালে সেই সময়ের সেনাপ্রধান কামার বাজওয়া সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন যে তাঁদের ট্যাংক চালানোর মতো ডিজেল পর্যন্ত নেই। সামরিক যানবাহন বা অস্ত্র সচল রাখার জন্য রক্ষণাবেক্ষণ করার টাকাও নেই তহবিলে। সেই দুর্বলতা আজও কাটেনি।
ভারতের অবস্থা একেবারে ভিন্ন। ২০২৪ সালে পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের রপ্তানি ছিল ভারতের মোট রপ্তানির শূন্য দশমিক ৫ শতাংশের কম। অর্থাৎ দুই দেশের মধ্যে বড় ধরনের সামরিক উত্তেজনা হলেও ভারতের অর্থনীতি তেমন প্রভাবিত হবে না।
তবে ভারতের ক্ষেত্রেও কিছু বিষয় গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় বাড়লে বাজেটঘাটতি বাড়তে পারে। তাহলে উন্নয়ন ও সামাজিক খাতে বরাদ্দ কমিয়ে দিতে হবে। এ ছাড়া ভারতের জন্য নিরাপত্তাচাপ কেবল পশ্চিম সীমান্তেই নয়, চীন সীমান্তেও রয়েছে। দুই সীমান্তে একসঙ্গে প্রস্তুত থাকতে হলে অনেক খরচ হয়। তাই ভারতেরও সাবধানতা অবলম্বন করা ছাড়া উপায় নেই।
কিন্তু এই সব চাপ পাকিস্তানের বিপদের সঙ্গে তুলনীয় নয়। পাকিস্তানের জন্য যুদ্ধ মানে কেবল সাময়িক রাজনৈতিক উত্তেজনা নয়, বরং অর্থনৈতিক ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছানো। চীনের কাছে থেকে তারা সম্প্রতি দুই বিলিয়ন ডলার ঋণ নবায়ন করেছে। কিন্তু এর ফলে পাকিস্তান চীনের ওপর আরও বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়বে। আর তা পশ্চিমা মিত্রদের (বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের) সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্ক জটিল করে তুলতে পারে।
এ ছাড়া পাকিস্তানের কৃষি খাত সামরিক উত্তেজনায় বড় ধাক্কা খেতে পারে। ভারত ১৯৬০ সালের সিন্ধু পানিবণ্টন চুক্তি স্থগিত করেছে। এটা বড় ধরনের অস্থিতিশীলতার সংকেত। অথচ কৃষিই পাকিস্তানের মূল অর্থনৈতিক খাত। এই খাতে তাদের ৪০ শতাংশের মতো মানুষ কাজ করে। ২০২২ সালের ভয়াবহ বন্যার ধাক্কা এখনো সামলে উঠতে পারেনি দেশটি। এ অবস্থায় আরেকটি বড় সংকট এলে দেশের অর্থনীতি ভেঙে পড়বে। সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ সীমা ছাড়াবে।
তাই পাকিস্তানের জন্য বড় ধরনের সামরিক সংঘাত এড়িয়ে চলা কেবল কৌশলগত নয়, বরং টিকে থাকার প্রশ্ন।
এই মুহূর্তে আন্তর্জাতিক মহল জরুরি হস্তক্ষেপ না করলে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠবে। আর তখন শুধু ভারত-পাকিস্তান অঞ্চলে নয়, গোটা দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়বে। দক্ষিণ এশিয়ায় বিশ্বের সবচেয়ে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর বসবাস। এখানে মানুষ প্রতিদিন ৩ দশমিক ৬৫ ডলারের কম আয় করে কোনোমতে টিকে থাকে। যুদ্ধ হলে এই সব দরিদ্র মানুষের জীবন আরও বিপন্ন হবে।
পুরোদস্তুর যুদ্ধ না হলেও সীমিত মাত্রায় সংঘাত হতে পারে। আর তা হচ্ছেও। দুই দেশের মধ্যে এমন সংঘাত নতুন কিছু নয়। এমন ছোটখাটো সংঘর্ষেও বিপুল অর্থনৈতিক ও মানবিক ক্ষতি হতে পারে। আর তা পাকিস্তানের মতো দুর্বল দেশের জন্য কম মারাত্মক হবে না।
ইউসুফ নজর পাকিস্তানি লেখক
ফিন্যান্সিয়াল টাইমস থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনুবাদ।