বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক রূপান্তরের প্রশ্নে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো সংবিধান সংস্কার। নির্বাহী বিভাগের এককেন্দ্রিক ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব দেশে কার্যত একনায়কতান্ত্রিক শাসনের ভিত্তি তৈরি করেছে। গত রোববার নাগরিক কোয়ালিশন নামে একটি নাগরিক সংগঠনের পক্ষ থেকে সংবিধান সংস্কারের জন্য যে সাতটি প্রস্তাব উত্থাপিত হয়েছে, তা সময়োপযোগী ও বিবেচনার দাবি রাখে।

নাগরিক কোয়ালিশনের প্রস্তাবগুলোর কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা সীমিতকরণ ও ভারসাম্যপূর্ণ রাষ্ট্রকাঠামো গড়ে তোলা। এই প্রস্তাবে বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি সর্বোচ্চ দুবার পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন।

এই দাবি বেশ জনপ্রিয় হলেও বক্তাদের কেউ কেউ যুক্তি তুলে ধরেছেন যে শুধু মেয়াদ নির্ধারণ করলেই একনায়কতান্ত্রিক শাসন ঠেকানো যাবে না। তাঁরা বলেছেন, প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা সীমিত না করলে মেয়াদসীমা নির্ধারণ কোনো বাস্তব পরিবর্তন আনবে না। কারণ, পরিবারভিত্তিক ক্ষমতা হস্তান্তর এই বিধানকে অকার্যকর করে তুলতে পারে। একই পরিবারের সদস্যরা যদি পালাক্রমে ক্ষমতায় বসেন, তাহলে মেয়াদ নির্ধারণের বিষয়টি অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়বে এবং পুনরায় স্বৈরাচার বা একনায়কতান্ত্রিক শাসনের উত্থান হতে পারে।

বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শে কাজ করেন। এ ধরনের কেন্দ্রীকরণ রাজনৈতিক জবাবদিহি হ্রাস করে এবং প্রাতিষ্ঠানিক শক্তিগুলোকে দুর্বল করে তোলে। এই বাস্তবতায় সবচেয়ে জরুরি কাজ হলো প্রধানমন্ত্রীর অসীম ক্ষমতা হ্রাস করে ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করা। ভারত বা যুক্তরাজ্যের মতো সংসদীয় গণতন্ত্রে যেভাবে রাষ্ট্রপতির ভূমিকায় ন্যূনতম স্বশাসন ও প্রতীকী ভারসাম্য রাখা হয়েছে, তেমনি বাংলাদেশেও একটি গণতান্ত্রিক পুনর্বিন্যাস প্রয়োজন।

আলোচনায় অংশ নেওয়া বিশেষজ্ঞদের মতে, শেখ হাসিনার ‘স্বৈরতান্ত্রিক রূপান্তর’ কোনো সামরিক অভ্যুত্থান বা সংবিধানবহির্ভূত প্রক্রিয়ায় ঘটেনি; বরং বর্তমান সংবিধানই এমন এক কাঠামো তৈরি করেছে, যেখানে নির্বাহী প্রধানের ওপর অন্য কোনো বিভাগের কার্যকর কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। এই কাঠামোই তাকে সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী করেছে। সেই কাঠামো ভেঙে ফেলাই এখন সবচেয়ে জরুরি কাজ।

প্রস্তাবিত সাত দফায় আরও বলা হয়েছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তন, উচ্চকক্ষসহ দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ গঠন, রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে নারীদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি, নারী প্রতিনিধিত্বে সরাসরি ভোট, তত্ত্বাবধায়কধর্মী সর্বদলীয় কমিটি এবং সংবিধানের প্রস্তাবে ‘জুলাই সনদ’-এর অন্তর্ভুক্তি।

নাগরিক কোয়ালিশনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব হলো সাংবিধানিক নিয়োগে স্বচ্ছতা আনার বিষয়টি। সংবিধান সংস্কার কমিশনের সুপারিশের মতো তাদের পক্ষ থেকেও জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল গঠনের কথা বলা হয়েছে, যা রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গঠিত হবে। এসব পদক্ষেপ যদি যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করা যায়, তবে রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলোয় জবাবদিহি ফিরে আসবে এবং জনগণের আস্থা পুনর্গঠিত হবে।

একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মূল শর্ত হচ্ছে ক্ষমতার ভারসাম্য এবং জবাবদিহিমূলক শাসনব্যবস্থা। বাংলাদেশের সংবিধান বর্তমানে একজন প্রধানমন্ত্রীর হাতে যে অগাধ ক্ষমতা তুলে দিয়েছে, তা একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। এখনই সময় সংবিধান সংস্কারের মাধ্যমে রাষ্ট্রের শাসনব্যবস্থাকে পুনর্গঠন করে প্রকৃত অর্থে জনগণের মালিকানাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার।

আমরা মনে করি, নাগরিক কোয়ালিশনের এই প্রস্তাবগুলো শুধু রাজনৈতিক বিতর্কের খোরাক হবে না, বরং একটি ভবিষ্যৎমুখী, গ্রহণযোগ্য এবং গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গঠনের বাস্তব রূপরেখা তৈরি করতে সহায়ক হবে। এটি কেবল সংবিধান সংস্কারের প্রশ্ন নয়, এটি জনগণের মালিকানায় রাষ্ট্র পুনরুদ্ধারের বিষয়ে আলোকপাত করেছে। প্রস্তাবগুলোর বাস্তবায়নে রাজনৈতিক দলগুলোর আন্তরিকতা ও অঙ্গীকার অপরিহার্য। ১৯৯০ সালে গণ-আন্দোলনের পরও রাজনৈতিক দলগুলো জনগণকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি থেকে সরে এসেছিল। এবার যেন ইতিহাসের সেই পুনরাবৃত্তি আর না হয়।

 বাংলাদেশের গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে এই সময়ের সাহসী ও দূরদর্শী সিদ্ধান্তের ওপর। সংবিধান সংস্কারের উদ্যোগ একটি গণতান্ত্রিক ও জবাবদিহিমূলক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সেতুবন্ধ হবে—এটাই আমাদের প্রত্যাশা।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: গণত ন ত র ক প রস ত ব ভ রস ম য র জন ত ক ব যবস থ ক ষমত

এছাড়াও পড়ুন:

সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, জাতীয়তাবাদ আমাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে: ফরহাদ মজহার

বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া আপসহীনভাবে না দাঁড়ালে এই গণ–অভ্যুত্থান হতো না বলে মন্তব্য করেছেন কবি ও চিন্তক ফরহাদ মজহার। অভ্যুত্থানের পর কেন নতুন বাংলাদেশ গঠন করতে চান, তার ব্যাখ্যা দিয়ে তিনি বলেছেন, ‘কারণ জিয়াউর রহমান নতুন বাংলাদেশ গঠনের জন্য লড়াই করেছিলেন। তাঁর ঘোষণা ছিল সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচারের ভিত্তিতে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। এ জন্য তিনি যুদ্ধ করেছেন, নেতৃত্ব দিয়েছেন। তিনি কি সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা বা জাতীয়তাবাদের জন্য যুদ্ধ করেছিলেন? না, আমরা এসবের জন্য কেউ যুদ্ধ করিনি। আমাদের ওপর এটা চাপানো হয়েছে।’

আজ মঙ্গলবার দুপুরে রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাবের মাওলানা মোহাম্মদ আকরাম খাঁ হলে গণশক্তি সভা আয়োজিত ‘জুলাই ঘোষণাপত্রে বঞ্চনা’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে তিনি এসব কথা বলেন।

ফরহাদ মজহার বলেন, ‘৮ আগস্ট শেখ হাসিনার ফ্যাসিস্ট সংবিধানে শপথ গ্রহণের সময় আমি তাৎক্ষণিক বলেছিলাম, এখানে সাংবিধানিক প্রতিবিপ্লব ঘটেছে। এ বিষয় বোঝার জন্য যে বুদ্ধিমত্তা ও দূরদৃষ্টি প্রয়োজন, তা না থাকলে সমাজ অশিক্ষিতই থেকে যায়। জনগণকে কী করে প্রতারণা করা হয়, কী ভাষায় প্রতারণা হয়, ওটাও তারা সহজে বুঝতে পারে না। আপনাদের বুঝতে বুঝতে এক বছর লেগে গেল। গণ–অভ্যুত্থানের পর আমরা জাতীয় সরকার গঠনের প্রস্তাব দিয়েছিলাম। তরুণেরা যারা বুলেটের মুখে দাঁড়িয়ে এই অভ্যুত্থান এনেছে, আমরা বলেছি, এটা আমাদের সবার অর্জন। আসুন, আমরা জাতীয় সরকার গঠন করি। শেখ হাসিনার ফ্যাসিস্ট সংবিধান ফেলে দিয়ে নতুন বাংলাদেশ গঠন করি।’

বিএনপির উদ্দেশে ফরহাদ মজহার বলেন, ‘বাহাত্তর সালের সংবিধান যারা লিখেছে, তারা ছিলেন পাকিস্তানি। কারণ, পাকিস্তানের সংবিধান লেখার জন্য আমরা তাদের ১৯৭০ সালে নির্বাচিত করেছিলাম। বিএনপির কাছে আমার প্রশ্ন, আপনারা যে বাহাত্তর সালের সংবিধান ধরে রাখতে চান, আপনারা কি পাকিস্তানি? জিয়াউর রহমান তো এই সংবিধান ধরে রাখতে চান নাই। যত দূর জানি, বেগম খালেদা জিয়াও এই সংবিধান রাখতে চাননি। তিনি তো বলেছেন, এই সংবিধান ছুড়ে ফেলে দিতে হবে।’

ফরহাদ মজহার আরও বলেন, ‘তাহলে আপনারা কেন গণ-অভ্যুত্থানের পরও এই সংবিধান এখনো চাপ দিয়ে ধরে রেখেছেন। গণ-অভ্যুত্থানের পর আপনারা বারবার বলেছেন, নির্বাচন লাগবে। আমরাও বলেছি, অবশ্যই নির্বাচন দরকার। নির্বাচন ছাড়া কোনো গণতন্ত্র হয় না। গণতন্ত্র মানে তো নির্বাচন নয়। আমরা আপনাদের বোঝাবার চেষ্টা করেছি, গণতন্ত্রের কথা অনুসারে জনগণের ক্ষমতা জনগণের হাতে ফিরিয়ে দিন। আপনাদের জনগণের ক্ষমতা ফিরিয়ে দিতে এত আপত্তি কেন?’

গণপরিষদ নির্বাচনকে জনগণের হাতে ক্ষমতা ফিরিয়ে দেওয়ার প্রথম ধাপ হিসেবে উল্লেখ করে ফরহাদ মজহার বলেন, ‘গণপরিষদ আর সরকার নির্বাচন এক কথা নয়। গণপরিষদে বসে আমরা বাংলাদেশের জন্য কী ধরনের গঠনতন্ত্র, কী ধরনের রাষ্ট্র দরকার, সেটা নিয়ে তর্কবিতর্ক করতাম। উপদেষ্টা পরিষদে নতুন প্রতিনিধি নির্বাচন করে পাঠালাম। কারণ, আমরা যেন নতুন গঠনতন্ত্র পেতে পারি। আপনারা ওইটা করলেন না। আপনারা কী করলেন, ইউনূসের হাত ধরে কতগুলো কমিশন বানালেন। এই কমিশন বানিয়ে আপনারা আমাদের ধোঁকা দেওয়া শুরু করলেন। এই কমিশন বানিয়ে আপনারা অনেক সংস্কার করে ফেললেন। কমিশন গঠনের পুরো প্রক্রিয়া গণ–অভ্যুত্থানে জনগণ যে ইচ্ছা থেকে জীবন দিয়েছে, সেই ইচ্ছার বিরুদ্ধে।’

জুলাই ঘোষণাপত্রের বিষয়ে ফরহাদ মজহার বলেন, ছাত্ররা আরও আগে থেকে বারবার ঘোষণা চেয়েছেন। তাঁদের মিথ্যা বুঝিয়ে ঘোষণা দিতে দেওয়া হলো না। কিন্তু এখন একটা ঘোষণাপত্র দিলেন, সবাই যেটার সমালোচনা করছে। আমি নিজেও এটা প্রত্যাখ্যান করেছি। কারণ, আইনগতভাবে ইউনূসের জুলাই ঘোষণাপত্র ঘোষণার অধিকার নেই। তিনি শেখ হাসিনার সংবিধানের অধীন একজন উপদেষ্টামাত্র। তিনি গণ-অভ্যুত্থানের নেতা নন। তিনি গণ-অভ্যুত্থানের ফলমাত্র। ফলে গণ-অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র দেওয়ার সামাজিক বা অন্য কোনো অধিকার তাঁর নেই।

সরকারের উদ্দেশে মজহার বলেন, ‘আপনারা সেনাবাহিনীকে দিয়ে নির্বাচন করাতে চাইছেন। কারণ, নির্বাচন করার ক্ষমতা আপনাদের নেই। কিন্তু সেনাবাহিনীর কাজ তো নির্বাচন পরিচালনা করা নয়। সেনাপ্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কোনো প্রকার ষড়যন্ত্র আমরা নাগরিকেরা সহ্য করব না।’

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • লাঙ্গল কাউকে দিতে চাইলেই আন্দোলন: জি এম কা‌দের
  • গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে অনাকাঙ্ক্ষিত ও ঢালাও অভিযোগের প্রতিবাদ সম্পাদক পরিষদের
  • বাংলাদেশের ‘তরুণকম্পের’ সম্ভাবনা ও ঝুঁকি
  • গণতন্ত্রে উত্তরণে আমরা কেন বারবার হোঁচট খাচ্ছি
  • আমরা জনগণের হাতে ক্ষমতা ফিরিয়ে দিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ: প্রধান উপদেষ্টা
  • জুলাই সনদে এক বিন্দু ছাড় নয়: নাহিদ
  • জনগণ প্রচলিত রাজনীতির পরিবর্তন চাইছে: তারেক রহমান
  • সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, জাতীয়তাবাদ আমাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে: ফরহাদ মজহার
  • নেতৃত্ব কেন উদাসীন থাকবে
  • ইসি অভিযান থেকে রাহুলদের আটক, পরে ছেড়ে দিল পুলিশ