গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নির্ভর করে দূরদর্শী সিদ্ধান্তে
Published: 13th, May 2025 GMT
বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক রূপান্তরের প্রশ্নে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো সংবিধান সংস্কার। নির্বাহী বিভাগের এককেন্দ্রিক ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব দেশে কার্যত একনায়কতান্ত্রিক শাসনের ভিত্তি তৈরি করেছে। গত রোববার নাগরিক কোয়ালিশন নামে একটি নাগরিক সংগঠনের পক্ষ থেকে সংবিধান সংস্কারের জন্য যে সাতটি প্রস্তাব উত্থাপিত হয়েছে, তা সময়োপযোগী ও বিবেচনার দাবি রাখে।
নাগরিক কোয়ালিশনের প্রস্তাবগুলোর কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা সীমিতকরণ ও ভারসাম্যপূর্ণ রাষ্ট্রকাঠামো গড়ে তোলা। এই প্রস্তাবে বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি সর্বোচ্চ দুবার পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন।
এই দাবি বেশ জনপ্রিয় হলেও বক্তাদের কেউ কেউ যুক্তি তুলে ধরেছেন যে শুধু মেয়াদ নির্ধারণ করলেই একনায়কতান্ত্রিক শাসন ঠেকানো যাবে না। তাঁরা বলেছেন, প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা সীমিত না করলে মেয়াদসীমা নির্ধারণ কোনো বাস্তব পরিবর্তন আনবে না। কারণ, পরিবারভিত্তিক ক্ষমতা হস্তান্তর এই বিধানকে অকার্যকর করে তুলতে পারে। একই পরিবারের সদস্যরা যদি পালাক্রমে ক্ষমতায় বসেন, তাহলে মেয়াদ নির্ধারণের বিষয়টি অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়বে এবং পুনরায় স্বৈরাচার বা একনায়কতান্ত্রিক শাসনের উত্থান হতে পারে।
বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শে কাজ করেন। এ ধরনের কেন্দ্রীকরণ রাজনৈতিক জবাবদিহি হ্রাস করে এবং প্রাতিষ্ঠানিক শক্তিগুলোকে দুর্বল করে তোলে। এই বাস্তবতায় সবচেয়ে জরুরি কাজ হলো প্রধানমন্ত্রীর অসীম ক্ষমতা হ্রাস করে ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করা। ভারত বা যুক্তরাজ্যের মতো সংসদীয় গণতন্ত্রে যেভাবে রাষ্ট্রপতির ভূমিকায় ন্যূনতম স্বশাসন ও প্রতীকী ভারসাম্য রাখা হয়েছে, তেমনি বাংলাদেশেও একটি গণতান্ত্রিক পুনর্বিন্যাস প্রয়োজন।
আলোচনায় অংশ নেওয়া বিশেষজ্ঞদের মতে, শেখ হাসিনার ‘স্বৈরতান্ত্রিক রূপান্তর’ কোনো সামরিক অভ্যুত্থান বা সংবিধানবহির্ভূত প্রক্রিয়ায় ঘটেনি; বরং বর্তমান সংবিধানই এমন এক কাঠামো তৈরি করেছে, যেখানে নির্বাহী প্রধানের ওপর অন্য কোনো বিভাগের কার্যকর কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। এই কাঠামোই তাকে সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী করেছে। সেই কাঠামো ভেঙে ফেলাই এখন সবচেয়ে জরুরি কাজ।
প্রস্তাবিত সাত দফায় আরও বলা হয়েছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তন, উচ্চকক্ষসহ দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ গঠন, রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে নারীদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি, নারী প্রতিনিধিত্বে সরাসরি ভোট, তত্ত্বাবধায়কধর্মী সর্বদলীয় কমিটি এবং সংবিধানের প্রস্তাবে ‘জুলাই সনদ’-এর অন্তর্ভুক্তি।
নাগরিক কোয়ালিশনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব হলো সাংবিধানিক নিয়োগে স্বচ্ছতা আনার বিষয়টি। সংবিধান সংস্কার কমিশনের সুপারিশের মতো তাদের পক্ষ থেকেও জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল গঠনের কথা বলা হয়েছে, যা রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গঠিত হবে। এসব পদক্ষেপ যদি যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করা যায়, তবে রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলোয় জবাবদিহি ফিরে আসবে এবং জনগণের আস্থা পুনর্গঠিত হবে।
একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মূল শর্ত হচ্ছে ক্ষমতার ভারসাম্য এবং জবাবদিহিমূলক শাসনব্যবস্থা। বাংলাদেশের সংবিধান বর্তমানে একজন প্রধানমন্ত্রীর হাতে যে অগাধ ক্ষমতা তুলে দিয়েছে, তা একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। এখনই সময় সংবিধান সংস্কারের মাধ্যমে রাষ্ট্রের শাসনব্যবস্থাকে পুনর্গঠন করে প্রকৃত অর্থে জনগণের মালিকানাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার।
আমরা মনে করি, নাগরিক কোয়ালিশনের এই প্রস্তাবগুলো শুধু রাজনৈতিক বিতর্কের খোরাক হবে না, বরং একটি ভবিষ্যৎমুখী, গ্রহণযোগ্য এবং গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গঠনের বাস্তব রূপরেখা তৈরি করতে সহায়ক হবে। এটি কেবল সংবিধান সংস্কারের প্রশ্ন নয়, এটি জনগণের মালিকানায় রাষ্ট্র পুনরুদ্ধারের বিষয়ে আলোকপাত করেছে। প্রস্তাবগুলোর বাস্তবায়নে রাজনৈতিক দলগুলোর আন্তরিকতা ও অঙ্গীকার অপরিহার্য। ১৯৯০ সালে গণ-আন্দোলনের পরও রাজনৈতিক দলগুলো জনগণকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি থেকে সরে এসেছিল। এবার যেন ইতিহাসের সেই পুনরাবৃত্তি আর না হয়।
বাংলাদেশের গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে এই সময়ের সাহসী ও দূরদর্শী সিদ্ধান্তের ওপর। সংবিধান সংস্কারের উদ্যোগ একটি গণতান্ত্রিক ও জবাবদিহিমূলক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সেতুবন্ধ হবে—এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: গণত ন ত র ক প রস ত ব ভ রস ম য র জন ত ক ব যবস থ ক ষমত
এছাড়াও পড়ুন:
পদ্মা সেতু ও এক্সপ্রেসওয়েতে বাড়ানো হয়েছে নিরাপত্তা
মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তিনজনের মামলার রায়কে কেন্দ্র করে শরীয়তপুরে পদ্মা সেতুর জাজিরা টোল প্লাজা ও ঢাকা-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়েতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপর রয়েছে। পুলিশ, র্যাব ও সেনাবাহিনীর সদস্য মোতায়েন রয়েছে।
সোমবার (১৭ নভেম্বর) সকাল থেকেই পদ্মা সেতু দিয়ে বিভিন্ন ধরনের যানবাহন স্বাভাবিকভাবে চলাচল করছে।
আরো পড়ুন:
চেকপোস্ট বসিয়ে চলছে তল্লাশি, ঢাকায় যান চলাচল স্বাভাবিক
মুরগির ঘরে মিলল নানি ও নাতি-নাতনির মরদেহ
ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি রেজাউল করিম মল্লিক পদ্মা সেতু দক্ষিণ থানা এলাকা পরিদর্শন শেষে জানান, শরীয়তপুর, মাদারীপুর ও ফরিদপুর—এই তিনটি জেলা তিনি সরেজমিনে ঘুরে দেখেছেন। জনগণের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে টহল ও নিয়মিত পরিদর্শন সর্বক্ষণ চলমান রয়েছে।
এদিকে, রবিবার সন্ধ্যার পর থেকেই শরীয়তপুর জেলায় টহল পরিচালনা করেছে পুলিশ ও অন্যান্য নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা। গতকাল রাতে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম পদ্মা সেতু জাজিরা প্রান্ত পরিদর্শন করেন এবং নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ে কর্মকর্তাদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন।
ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি রেজাউল করিম মল্লিক জানান, গতকাল স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বরিশাল সফর শেষে পদ্মা সেতু হয়ে ঢাকায় ফিরেছেন। বাংলাদেশ পুলিশ শুধু পদ্মা সেতুকেই নয়, দেশের প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ স্থানকে সমান প্রাধান্য দিচ্ছে এবং জনগণের নিরাপত্তায় টহল টিম দিনরাত কাজ করছে।
ঢাকা/সাইফুল/মাসুদ