অতি সম্প্রতি ২০২৫ সালের বৈশ্বিক মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। বাংলায় অনুবাদ করলে এর শিরোনাম দাঁড়ায়, ‘চয়নের একটি বিষয়: কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যুগে মানুষ এবং সম্ভাবনা’। বিষয়বস্তুর বিশ্লেষণ ভিন্ন হলেও এই প্রতিবেদনে ২০২৩ সালের বৈশ্বিকভাবে তুলনাযোগ্য উপাত্ত নিয়ে তৈরি করা মানব উন্নয়ন সূচকে ১৯৩ দেশ এবং ভূখণ্ডের মানব উন্নয়নের মান ও অবস্থান নির্ণয় করা হয়েছে।

বলা প্রয়োজন যে একটি দেশের প্রত্যাশিত গড় আয়ু, বিদ্যালয় শিক্ষার গড় ও প্রত্যাশিত বছর এবং মাথাপিছু আয়ের ভিত্তিতে একটি সমন্বিত মানব উন্নয়ন সূচক তৈরি করা হয়। এ বছরের মানব উন্নয়ন প্রতিবেদনের মানব উন্নয়ন সূচকে গত দুই বছরের শীর্ষস্থানীয় দেশ সুইজারল্যান্ডকে হটিয়ে দিয়ে আইসল্যান্ড শীর্ষ স্থান দখল করেছে।

অন্যদিকে তালিকার শেষ প্রান্তের দেশ সোমালিয়া এক ধাপ ওপরে উঠে এসেছে। ফলে এখন মানব উন্নয়ন সূচক তালিকার সর্বনিম্নে স্থান হয়েছে দক্ষিণ সুদানের।

আসলে নিজেদের মধ্যে অবস্থান পাল্টালেও মানব উন্নয়ন সূচক তালিকার একেবারের ওপরের কিংবা একেবারে নিচের পাঁচটি দেশ মোটামুটি কিন্তু অপরিবর্তিতই থেকেছে।

.

মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন এবং মানব উন্নয়ন সূচক বিষয়ে তিনটি পর্যবেক্ষণ অত্যন্ত জরুরি। প্রথমত, মনে রাখা দরকার যে কোনো তাত্ত্বিক ধারণাই তার প্রাসঙ্গিক পরিমাপের চেয়ে বড়। অন্য কথায়, কোনো পরিমাপ, তা যত সঠিকই হোক না কেন, সংশ্লিষ্ট ধারণার পুরোটাকে যথার্থভাবে ধরতে পারে না। মানব উন্নয়ন সূচকও মানব উন্নয়নের বিস্তৃত পরিব্যাপ্তির প্রতিনিধিত্ব করতে পারে না।

দ্বিতীয়ত, একটি সুস্থ দীর্ঘ সৃষ্টিশীল জীবন, জ্ঞান, জীবনযাত্রার মানের মতো মানব উন্নয়নের অত্যন্ত মৌলিক বিষয়গুলো নিয়ে মানব উন্নয়ন সূচক তৈরি করা হয়। বাহ্যতই, জন অংশগ্রহণ, মানব নিরাপত্তা, পরিবেশ বজায় ক্ষমতার মতো মানব উন্নয়নের বৃহত্তর মাত্রিকতাগুলো এই সূচকে অন্তর্ভুক্ত হয়নি। সুতরাং মানব উন্নয়ন সূচক একটি দেশের মানব উন্নয়নের বৃহত্তর চালচিত্রকে ধারণ করে না।

তৃতীয়ত, এটা নিতান্ত দুর্ভাগ্যজনক যে মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন প্রকাশিত হলেই সংবাদপত্র, প্রচারমাধ্যম এবং সেই সঙ্গে দেশের সরকারসমূহের নজর ও মনোযোগ পড়ে থাকে মানব উন্নয়ন সূচকে বিভিন্ন দেশের অবস্থান কী রকম, সেদিকে। এই অনাকাঙ্ক্ষিত ঘোরের কারণে মানব উন্নয়ন প্রতিবেদনে বিষয়বস্তুর যে যথার্থ বিশ্লেষণ ও নীতিমালার সুপারিশ থাকে, তা ‘অপাঙ্‌ক্তেয়’ হয়ে যায়।

আরও পড়ুনবাংলাদেশের সম্পদ, বাংলাদেশের সম্ভাবনা২৮ মার্চ ২০২৫

কিন্তু বিপদ হচ্ছে যে মানব উন্নয়ন সূচকে দেশসমূহের অবস্থান বিষয়ে মাতামাতি অনেক সময়েই বিভ্রান্তমূলক উপসংহারের জন্ম দেয়। যেমন একটি দেশের মানব উন্নয়ন মান বাড়লেও, সূচক তালিকায় দেশটি নিচে নেমে যেতে পারে।

দুটি কারণে এটা হতে পারে। অন্য দেশের মানব উন্নয়ন সূচকের মান আরও বেশি করে বৃদ্ধি পেলে এবং যদি আরও দেশ মানব উন্নয়ন সূচক তালিকার অন্তর্ভুক্ত হয় কিংবা এ দুটি কারণের সম্মিলনে। কিন্তু এর ফলে যদি বলা হয় যে মানব উন্নয়ন সূচক তালিকায় নেমে যাওয়া সংশ্লিষ্ট দেশটির মানব উন্নয়নে অবনতি ঘটেছে, তবে সে উপসংহারটি হবে বিভ্রান্তমূলক।

৩.

বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতোই, বৈশ্বিক মানব উন্নয়ন প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের দেশেও সব মনোযোগ আর নজর মানব উন্নয়ন সূচক তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান নিয়ে। এ বছরের বৈশ্বিক মানব উন্নয়ন প্রতিবেদনে বাংলাদেশের মানব উন্নয়ন সূচকের মান ০.৬৮৫, যা গত বছরের প্রতিবেদনে ছিল ০.৬৮০।

গত ৩৫ বছরে বাংলাদেশের মানব উন্নয়ন সূচক ৭২ শতাংশ বেড়েছে। কিন্তু দেশে এসব ব্যাপারের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে সূচক অবস্থানে বাংলাদেশ কত ধাপ নামল বা উঠল কিংবা সেই অবস্থানে প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশের অবস্থান কোথায়?

তাই বৈশ্বিক মানব উন্নয়ন প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বর্তমান আলোচনা ঘুরছে, ‘গত প্রতিবেদনে মানব উন্নয়ন সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১২৯, এবার হয়েছে ১৩০। খুবই খারাপ খবর’ কিংবা ‘সূচক অবস্থানে আঞ্চলিক প্রেক্ষাপটে শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপ বাংলাদেশের চেয়ে অনেক এগিয়ে আছে’।

আমার মনে হয়, সংখ্যা এবং সূচক অবস্থান থেকে বেরিয়ে এসে মানব উন্নয়ন সূচকের আলোচনাটি বাংলাদেশে আরেকটু ভিন্ন খাতে প্রবাহিত হওয়া দরকার। মনোযোগ দেওয়া দরকার কিছু মৌলিক বিষয়ের ওপরে, যেখানে নীতিমালার প্রশ্নটি সম্পৃক্ত। প্রথমত, সাধারণ মানব উন্নয়ন সূচকে যখন অসমতাকে বিবেচনা করা হয়, তখন সাধারণ মানব উন্নয়ন সূচকের মান কমে যায়।

২০২৫ সালের বৈশ্বিক মানব উন্নয়ন প্রতিবেদনে যখন আমরা অসমতা-সমন্বিত মানব উন্নয়ন সূচকের দিকে তাকাই, তখন দেখতে পাই যে বাংলাদেশের প্রথাগত মানব উন্নয়ন সূচকের তুলনায় অসমতা-সমন্বিত সূচকের মান এখন ৩০ শতাংশ কম। অথচ দুই বছর আগে এটা ছিল ২৩ শতাংশ কম। এর মানে হচ্ছে যে বাংলাদেশে মানব উন্নয়ন ফলাফলে অসমতা আরও বিস্তৃত হচ্ছে এবং বাংলাদেশের মানব উন্নয়নের অর্জনগুলোকে ক্রমবর্ধমান অসমতা গ্রাস করছে।

তা ছাড়া বাংলাদেশে মানব উন্নয়ন ফলাফলের অসমতা হয়তো নিহিত আছে দেশের মানব উন্নয়ন সুযোগের বৈষম্যের মধ্যে। সুতরাং মানব উন্নয়ন সুযোগ এবং ফলাফলের অসমতার কারণগুলো শনাক্ত করে প্রয়োজনীয় নীতিমালা এবং কৌশল গ্রহণ করতে হবে।

দ্বিতীয়ত, অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে যে একটি ‘মধ্যম আয়ের ফাঁদের’ মতো মানব উন্নয়নের ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ একটি ‘মধ্যম মানের মানব উন্নয়ন ফাঁদে’ আটকা পড়ে আছে। যদিও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের মানব উন্নয়ন সূচকের মান বৃদ্ধি পেয়েছে, তবু এক দশকের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশ মধ্যম মানের মানব উন্নয়ন স্তরে আটকে আছে।

প্রশ্ন হচ্ছে যে এই ফাঁদ থেকে বাংলাদেশ কেন বের হতে পারছে না? আমরা যদি বাংলাদেশের মানব উন্নয়ন সূচকের উপাদানগুলোর দিকে তাকাই, তাহলে দেখতে পাব যে ২০২১-২০২৩ সময়কালের মধ্যে বাংলাদেশের গড় আয়ু ২ বছর বেড়েছে, প্রত্যাশিত বিদ্যালয়-গমনের সময় একটুখানি বৃদ্ধি পেয়েছে, কিন্তু গড় বিদ্যালয়-গমনের সময় হ্রাস পেয়েছে। সেই সঙ্গে মাথাপিছু আয় যথেষ্ট পরিমাণে বাড়েনি।

সুতরাং বাংলাদেশকে যদি উচ্চ মানব উন্নয়ন স্তরে নিয়ে যেতে হয়, তাহলে অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে সঙ্গে নীতির অগ্রাধিকার দিতে হবে যে কী করে গড় বিদ্যালয়-গমনের সময় আরও বাড়ানো যায়, কেমন করে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত করা যায়।

এ ব্যাপারে শ্রীলঙ্কার দিকে একটু নজর ফেরানো যাক। দীর্ঘদিন ধরে শ্রীলঙ্কার অবস্থান উচ্চ মানব উন্নয়ন স্তরে। কিন্তু এটা সবারই জানা যে ২০২২ সালে দেশটি একটি রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিপর্যয়ের মধ্যে পড়েছিল। কিন্তু এই সব বিপর্যয় কাটিয়ে উঠে শ্রীলঙ্কা তার জনগণের প্রত্যাশিত গড় আয়ু দুই বছর বাড়িয়েছে, রোধ করতে পেরেছে তার মাথাপিছু আয়ের হ্রাস। ফলে দেশটির মানব উন্নয়ন সূচকের মান মাত্র ০.০০৬ কমেছে (২০২১ সালের ০.৭৮২ থেকে ২০২৩ সালে ০.৭৭৬)। এত সব বিপর্যয় সত্ত্বেও শ্রীলঙ্কা তার উচ্চ মানব উন্নয়ন মান ধরে রাখতে পেরেছে।

প্রশ্ন হচ্ছে যে বাংলাদেশের গত এক বছরের রাজনৈতিক ও আর্থসামাজিক পরিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে ভবিষ্যৎ পথযাত্রায় বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কার অভিজ্ঞতা থেকে কী শিখতে পারে?

তৃতীয়ত, ভারত এখন বাংলাদেশের মানব উন্নয়ন সূচকের মানকে ছুঁয়ে ফেলেছে। ২০২১ সালে বাংলাদেশের মানব উন্নয়ন সূচকের মান ছিল ০.৬৪১ আর ভারতের ০.৬৩৩। দুই বছর পরে ২০২৩ সালে দুটি দেশেরই মানব উন্নয়ন সূচকের মান হয়েছে ০.৬৮৫। ফলে ২০২১ সালে দুটি দেশের মধ্যে মানব উন্নয়ন সূচকের অবস্থানের যে তারতম্য ছিল (বাংলাদেশের অবস্থান ১২৯তম ও ভারতের ১৩২তম) তা এখন অন্তর্হিত হয়েছে।

মানব উন্নয়ন সূচক মানে দুটি দেশেরই অবস্থান এখন ১৩০তম। দুটি কারণে মানব উন্নয়ন সূচকে ভারত বাংলাদেশের সঙ্গে ফারাকটা দূর করতে পেরেছে।

এক. জনগণের প্রত্যাশিত গড় আয়ু ভারত ৫ বছর বাড়াতে পেরেছে (২০২১ সালের ৬৭ বছর থেকে ২০২৩ সালে ৭২ বছর) এবং দুই. প্রত্যাশিত বিদ্যালয়-গমন বছর ১২ বছর থেকে ১৩ বছর বেড়েছে। ভারত কী করে তার মানব উন্নয়ন ফলাফল উন্নীত করল, সে অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের জন্য শিক্ষণীয় হতে পারে।

চতুর্থত, বৈশ্বিক মানব উন্নয়ন প্রতিবেদনে যে পরিসংখ্যান ব্যবহার করা হয়, তা বৈশ্বিকভাবে তুলনাযোগ্য। দেশজ উপাত্তকে সমভিত্তিক করে এ পরিসংখ্যান কাঠামো গড়ে তোলা হয়।

৪.

দেশজ উপাত্ত হচ্ছে সব উপাত্তের মূল। বিভিন্ন দেশের জাতীয় পরিসংখ্যান সংস্থা যদি বিশ্বাসযোগ্য ও মানসম্পন্ন উপাত্ত সংগ্রহের সক্ষমতা বাড়ায় এবং বৈশ্বিক পর্যায়ে যেসব জাতিসংঘ সংস্থা মানব উন্নয়ন উপাত্ত কাঠামো গড়ে তোলার দায়িত্বে নিয়োজিত, তাদের কাছে দ্রুত এবং সময়মতো দেশজ উপাত্ত লভ্য করে দেয়, তাহলে বৈশ্বিক মানব উন্নয়ন প্রতিবেদনের তথ্য-উপাত্ত অনেক বেশি উন্নত হবে। জাতীয় নীতিমালার উচিত হবে এ প্রচেষ্টাকে ত্বরান্বিত করা।

পঞ্চমত, বাংলাদেশের নারী ও পুরুষের বিভাজিত মানব উন্নয়ন সূচক থেকে এটা সুস্পষ্ট যে সেখানে উল্লেখযোগ্য বৈষম্য রয়েছে। আমাদের দেশে নারীর মানব উন্নয়ন সূচক ০.৬৫০। পুরুষের ক্ষেত্রে তা হচ্ছে ০.৭০৮।

শুধু জৈবিক সুবিধার কারণে নারীর প্রত্যাশিত গড় আয়ু পুরুষের চেয়ে বেশি; ৭৬ বছর বনাম ৭৩ বছর। অন্যদিকে গড় বিদ্যালয়–গমনের সময়, মাথাপিছু আয় ইত্যাদি ক্ষেত্রে বাংলাদেশের নারীরা পুরুষদের চেয়ে পিছিয়ে আছে।

পুরুষের গড় বিদ্যালয়-গমন সময় যেখানে ৭.৩ বছর, নারীদের ক্ষেত্রে সেটা হচ্ছে ৬.২ বছর। বাংলাদেশের নারীদের মাথাপিছু আয় পুরুষদের মাথাপিছু আয়ের অর্ধেক। শুধু প্রত্যাশিত বিদ্যালয়–গমন সময়ের ক্ষেত্রে নারীদের সময় যেখানে ১২.৪ বছর, পুরুষদের ক্ষেত্রে তা হচ্ছে ১১.৯ বছর।

সুতরাং প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন হচ্ছে, মানব উন্নয়ন ফলাফলে বৈষম্য কমানোর জন্য কী কী ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে?

বাংলাদেশের আগামীর উন্নয়ন পথযাত্রায় দেশটি নানা রকম দেশজ ও বৈশ্বিক অন্তরায়ের সম্মুখীন হবে। সেসব সমস্যা বাংলাদেশের মানব উন্নয়নকে প্রভাবিত করবে। দেশজ বলয়ে অর্থনৈতিক শ্লথতা, উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও বেকারত্বের হার, ব্যাংকিং এবং বহিঃ খাতের নাজুকতা ও ভঙ্গুরতা বাংলাদেশের মানব উন্নয়নের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াবে। বৈশ্বিক বলয়ে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে বাংলাদেশের উত্তরণ, বৈশ্বিক শুল্কযুদ্ধ, বিশ্বের নানান অংশে চলমান সংঘাত বাংলাদেশের মানব উন্নয়নকে প্রভাবিত করবে।

মানবসম্পদ হচ্ছে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সম্পদ। সুতরাং বাংলাদেশের উন্নয়ন দেশের মানব উন্নয়নের ওপর উল্লেখযোগ্যভাবে নির্ভর করে। এর জন্য দেশের মানব উন্নয়নের পথের প্রতিবন্ধকতাসমূহ চিহ্নিত করতে হবে, সমস্যাগুলোর বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন এবং সেসব সমস্যা সমাধানের জন্য কৌশল প্রণয়ন করা দরকার।

আমরা অর্থনীতির সমস্যাগুলো ঠিক করতে পারি, সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে পারি, ভৌত অবকাঠামো গড়ে তুলতে পারি; কিন্তু চূড়ান্ত বিচারে, আমাদেরকে মানব উন্নয়নকে অগ্রাধিকার দিতেই হবে। কারণ, বাংলাদেশে মানব উন্নয়নের কোনো বিকল্প নেই।

ড. সেলিম জাহান জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন দপ্তর এবং দারিদ্র্য দূরীকরণ বিভাগের ভূতপূর্ব পরিচালক।

মতামত লেখকের নিজস্ব

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ল দ শ র অবস থ ন ২০২১ স ল ২০২৩ স ল দ ই বছর ব ত কর উপ ত ত র জন য সমস য বছর ব দরক র বছর র

এছাড়াও পড়ুন:

সাগর থেকে মাছ আহরণ বাংলাদেশের কমছে, ভারত-মিয়ানমারে বাড়ছে

বঙ্গোপসাগর থেকে গত তিন বছর বাংলাদেশের মাছ আহরণ ধারাবাহিকভাবে কমছে। ব্যাপকভাবে কমেছে সামুদ্রিক ইলিশ, কাঁকড়া ও চিংড়ি আহরণ। সাগর থেকে মাছ ধরার পরিমাণ কমতে থাকায় সার্বিকভাবে দেশের মাছের জোগানের গতিও কমে গেছে। যদিও ভিন্ন চিত্র প্রতিবেশী দেশগুলোর। বছর বছর সাগর থেকে মাছ ধরা বাড়িয়ে মাছ আহরণে বিশ্বের শীর্ষ দশ দেশের মধ্যে স্থান করে নিয়েছে ভারত। এমনকি গৃহযুদ্ধে বিধ্বস্ত মিয়ানমারেও প্রতিবছর বাড়ছে সামুদ্রিক মাছ আহরণ।

সাগর থেকে বাংলাদেশের মাছ আহরণ কমে যাওয়ার কারণ হিসেবে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সাগরের তাপমাত্রা বৃদ্ধি ও ঘূর্ণিঝড়কে দায়ী করছেন এ দেশের মৎস্য কর্মকর্তারা। তা ছাড়া অতিরিক্ত মাছ আহরণের কারণেও মাছের মজুত কমে আসছে বলে জানান তাঁরা।

মৎস্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত ২০২১-২২ অর্থবছরে দেশে মোট সামুদ্রিক মাছ আহরণের পরিমাণ ছিল ৭ লাখ ৬ হাজার টন। পরের অর্থবছরে তা কমে দাঁড়ায় ৬ লাখ ৭৯ হাজার টনে। সর্বশেষ গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে তা আরও কমে দাঁড়ায় ৬ লাখ ২৮ হাজার টনে। অর্থাৎ ২০২২–২৩ অর্থবছরের চেয়ে ২০২৩–২৪ অর্থবছরে সাগর থেকে মাছ আহরণ প্রায় সাড়ে ৭ শতাংশ কমেছে। গত জুনে শেষ হওয়া ২০২৪–২৫ অর্থবছরে এই পরিমাণ আরও কমেছে বলে জানিয়েছেন মৎস্য অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। তবে এখনো অনুষ্ঠানিকভাবে গত অর্থবছরের তথ্য প্রকাশ করেনি সংস্থাটি।

সমুদ্র খাতের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বেশ কয়েক বছর ধরে সাগরে অতিরিক্ত মাছ আহরণের কারণে মাছের মজুত কমে গেছে। এ বিষয়ে মৎস্য অধিদপ্তরের সামুদ্রিক শাখার সহকারী পরিচালক মো. আবদুল্লাহ আল মামুন প্রথম আলোকে বলেন, ২০ বছর আগেও সাগরে বাণিজ্যিক ট্রলারের সংখ্যা ছিল এক শর কম। এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৬৫টিতে। তিনি জানান, সাগরের ৪০ মিটারের ভেতরে মাছ না ধরার কথা থাকলেও এসব নৌযান তা মানছে না। আবার ছোট নৌযানের সংখ্যা এখন ২৯ হাজার ছাড়িয়েছে। এসব নৌযানেও আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে, যা তাদের ব্যবহার করার কথা নয়। পাশাপাশি অবৈধ জালও ব্যবহার করা হচ্ছে। এমনকি উপকূলের ৫ থেকে ১০ মিটারের মধ্যে মাছ ধরা হচ্ছে। এতে ডিম থেকে নতুন পোনা তৈরির সুযোগ নষ্ট হচ্ছে।

বিশ্বে সমুদ্র থেকে মাছ আহরণে নেতৃত্ব দিচ্ছে চীন। এ ছাড়া শীর্ষ ১০ দেশের মধ্যে ভারত ৬ষ্ঠ অবস্থানে রয়েছে। ভারতের মৎস্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১–২২ সালে সাগর থেকে দেশটির মাছ আহরণের পরিমাণ ছিল ৪১ লাখ ২৭ হাজার টন, যা আগের বছরের তুলনায় ১৮ শতাংশ বেশি। সর্বশেষ ২০২৩–২৪ অর্থবছরে ৪৪ লাখ ৯৫ হাজার টন মাছ আহরণ করেছে ভারত।

মিয়ানমারের মৎস্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, দেশটিতে ২০২০-২১ সালে সাগর থেকে মাছ আহরণের পরিমাণ ছিল ৩২ লাখ ৯৫ হাজার। সর্বশেষ ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এই পরিমাণ আরও বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৪ লাখ ১৪ হাজার টনে। অর্থাৎ গৃহযুদ্ধের মধ্যেও দেশটির সাগর থেকে মাছ আহরণ বাড়ছে।

এদিকে বাংলাদেশে সাগরে সবচেয়ে বেশি আহরণ কমছে ইলিশ ও চিংড়ির। মৎস্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩–২৪ অর্থবছরে সাগর থেকে ইলিশ আহরণ তার আগের অর্থবছরের চেয়ে প্রায় সাড়ে ৬ শতাংশ কমেছে। আর চিংড়ির আহরণ কমেছে প্রায় ৪৪ শতাংশ। কাঁকড়া আহরণও কমেছে ১৬ শতাংশের বেশি।

সাগর থেকে মাছ আহরণ কমে যাওয়া এবং এ বিষয়ে করণীয় প্রসঙ্গে সাসটেইনেবল কোস্টাল অ্যান্ড মেরিন ফিশারিজ প্রকল্পের উপপরিচালক মোহাম্মদ শরিফুল আজম প্রথম আলোকে বলেন, ‘২০১৯ সাল থেকেই চিংড়ি আহরণ কমে যাওয়ার তথ্য পাচ্ছিলাম। তাই সামুদ্রিক মৎস্য বিধিমালায় চিংড়ি ধরার ট্রলারের লাইসেন্স আর না বাড়ানোর নীতি গ্রহণ করি। ২০২৮ সাল পর্যন্ত এসব ট্রলাররের লাইসেন্স নবায়ন করা হবে না।’

সাগর থেকে মাছ আহরণ বাড়াতে হলে বঙ্গোপসাগরের নিয়ন্ত্রণহীন মৎস্য আহরণকে নজরদারির মধ্যে আনার কথা বলছেন খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। মৎস্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক মো. জিয়া হায়দার চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, পরীক্ষামূলকভাবে পাঁচটি ট্রলারে স্যাটেলাইট ট্রেকার বসিয়ে নজরদারি করা হচ্ছে। পর্যায়ক্রমে সব ট্রলার ডিজিটাল নজরদারির আওতায় আনার পরামর্শ তাঁর।

এদিকে মাছ আহরণ কমতে থাকায় সাগরের ওপর নির্ভরশীল জেলেরাও বিপাকে পড়ছেন। ঋণের দাদনের টাকা শোধ করে লাভের অঙ্ক মিলছে না তাঁদের। কক্সবাজারে পাঁচ হাজারের বেশি মাছ ধরার কাঠের নৌযান আছে। এসব নৌকায় এখন মাছ ধরা পড়ছে কম। কক্সবাজার ফিশিংবোট মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. দেলোয়ার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, টানা ছয় থেকে সাত মাস তেমন মাছ ধরা পড়ছে না। কয়েক বছর ধরেই মাছ কম পাওয়া যাচ্ছে। এক সপ্তাহের জন্য সাগরে গেলে দুই থেকে তিন লাখ টাকা পর্যন্ত খরচ হয়। কিন্তু মাছ কম পাওয়ায় দাদন পরিশোধ করাই এখন কষ্টকর হয়ে গেছে।

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে মৎস্য অধিদপ্তরের ব্লু ইকোনমি সেলের পরিচালক মো. সাজদার রহমান প্রথম আলোকে বলেন, সাগরে এখন ঘন ঘন ঘূর্ণিঝড় হচ্ছে। সাগরের তাপমাত্রাও বেড়ে গেছে। তা ছাড়া জেলিফিশের প্রকোপ বেড়েছে। আর অতিরিক্ত মৎস্য আহরণের কারণে মাছের মজুত কমছে। তাই মাছ আহরণ আরও কমিয়ে আনতে হবে।

এ বিষয়ে গত মঙ্গলবার জাতীয় প্রেসক্লাবে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র মৎস্যজীবী জেলে সমিতির এক সভায় গণমাধ্যমে সঙ্গে কথা বলেন অন্তর্বর্তী সরকারের মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার। তিনি বলেন, ‘ভারতের জেলেরা যাতে বাংলাদেশে এসে মাছ ধরতে না পারেন, সেটা আমাদের বন্ধ করতে হবে।’

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালে সারা বিশ্বে সাগর থেকে ৭ কোটি ৯৭ লাখ টন মাছ ধরা হয়। যার মধ্যে অর্ধেক মাছ আহরণ করেছে এশিয়ার দেশগুলো। ওই বছর বিশ্বের মোট সামুদ্রিক মাছের ১৪ দশমিক ৮ শতাংশই আহরণ করেছিল চীন, যার পরিমাণ ১ কোটি ১৮ লাখ ১৯ হাজার টন। দ্বিতীয় স্থানে থাকা ইন্দোনেশিয়া ওই বছর আহরণ করেছে ৬৮ লাখ ৪৩ হাজার টন মাছ। আর ভারত আহরণ করেছে ৩৫ লাখ ৯৭ হাজার টন। যেখানে বাংলাদেশের হিস্যা ছিল বৈশ্বিক মাছ আহরণের মাত্র শূন্য দশমিক ৯ শতাংশ।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • কারানির্যাতিত জবি শিক্ষার্থী খাদিজাতুল কুবরাকে পদ দিল ছাত্রদল
  • সাগর থেকে মাছ আহরণ বাংলাদেশের কমছে, ভারত-মিয়ানমারে বাড়ছে
  • ক্যাম্প ন্যুর বাইরে মেসির ভাস্কর্য হবে, নিশ্চিত করল বার্সেলোনা