যখন সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতভেদ বেড়ে চলেছে, তখন নাগরিক কোয়ালিশন নামে একটি প্ল্যাটফর্ম গুরুত্বপূর্ণ এক সংলাপের আয়োজন করেছে। ১১ মে আয়োজিত এই সংলাপে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা, কয়েকটি সংস্কার কমিশনের প্রধান ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরাও অংশ নেন।

নাগরিক জোটের পক্ষ থেকে সাত দফা প্রস্তাবও উত্থাপন করা হয়, যা জট কাটাতে সহায়ক হতে পারে। তবে ওই সংলাপে রাজনৈতিক নেতাদের বক্তৃতায় মনে হয়, তাঁরা নিজ নিজ অবস্থানে অনড় আছেন। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের কাছে দেওয়া বক্তব্যেরই পুনরাবৃত্তি ঘটেছে। অনেকটা সেই গ্রামীণ প্রবাদের মতো, ‘সালিস মানি, কিন্তু তালগাছটা আমার।’

সংলাপে অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর অসীম ক্ষমতার বিষয়টিও উঠে আসে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ ১৯৯১ সালের দ্বাদশ সংশোধনীর প্রসঙ্গ টেনে বলেন, বাংলাদেশ যখন সংসদীয় পদ্ধতিতে প্রবেশ করল, তখন রাষ্ট্রপতির হাতে যে অভাবনীয় ক্ষমতা দেওয়া হয়েছিল, সেই ক্ষমতার প্রতিটি অংশ প্রধানমন্ত্রীর হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিল।

তবে আমাদের এটাও জানা আছে যে ১৯৭৫ সালে একদলীয় বাকশাল রাষ্ট্রপতিকে যে ক্ষমতা দিয়েছিল, পরবর্তী রাষ্ট্রপতিরাও তা ভোগ করেছেন বহুদলীয় গণতন্ত্রের নামে। আমাদের এখানে একদলীয়, বহুদলীয়, রাষ্ট্রপতিশাসিত কিংবা সংসদীয় শাসন—সবই পরিচালিত হয় ব্যক্তিকে কেন্দ্র করে। এক ব্যক্তি কয়বার প্রধানমন্ত্রী হবেন, সেটা নিয়ে যে বিএনপি ও অন্যান্য দল বিতর্ক করছে, তা–ও ওই ব্যক্তিকে সামনে রেখে। আগে আপনারা সংস্কারের মৌলিক বিষয়ে একমত হোন, এরপর মেয়াদ ঠিক করা যাবে।

আমাদের রাজনীতিকেরা ভুলে যান যে দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হলে দলেও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা জরুরি। রাজনৈতিক দলগুলোর গঠনতন্ত্রে যা–ই লেখা থাকুক না কেন, তাদের গণতান্ত্রিক উপায়ে নেতৃত্ব নির্বাচনের রেওয়াজ নেই। দলের সম্মেলন হওয়ার আগে ‘নেতা’ ঠিক করে রাখে।

সাম্প্রতিক কালে রাষ্ট্র সংস্কারের যেসব গুরুত্বপূর্ণ দিক নিয়ে কথাবার্তা হচ্ছে, এর প্রায় সবটা নিয়ে আলোচনা করেছেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা আকবর আলি খান তাঁর অবাক বাংলাদেশ: বিচিত্র ছলনাজালে রাজনীতি বইয়ে। ২০১৭ সালে প্রকাশিত এ বইয়ে রাষ্ট্রের মৌলিক নীতি থেকে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর চুলচেরা বিশ্লেষণ করা হয়েছে।

আকবর আলি খান যে প্রশ্ন রেখেছিলেন, নির্বাহী বিভাগ নির্বাচিত স্বৈরতন্ত্রের পথে যাচ্ছে কি না। আমরা তার চূড়ান্ত রূপ দেখলাম আওয়ামী লীগ শাসনামলে। তিনি আরও লিখেছেন, ক্ষমতার দিক থেকে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা ফ্রান্সের বুরবন সম্রাট, রাশিয়ার জার ও মোগল বাদশাহর সঙ্গে তুলনীয়।

সংবিধানের ৫৫ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, ১.

প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে বাংলাদেশের একটি মন্ত্রিসভা থাকিবে এবং প্রধানমন্ত্রী ও সময়ে সময়ে তিনি যে রূপ স্থির করিবেন, সেই রূপ অন্যান্য মন্ত্রী লইয়া এই মন্ত্রিসভা গঠিত হইবে। ২. প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক বা তাহার কর্তৃত্ব এই সংবিধান অনুযায়ী প্রজাতন্ত্রের নির্বাহী ক্ষমতা প্রযুক্ত হইবে। ৩. মন্ত্রিসভা যৌথভাবে সংসদের নিকট দায়ী থাকিবেন।

১৯৭২ সালে প্রণীত সংবিধান রাষ্ট্রপতিকে রাষ্ট্রের অন্য সব নাগরিকের ওপর স্থান দিলেও কোনো ক্ষমতা দেয়নি। সংবিধানের ৪৮(৩) ধারা অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রীর নিয়োগ ছাড়া সব ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ নেওয়ার কথা বলা হয়েছিল। ১৯৯১ সালে প্রধান বিচারপতি নিয়োগের বিষয়টি যুক্ত হয়।

সংসদীয় ব্যবস্থায় এত দিন একই ব্যক্তি ছিলেন একাধারে প্রধানমন্ত্রী, সংসদ নেতা এবং ক্ষমতাসীন দলের প্রধান। বিএনপি ও আওয়ামী লীগ, দুই দলের আমলেই এমনটি ছিল। এতে সরকার, সংসদ ও দলে এক ব্যক্তির একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ থাকে। সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবে বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রী থাকা অবস্থায় কোনো রাজনৈতিক দলের প্রধান এবং সংসদ নেতা হতে পারবেন না।

বাংলাদেশে সংসদীয় ব্যবস্থায় মন্ত্রিপরিষদ শাসিত ব্যবস্থার বদলে প্রধানমন্ত্রী শাসিত ব্যবস্থা কায়েম করা হয়েছে। অন্যান্য দেশে মন্ত্রিপরিষদ শাসিত ব্যবস্থায় অন্য মন্ত্রীরা প্রধানমন্ত্রীর অধীন নন, তিনি তাঁর সহকর্মীদের মধ্যে ‘প্রথম’। আর বাংলাদেশে এত দিন যা চলছিল, সেটি হলো প্রধানমন্ত্রীই মন্ত্রিসভার প্রধান, অন্যরা তাঁর অধীন। তিনি চাইলে যেকোনো সংসদ সদস্যকে মন্ত্রী করতে পারেন, যেকোনো মন্ত্রীকে যেকোনো সময় বিদায় দিতে পারেন। এমনকি তিনি বিরোধী দল থেকেও মন্ত্রী নিতে পারেন।

২০১৪-২০১৮ সংসদে জাতীয় পার্টি ছিল বিরোধী দলে। অথচ সেই দলের একাধিক মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীও ছিলেন। এটা ছিল বিরোধী দলহীন সংসদকে বিরোধী দল হিসেবে দেখানোর চেষ্টা। সংসদীয় গণতন্ত্রে একই সঙ্গে মন্ত্রিসভা ও বিরোধী দলে থাকার সুযোগ নেই।

আকবর আলি খানের মতে, কেবল আইন করেই প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা বাড়ানো হয়নি, বিধিমালায়ও তাঁকে যথেচ্ছ ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। তাঁর ক্ষমতা প্রয়োগের জন্য স্বতন্ত্র সচিবালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে এবং এর দ্রুত সম্প্রসারণ ঘটছে।

বিগত আওয়ামী লীগ শাসনামলে প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়ে ছয়জন মন্ত্রী পদমর্যাদার উপদেষ্টা, দুজন সচিব এবং তাঁদের সমর্থনের জন্য উপযুক্ত অতিরিক্ত, যুগ্ম ও সহকারী সচিবের সমন্বয়ে এক বিরাট দাপ্তরিক কাঠামো প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এই সচিবালয়ের কর্মকর্তারা মন্ত্রীদের দ্বারা পরিচালিত মন্ত্রণালয়গুলোর বিভিন্ন কাজে হস্তক্ষেপ করতেন। এর ফলে মন্ত্রীরাও হয়ে পড়েন হুকুমবরদার।

সংসদীয় ব্যবস্থায় এত দিন একই ব্যক্তি ছিলেন একাধারে প্রধানমন্ত্রী, সংসদ নেতা এবং ক্ষমতাসীন দলের প্রধান। বিএনপি ও আওয়ামী লীগ, দুই দলের আমলেই এমনটি ছিল। এতে সরকার, সংসদ ও দলে এক ব্যক্তির একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ থাকে। সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবে বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রী থাকা অবস্থায় কোনো রাজনৈতিক দলের প্রধান এবং সংসদ নেতা হতে পারবেন না।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় এটাকে এই মুহূর্তে অসম্ভব মনে হলেও আমাদের সেখানেই যেতে হবে, যদি আমরা ব্যক্তিতন্ত্রের স্থলে গণতন্ত্র এবং প্রধানমন্ত্রী শাসিত শাসনব্যবস্থার বদলে মন্ত্রিসভা শাসিত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চাই।

আমরা রাষ্ট্রপতি পদ্ধতির সরকারকে ব্যক্তিকেন্দ্রিক বলে পরিত্যাগ করেছি। এর জন্য জনগণকে দীর্ঘ সংগ্রাম করতে হয়েছে ১৯৭৫ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত। কিন্তু একানব্বই সালে জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে যে সংসদীয় ব্যবস্থা কায়েম হলো, তাতে রাষ্ট্রপতির সমুদয় ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রীর হাতেই অর্পণ করা হলো। আইন ও বিধিমালা এমনভাবে তৈরি করা হলো, যাতে প্রধানমন্ত্রী পদটি থেকে গেল সবার ওপরে।

প্রধানমন্ত্রীও একটি সংসদীয় আসনে নির্বাচন করে জয়ী হন। অন্য মন্ত্রীরাও নিজ নিজ আসনে নির্বাচন করে জয়ী হন। অর্থাৎ দুজনই জনপ্রতিনিধি। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর হাতে অবারিত ক্ষমতা।

৭০ অনুচ্ছেদ দিয়ে যেমন সাধারণ সদস্যদের হাত–পা বেঁধে দেওয়া হয়েছে, তেমনি মন্ত্রীদেরও প্রধানমন্ত্রীর কৃপাপ্রার্থী করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী ঠিক করেন কাকে কোন মন্ত্রণালয় দেবেন, ওই মন্ত্রণালয়ে তাঁর কাজের কোনো যোগ্যতা থাকুক আর না–ই থাকুক।

খালেদা জিয়ার প্রথম শাসনামলে যখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে বিরোধী দল আন্দোলন করছিল, তখন স্যার নিনিয়ান একটি আপস প্রস্তাব দিয়েছিলেন, নির্বাচনকালীন মন্ত্রিসভায় সরকারি ও বিরোধী দল থেকে সমানসংখ্যক মন্ত্রী নেওয়া হবে এবং আগের সংসদের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রীই সরকারের প্রধান থাকবেন। সে সময় বিরোধী দল তা মানেনি এই যুক্তিতে যে প্রধানমন্ত্রীর হাতেই তো সব ক্ষমতা। অন্য মন্ত্রীরা নিমিত্ত মাত্র।

যে বিরোধী দল আন্দোলন–সংগ্রাম করে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা কায়েম করেছিল, তারাই ক্ষমতায় এসে সেটি বাতিল করে দেয় আদালতের রায়ের দোহাই দিয়ে।  আওয়ামী লীগ সরকার যখন পঞ্চদশ সংশোধনী পাসের তোড়জোড় করে, তখন দলের ভেতরে ও বাইরে প্রায় সবাই তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বহাল রাখার পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন।

দেশের শীর্ষস্থানীয় আইনজীবীরাও সেই রকম মত দিয়েছিলেন। কিন্তু তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর একক সিদ্ধান্তে সেটি বাতিল করা হয়। অর্থাৎ গণতন্ত্রের চেয়ে ব্যক্তির ইচ্ছাই প্রাধান্য পেয়েছে। ভবিষ্যতে যে তার পুনরাবৃত্তি ঘটবে না, সেই নিশ্চয়তা কে দেবে?

সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি

[email protected]

(মতামত লেখকের নিজস্ব)

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ন য মন ত র র ষ ট রপত ব যবস থ য় গণতন ত র প রস ত ব অন য ন য সরক র র আম দ র র প রস ক ষমত অবস থ আওয় ম

এছাড়াও পড়ুন:

রাষ্ট্রের সঙ্গে জনগণের সম্পর্ক প্রতিস্থাপনই মূল সংস্কার

প্রায় দেড় যুগ রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বাধীনতা ও জবাবদিহি বিপন্ন ছিল। শেখ হাসিনা ও তাঁর আমলাতন্ত্র দীর্ঘদিন ধরে রাষ্ট্রের সাংবিধানিক কাঠামো, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ও প্রশাসন ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে কার্যত একটি স্বৈরতান্ত্রিক শাসন কায়েম করেছেন। সবখানেই স্বাধীনতা ও জবাবদিহির পরিবর্তে ক্ষমতার প্রতি আনুগত্য, দমন-পীড়ন ও রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্ব প্রধান হয়ে উঠেছে। ফলে রাষ্ট্রের সঙ্গে জনগণের সম্পর্ক ভেঙে পড়েছে; জনগণ রাষ্ট্র থেকে বিচ্ছিন্ন এবং আস্থাহীন হয়ে পড়েছে। এই প্রেক্ষাপটে এখন প্রধান রাজনৈতিক ও সামাজিক কর্তব্য হচ্ছে– রাষ্ট্র ও জনগণের সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা। এ সম্পর্ক কেবল সংস্কারের কথায় নয়, বাস্তব কাঠামোয় প্রতিস্থাপন করতে হবে– যেখানে জনগণ হবে রাষ্ট্রের প্রকৃত মালিক এবং রাষ্ট্র হবে জনগণের সেবক। এ পরিবর্তনের জন্য সবচেয়ে জরুরি হচ্ছে একটি অবাধ, সুষ্ঠু, প্রতিযোগিতামূলক ও অংশগ্রহণমূলক জাতীয় নির্বাচন– যা হবে ক্ষমতার বৈধ হস্তান্তরের একমাত্র মাধ্যম এবং গণতান্ত্রিক সম্পর্ক পুনর্গঠনের প্রথম ধাপ।

রাষ্ট্র ও জনগণের সম্পর্ক রাষ্ট্র ব্যবস্থার মৌলিক ভিত্তি। এই সম্পর্ক যদি পারস্পরিক আস্থা, জবাবদিহি ও অংশগ্রহণের ওপর প্রতিষ্ঠিত না হয়, তবে রাষ্ট্র পরিণত হয় একচেটিয়া স্বৈরক্ষমতার যন্ত্রে– যেখানে জনগণ আর মালিক নয়, বরং হয়ে পড়ে প্রজা। তখন যে সম্পর্কের মাধ্যমে রাষ্ট্রকে জনগণের ইচ্ছা ও কল্যাণে দায়বদ্ধ থাকার কথা, তা উল্টোভাবে ক্ষমতার দমনমূলক ও কর্তৃত্ববাদী প্রয়োগে রূপ নেয়। এই বাস্তবতায় রাষ্ট্র ও জনগণের সম্পর্ক কেবল পুনর্গঠনের নয়, বরং সম্পূর্ণরূপে নতুন ভিত্তিতে প্রতিস্থাপনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে– এটাই আজকের সবচেয়ে মৌলিক ও অপরিহার্য সংস্কার।

এই প্রতিস্থাপনের ধারণা রাজনৈতিক ও নৈতিক দর্শনে গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। দার্শনিক বিশ্লেষণে রাষ্ট্র ও জনগণের সম্পর্ক মূলত স্বাধীনতা, ন্যায়, কর্তৃত্ব ও ক্ষমতার বৈধতার প্রশ্নের সঙ্গে গভীরভাবে সম্পৃক্ত। এটি এমন এক রাজনৈতিক ও নৈতিক কাঠামোর ওপর প্রতিষ্ঠিত হওয়া প্রয়োজন– যা জনগণের সম্মতি, অধিকার এবং মর্যাদার ভিত্তিতে রাষ্ট্রকে বৈধতা দেয়।

স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের জনগণ আশা করেছিল যে, রাষ্ট্র তাদের স্বপ্নের বাস্তবায়ন করবে। কিন্তু দীর্ঘ সামরিক শাসন, একদলীয় রাজনীতি, বিচার বিভাগের দলীয়করণ, প্রশাসনিক পক্ষপাত এবং নির্বাচনী ব্যবস্থার অব্যবস্থাপনার ফলে রাষ্ট্র ক্রমেই জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। ক্ষমতা জনগণের প্রতিনিধিদের মধ্যে আবদ্ধ না হয়ে, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অভিজাত শ্রেণির হাতে কেন্দ্রীভূত হয়ে গেছে। এর ফলস্বরূপ রাষ্ট্রব্যবস্থা অংশীজনবিহীন আমলাতান্ত্রিক-দলীয় যন্ত্রে পরিণত হয়েছে– যেখানে নীতিনির্ধারণ এবং সম্পদ বণ্টন জনগণের বাইরে হয়ে থাকে। এই বিচ্ছিন্নতা রাজনৈতিক অনাস্থা, নির্বাচন বিমুখতা এবং গণতন্ত্রের সংকট সৃষ্টি করেছে।


এই সংকট আরও তীব্র হয়েছে একের পর এক অবৈধ, একতরফা ভোট চুরি, ভোট ডাকাতি এবং প্রহসনমূলক নির্বাচনের মাধ্যমে। ২০১১ সালে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করার পর দেশের নির্বাচন ব্যবস্থা বিশ্বাসযোগ্যতা হারায়। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে ১৫৩টি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ী হন সরকারদলীয় প্রার্থীরা, যা ইতিহাসে নজিরবিহীন। ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ‘রাতের ভোট’ বলে অভিহিত করা হয়– যেখানে আগেই ব্যালট বাক্স পূর্ণ করা হয়েছিল। ২০২৪ সালের দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন ছিল এক সম্পূর্ণ ‘ডামি নির্বাচন’, যার ফলাফল আগেই নির্ধারিত ছিল। বিরোধী দল ও জনগণ এই নির্বাচন বর্জন করে এবং সরকারের ওপর জনগণকে ধোঁকা দেওয়ার অভিযোগ তোলে। এরপর জনগণের চূড়ান্ত প্রতিরোধ গড়ে ওঠে এবং ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মাধ্যমে স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে, শেখ হাসিনা দেশত্যাগ করে ভারতে চলে যেতে বাধ্য হন।


এই প্রেক্ষাপটে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান নতুন রাষ্ট্রদর্শন তুলে ধরেন, যার মূল ভিত্তি হলো অন্তর্ভুক্তিমূলক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা; রাষ্ট্রকে জনগণের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া এবং গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা। তার বক্তব্য অনুযায়ী, ‘আমি মনে করি, একজন রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে আমি তখনই কিছু অর্জন করেছি বলতে পারব, যেদিন বাংলাদেশের জনগণের ভোটাধিকার ফিরিয়ে দিতে পারব।’ এটি শুধু একটি রাজনৈতিক অঙ্গীকার নয়, বরং একটি নতুন রাষ্ট্রচিন্তার প্রতিফলন। 
এমন পরিস্থিতিতে কেউ কেউ নির্বাচন কমিশনের সংস্কার, প্রশাসনের নিরপেক্ষতা বা দুর্নীতিবিরোধী পদক্ষেপের কথা বলেন। তবে এসব প্রচেষ্টা আংশিক ও উপসর্গ নিরাময় মাত্র। কারণ, যদি পুরো কাঠামোই জনগণের ইচ্ছা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকে, তবে কেবল কাঠামোর যন্ত্রাংশ পাল্টে কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন আনা সম্ভব নয়।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশ তাদের রাজনৈতিক সংকট ও রাষ্ট্রীয় বৈধতার প্রশ্নে যেভাবে জনগণ-রাষ্ট্র সম্পর্ককে পুনরায় সংজ্ঞায়িত করেছে, তা বাংলাদেশের জন্য শিক্ষণীয়। উদাহরণস্বরূপ, জার্মানিতে নাৎসি আমলের পর গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য ১৯৪৯ সালে ‘বেসিক ল’ প্রণয়ন করা হয়। এতে জনগণকে রাষ্ট্রক্ষমতার একমাত্র উৎস হিসেবে সংবিধানে সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করা হয় এবং প্রশাসন, বিচার ও নির্বাহী বিভাগকে জনগণের কাছে জবাবদিহির কাঠামোতে আনা হয়।

নেপালে রাজতন্ত্র বিলুপ্ত করে ২০০৮ সালে প্রজাতন্ত্রে উত্তরণের ঘটনা গুরুত্বপূর্ণ। সেখানে রাষ্ট্রক্ষমতার কেন্দ্রীভূত কাঠামো ভেঙে জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণে সংবিধান রচিত হয় এবং রাষ্ট্রকে জনগণের সম্মতিতে গঠিত এক সেবাদানকারী কাঠামোতে রূপান্তর করা হয়। এসব দেশ প্রমাণ করেছে জনগণের সঙ্গে রাষ্ট্রের নতুন সম্পর্ক স্থাপন করলেই কেবল গণতন্ত্র, স্থিতিশীলতা ও জনগণের আস্থা অর্জন সম্ভব।

বাংলাদেশে রাষ্ট্র ও জনগণের মধ্যে এমন একটি সম্পর্ক গড়ে তোলার জন্য প্রয়োজন জাতীয় ঐকমত্যভিত্তিক একটি অন্তর্বর্তী রাজনৈতিক চুক্তি– যেখানে জনগণ হবে রাষ্ট্র কাঠামোর কেন্দ্রবিন্দু। এমন একটি কাঠামো দরকার– যেখানে সংবিধান হবে জনসম্মত, প্রশাসন হবে নিরপেক্ষ, বিচার বিভাগ হবে স্বাধীন এবং নীতিনির্ধারণ হবে জনঅংশগ্রহণভিত্তিক। রাষ্ট্রকে জনগণের জন্য স্বচ্ছ, দায়বদ্ধ ও মানবিক রূপে গড়ে তুলতে হলে গণশুনানি, নীতি পর্যালোচনায় নাগরিক অংশগ্রহণ, বাজেট প্রণয়নে জনগণের পরামর্শ এবং রাজনৈতিক জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। রাষ্ট্র কেবল আইন ও প্রতিষ্ঠানের সংকলন নয়; এটি এক জীবন্ত সামাজিক সম্পর্ক, যার প্রাণ হচ্ছে জনগণ।

যতদিন রাষ্ট্র ও জনগণের সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠিত না হয়, ততদিন নির্বাচনের মাধ্যমে সরকারের বৈধতা অর্জিত হবে না, সমাজে অনাস্থা ও বঞ্চনা বেড়ে যাবে। তাই এখন সময় এসেছে শুধু সম্পর্ক মেরামত নয়, বরং অন্তর্ভুক্তিমূলক গণতান্ত্রিক ও রাজনৈতিক রূপান্তরের মাধ্যমে সম্পর্কের পূর্ণ পুনর্গঠন করার– যেখানে রাষ্ট্র হবে জনগণের এবং জনগণ হবে রাষ্ট্রের সার্বভৌম মালিক। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা জনগণের কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য হবেন। কারণ, আমরা জানি কেতাবি সংস্কার বা পুঁথিগত আইন দিয়ে স্বৈরাচার বা ফ্যাসিবাদে হেজিমনি ঠেকানো যায় না। 

গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি হলো নির্বাচন। জাতীয় নির্বাচন খুব জরুরি; এটি গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার, জনগণের রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং জনগণের শাসনে জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার অন্যতম উপায়। নির্বাচন ছাড়া কোনো সরকার জনগণের প্রকৃত প্রতিনিধি হতে পারে না। নির্বাচনের বাইরে ক্ষমতা পরিবর্তন হলে তা অবৈধ শাসন ব্যবস্থার জন্ম দেয়– যা রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং জনগণের অধিকার ক্ষুণ্ন করে।

তাই এখন একান্তভাবে প্রয়োজন একটি অবাধ, সুষ্ঠু এবং গ্রহণযোগ্য জাতীয় নির্বাচন আয়োজন। সরকারের পক্ষ থেকে অবিলম্বে নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট তারিখ ও রোডম্যাপ ঘোষণা করা উচিত। জনগণ প্রস্তুত– তারা তাদের ভবিষ্যৎ, অধিকার এবং মর্যাদার প্রতিফলন দেখতে চায় ব্যালটের মাধ্যমে। এই বাস্তবতায় রাষ্ট্র সংস্কারে অগ্রগতি তখনই অর্থবহ হবে, যখন তা নির্বাচনের মাধ্যমে বৈধতা পাবে। নির্বাচন ছাড়া সংস্কারের কোনো কার্যকর ভিত্তি থাকতে পারে না। সুশাসনের প্রতিশ্রুতি রক্ষা এবং গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা নিশ্চিত করতে জাতীয় নির্বাচনের উদ্যোগ গ্রহণ এখন সময়ের অনিবার্য দাবিতে পরিণত হয়েছে।

সাঈদ খান: সাংবাদিক; সাংগঠনিক সম্পাদক, ডিইউজে
 

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ‘আপনার সরকারের দুইজন উপদেষ্টা এনসিপির প্রতিনিধি’
  • গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে প্রয়োজন নিরপেক্ষ নির্বাচন: মঈন খান
  • মালয়েশিয়ায় ‘নতুন রাজনৈতিক দলের কাছে প্রবাসীদের প্রত্যাশা’ শীর্ষক আলোচনা
  • নিউ নরমাল ভারতের গণতন্ত্রকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে
  • শেখ হাসিনা সরকার পালিয়ে গেছে নয় মাসের অধিক, এখনো গণতন্ত্র ফিরে আসেনি: বিএনপি নেতা আজিজুল বারী
  • কারও দল গোছানো জন্য নির্বাচন বিলম্বিত হতে পারে না: নজরুল ইসলাম খান
  • রাষ্ট্রের সঙ্গে জনগণের সম্পর্ক প্রতিস্থাপনই মূল সংস্কার
  • শাহরিয়ার হত্যায় ক্ষোভ, এমন বর্বরতা গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের লঙ্ঘন