দেশে উন্নয়ন প্রকল্প নিতে সরকার যে ব্যয় করে, তা আগামী অর্থবছরে ৩৫ হাজার কোটি টাকা কমছে। প্রায় সব খাতেই বরাদ্দ কমছে। এর মধ্যে রয়েছে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতও। যদিও আশা করা হয়েছিল, এবার শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাত সর্বোচ্চ গুরুত্ব পাবে এবং সেখানে বরাদ্দ বাড়বে।

উন্নয়ন প্রকল্প নেওয়া হয় বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আওতায়। ৬ মে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বর্ধিত সভায় আগামী অর্থবছরের (২০২৫-২৬) এডিপির খসড়া চূড়ান্ত করা হয়। আজ রোববার জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের (এনইসি) সভায় নতুন এডিপি পাস হবে। প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস এতে সভাপতিত্ব করবেন।

বাজেট ব্যয়ের দুটি ভাগ থাকে। একটি উন্নয়ন ব্যয় বা এডিপি, অন্যটি অনুন্নয়ন ব্যয়। সার্বিকভাবে বাজেটে কোন খাত কতটা গুরুত্ব পেল, তা বোঝা যায় সামগ্রিক বরাদ্দ দেখে। তবে উন্নয়ন বরাদ্দ দেখে বোঝা যায়, উন্নয়নের ক্ষেত্রে কোন খাত গুরুত্ব পেল।

শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে নতুন অবকাঠামো প্রকল্প নেওয়াকে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। গুণগত পরিচালনায় বেশি বিনিয়োগ করতে চাইপরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ

নতুন এডিপিতে উন্নয়ন বরাদ্দের দিক দিয়ে সবচেয়ে অগ্রাধিকার পেয়েছে পরিবহন ও যোগাযোগ খাত। এরপর রয়েছে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি। বিগত বছরগুলোতেও এই দুটি খাতকেই অগ্রাধিকার পেতে দেখা গেছে। এবার শিক্ষা খাতের অবস্থান তিন নম্বরে। চার নম্বরে আছে গৃহায়ণ। স্বাস্থ্য খাতের অবস্থান পঞ্চম।

জানতে চাইলে পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ প্রথম আলোকে বলেন, উন্নয়ন প্রকল্পে দুর্নীতি যেন না হয় এবং প্রকল্প যেন বাস্তবায়নযোগ্য হয়; সে জন্য শিক্ষা, স্বাস্থ্য খাতসহ প্রায় সব খাতেই বরাদ্দ কমানো হয়েছে। তিনি বলেন, ‘শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে নতুন অবকাঠামো প্রকল্প নেওয়াকে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। গুণগত পরিচালনায় বেশি বিনিয়োগ করতে চাই।’

উন্নয়ন বাজেটকে দুষ্টু চক্র থেকে বের করে আনার চেষ্টার কথা উল্লেখ করে ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ আরও বলেন, ‘এবার চলমান প্রকল্পকে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। নতুন প্রকল্প কিংবা মেগা প্রকল্প নিচ্ছি না। বাড়তি ব্যয় কমানোর চেষ্টা করছি। প্রকল্পের দুর্নীতি, অসংগতি দূর করতে পরিবীক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।’

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে স্বৈরতান্ত্রিক আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর গত ৮ আগস্ট দায়িত্ব নেয় অন্তর্বর্তী সরকার। এই সরকারের প্রথম বাজেট ঘোষণা করা হবে আগামী ২ জুন। নতুন বাজেটে এডিপির আকারও চলতি অর্থবছরের মূল এডিপি থেকে প্রায় ৩৫ হাজার কোটি টাকা কমানোর প্রস্তাব করেছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়। নতুন এডিপির আকার ২ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা।

বাস্তবায়নযোগ্য করতে হলে ব্যয় কমাতে হবে; কিন্তু সব খাতে কমিয়ে দেব, এটা নীতি হতে পারে না। আমরা আশা করেছিলাম শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সামাজিক সুরক্ষার মতো খাতে বরাদ্দ বাড়বে; কমবে পরিবহন, জ্বালানির মতো খাতে।বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন শিক্ষা ও স্বাস্থ্যে কত বরাদ্দ

চলতি অর্থবছরের (২০২৪-২৫) বাজেটে উন্নয়ন ব্যয়ে বরাদ্দ রাখা হয়েছিল ২ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা। পরে তা সংশোধন করে ২ লাখ ১৬ হাজার কোটি টাকায় নামিয়ে আনা হয়। এ বছর এডিপি বাস্তবায়ন কম হয়েছে। এর আগে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের সংশোধিত এডিপির আকার ছিল ২ লাখ ৫৪ হাজার ৩৯১ কোটি টাকা।

অর্থনীতিবিদেরা এডিপির আকার কমানোর পক্ষে। তাঁরা বলছেন, বিগত সরকারের আমলে বড় বাজেট তৈরি করা হতো। কিন্তু বাস্তবায়নের হার হতো কম। যেমন ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এডিপি বাস্তবায়নের হার ছিল ৮১ শতাংশের মতো।

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, ‘বাস্তবায়নযোগ্য করতে হলে ব্যয় কমাতে হবে; কিন্তু সব খাতে কমিয়ে দেব, এটা নীতি হতে পারে না। আমরা আশা করেছিলাম শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সামাজিক সুরক্ষার মতো খাতে বরাদ্দ বাড়বে; কমবে পরিবহন, জ্বালানির মতো খাতে।’ তিনি মনে করেন, বাজেটে কোন খাত অগ্রাধিকার পেয়েছে, তা পুরো বাজেট দেখে বিবেচনা করাই ভালো। তবে উন্নয়ন বরাদ্দের ক্ষেত্রেও সরকারের অগ্রাধিকার বোঝা যায়। এডিপি দেখে মনে হচ্ছে, অগ্রাধিকার আগের মতোই রয়ে গেছে।

বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুসারে, পৃথিবীর যে ১০টি দেশ অর্থনীতির আকারের তুলনায় শিক্ষা খাতে সবচেয়ে কম বরাদ্দ দেয়, বাংলাদেশ তার একটি। শিক্ষা খাতে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৬ শতাংশ খরচ করার প্রয়োজন হলে বাংলাদেশে উন্নয়ন ও পরিচালনা মিলিয়ে মাত্র ২ শতাংশ খরচ হয়।

পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের খসড়া এডিপি অনুসারে, শিক্ষা খাতে ৯১টি প্রকল্পে আগামী অর্থবছরে বরাদ্দ রাখা হচ্ছে ২৮ হাজার ৫৫৭ কোটি টাকা, যা চলতি এডিপির বরাদ্দ থেকে ২ হাজার ৯৭১ কোটি টাকা কম। শতকরা হারে এডিপির বরাদ্দ কমেছে প্রায় সাড়ে ৯ শতাংশ।

অন্যদিকে স্বাস্থ্য খাতের ৩৫টি প্রকল্পে আগামী অর্থবছরের বরাদ্দ থাকছে ১৮ হাজার ১৪৮ কোটি টাকা। চলতি এডিপিতে বরাদ্দ ২০ হাজার ৬৮২ কোটি টাকা। বরাদ্দ কমেছে সোয়া ১২ শতাংশ।

পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতের প্রকল্পগুলোর মধ্যে বেশির ভাগই স্কুল-কলেজ, হাসপাতালের ভবনসহ অবকাঠামো নির্মাণ প্রকল্প। প্রকল্প বা কর্মসূচির আওতায় শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের গুণগত মান উন্নয়নে বরাদ্দ কম থাকে।

বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুসারে, পৃথিবীর যে ১০টি দেশ অর্থনীতির আকারের তুলনায় শিক্ষা খাতে সবচেয়ে কম বরাদ্দ দেয়, বাংলাদেশ তার একটি। শিক্ষা খাতে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৬ শতাংশ খরচ করার প্রয়োজন হলে বাংলাদেশে উন্নয়ন ও পরিচালনা মিলিয়ে মাত্র ২ শতাংশ খরচ হয়।

অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে মানুষের প্রত্যাশা ছিল শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে সংস্কার হবে, বরাদ্দ বাড়বে। সুযোগ ছিল পুরোনো বাজেট কাঠামো বাদ দিয়ে নতুন বাজেট কাঠামো তৈরি করার। কিন্তু শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ কমিয়ে দেওয়া হলে তা হবে আশ্চর্য হওয়ার মতো।সানেমের নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান

অন্যদিকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) বলছে, মৌলিক স্বাস্থ্যসেবা পেতে একজন বাংলাদেশির বছরে ৮৮ ডলার খরচ করা প্রয়োজন। কিন্তু বাংলাদেশে চিকিৎসা খাতে মাথাপিছু খরচ হয় ৫৮ ডলার, যার বড় অংশই নাগরিকেরা নিজেরা সংস্থান করেন।

এই প্রসঙ্গে এডিপি প্রণয়নের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা জানান, আগামী এডিপি যাতে পুরোপুরি বাস্তবায়ন করা যায়, তাই সক্ষমতা বিবেচনা করে এডিপির আকার কমানো হয়েছে। অন্য বছরে দেখা গেছে, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ থাকলেও তা পুরো খরচ করতে পারেন না ওই দুই মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। তাই বরাদ্দ কমানো হয়েছে।

অবশ্য অর্থনীতিবিদদের মত হলো, কেন বরাদ্দ ব্যয় হয় না, সেটা নিয়ে প্রশ্ন তুলে জবাবদিহি নিশ্চিত করা উচিত। তার বদলে বরাদ্দ কমিয়ে দেওয়া যৌক্তিক নয়। শিক্ষা-স্বাস্থ্যে সবচেয়ে বেশি জোর দিতে হবে।

কোন খাতে কত বরাদ্দ

পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাব অনুসারে, আগামী এডিপির অর্থের মধ্যে স্থানীয় উৎস থেকে জোগান দেওয়া হবে ১ লাখ ৪৪ হাজার কোটি টাকা। আর প্রকল্প সহায়তা হিসেবে পাওয়া যাবে ৮৬ হাজার কোটি টাকা। মোট প্রকল্প সংখ্যা ১ হাজার ১৪২।

প্রস্তাবিত এডিপিতে বরাদ্দের ৭০ শতাংশ বরাদ্দ রয়েছে পাঁচটি খাতে। এগুলো হলো পরিবহন ও যোগাযোগ; বিদ্যুৎ ও জ্বালানি; শিক্ষা; গৃহায়ণ ও কমিউনিটি সুবিধাবলি; স্বাস্থ্য। এই পাঁচটি খাতে বরাদ্দ কমছে ৮ শতাংশ থেকে ২০ শতাংশ পর্যন্ত।

নতুন খসড়া এডিপিতে বরাদ্দের দিক থেকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে পরিবহন ও যোগাযোগ খাতকে। এ খাতে মোট ৫৮ হাজার ৯৭৩ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বরাদ্দ রাখা হয়েছে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে। এ খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৩২ হাজার ৩৯২ কোটি টাকা।

তৃতীয় সর্বোচ্চ বরাদ্দ রাখা হয়েছে শিক্ষা খাতে। এ খাতে আগামী অর্থবছরের এডিপিতে বরাদ্দের পরিমাণ ২৮ হাজার ৫৫৭ কোটি টাকা। গৃহায়ণ খাতে ২২ হাজার ৭৭৬ কোটি টাকা; স্বাস্থ্যে ১৮ হাজার ১৪৮ কোটি টাকা; স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়নে ১৬ হাজার ৪৭২ কোটি টাকা; কৃষিতে ১০ হাজার ৭৯৫ কোটি টাকা; পরিবেশ, জলবায়ু পরিবর্তন এবং পানিসম্পদ খাতে ১০ হাজার ৬৪১ কোটি টাকা; শিল্প ও অর্থনৈতিক সেবায় ৫ হাজার ৩৮ কোটি টাকা; বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি খাতে ৩ হাজার ৮৯৪ কোটি টাকা বরাদ্দ যাচ্ছে।

দেখা যাচ্ছে, পরিবহন ও যোগাযোগ খাতে শিক্ষার দ্বিগুণ ও স্বাস্থ্যের তিন গুণের বেশি বরাদ্দ রাখা হয়েছে।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান প্রথম আলোকে বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে মানুষের প্রত্যাশা ছিল শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে সংস্কার হবে, বরাদ্দ বাড়বে। সুযোগ ছিল পুরোনো বাজেট কাঠামো বাদ দিয়ে নতুন বাজেট কাঠামো তৈরি করার। কিন্তু শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ কমিয়ে দেওয়া হলে তা হবে আশ্চর্য হওয়ার মতো। যাঁরা এখন নীতিনির্ধারকের দায়িত্বে, তাঁরা এত বছর বলে আসছেন, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য বরাদ্দ বাড়ানোর পাশাপাশি কাঠামোগত সংস্কার প্রয়োজন।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: পর বহন ও য গ য গ বর দ দ র খ ন প রকল প প রকল প ন বর দ দ দ ন বর দ দ সরক র র খরচ কর অন স র সব খ ত শ খরচ সবচ য়

এছাড়াও পড়ুন:

সাগর থেকে মাছ আহরণ বাংলাদেশের কমছে, ভারত-মিয়ানমারে বাড়ছে

বঙ্গোপসাগর থেকে গত তিন বছর বাংলাদেশের মাছ আহরণ ধারাবাহিকভাবে কমছে। ব্যাপকভাবে কমেছে সামুদ্রিক ইলিশ, কাঁকড়া ও চিংড়ি আহরণ। সাগর থেকে মাছ ধরার পরিমাণ কমতে থাকায় সার্বিকভাবে দেশের মাছের জোগানের গতিও কমে গেছে। যদিও ভিন্ন চিত্র প্রতিবেশী দেশগুলোর। বছর বছর সাগর থেকে মাছ ধরা বাড়িয়ে মাছ আহরণে বিশ্বের শীর্ষ দশ দেশের মধ্যে স্থান করে নিয়েছে ভারত। এমনকি গৃহযুদ্ধে বিধ্বস্ত মিয়ানমারেও প্রতিবছর বাড়ছে সামুদ্রিক মাছ আহরণ।

সাগর থেকে বাংলাদেশের মাছ আহরণ কমে যাওয়ার কারণ হিসেবে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সাগরের তাপমাত্রা বৃদ্ধি ও ঘূর্ণিঝড়কে দায়ী করছেন এ দেশের মৎস্য কর্মকর্তারা। তা ছাড়া অতিরিক্ত মাছ আহরণের কারণেও মাছের মজুত কমে আসছে বলে জানান তাঁরা।

মৎস্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত ২০২১-২২ অর্থবছরে দেশে মোট সামুদ্রিক মাছ আহরণের পরিমাণ ছিল ৭ লাখ ৬ হাজার টন। পরের অর্থবছরে তা কমে দাঁড়ায় ৬ লাখ ৭৯ হাজার টনে। সর্বশেষ গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে তা আরও কমে দাঁড়ায় ৬ লাখ ২৮ হাজার টনে। অর্থাৎ ২০২২–২৩ অর্থবছরের চেয়ে ২০২৩–২৪ অর্থবছরে সাগর থেকে মাছ আহরণ প্রায় সাড়ে ৭ শতাংশ কমেছে। গত জুনে শেষ হওয়া ২০২৪–২৫ অর্থবছরে এই পরিমাণ আরও কমেছে বলে জানিয়েছেন মৎস্য অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। তবে এখনো অনুষ্ঠানিকভাবে গত অর্থবছরের তথ্য প্রকাশ করেনি সংস্থাটি।

সমুদ্র খাতের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বেশ কয়েক বছর ধরে সাগরে অতিরিক্ত মাছ আহরণের কারণে মাছের মজুত কমে গেছে। এ বিষয়ে মৎস্য অধিদপ্তরের সামুদ্রিক শাখার সহকারী পরিচালক মো. আবদুল্লাহ আল মামুন প্রথম আলোকে বলেন, ২০ বছর আগেও সাগরে বাণিজ্যিক ট্রলারের সংখ্যা ছিল এক শর কম। এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৬৫টিতে। তিনি জানান, সাগরের ৪০ মিটারের ভেতরে মাছ না ধরার কথা থাকলেও এসব নৌযান তা মানছে না। আবার ছোট নৌযানের সংখ্যা এখন ২৯ হাজার ছাড়িয়েছে। এসব নৌযানেও আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে, যা তাদের ব্যবহার করার কথা নয়। পাশাপাশি অবৈধ জালও ব্যবহার করা হচ্ছে। এমনকি উপকূলের ৫ থেকে ১০ মিটারের মধ্যে মাছ ধরা হচ্ছে। এতে ডিম থেকে নতুন পোনা তৈরির সুযোগ নষ্ট হচ্ছে।

বিশ্বে সমুদ্র থেকে মাছ আহরণে নেতৃত্ব দিচ্ছে চীন। এ ছাড়া শীর্ষ ১০ দেশের মধ্যে ভারত ৬ষ্ঠ অবস্থানে রয়েছে। ভারতের মৎস্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১–২২ সালে সাগর থেকে দেশটির মাছ আহরণের পরিমাণ ছিল ৪১ লাখ ২৭ হাজার টন, যা আগের বছরের তুলনায় ১৮ শতাংশ বেশি। সর্বশেষ ২০২৩–২৪ অর্থবছরে ৪৪ লাখ ৯৫ হাজার টন মাছ আহরণ করেছে ভারত।

মিয়ানমারের মৎস্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, দেশটিতে ২০২০-২১ সালে সাগর থেকে মাছ আহরণের পরিমাণ ছিল ৩২ লাখ ৯৫ হাজার। সর্বশেষ ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এই পরিমাণ আরও বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৪ লাখ ১৪ হাজার টনে। অর্থাৎ গৃহযুদ্ধের মধ্যেও দেশটির সাগর থেকে মাছ আহরণ বাড়ছে।

এদিকে বাংলাদেশে সাগরে সবচেয়ে বেশি আহরণ কমছে ইলিশ ও চিংড়ির। মৎস্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩–২৪ অর্থবছরে সাগর থেকে ইলিশ আহরণ তার আগের অর্থবছরের চেয়ে প্রায় সাড়ে ৬ শতাংশ কমেছে। আর চিংড়ির আহরণ কমেছে প্রায় ৪৪ শতাংশ। কাঁকড়া আহরণও কমেছে ১৬ শতাংশের বেশি।

সাগর থেকে মাছ আহরণ কমে যাওয়া এবং এ বিষয়ে করণীয় প্রসঙ্গে সাসটেইনেবল কোস্টাল অ্যান্ড মেরিন ফিশারিজ প্রকল্পের উপপরিচালক মোহাম্মদ শরিফুল আজম প্রথম আলোকে বলেন, ‘২০১৯ সাল থেকেই চিংড়ি আহরণ কমে যাওয়ার তথ্য পাচ্ছিলাম। তাই সামুদ্রিক মৎস্য বিধিমালায় চিংড়ি ধরার ট্রলারের লাইসেন্স আর না বাড়ানোর নীতি গ্রহণ করি। ২০২৮ সাল পর্যন্ত এসব ট্রলাররের লাইসেন্স নবায়ন করা হবে না।’

সাগর থেকে মাছ আহরণ বাড়াতে হলে বঙ্গোপসাগরের নিয়ন্ত্রণহীন মৎস্য আহরণকে নজরদারির মধ্যে আনার কথা বলছেন খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। মৎস্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক মো. জিয়া হায়দার চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, পরীক্ষামূলকভাবে পাঁচটি ট্রলারে স্যাটেলাইট ট্রেকার বসিয়ে নজরদারি করা হচ্ছে। পর্যায়ক্রমে সব ট্রলার ডিজিটাল নজরদারির আওতায় আনার পরামর্শ তাঁর।

এদিকে মাছ আহরণ কমতে থাকায় সাগরের ওপর নির্ভরশীল জেলেরাও বিপাকে পড়ছেন। ঋণের দাদনের টাকা শোধ করে লাভের অঙ্ক মিলছে না তাঁদের। কক্সবাজারে পাঁচ হাজারের বেশি মাছ ধরার কাঠের নৌযান আছে। এসব নৌকায় এখন মাছ ধরা পড়ছে কম। কক্সবাজার ফিশিংবোট মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. দেলোয়ার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, টানা ছয় থেকে সাত মাস তেমন মাছ ধরা পড়ছে না। কয়েক বছর ধরেই মাছ কম পাওয়া যাচ্ছে। এক সপ্তাহের জন্য সাগরে গেলে দুই থেকে তিন লাখ টাকা পর্যন্ত খরচ হয়। কিন্তু মাছ কম পাওয়ায় দাদন পরিশোধ করাই এখন কষ্টকর হয়ে গেছে।

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে মৎস্য অধিদপ্তরের ব্লু ইকোনমি সেলের পরিচালক মো. সাজদার রহমান প্রথম আলোকে বলেন, সাগরে এখন ঘন ঘন ঘূর্ণিঝড় হচ্ছে। সাগরের তাপমাত্রাও বেড়ে গেছে। তা ছাড়া জেলিফিশের প্রকোপ বেড়েছে। আর অতিরিক্ত মৎস্য আহরণের কারণে মাছের মজুত কমছে। তাই মাছ আহরণ আরও কমিয়ে আনতে হবে।

এ বিষয়ে গত মঙ্গলবার জাতীয় প্রেসক্লাবে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র মৎস্যজীবী জেলে সমিতির এক সভায় গণমাধ্যমে সঙ্গে কথা বলেন অন্তর্বর্তী সরকারের মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার। তিনি বলেন, ‘ভারতের জেলেরা যাতে বাংলাদেশে এসে মাছ ধরতে না পারেন, সেটা আমাদের বন্ধ করতে হবে।’

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালে সারা বিশ্বে সাগর থেকে ৭ কোটি ৯৭ লাখ টন মাছ ধরা হয়। যার মধ্যে অর্ধেক মাছ আহরণ করেছে এশিয়ার দেশগুলো। ওই বছর বিশ্বের মোট সামুদ্রিক মাছের ১৪ দশমিক ৮ শতাংশই আহরণ করেছিল চীন, যার পরিমাণ ১ কোটি ১৮ লাখ ১৯ হাজার টন। দ্বিতীয় স্থানে থাকা ইন্দোনেশিয়া ওই বছর আহরণ করেছে ৬৮ লাখ ৪৩ হাজার টন মাছ। আর ভারত আহরণ করেছে ৩৫ লাখ ৯৭ হাজার টন। যেখানে বাংলাদেশের হিস্যা ছিল বৈশ্বিক মাছ আহরণের মাত্র শূন্য দশমিক ৯ শতাংশ।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ওয়েস্টিন ও শেরাটনের ব্যবসা বেড়েছে 
  • নভেম্বরের ১৫ দিনে রেমিট্যান্স এসেছে সাড়ে ১৮ হাজার কোটি টাকা 
  • সরবরাহ বাড়ছে শীতের আগাম ফুলকপি ও বাঁধাকপির, কমছে দাম
  • সামিট অ্যালায়েন্স পোর্টের ব্যবসা বেড়ে তিন গুণ
  • তিন মাসে ওয়ালটনের মুনাফা ২২১ কোটি টাকা
  • সাগর থেকে মাছ আহরণ বাংলাদেশের কমছে, ভারত-মিয়ানমারে বাড়ছে