কেউ বলেন ‘নাগ ফজলি’, কেউ বলেন ‘নাক ফজলি’। নাম শোনার পর অনেকের চোখের সামনে সাপের ফণা তোলা ছবি অথবা লম্বা নাকের ছবি ভেসে উঠতে পারে। কিন্তু নাগ বা নাক যাই হোক না কেন মানুষের কাছে এই জাতের আম স্বাদ-গন্ধ, মিষ্টতায় অনন্য হয়ে উঠেছে। আমটি দেখতে কিছুটা লম্বা এবং চ্যাপ্টা আকৃতির হওয়ায় নাক ফজলিই উপযুক্ত নাম।
এই আমের জিআই পণ্যের স্বীকৃতির জন্য দীর্ঘদিন চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন নওগাঁর বদলগাছীর নাক ফজলি আমচাষী সমিতি। তাদের সেই প্রচেষ্টা সফল হয়েছে। প্রায় চার ইঞ্চি দৈর্ঘ্য এবং দেড় ইঞ্চি প্রস্থের গড় আকারের এই আমটি জিআই পণ্যের স্বীকৃতি পেয়েছে।
চলতি বছর ৩০ এপ্রিল ঢাকায় এক জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠানে এই স্বীকৃতির ঘোষণা এবং সনদ প্রদান করা হয়। নওগাঁ জেলার পক্ষ থেকে জিআই পণ্য নির্ধারণ কমিটির উপদেষ্টামণ্ডলীর কাছ থেকে সনদ গ্রহণ করেন বদলগাছী নাক ফজলি আমচাষী সমিতির সভাপতি বেলালুর রহমান এবং সহ-সভাপতি অ্যাডভোকেট মো.
নওগাঁ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কার্যালয় থেকে জানা গেছে, নাক ফজলি আম জেলার ধামইরহাট এবং বদলগাছীতেই বেশি হয়। জেলায় মোট আম চাষের জমি ৩০ হাজার ৩০০ হেক্টর। এর মধ্যে নাক ফজলি আম চাষ হয় ৮৯৮ হেক্টর জমিতে। আম্রপালি, বারি-৪ এর দাপটে নাক ফজলির জমি গত ৫ বছরে কিছুটা কমেছে। তবে স্বীকৃতির কারণে এবং সর্বত্র পরিচিতি পাওয়ায় এই আম চাষের জমি বাড়বে বলে মনে করছে নওগাঁর কৃষি বিভাগ।
বদলগাছী নাক ফজলি আম চাষী সমিতির সভাপতি বেলালুর রহমান নাক ফজলি আমের ইতিহাস সম্পর্কে জানান, তিনি লোকমুখে শুনেছেন, বদলগাছী উপজেলার ভান্ডারপুর গ্রামের জমিদার বিনোদ কুমার লাহিড়ী তার বাড়িতে এই আমের চারা রোপণ করেন। সেই গাছের আম খেয়ে সবাই খুব প্রশংসা করে। আমের নিচের আকৃতি কিছুটা মানুষের নাকের মতো হওয়ায় আমটির নাম ‘নাক ফজলি’ রাখা হয়।
জিআই সনদের প্রচেষ্টার শুরুর দিকের কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘‘২০১৭ সালে বদলগাছী উপজেলা নির্বাহী অফিসার ছিলেন হোসেন স্বপন। মন্ত্রণালয় থেকে তার কাছে চিঠি আসে। তখন তিনি আমাদের ডাকেন। তিনি জানান, নাক ফজলি আমের যদি বাগান থাকে তাহলে এই আম বিদেশে পাঠানো সম্ভব। তিনি আমাদের পরামর্শ দেন একটি সমিতি করে রেজিস্ট্রেশন করার। তার কথা মতো ৭২ সদস্যবিশিষ্ট একটি সমিতি গঠন করি। এরপর জিআই সনদের জন্য আমরা আবেদন করি। এ জন্য অনেক তথ্যউপাত্ত সংগ্রহ করতে হয়েছে। পরে আমাদের ফাইল চলে যায় গাজীপুর কৃষি গবেষণা কেন্দ্রে। সেখান থেকে ড. সরফুদ্দিন আহমেদ আমাদের বদলগাছী আসেন নাক ফজলি বাগান পরিদর্শন করতে। তিনি শতবর্ষী নাক ফজলি আমের গাছ দেখতে চাইলে উপজেলার ইসমাইলপুর গ্রামে দুটি গাছ দেখাই। তিনি ছবি উঠিয়ে গাছের পাতা ডিএনএ টেস্ট করার জন্য নিয়ে যান। এরপর তিনি প্রতিবেদন দেওয়ার পর জিআই সনদপ্রাপ্তির পথ সুগম হয়।’’
জিআই সনদ পাওয়ার পর আম চাষের জমি বাড়াবেন কিনা জানতে চাইলে বেলালুর রহমান বলেন, ‘‘যদি দাম ভালো পাওয়া যায় তাহলে অবশ্যই বাড়াবো। কারণ আম বছরে একবার ফলন দেয়। কিন্তু অন্য ফসল তিনবার, দুইবার দেয়। বিদেশে যদি রপ্তানি শুরু হয়ে যায় তখনও বাড়ানো যাবো। এগুলো আসলে আলোচনার মাধ্যমে করতে হবে। সবে তো জিআই সনদ পাওয়া গেলো। তবে আমটির ব্যাপক উৎপাদন লক্ষ্য আমাদের আছে।’’
নওগাঁ জেলা প্রেসক্লাবের সাবেক সাধারণ সম্পাদক শফিক ছোটন বলেন, ‘‘নাক ফজলি আম জিআই পণ্যের স্বীকৃতি অর্জন করায় নওগাঁবাসী হিসেবে আমরা খুবই খুশি। এটি এখন শুধু দেশে নয়, দেশের বাইরেও নওগাঁকে রিপ্রেজেন্ট করবে। এ জন্য সরকার আরো পদক্ষেপ নেবে বলে আমরা আশা করি।’’
নাক ফজলির ওজন ২৫০ থেকে ৩০০ গ্রাম। আমটি খুব অল্প পরিমাণে ঢাকায় যায়। বদলগাছীর মাটির কারণে আম বেশি মিষ্টি হয়। আমটি কাঁচা এবং পাকা দুই অবস্থাতেই খেতে মিষ্টি। আঁটি পাতলা।
নওগাঁ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত উপপরিচালক (শস্য) মো. খলিলুর রহমান বলেন, ‘‘নাক ফজলি আম খেতে সুস্বাদু। এই আমের চারা লাগানোর প্রথম বছরেই গাছে মুকুল আসে। তবে আমরা কৃষকদের প্রথম বছরে আসা মুকুল থেকে ফসল নিতে নিরুৎসাহিত করি। তবে ৩ বছর বয়সী গাছ পুরোদমে ফল দিতে সক্ষম।’’
‘‘নওগাঁয় সবচেয়ে বেশি চাষ হয় আম্রপালি এবং বারি-৪ জাতের আম। কিন্তু আমটি জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার পর সারা দেশে নাম ছড়িয়ে পড়েছে। আমটি সম্পর্কে জানার আগ্রহ তৈরি হয়েছে। এখন এই আমের উৎপাদন বাড়বে। নাক ফজলি আমের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা এবার ১২ হাজার ৫৭২ মেট্রিক টন ধরা হয়েছে। জুন মাসের ৭ দিনের মধ্যে এই আম সংগ্রহ শুরু করা হবে। এরপর অর্জন কতটুকু বলা যাবে,’’ যোগ করেন খলিলুর রহমান।
নওগাঁ কৃষি বিপণন কর্মকর্তা সোহাগ সরকার বলেন, ‘‘নাক ফজলি জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি অর্জন করায় আমটির মার্কেটিং নিয়ে আমরা নতুন করে ভাবছি।’’
ঢাকা/তারা//
উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর ল ল র রহম ন ন ক ফজল বদলগ ছ আম চ ষ আম দ র সনদ প
এছাড়াও পড়ুন:
রোজার আগেই নির্বাচন, এরপর আগের কাজে ফিরে যাবেন
অন্তর্বর্তী সরকার সময়মতো ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন আয়োজনের জন্য অঙ্গীকারবদ্ধ বলে উল্লেখ করেছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেছেন, আগামী ফেব্রুয়ারিতে পবিত্র রমজানের আগেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। নির্বাচনের পর তিনি তাঁর আগের কাজে ফিরে যাবেন।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্রিস্টালিনা জর্জিয়েভাকে এসব কথা বলেছেন প্রধান উপদেষ্টা। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় ওয়াশিংটন থেকে ভিডিও ফোনকলে অধ্যাপক ইউনূসের সঙ্গে কথা বলেন জর্জিয়েভা।
এ সময় তাঁরা বাংলাদেশের চলমান অর্থনৈতিক সংস্কার, আঞ্চলিক পরিস্থিতি এবং আগামী ফেব্রুয়ারিতে সাধারণ নির্বাচনের পূর্ববর্তী চ্যালেঞ্জ নিয়ে আলোচনা করেন।
আলোচনায় প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বের ভূয়সী প্রশংসা করেন ক্রিস্টালিনা জর্জিয়েভা। তিনি বলেন, অধ্যাপক ইউনূস দায়িত্ব গ্রহণের পর বাংলাদেশের অর্থনীতি উল্লেখযোগ্যভাবে ঘুরে দাঁড়িয়েছে এবং এই কৃতিত্ব তাঁর নিজের।
অর্থনীতির সংকটকালীন পরিস্থিতি স্মরণ করে আইএমএফ প্রধান বলেন, ‘আপনার অর্জন আমাকে মুগ্ধ করেছে। অল্প সময়ে আপনি অনেক কিছু করেছেন। যখন অবনতির ঝুঁকি অত্যন্ত বেশি ছিল, তখন আপনি দেশের দায়িত্ব নিয়েছেন। আপনি সঠিক সময়ে সঠিক ব্যক্তি।’
ক্রিস্টালিনা জর্জিয়েভা বিশেষভাবে বৈদেশিক মুদ্রা বাজারের স্থিতিশীলতা এবং রিজার্ভ পুনরুদ্ধারের জন্য সরকারের সাহসী পদক্ষেপ, বাজারভিত্তিক বিনিময় হার প্রবর্তনের প্রশংসা করেন।
অধ্যাপক ইউনূস বাংলাদেশের এক সংকটময় সময়ে আইএমএফ প্রধানের অবিচল সহায়তার জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বলেন, ‘চমৎকার সহায়তার জন্য ধন্যবাদ।’ তিনি স্মরণ করিয়ে দেন, গত বছর নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে তাঁদের প্রথম সাক্ষাৎ বাংলাদেশের অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের পথ সুগম করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল।
কথোপকথনে আইএমএফ প্রধান অভ্যন্তরীণ রাজস্ব আয় বৃদ্ধি এবং ব্যাংকিং খাতে গভীর সংস্কার বাস্তবায়নের ওপর গুরুত্বারোপ করেন। তিনি বলেন, ‘শক্ত অবস্থানে থাকতে হলে সংস্কার অনিবার্য। এটি বাংলাদেশের ইতিহাসের এক অমূল্য মুহূর্ত।’
অধ্যাপক ইউনূস জানান, তাঁর সরকার ইতিমধ্যে ব্যাংকিং খাত পুনর্গঠন এবং রাজস্ব সংগ্রহ জোরদারের জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। তিনি বলেন, ‘আমরা এক বিধ্বস্ত ও সম্পূর্ণ ভেঙে পড়া অর্থনীতি উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছি। কিছু ব্যক্তি আক্ষরিক অর্থে ব্যাগভর্তি টাকা ব্যাংক থেকে নিয়ে পালিয়ে গেছে।’
এ ছাড়া আঞ্চলিক পরিস্থিতি নিয়েও আলোচনা হয়। এর মধ্যে ছিল নেপালে চলমান যুব আন্দোলন এবং আসিয়ানভুক্তির জন্য বাংলাদেশের আকাঙ্ক্ষা। অধ্যাপক ইউনূস আঞ্চলিক কানেক্টিভিটি জোরদারের লক্ষ্যে ঢাকার বৃহৎ অবকাঠামো উদ্যোগ—যেমন নতুন বন্দর ও টার্মিনাল প্রকল্প—সম্পর্কেও অবহিত করেন।
আলোচনাকালে অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ এবং অর্থসচিব খায়রুজ্জামান মজুমদার উপস্থিত ছিলেন।