সংবিধান সংস্কার কমিশন ‘জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল’ (এনসিসি) নামে একটি সমন্বিত রাষ্ট্রীয় সংস্থা প্রতিষ্ঠার সুপারিশ করেছে। কমিশনের সুপারিশগুলোর মধ্যে এনসিসি গঠন একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ও যুগান্তকারী প্রস্তাব।

এনসিসি একটি টেকসই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠন এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠায় মৌলিক পরিবর্তন আনবে। সংবিধান সংস্কার কমিশনের রিপোর্ট প্রকাশিত হওয়ার পর শুরুতে এনসিসি নিয়ে অনেকের মধ্যেই যথেষ্ট কৌতূহল পরিলক্ষিত হয়েছে।

কিন্তু পর্যায়ক্রমে এ বিষয়ে যথাযথ ও সম্যক ধারণা তৈরি না হওয়ায় জনগণ এনসিসির গুরুত্ব স্পষ্টভাবে উপলব্ধি করতে পারেনি। এই নিবন্ধে এনসিসি–সম্পর্কিত কমিশনের প্রস্তাবের কিছু বৈশিষ্ট্যের ওপর আলোকপাত করা হয়েছে।

এনসিসির গঠন

এনসিসির কাঠামোগত গঠন নানান দিক থেকে অত্যন্ত ভারসাম্যপূর্ণ ও প্রতিনিধিত্বশীল। রাষ্ট্রের তিনটি বিভাগেরই সর্বোচ্চ ব্যক্তিরা পদাধিকারবলে এনসিসির সদস্য হবেন। এতে এনসিসির সদস্য হওয়ার প্রক্রিয়া সহজ হবে এবং নিয়োগসংক্রান্ত চিরাচরিত জটিলতা থাকবে না।

আইনসভা থেকে ছয়জন (বিরোধীদলীয় নেতা, উভয় কক্ষের দুজন স্পিকার, দুজন বিরোধী দল মনোনীত ডেপুটি স্পিকার এবং একজন সংসদ সদস্য), নির্বাহী বিভাগ থেকে দুজন (রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী, তিনি আইনসভারও সদস্য), বিচার বিভাগ থেকে একজন (প্রধান বিচারপতি) এনসিসির সদস্য হবেন।

কমিশনের প্রস্তাবে এনসিসিতে সরকারি ও বিরোধী দলের প্রতিনিধিত্বেরও সুষম বণ্টন নিশ্চিত করা হয়েছে। একদিকে প্রধানমন্ত্রী ও আইনসভার উভয় কক্ষের স্পিকার মিলে তিনজন সরকারি দল থেকে, অন্যদিকে বিরোধী দলের নেতা ও আইনসভার উভয় কক্ষের দুজন ডেপুটি স্পিকারসহ তিনজন বিরোধী দলের প্রতিনিধিত্ব করবে। বাকি তিনজন অনেকটা নিরেপক্ষ অবস্থান থেকে দায়িত্ব পালনের সুযোগ রয়েছে।

রাষ্ট্রপতি সাধারণত সরকারি দল থেকে নির্বাচিত হলেও পদাসীন হওয়ার পর তিনি দলনিরপেক্ষ হিসেবে বিবেচিত হন। তথাপি ভারসাম্যের স্বার্থে এমন একজন সংসদ সদস্য এনসিসির সদস্য হবেন, যিনি প্রধানমন্ত্রী এবং বিরোধীদলীয় নেতার প্রতিনিধিত্বকারী সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দলের উভয় কক্ষের সদস্য ব্যতীত বাকি সব সদস্য দ্বারা মনোনীত। তিনি আইনসভার উভয় কক্ষের নির্বাচিত ছোট দল ও স্বতন্ত্র সদস্যদের প্রতিনিধিও বটে।

আরেকজন নিরপেক্ষ সদস্য হলেন প্রধান বিচারপতি, যিনি অত্যন্ত সম্মানিত, সবার কাছে গ্রহণযোগ্য এবং সাংবিধানিকভাবে নিরপেক্ষ।

এনসিসি একটি জাতীয় ঐক্যের প্রতীক

যেহেতু এনসিসি রাষ্ট্রের সব অঙ্গ নিয়ে গঠিত এবং সংসদের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর শীর্ষ নেতৃত্ব এতে একসঙ্গে কাজ করবে, তাই তাদের সম্মিলিত সিদ্ধান্ত রাষ্ট্রকে ব্যাপকভাবে শক্তিশালী করবে ও এই গণতান্ত্রিক অনুশীলন দেশের সব রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের ওপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

সংবিধান দ্বারা এনসিসিকে অর্পণের প্রস্তাবিত যেসব জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে বর্তমানে প্রধানমন্ত্রীর একক সিদ্ধান্তে নেওয়া হয়, সেসব বিষয়ে এনসিসি কর্তৃক সম্মিলিত সিদ্ধান্ত হওয়ায় তা সুবিবেচনাপ্রসূত হবে এবং দেশের মানুষের কাছে অধিক গ্রহণযোগ্য হবে।

এনসিসির কাজ কী

গণতন্ত্রের বিকাশের জন্য নির্বাচন কমিশন, স্থানীয় সরকার কমিশন (প্রস্তাবিত) ও পাবলিক সার্ভিস কমিশন ইত্যাদির মতো সাংবিধানিক সংস্থাগুলোকে সব ধরনের রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত হয়ে স্বচ্ছ এবং স্বাধীন সংস্থা হিসেবে কাজ করতে হবে।

অন্যদিকে দুর্নীতি দমন কমিশন, মানবাধিকার কমিশন ইত্যাদির মতো কিছু সাংবিধানিক সংস্থাকে (প্রস্তাবিত) সাহসিকতার সঙ্গে, আপসহীন হয়ে ও স্বাধীনভাবে কাজ করতে হবে; সরকার বা তার কর্মকর্তাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দুর্নীতি, অনিয়ম এবং অপব্যবহারের তদন্তের ক্ষেত্রে এটা বিশেষভাবে প্রযোজ্য।

যখন সাংবিধানিক সংস্থাগুলো সঠিকভাবে কার্যকর হয়, তখন জনগণ শক্তিশালী গণতন্ত্র ও সুশাসনের মাধ্যমে প্রকৃত সেবা পেতে এবং সুবিধা ভোগ করতে শুরু করে। সব রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় আইনের প্রতি শ্রদ্ধা বাড়ে ও জবাবদিহি নিশ্চিত হয়। ফলে রাজনৈতিক সরকারও তার কার্যক্রম সঠিকভাবে ও দক্ষতার সঙ্গে পরিচালনা করতে পারে।

যদি একজন গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিকে স্বচ্ছ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে একটি সাংবিধানিক সংস্থার প্রধান হিসেবে নিযুক্ত করা হয়, তাহলে সেই সংস্থা স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে পারবে।

বর্তমান সংবিধানের অধীনে এই ধরনের নিয়োগ মূলত প্রধানমন্ত্রীর একক বিবেচনার ভিত্তিতে করা হয়। ফলে সেই সংস্থাগুলোর ওপর নির্বাহী বিভাগের প্রভাব এবং ক্রমাগত হস্তক্ষেপ তাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে ব্যাহত করে।

সংবিধান সংস্কার কমিশনের সুপারিশ অনুসারে, এনসিসি সব সাংবিধানিক সংস্থার কমিশনারদের নিয়োগ করবে। এতে সাংবিধানিক সংস্থাগুলো কার্যকর ও স্বাধীনভাবে কাজ করে সব প্রাসঙ্গিক রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে যথাযথ তদারক করবে এবং তাদের জবাবদিহির আওতায় আনবে; যা পর্যায়ক্রমে তাদেরকে দক্ষ, দুর্নীতিমুক্ত এবং দেশ ও দেশের মানুষের প্রকৃত সেবক হতে সাহায্য করবে।

আরও পড়ুনজাতীয় সাংবিধানিক কমিশন যে কারণে প্রয়োজন১০ এপ্রিল ২০২৫

যদিও সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা কে হবেন, তা প্রশ্নবিদ্ধ হলেও বিস্তারিতভাবে উল্লেখ করা হয়েছে, তবে তাকে কীভাবে নিয়োগ করা হবে, সে সম্পর্কে কোনো গ্রহণযোগ্য পদ্ধতি উল্লেখ করা হয়নি। যেহেতু রাষ্ট্রপতি মূলত প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শে এই নিয়োগ করেছিলেন, তাই বিরোধীদের দ্বারা প্রধান উপদেষ্টার নিরপেক্ষতা নিয়ে সর্বদা প্রশ্ন তোলা হয়েছে।

কমিশন সুপারিশ করেছে যে এনসিসি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা সংবিধান দ্বারা নির্ধারিত পদ্ধতিতে মনোনীত করে রাষ্ট্রপতির কাছে নিয়োগের জন্য নাম প্রেরণ করবে। প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগ গ্রহণযোগ্য হতে হলে অত্যন্ত স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় এবং সরকারি ও বিরোধী দলের যৌথ সিদ্ধান্তে হওয়া বাঞ্ছনীয়।

যেহেতু এনসিসিতে আইনসভায় নির্বাচিত অধিকাংশ দলের প্রতিনিধিত্ব থাকবে এবং সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নেওয়ার চর্চা ও সংস্কৃতি তৈরি হবে, সেহেতু প্রধান উপদেষ্টার মতো গুরুত্বপূর্ণ পদে মনোনয়নে এনসিসি হবে সবচেয়ে উপযুক্ত সংস্থা।

প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগপ্রক্রিয়ায় এনসিসির সমষ্টিগত সিদ্ধান্ত নেওয়ার পদ্ধতি তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনরুদ্ধারের সঙ্গে সঙ্গে এটি একটি ন্যায্য ও টেকসই ব্যবস্থায় রূপ নেবে।

ওপরে উল্লিখিত বিষয় ছাড়া এনসিসি সংবিধান দ্বারা নির্ধারিত অন্য সুনির্দিষ্ট কার্যাবলি ও আইন দ্বারা অর্পিত কার্যাদি সম্পাদন করতে পারবে।

এনসিসি প্রধানমন্ত্রীর কাজে প্রতিবন্ধক নয়, বরং সহায়ক

এনসিসি কেবল সংবিধান দ্বারা নির্ধারিত সুনির্দিষ্ট দায়িত্ব পালন করবে। এনসিসি কোনো নির্বাহী কর্তৃত্ব প্রয়োগ করবে না বা প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতাও হরণ করবে না।

এনসিসি কর্তৃক সরকারের কোনো কাজে হস্তক্ষেপ করা কিংবা আপত্তি জানানোর সুযোগ নেই। এনসিসিতে যেহেতু স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী সদস্য হিসেবে থাকবেন, রাষ্ট্র পরিচালনায় এনসিসি সরকারের সহায়ক ও সম্পূরক শক্তি হিসেবে কাজ করবে।

সরকারকে সঠিক পথে চালানোর জন্য যেসব সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যদি তাদের প্রধানদের সরকার বা সরকারপ্রধানের ইচ্ছেমতো নিযুক্ত করা হয়, তাহলে সরকার নিজেই প্রশ্নবিদ্ধ এবং বিতর্কিত হয়ে ওঠে।

তাই ওই সব নিয়োগ এনসিসির মাধ্যমে হলে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত হবে এবং সরকার বিতর্কের ঊর্ধ্বে থাকবে। এ রকমটা করতে পারলে সার্বিকভাবে দেশের জন্যে আশীর্বাদ বয়ে আনবে।

জাতীয় সংকটের সময় সরকার এনসিসিকে ইতিবাচকভাবে ব্যবহার করতে পারবে। বিতর্কিত বিষয়গুলো এনসিসির কাছে অর্পণ করে সরকার রাজনৈতিক গ্রহণযোগ্যতা অর্জনের পাশাপাশি তার ভাবমূর্তি বজায় রাখতে পারে। যেহেতু বেশির ভাগ শীর্ষ নেতৃত্ব এনসিসির অংশ হবেন, তাই এটি কার্যকরভাবে সরকার এবং তার বিরোধী দলের মধ্যে সেতুবন্ধ হিসেবে কাজ করতে পারে।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বিরোধী দলগুলো সাধারণত অভিযোগ করে যে জাতীয় ইস্যুতে তাদের কণ্ঠস্বর সর্বদা উপেক্ষা করা হয়। এনসিসির মাধ্যমে বিরোধী দলের কথা সিদ্ধান্তে রূপ নিতে পারে। এর ফলে গণতন্ত্র মজবুত হয়ে সরকার ও দেশেরই লাভ হবে।

এনসিসি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় কার্যকর ভূমিকা পালন করবে

এনসিসি হবে নিরবচ্ছিন্ন একটি কার্যকর রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান। সংসদ ভেঙে গেলে বা সরকার পতন হলেও এনসিসি বহাল থাকবে। এতে দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় ও শাসনব্যবস্থা চলমান রাখতে এনসিসি একটি কার্যকর রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানরূপে ভূমিকা পালন করতে পারবে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় নিরপেক্ষতার স্বার্থে কোনো রাজনৈতিক দলীয় ব্যক্তি এনসিসিতে অন্তর্ভুক্ত থাকবে না।

শক্তিশালী রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান, শাসনব্যবস্থায় নিয়ন্ত্রণ ও ভারসাম্য এবং জনগণের আস্থা একটি স্থিতিশীল গণতন্ত্রের চালিকা শক্তি। এটা সত্য যে সরকার নির্বাচিত রাজনীতিবিদদের দ্বারা পরিচালিত হতে হবে, তবে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সুষ্ঠু যাত্রার জন্য রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো যোগ্য, সৎ এবং নির্দলীয় ব্যক্তিদের দ্বারা পরিচালিত হওয়া অত্যাবশ্যকীয়।

দলনিরপেক্ষ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো দীর্ঘ মেয়াদে সব রাজনৈতিক দলের জন্যই সুফল বয়ে আনে। এনসিসি হবে একটি অনন্য সম্মিলিত সংস্থা, যেখানে ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির মানুষ দেশ গঠন এবং শাসনব্যবস্থার জন্য একসঙ্গে কাজ করবে। এটা গণতন্ত্রের বিকাশে সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলবে বলে যৌক্তিকভাবেই আশা করা যায়।

ব্যারিস্টার মঈন ফিরোজী সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী। সংবিধান সংস্কার কমিশনের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।

মতামত লেখকের নিজস্ব

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: এনস স র সদস য গণত ন ত র ক গণতন ত র র গ রহণয গ য র ষ ট রপত র সদস য হ আইনসভ র প রস ত ব ক জ করত ব যবস থ ক সরক র সরক র র ক র যকর ক জ করব এনস স ত পর চ ল প রক র র জন য ক জ কর

এছাড়াও পড়ুন:

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যেভাবে সুষ্ঠু ভোটে বাধা হতে পারে

বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশে, যেখানে নির্বাচনপ্রক্রিয়া নিয়ে ইতিমধ্যে প্রশ্ন ও চ্যালেঞ্জ রয়েছে, সেখানে এআইয়ের (কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা) ব্যবহার এক নতুন ধরনের হুমকি নিয়ে এসেছে। এটি শুধু প্রচলিত কারচুপির পদ্ধতিগুলোকেই আরও সফিসটিকেটেড বা কৌশলী করে তুলবে না; বরং আমাদের গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি যে জনগণের বিশ্বাস, সেটিই নষ্ট করে দিতে পারে।

নির্বাচনে এআইয়ের প্রভাব কোনো কাল্পনিক গল্প নয়, এটি একটি বাস্তব ঝুঁকি। এআই-চালিত টুলগুলো ব্যবহার করে রাজনৈতিক নেতা বা কর্মকর্তাদের অত্যন্ত বিশ্বাসযোগ্য ‘ডিপফেক’ (ভুয়া অডিও, ভিডিও এবং ছবি) তৈরি করা সম্ভব।

এই ডিপফেকগুলো সহজেই মিথ্যা কেলেঙ্কারি ছড়াতে পারে, যা ভোটারদের বিভ্রান্ত করে তাঁদের সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করতে সক্ষম। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এআই-চালিত বটগুলো সেকেন্ডের মধ্যে এমন সব মিথ্যা তথ্য ছড়িয়ে দিতে পারে, যা একটি রাজনৈতিক দলের জন্য ব্যাপক জনসমর্থনে বা বিরোধিতায় ভূমিকা রাখতে পারে।

যখন জনগণ দেখতে পাবে, তারা যা দেখছে বা শুনছে, তার মধ্যে কোনটা আসল আর কোনটা নকল, তা বোঝা কঠিন, তখন স্বাভাবিকভাবেই তাদের মধ্যে সংবাদমাধ্যম, নির্বাচন কর্তৃপক্ষ এবং পুরো গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার বিষয়ে সন্দেহ ঢুকে যাবে। এটি একটি দেশের স্থিতিশীলতার জন্য দীর্ঘমেয়াদি হুমকি।

এআই অ্যালগরিদমগুলো বিশাল পরিমাণ ডেটা বিশ্লেষণ করে নির্দিষ্ট ভোটারদের লক্ষ করে তাদের ব্যক্তিগত আগ্রহ ও দুর্বলতা অনুযায়ী রাজনৈতিক বার্তা পাঠাতে পারে। এই ‘মাইক্রো টার্গেটিং’-এর মাধ্যমে ভোটারদের মনোভাবকে প্রভাবিত করা বা নির্দিষ্ট গোষ্ঠীকে ভোটদানের সময় বা স্থান সম্পর্কে ভুল তথ্য ছড়িয়ে দিয়ে তাদের ভোটদান থেকে বিরত রাখাও সম্ভব।

আমাদের গণতন্ত্রকে সুরক্ষিত রাখতে হলে এই নতুন প্রযুক্তির ঝুঁকিগুলো সম্পর্কে সচেতন হতে হবে এবং সময়োপযোগী পদক্ষেপ নিতে হবে

এআই শুধু মিথ্যা তথ্য ছড়ানোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না, এটি নির্বাচনী পরিকাঠামোর ওপর সাইবার হামলাও জোরদার করতে পারে। এআই-চালিত টুলগুলো আরও সফিসটিকেটেড ফিশিং আক্রমণ তৈরি করে নির্বাচনী কর্মকর্তাদের অ্যাকাউন্ট হ্যাক করতে বা এমন ম্যালওয়্যার তৈরি করতে পারে, যা প্রচলিত নিরাপত্তাব্যবস্থা এড়িয়ে যেতে সক্ষম। এ ধরনের আক্রমণ ভোটার ডেটাবেজ বা ভোটিং মেশিনকে লক্ষ্য করে করা যেতে পারে। সেটি নির্বাচনের ফলাফল পরিবর্তন বা পুরো প্রক্রিয়াকে বিঘ্নিত করতে পারে।

প্রশ্ন হচ্ছে, এই বিপত্তির সমাধান কী? এ প্রশ্নের জবাব হিসেবে প্রথমেই মনে রাখা দরকার, এই গুরুতর চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলায় একটি সমন্বিত ও কার্যকর পদক্ষেপ প্রয়োজন। এখানে এক্সপ্লেইনেবল এআই (এক্সএআই) একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। এআই মডেলের সিদ্ধান্তগুলো মানুষের কাছে বোধগম্য করে তোলে এক্সএআই। এটি এআইয়ের স্বচ্ছতা বাড়ায়।

ডিপফেক শনাক্তকরণ: এক্সএআই ব্যবহার করে এমন টুল তৈরি করা সম্ভব, যা কেবল ডিপফেক শনাক্ত করে না; বরং কেন একটি বিষয়বস্তু জাল বলে চিহ্নিত হয়েছে, তার বিস্তারিত ব্যাখ্যাও দেয়। এর ফলে মানব ফ্যাক্ট-চেকাররা বিশ্লেষণ যাচাই করতে পারেন এবং জনগণের আস্থা তৈরি হয়।

প্রচারণার নিরীক্ষা: এক্সএআই রাজনৈতিক প্রচারণায় এআই ব্যবহারের নিরীক্ষা করতে পারে। এটি বিশ্লেষণ করে দেখাতে পারে, কীভাবে একটি অ্যালগরিদম তার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যা পক্ষপাতদুষ্ট বা কারসাজিমূলক টার্গেটিং কৌশলগুলো প্রকাশ করতে সাহায্য করে।       

নিরাপত্তা বৃদ্ধি: সাইবার নিরাপত্তার ক্ষেত্রে এক্সএআই হুমকির শনাক্তকরণ সিস্টেমকে উন্নত করতে পারে। এটি ব্যাখ্যা করতে পারে, কেন একটি নির্দিষ্ট কার্যকলাপকে ক্ষতিকর বলে মনে করা হয়েছে। এই প্রক্রিয়া নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞদের দ্রুত এবং কার্যকরভাবে প্রতিক্রিয়া জানাতে সাহায্য করে।

অংশগ্রহণকারীদের করণীয়: এআইয়ের হুমকি মোকাবিলায় সব গুরুত্বপূর্ণ অংশগ্রহণকারীকে সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে। প্রথমত, রাজনৈতিক দলগুলো এবং নেতাদের প্রকাশ্যে প্রতিশ্রুতি দিতে হবে, তাঁরা প্রতারণামূলক এআই জেনারেটেড কনটেন্ট বা ভুল তথ্য ছড়ানোর প্রচারে জড়িত হবেন না। তাঁদের উচিত এআইয়ের যেকোনো বৈধ ব্যবহার সম্পর্কে স্বচ্ছ থাকা এবং এআই জেনারেটেড কনটেন্টে সুস্পষ্ট লেবেল ব্যবহার করা। দ্বিতীয়ত, নির্বাচন কমিশনকে রাজনৈতিক প্রচারে এআই ব্যবহারের বিষয়ে সুস্পষ্ট নিয়ম ও প্রবিধান তৈরি এবং প্রয়োগ করতে হবে। তাদের উচিত এআই-চালিত টুলগুলোতে বিনিয়োগ করা এবং ভোটারদের সচেতন করার জন্য বড় আকারের প্রচার চালানো।

এ ছাড়া একটি যৌথ গবেষণা ও উন্নয়ন দল গঠন করা প্রয়োজন, যারা নির্বাচনের আগপর্যন্ত কমিশনকে এআই এবং সাইবার নিরাপত্তা বিষয়ে নিরবচ্ছিন্ন সহায়তা দেবে। তৃতীয়ত, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, সংবাদমাধ্যম এবং সুশীল সমাজকে এআইয়ের হুমকি সম্পর্কে তথ্য আদান-প্রদান করতে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। মিথ্যা তথ্য ছড়িয়ে পড়লে তা দ্রুত মোকাবিলা করার জন্য একটি সুস্পষ্ট প্রটোকল স্থাপন করা জরুরি। সংবাদমাধ্যম এবং সুশীল সমাজের উচিত ফ্যাক্ট-চেকিং এবং জনগণের মধ্যে মিডিয়া লিটারেসি বাড়াতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করা।

আমাদের গণতন্ত্রকে সুরক্ষিত রাখতে হলে এই নতুন প্রযুক্তির ঝুঁকিগুলো সম্পর্কে সচেতন হতে হবে এবং সময়োপযোগী পদক্ষেপ নিতে হবে। এআইয়ের ক্ষমতা যেমন বিশাল, তেমনি এর অপব্যবহারের বিপদও কম নয়।

জনগণের বিশ্বাস এবং একটি ন্যায্য নির্বাচনের অধিকার নিশ্চিত করতে এখনই আমাদের সবাইকে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হলো, বাংলাদেশ সরকারের একটি সম্মিলিত গবেষণা ও উন্নয়ন (আরএনডি) দল গঠন করা। এই বিশেষজ্ঞ দল এআই-সম্পর্কিত ঝুঁকিগুলো ক্রমাগত বিশ্লেষণ ও অনুমান করবে এবং দৃঢ় সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য সরবরাহ করবে।

অধ্যাপক ড. আলমগীর হোসেন এআইয়ের সাবেক অধ্যাপক, যুক্তরাজ্যের কেমব্রিজে অবস্থিত এআরআইটিআইয়ের সাবেক পরিচালক

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • এক-এগারোর মতো ঘটনা ঘটা এখানে অস্বাভাবিক কিছু নয়
  • কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যেভাবে সুষ্ঠু ভোটে বাধা হতে পারে
  • মিয়ানমারে ডিসেম্বরে নির্বাচনের ঘোষণা জান্তা সরকারের, জরুরি অবস্থা প্রত্যাহার
  • বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে বেশির ভাগ শিক্ষার্থী সরাসরি ছাত্র সংসদ নির্বাচনের পক্ষে
  • ট্রাম্পের বিরুদ্ধে লুলার প্রতিবাদে অন্যরাও শামিল হোক
  • এমন কিছু করবেন না যাতে গণতন্ত্র ব্যাহত হয়: মির্জা ফখরুল
  • সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক ৭ দিনের রিমান্ডে
  • বিতর্কমুক্ত তত্ত্বাবধায়ক সরকারব‍্যবস্থা না হলে গণতন্ত্র আবার হুমকিতে পড়বে: এবি পার্টি
  • মানুষ ঠিকমতো ইভিএম বোঝে না, পিআর বুঝবে কী করে: মির্জা ফখরুল