ক্ষমতার লোভে বেহুঁশ বিএনপি, হুঁশে ফিরতে বললেন এনসিপি নেতা
Published: 31st, May 2025 GMT
বিএনপি ক্ষমতার লোভে বেহুঁশ হয়ে গেছে বলে মন্তব্য করে দলটিকে হুঁশে ফিরে আসার আহ্বান জানিয়েছেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী। তিনি বিএনপিকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘ক্ষমতার লোভে আপনারা বেহুঁশ হয়ে গিয়েছেন। এই বেহুঁশ অবস্থা থেকে হুঁশে ফিরে আসার জন্য আমরা এখনো আপনাদের সাবধান করছি।’
এনসিপি আয়োজিত ‘মৌলিক সংস্কার ও আগামীর রাজনীতি’ শীর্ষক কর্মশালায় এ কথা বলেন নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী। আজ শনিবার রাতে রাজধানীর গুলশানের একটি কনভেনশন সেন্টারে আয়োজিত এই কর্মশালায় এনসিপির ঢাকা মহানগর উত্তর শাখার নেতা-কর্মীরা অংশ নেন।
ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন হতেই হবে—এ ধরনের কথা বলা একটি স্থিতিশীল রাষ্ট্রকে হুমকি দেওয়া বলে মন্তব্য করেন এনসিপির মুখ্য সমন্বয়ক। তিনি বলেন, ‘এ ধরনের গুন্ডামি-মাস্তানি, থ্রেটের রাজনীতি তরুণ প্রজন্ম মেনে নেবে না।’
নাসীরুদ্দিন পাটওয়ারী বলেন, সংস্কারপ্রক্রিয়া বাংলাদেশে হবে, বিচার বাংলাদেশে হবে, তারপরে বাংলাদেশের মানুষ একটি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় যাবে। যাদের এই কথাটি বুঝতে সমস্যা তারা জনগণের কাছে যান, জনগণের কাছে বুঝুন, তারা কী চায়।
এর আগে কর্মশালায় বক্তব্য দেন বিশিষ্ট আলোকচিত্রী শহিদুল আলম। তিনি পরিবর্তনের জন্য সবাইকে একসঙ্গে লড়াই করার আহ্বান জানান।
অর্থনীতিবিদ জিয়া হাসান বলেন, গণ-অভ্যুত্থানের ধারক-বাহক শক্তি এনসিপি, তাদের কাছে অনেক প্রত্যাশা। সেই প্রত্যাশা পূরণে এনসিপির সব পর্যায়ের নেতা–কর্মীদের কাজ করার আহ্বান জানান তিনি।
এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক সারোয়ার তুষার বলেন, ‘আমাদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার হচ্ছে যে আমরা নির্বাচনের বিরোধিতা করছি এবং নির্বাচন চাই না। ব্যাপারটা কিন্তু মোটেও এ রকম না। বরং আমরা বলছি যে যদি বাংলাদেশে একটা সুষ্ঠু নির্বাচন করতে চান, অর্থবহ নির্বাচন করতে চান, জনগণের ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠা হয়, এমন নির্বাচনও যদি আমরা করতে চাই; তাহলে মৌলিক সংস্কার করতে হবে। যার মানে হচ্ছে এই যে রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, বিচার বিভাগ, নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন, সরকারি কর্ম কমিশনসহ যেসব প্রতিষ্ঠান আছে, সেগুলো সংস্কার করতে হবে।
লেখক ও মানবাধিকারকর্মী মুস্তাইন জহির বলেন, ‘বাংলাদেশে একাত্তর সালে মুক্তিযুদ্ধের পর প্রশাসন, পুলিশ, বিচার বিভাগ—রাষ্ট্রের এই ধরনের মৌলিক প্রতিষ্ঠানগুলো আজকের মতো এতটা বিপর্যস্ত অবস্থায় ছিল না। এত সামাজিক পোলারাইজেশনের মধ্য দিয়ে কখনো আমরা যাইনি। সব মিলিয়ে রাষ্ট্র যেই অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে, এখান থেকে ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের পথরেখা খুঁজতে হচ্ছে। সে জন্য করণীয় ঠিক করতে সবার একসঙ্গে কাজ করতে হবে।’
কর্মশালায় বিভিন্ন বিষয়ে আরও অনেকে কথা বলেন। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন বিডিজবস–এর সিইও ফাহিম মাশরুর, কাতারের নর্থ ওয়েস্টার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক হাসান মাহমুদ, ‘ট্রাক লাগবে’-এর প্রতিষ্ঠাতা এনায়েত রশিদ প্রমুখ।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: এনস প র
এছাড়াও পড়ুন:
কর ব্যবস্থার অতীত-বর্তমান
‘আপনি কি সরকারকে কর দেন’– এমন প্রশ্নে অনেক মানুষই হয়তো বলবেন, ‘না’। প্রায় ১৮ কোটি জনসংখ্যার এ দেশে ৪০ লাখ মানুষও আয়কর রিটার্ন জমা দেন না। যারা রিটার্ন জমা দেন না, স্বভাবতই তারা মনে করেন, তারা সরকারকে কর দেন না। আদতে বিদ্যমান ব্যবস্থায় এমন কেউ নেই যে কর দেন না।
প্রাচীনকাল থেকে যখন রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রবর্তন হয়, তখন থেকে কর ব্যবস্থার শুরু। সে কর ছিল প্রত্যক্ষ কর। তবে রাষ্ট্রের প্রয়োজনে কর ব্যবস্থা বিস্তৃত হয়েছে। প্রত্যক্ষ করের বাইরে, পরোক্ষ করও আদায় করছে সরকার। অত্যাবশ্যক কিছু পণ্য ছাড়া উৎপাদন, সরবরাহ বা আমদানির বিভিন্ন পর্যায়ে সরকার কর বা শুল্ক আরোপ করে। ফলে আপনি যে পণ্যই কিনুন না কেন, পরোক্ষভাবে সরকারকে কর দিচ্ছেন। আধুনিক কর ব্যবস্থায় শিশু থেকে বৃদ্ধ, হতদরিদ্র ভিক্ষুক থেকে ধনী– কেউই আদতে করজালের বাইরে নেই।
প্রাচীন যুগে কর
মানব সভ্যতার ইতিহাসে কর ধারণা বেশ পুরোনো। এখন থেকে প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে প্রাচীন মিসরের ফারাও সম্রাটরা জনগণের কাছ থেকে কর আদায় করতেন। তখন কৃষকের ঘরে ঘরে গিয়ে কর আদায় করতেন সম্রাটের নিযুক্ত কর্মকর্তারা। কখনও গম, কখনও পশু, কখনওবা এক দিনের শ্রম– এ সবই ছিল করের উপাদান।
প্রাচীন মিসরের বাইরে মেসোপটেমিয়া (বর্তমানে ইরাক), ভারতীয় উপমহাদেশ– সবখানেই কর আদায়ের রীতি চালু ছিল কৃষি ও সামরিক খরচ মেটাতে। সে সময়ে কর আদায়ের প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল– রাজপরিবার ও সামরিক বাহিনীর রক্ষণাবেক্ষণ, ধর্মীয় বা রাজকীয় স্থাপনার নির্মাণ এবং যুদ্ধের জন্য রসদ সংগ্রহ। করের অর্থ জনগণের স্বার্থে ব্যবহারে সামন্ত শাসকদের কোনো দায় ছিল না।
ভারতের মৌর্য যুগে কৌটিল্য কর আদায়কে রাষ্ট্র পরিচালনার কেন্দ্রীয় স্তম্ভ হিসেবে দেখেছেন। বাংলার ইতিহাসেও পাল, সেন ও পরে মুসলিম শাসকরা কৃষিপণ্যের ওপর কর আদায় করতেন। মোগল আমলে আকবরের দহসালা ব্যবস্থা বাংলায় কার্যকর ছিল, যা ছিল একটি ভূমি জরিপ ও কর নির্ধারণ পদ্ধতি। ব্রিটিশ আমলে করের চরিত্র রূপ নেয় শোষণমূলক কাঠামোয়। ১৭৯৩ সালের স্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে জমিদারদের হাতে কর আদায়ের ক্ষমতা দেওয়া হয়, যার ফলে কৃষকদের ওপর ব্যাপক চাপ সৃষ্টি হয়। এই সময় রাজস্ব আদায়ের অর্থ ঔপনিবেশিক সরকারের খরচ এবং মুনাফার জোগান দিত।
সভ্যতার উন্নতির সঙ্গে কর ব্যবস্থার বদল হয়েছে। সময়ের প্রবাহে কর ব্যবস্থার রূপ ও উদ্দেশ্য বদলেছে। এখন প্রচলিত মুদ্রায় কর দিতে হয়। বলা চলে, করব্যবস্থাই মানব সভ্যতাকে এগিয়ে দিয়েছে আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার পথে এবং আজকের উন্নত সভ্যতা গড়ার পথে মূল নিয়ামকের ভূমিকা রেখেছে। আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় জনগণের অর্থ জনগণের স্বার্থে ব্যবহারে বাধ্যবাধকতা আছে সব দেশে।
বর্তমানে কর উন্নয়ন ও পুনর্বণ্টনের নিয়ামক
করের এখন অর্থ জীবনমান উন্নয়ন, নিরাপত্তাসহ জনগণের জন্য ব্যবহার হয়। একদিকে জনপ্রশাসন চালানোর সঙ্গে অবকাঠামোগত উন্নয়ন, আয় পুনর্বণ্টন এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য সরকারের বিশাল অঙ্কের কর চাহিদা রয়েছে। বর্তমান কর আদায়ের উদ্দেশ্য অবকাঠামো উন্নয়ন (যেমন– সড়ক, বিদ্যুৎ, হাসপাতাল), শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ, দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য ভর্তুকি ও সামাজিক সুরক্ষা এবং আয়বৈষম্য কমাতে ধনীদের ওপর অধিক কর।
করের নানা ধরন
বাংলাদেশে কর দুই প্রকার– প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ। ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের আয় বা সম্পদের ওপর সরাসরি যে কর আরোপ করা আছে, সেটি প্রত্যক্ষ কর। পণ্য বা সেবা কেনার সময় সরকার যে কর আদায় করে তা পরোক্ষ কর। কোনো ব্যক্তির আয় নির্দিষ্ট আয়সীমা অতিক্রম করলে তাকে কর দিতে হয়। এটিকে ব্যক্তি আয়কর বলা হয়। বর্তমানে করমুক্ত সীমা সাড়ে ৩ লাখ টাকা। এটি অবশ্য স্বাভাবিক পুরুষ করদাতার ক্ষেত্রে। নারী, প্রতিবন্ধী, বয়স্ক এবং তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের জন্য করমুক্ত আয়সীমা কিছুটা বেশি। ব্যক্তি করহার ৫ থেকে ২৫ শতাংশ। স্বাভাবিক ব্যক্তি ভিন্ন কোনো প্রতিষ্ঠান যখন আয়ের ওপর কর দেয়, তা করপোরেট কর হিসেবে পরিচিত। প্রাতিষ্ঠানিক করহার কোম্পানিভেদে ১০ থেকে ৪৫ শতাংশ। কর ফাঁকিসহ নানা কারণে মুনাফা না হলেও সরকার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ওপর লেনদেনের ওপর ন্যূনতম কর আরোপ করেছে। এটিকে বলা হয় টার্নওভ্যার ট্যাক্স।
এর বাইরে আরেক ধরনের প্রত্যক্ষ কর রয়েছে। এটি হলো উৎসে কর। যেমন– ব্যাংকে আমানত বা সরকারি বন্ড বা সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ থেকে সুদ বা মুনাফা পেলে তার ওপর ১০ থেকে ১৫ শতাংশ হারে উৎসে কর কেটে রাখার বিধান করেছে। এর বাইরে কোনো ব্যবসা বা সেবা সরবরাহ করার পর মূল্য নেওয়ার জন্যও সরকারের আদেশে মূল্য পরিশোধকারী প্রতিষ্ঠান উৎসে কর কেটে নেয়। উচ্চ ধনীদের আয়েও সরকার কর আরোপ করেছে। ৪ কোটি টাকার বেশি সম্পদ থাকলে সরকার তার ওপর কর আরোপ করছে।
সরকার যখন জনগণের কাছ থেকে সরাসরি কর না নিয়ে পরোক্ষ ব্যবস্থায় কর নেয়, তখন সেটিকে পরোক্ষ করা বলা হয়। এই করব্যবস্থা পণ্য বা সেবা গ্রহণের সঙ্গে সম্পর্কিত। আপনি যখন প্রক্রিয়াজাত বা প্যাকেটজাত বা আমদানি পর্যায়ের কোনো পণ্য কেনেন, তার ওপর নিজের অজান্তেই কর দিচ্ছেন। আবার গ্যাস বা বিদ্যুৎ বিল দিচ্ছেন, তখনও পরোক্ষ করে আরোপ করে। এটিকে মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাট বলে। পণ্য ও সেবার ওপর আরোপিত যে কর ভোক্তা পরোক্ষভাবে বহন করেন সেগুলোর একটি ভ্যাট। এছাড়া আমদানি শুল্ক আকারে বিদেশি পণ্যের ওপর করারোপ হয়। এর বাইরে বিলাসবহুল ও ক্ষতিকর পণ্যের ওপর সরকার বিশেষ কর আরোপ করে থাকে। এটি হলো সম্পূরক শুল্ক। একজন সাধারণ নাগরিকের আয়কর না লাগলেও, পণ্য কিনলে বা মোবাইলে রিচার্জ করলেও তিনি কর দিচ্ছেন, এটিই পরোক্ষ করের বাস্তবতা।