ছেলের প্রতি একজন বাবার ভালোবাসা ও একটি সাইকেলের গল্প
Published: 7th, June 2025 GMT
সন্তানের মুখে হাসি ফোটাতে একজন বাবা কী না করেন! গাইবান্ধার পলাশবাড়ীর রাজু মিয়া (৫৫) প্রমাণ করলেন, ভালোবাসা আর দায়িত্ববোধ থাকলে অভাব কোনো বাধা হতে পারে না।
রাজু মিয়ার গল্পটা এ রকম—অভাবের কারণে ছেলের শখের বাইসাইকেল কিনে দিতে পারেননি। ঢাকায় গিয়ে আড়াই মাস রিকশা চালিয়ে দুই হাজার টাকায় কিনে নেন একটি পুরোনো বাইসাইকেল। কিন্তু সেটি বাড়ি নেওয়ার মতো পরিবহন খরচ ছিল না তাঁর। তাই রাজধানী ঢাকা থেকে সাইকেল চালিয়ে যাত্রা করেন গাইবান্ধা জেলা শহর থেকে প্রায় ১৭ কিলোমিটার দূরের তালুকজামিরা কবিরাজপাড়া গ্রামে। দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে সাইকেলটি তুলে দেন ছেলের হাতে।
ছেলের শখ আর শখপূরণ—এর মাঝখানে আছে এক অন্য রকমের এক গল্প। গল্পটি হয়তো অজানাই থেকে যেত। যদি না ঈদের আগে তাঁর এই বাড়ি ফেরা নিয়ে একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হতো।
রাজু মিয়ার এই গল্পের বিস্তারিত জানতে আজ শনিবার ঈদের দিন বিকেলে পলাশবাড়ী উপজেলার হরিণাথপুর ইউনিয়নে তালুকজামিরা কবিরাজপাড়া গ্রামে যান এই প্রতিবেদক। সেখান গিয়ে দেখা গেল, চারদিকে আবাদি জমি। মাঝখানে ছোট্ট দুটি টিনশেড ঘর। তার মধ্যে একটি জরাজীর্ণ। একটি ঘরে থাকে রাজু মিয়ার এক ছেলে ও মেয়ে। জরাজীর্ণ ঘরটিতে স্ত্রীকে নিয়ে থাকেন রাজু মিয়া। তাঁর বাড়িতে যাওয়ার কোনো রাস্তাও নেই। বাঁশঝাড় ও অন্যের জমির আইল দিয়ে যেতে হয় বাড়িতে।
অক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন রাজু মিয়া পেশায় দিনমজুর। প্রায় তিন শতক বসতভিটা ছাড়া কোনো সম্পদ নেই। এলাকায় কখনো দিনমজুরি করেন, কখনো রিকশা চালান। তাঁর দুই মেয়ে ও এক ছেলে। বড় মেয়ের বিয়ে হয়েছে। ছোট মেয়ে গাইবান্ধা সরকারি কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে স্নাতক (সম্মান) দ্বিতীয় বর্ষে পড়ছেন। একমাত্র ছেলে রেজওয়ান মিয়া এ বছর পলাশবাড়ীর তালুকজামিরা দ্বিমুখী উচ্চবিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞান বিভাগে এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছে।
রাজু মিয়ার সাইকেলের গল্প তাঁর এই ছেলেকে ঘিরে। রেজওয়ান হেঁটে বিদ্যালয়ে যাতায়াত করত। তার কষ্ট দেখে তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ার সময় মামা রবিউল ইসলাম নিজের বাইসাইকেলটি ভাগনেকে উপহার দেন। এই সাইকেলে চলছিল তার বিদ্যালয়ে আসা–যাওয়া। রেজওয়ান তখন ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র। একদিন তার সাইকেলটি বিদ্যালয় থেকে চুরি হয়ে যায়। তখন সে বাবার কাছে একটি বাইসাইকেল চায়। কিন্তু দিনমজুর বাবার সামর্থ্য হয়ে ওঠেনি ছেলেকে সাইকেল কিনে দেওয়ার।
রাজু মিয়া জানালেন, গত রমজান মাসে তিনি কাজের খোঁজে ঢাকায় যান। গিয়ে ওঠেন তেজগাঁওয়ের নাখালপাড়ার একটি মেসে। সেখানে থেকে ভাড়ায় রিকশা চালানোর কাজ বেছে নেন। প্রতিদিন উপার্জন হয় ১ হাজার থেকে ১ হাজার ২০০ টাকা। এর মধ্যে প্রতিদিন রিকশাভাড়া, থাকা–খাওয়াসহ ৭৫০ টাকা খরচ হয়ে যেত। যা বাঁচত তা থেকে কয়েক দিন পরপর বাড়িতে টাকা পাঠাতেন। আর ছেলের সাইকেল কেনার জন্য কিছু কিছু করে টাকা সঞ্চয় করতেন। ঈদুল আজহার আগে তাঁর সঞ্চয় হয় ৪ হাজার ৩০০ টাকা। নাখালপাড়া থেকে দুই হাজার টাকা দিয়ে একটি পুরোনো বাইসাইকেল কেনেন।
কিন্তু সাইকেলটি বাড়ি নেওয়ার ক্ষেত্রে বিপত্তি বাধায় আর্থিক অসংগতি। রাজু মিয়া জানান, গত বুধবার রাত সাড়ে ১১টার দিকে নাখালপাড়া থেকে সাইকেলটি চালিয়ে ঢাকার আবদুল্লাহপুরে যান। সেখানে গাইবান্ধাগামী বাসে ওঠার চেষ্টা করেন। কিন্তু বাসের সুপারভাইজার সাইকেলটির জন্য দুই হাজার টাকা ও তাঁর ভাড়া বাবদ তিন হাজার টাকা দাবি করেন। কিন্তু এত টাকা তাঁর কাছে নেই। কম টাকায় তাঁকে নিয়ে যাওয়ার অনুরোধ কেউ রাখেনি। ট্রাকচালক ও পিকআপভ্যানের চালকদের কাছেও ধরনা দিয়েও কাজ হয়নি। বাধ্য হয়ে বাইসাইকেল চালিয়ে বাড়ির উদ্দেশে যাত্রা করেন তিনি। পথে বিপত্তি বাধে যমুনা সেতুতে। সাইকেল নিয়ে সেতু পারাপারের নিয়ম নেই। সেখানে বাসের সুপারভাইজার, ট্রাকচালক ও পিকঅ্যাপ ভ্যানের চালকদের অনুরোধ করেন তাঁকে সেতু পার করে দিতে। কিন্তু কেউ তাঁর কথায় রাজি হননি। পরে একটি ট্রাকের সামনে দাঁড়িয়ে পড়েন। বাধ্য হয়ে ট্রাকচালক তাঁকে যমুনা সেতু পার করে দেন। তবে এ জন্য তাঁকে দিতে হয়েছে ৫০০ টাকা।
এরপর রাজু মিয়া আবার সাইকেল চালিয়ে বাড়ির উদ্দেশে যাত্রা করেন। বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত একটার দিকে বগুড়ার চারমাথা থেকে মাটিডালির মাঝখানে সেনাবাহিনীর তল্লাশিচৌকিতে তাঁকে থামানো হয়। তখন সাইকেল নিয়ে ঢাকা থেকে বাড়ি ফেরার গল্প শুনে সেনাবাহিনীর সদস্যরা তাঁকে একটি ট্রাকে তুলে দেন। ট্রাকটি ভোররাতে গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে রাজু মিয়াকে নামিয়ে দেয়। গোবিন্দগঞ্জে কিছু সময় কাটানোর পর সাইকেল চালিয়ে বাড়ির উদ্দেশে রওনা দেন। গতকাল শুক্রবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে তিনি বাড়ি পৌঁছে ছেলের হাতে তুলে দেন সাইকেলটি।
সেনাবাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে রাজু মিয়ার কথেপকথনের একটি ভিডিও ফেসবুকে ভাইরাল হয়।
রাজু মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘সাইকেলটা ও তেইশ শ ট্যাকা নিয়্যা ঢাকাত থাকি রওনা দিচিলাম। পথোত যমুনা বিরিজ পার হওয়া, টেরাক ভড়া ও খাওয়া মিলি তেরো শ ট্যাকা গেচে। খালি এক হাজার ট্যাকা নিয়্যা বাড়িত আচ্চি। ত্যাক দিয়্যা চাউল ও সোংসারের জিনিসপাতি কিনচি। কিন্তু ঈদোত খাবার জন্নে গোশত কিনব্যার পাই ন্যাই। ঈদের দিন মানসে কিচু গোশত দিচে, তাক খামো। হামার কসটো হোক, কিনতু ব্যাটা সাইকেলকোনা পায়্যা খুবি খুশি হচে। তাতেই হামি খুশি। কষ্ট হলেও ব্যাটাক আরও নেকাপড়া করামো।’
সাইকেল পেয়ে খুব খুশি রেজওয়ান। সাইকেল হাতে পেয়ে প্রথমেই বড় বোনের বাড়ি যায়, এরপর নানার বাড়ি। আজ ঈদের দিনেও সাইকেল চালিয়ে বিভিন্ন জায়গায় ঘুর বেড়িয়েছে সে।
রেজওয়ান জানাল, তার জন্য বাবার ওই ত্যাগস্বীকার সে কখনো ভুলবে না। লেখাপড়া করে বাবার স্বপ্ন পূরণ করতে চায় সে।
‘আমার বাবার মতো বাবা সবারই হোক। বাবাকে নিয়ে আমি গর্ববোধ করি।’ বলল ভবিষ্যতে প্রকৌশলী হতে চাওয়া রেজওয়ান।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: র জওয় ন
এছাড়াও পড়ুন:
৫০ শয্যার থানচি হাসপাতাল চলছে একজন চিকিৎসকে
বান্দরবানের থানচি উপজেলার প্রায় ৩০ হাজার মানুষের একমাত্র ভরসার জায়গা ৫০ শয্যার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। দীর্ঘদিন ধরে চিকিৎসক, নার্স ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির সংকটে এই হাসপাতাল কার্যত অচল হয়ে পড়েছে। বর্তমানে পুরো হাসপাতাল চালাচ্ছেন মাত্র একজন চিকিৎসক। গত পাঁচবছরে চিকিৎসাধীন ও রেফার্ড করা ২৪ জন রোগী মারা গেছেন।
হাসপাতাল সূত্র জানায়, ১৯৯৫ সালে ৩১ শয্যার থানচি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স যাত্রা শুরু করে। পরে এটি ৫০ শয্যায় উন্নীত হয়। এই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ১২ জন চিকিৎসক থাকার কথা থাকলেও কর্মরত আছেন মাত্র দুইজন। তাদের মধ্যে একজন ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘদিন চিকিৎসাধীন। এ কারণে রোগীদের সেবা দিতে পারছেন না। ১৮ জন নার্স পদে রয়েছেন মাত্র চারজন। চারজন মিডওয়াইফ থাকার কথা, নেই একজনও।
আরো পড়ুন:
ফরিদপুরে পাগলা ঘোড়ার কামড়ে আহত ২০
বক্তব্য দেওয়ার সময় অসুস্থ হয়ে পড়লেন কাদের সিদ্দিকী
প্রাথমিক থেকে শুরু করে জরুরি চিকিৎসার জন্য এই হাসপাতালে ছুটে যান পাহাড়ি ও বাঙালিরা। তাদের অভিযোগ, হাসপাতালটি ৫০ শয্যায় উন্নীত হলেও আধুনিক চিকিৎসা সুবিধা যোগ হয়নি। প্রয়োজনীয় সংখ্যক চিকিৎসক না থাকায় গর্ভবতী নারী, শিশু ও বৃদ্ধ রোগীরা সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে পড়ছেন।
দুর্গম এলাকার রোগীরা অনেক সময় নদীপথ কিংবা পাহাড়ি রাস্তা পাড়ি দিয়ে হাসপাতালে এলেও কাঙ্ক্ষিত চিকিৎসা সেবা পান না। বরং তাদের বান্দরবান সদর হাসপাতালে রেফার্ড করা হয়। অনেক সময় বান্দরবানে যাওয়ার পথে রোগীরা মারা যান। এ কারণে জরুরি ভিত্তিতে চিকিৎসক, নার্স ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি সরবরাহের দাবি জানিয়েছেন তারা।
হাসপাতালের পরিসংখ্যানবীদ পঙ্কজ বড়ুয়া জানান, ২০২০ থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত এখানে ভর্তি হয়েছেন ৫ হাজার ১৯৮ জন রোগী। এর মধ্যে ৪৫৬ জনকে রেফার্ড করা হয় বান্দরবান সদর হাসপাতালে। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন ১৭ জন রোগী।
থানচি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের অ্যাম্বুলেন্স চালক মংক্যসিং মারমা বলেন, “২০১৯ সালে চাকরিতে যোগদান করার পর থেকে অন্তত সাতজন রেফার্ড করা রোগী মাঝপথে আমার গাড়িতেই মারা গেছেন।”
শৈসাই মং মারমা তিন বছর আগে বিনা চিকিৎসায় তার মাকে মারা যেতে দেখেছেন। তিনি জানান, তার মা শৈমেপ্রু মারমা (৩৪) অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। ২০২২ সালের ১৪ নভেম্বর হঠাৎ তিনি অচেতন হয়ে পড়েন। রেমাক্রী বাজার থেকে নদীপথে থানচি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যান মাকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই তাকে জেলা সদর হাসপাতালে রেফার্ড করা হয়। ভাড়া গাড়িতে জেলা হাসপাতালে যাওয়ার সময় চিম্বুক বারো মাইল এলাকায় তার মা মারা যান।
লেংরু ম্রো নামে চার সন্তানের মা হারিয়েছেন স্বামীকে। তিনি জানান, তার স্বামী রেং য়ুং ম্রো (৪৫) কিডনি জটিলতা নিয়ে থানচি হাসপাতালে যান। সঙ্গে সঙ্গে সেখান থেকে তাকে বান্দরবান সদর হাসপাতালে রেফার্ড করা হয়। থানচি থেকে বান্দরবান যাওয়ার মাঝপথে মারা যান তার স্বামী।
স্থানীয় বাসিন্দা মংমে মারমা বলেন, “হাসপাতালে চিকিৎসক, ওষুধ ও যন্ত্রপাতির সংকট দীর্ঘদিন ধরেই চলছে। বিশেষজ্ঞ ডাক্তার বদলি হলেও অনেকেই থানচিতে যোগ দেন না, ডিপুটেশনে থেকে যান সদর হাসপাতালে। ফলে এ অঞ্চলের পাহাড়ি ও বাঙালি প্রায় ৩০ হাজার মানুষ স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।”
রিয়েং ম্রো নামে অপর বাসিন্দা বলেন, “পাহাড়ে বসবাসকারীদের অধিকাংশ গরিব। জেলা সদর হাসপাতালে রোগী নিয়ে যাওয়া ব্যয়বহুল ও কষ্টকর। রেমাক্রি, বড় মোদক, তিন্দু থেকে থানচি সদরে রোগী আনতেই অনেক টাকা খরচ হয়ে যায়। এরপর আবার বান্দরবান সদর হাসপাতালে রেফার্ড করলে সাধারণ মানুষ কীভাবে চিকিৎসা করাবে?”
থানচি উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা (ইউএইচএফপিও) ডা. মো. ওয়াহিদুজ্জামান মুরাদ বলেন, “বর্তমানে হাসপাতালে আমিসহ দুইজন চিকিৎসক রয়েছেন। একজন ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘদিন ধরে চিকিৎসাধীন। তিন রোগীদের সেবা দিতে পারছেন না। ফলে পুরো হাসপাতাল পরিচালনার দায়িত্ব আমাকে একাই সামলাতে হচ্ছে।”
তিনি আরো বলেন, “জনবল ও সরঞ্জাম সংকটের কারণে গুরুতর রোগীদের রেফার্ড করা ছাড়া উপায় থাকে না। দীর্ঘ পথের কারণে অনেকেই জীবিত অবস্থায় সদর হাসপাতালে পৌঁছাতে পারেন না।”
বান্দরবান জেলা সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ শাহীন হোসাইন চৌধুরী বলেন, “শুধু বান্দরবান নয়, পুরো তিন পার্বত্য জেলাতেই চিকিৎসক সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে। নতুন করে ৪৮তম বিসিএসের ডাক্তার পদায়ন না হওয়া পর্যন্ত এই সংকট পুরোপুরি সমাধান করা সম্ভব হচ্ছে না। তারপরও বিভাগীয় প্রধানকে বিষয়টি চিঠির মাধ্যমে জানানো হয়েছে। ইতোমধ্যে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজের আট-দশজন চিকিৎসককে বান্দরবানে বদলি করার জন্য প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।”
ঢাকা/মাসুদ