আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিন-তারিখ নিয়ে দড়ি–টানাটানিতে পড়ে জাতি আলোচনার ফুরসত পাচ্ছে না, আমজনতা তাদের ভাবী প্রতিনিধি ও সম্ভাব্য নির্বাচিত সরকারের কাছ থেকে কী আশা করছে।

রাজনৈতিক দলের বাইরেও গণমাধ্যম, বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়, অধিকারকর্মী ও সুশীল সমাজের পক্ষ থেকে আজকের ভোটাররা কী চায় এবং তাদের সমবেত কল্যাণে কী ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত, সেই দাবিনামা এবং নিদেনপক্ষে প্রত্যাশার ফর্দ এখন পর্যন্ত প্রস্তুত করা হয়নি।

৬ জুন সন্ধ্যায় প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে ২০২৬ সালের এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের যে ঘোষণা দেন, তা নিয়ে বক্তৃতামঞ্চে বিতর্ক যা–ই হোক, দেশ কার্যত নির্বাচনমুখীই হবে। শিগগিরই হয়তো দল ও অংশীজনকে তাদের জনসংযোগের কৌশল ঠিক করতে ব্যস্ত দেখা যাবে।

গণতান্ত্রিক দেশে নির্বাচনে জেতার জন্য রাজনীতিবিদেরা সাধারণত কিছু কাজ করে থাকেন। যেমন তাঁরা জাতীয় ও স্থানীয় সমস্যার কিছু সমাধানের চেষ্টা করেন; তাঁরা মানুষের উপকারে আসে—এমন কিছু উদ্যোগ নেন (বা লোকদেখানো উপকার করতে চান); তাঁরা বিরোধী দলের ভুল বা দুর্বলতা ধরে প্রচার চালান; তাঁরা কখনো কখনো খুব আক্রমণাত্মক বা উসকানিমূলক ভাষা ব্যবহার করেন। এসবই তাঁরা করেন ভোটারদের কাছে নিজেদের পছন্দের প্রার্থী হিসেবে তুলে ধরার জন্য।

বাংলাদেশে সামনে যে নির্বাচন হতে যাচ্ছে, সেটা একেবারে নতুন এক পরিস্থিতিতে হতে যাচ্ছে।

একদিকে আছে ফ্যাসিবাদী সরকারের সময় ঘটে যাওয়া হত্যা, দুর্নীতি ও অন্য অপরাধগুলোর বিচার করা এবং যেসব রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ধ্বংস হয়েছে, সেগুলোকে আবার গড়ে তোলার জন্য প্রয়োজনীয় সংস্কার করা।

আরেক দিকে আছে ২০২৪ সালের জুলাই–আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে মানুষের যেসব আশা-আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছে, সেই চাওয়াগুলোর প্রতিফলন ঘটানো।
এই দুদিক মিলিয়েই এ নির্বাচনের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি হয়েছে।

সরকার যতই আলোচনার মাধ্যমে সমঝোতা তৈরির চেষ্টা করুক, আর রাজনৈতিক দলগুলো ভোট পেতে যত কৌশলই নিক না কেন; যদি সাধারণ মানুষের আসল সমস্যা ও চাওয়া-পাওয়া নিয়ে সমাজে খোলাখুলি আলোচনা না হয়, আর সেই বিষয়ে জনমত না গড়ে ওঠে, তাহলে সেগুলো উপেক্ষিত হওয়ার আশঙ্কা থেকেই যাবে।

সাধারণ মানুষের জন্য যেসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সামনে আনা দরকার, সেগুলোর মধ্যে হতে পারে: তরুণদের মেধা বিকাশ ও সাফল্যের সুযোগ সৃষ্টি, ভালো চাকরি ও নিজের ব্যবসা শুরু করার সুযোগ, নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে রেখে মানুষকে খেয়ে-পরে বেঁচে থাকার নিশ্চয়তা প্রতিষ্ঠা, চাঁদাবাজি আর ঘুষ বন্ধ করা, সন্ত্রাস ও ভয়ভীতির রাজত্ব যাতে না গড়ে ওঠে সে ব্যবস্থা করা, সবার জন্য ন্যায়বিচার পাওয়ার সুযোগ তৈরি, মানসম্পন্ন শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা, রাস্তাঘাটে যাতায়াতে দুর্ভোগ কমানো, বাসযোগ্য শহর গড়ে তোলা, আবাদি জমি ও পরিবেশ রক্ষা করা, নাগরিক অধিকার বাস্তবায়নে বাধা দূর করা এবং এমন এক রাষ্ট্রনীতি গড়া, যা সাধারণ মানুষ সহজেই বুঝতে পারে ও নিজের বলেই ভাবতে পারে।

এসব বিষয় যদি নির্বাচনের সময় গুরুত্ব না পায়, তাহলে ভোটের মানে শুধু ক্ষমতা দখলের খেলা হয়ে দাঁড়াবে—মানুষের জীবনের আসল সমস্যাগুলো উপেক্ষিত থেকেই যাবে।

কোনো কোনো সংসদ সদস্য পদপ্রার্থী এমনও ভাবতে পারেন—জনস্বার্থের এসব বিষয় (যেমন চাকরি, শিক্ষা, পরিবেশ, ন্যায়বিচার ইত্যাদি) নিয়ে কথা বলা বা জাতীয় পর্যায়ে ঐক্য ও জনকল্যাণের কথা বলার সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত ভোট পাওয়ার কী সম্পর্ক?
কারণ, তাঁকে তো আগে দল থেকে মনোনয়ন পেতে অনেক চেষ্টা করতে হয়, অনেক সময় টাকা খরচ করে এলাকায় প্রচার চালাতে হয়।

তাঁর মনে হতে পারে, এলাকার বেশির ভাগ মানুষ যদি যেকোনো কারণেই (দল, পরিচিতি বা প্রভাব দেখে) তাঁকে ভোট দেয়, তাহলে বড় বড় ইস্যু নিয়ে ভাবার দরকারই–বা কী? তাঁকে কে ঠেকাবে নির্বাচনে জিততে?

এভাবে ৩০০ সংসদীয় আসনের মধ্যে একটি দল টেনেটুনে ১৫১টি পেলেই তো সরকার গঠনে আর কোনো বাধা থাকছে না। সংসদীয় ব্যবস্থায় সরকারপ্রধান হতে প্রধানমন্ত্রীকে নির্বাচিত রাষ্ট্রপতির মতো জনপ্রিয়তার পরীক্ষায় পাস করে আসতে হয় না।

বহুদলীয় নির্বাচনে বিজয়ী দলের এক দিনের মোটামুটি জনপ্রিয়তা এবং প্রয়োজনে কায়দাকানুন করে সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রমাণের সুযোগ থাকলে নির্বাচনী ইশতেহারের মাধ্যমে ভালো ভালো প্রতিশ্রুতি দেওয়ার কী দরকার?

অধ্যাপক ইউনূস তাঁর ভাষণে জনগণকে আহ্বান জানিয়েছেন যাতে তারা বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক দলের প্রতিশ্রুতি নিশ্চিত করে। যেমন তিনি বলেন, ‘আপনারা তাঁদের কাছে অঙ্গীকার আদায় করে নেবেন যে তাঁরা সম্পূর্ণ সততা ও স্বচ্ছতার সঙ্গে দেশ পরিচালনা করবেন এবং সকল প্রকার দুর্নীতি, দলীয়করণ, টেন্ডারবাজি, সিন্ডিকেটবাজি, চাঁদাবাজি, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ইত্যাদি গণবিরোধী কাজ থেকে নিজেদের সম্পূর্ণভাবে মুক্ত রাখবেন।’

এর তাৎক্ষণিক উত্তর একেবারেই জানা নেই আমাদের। কারণ, গত দেড় দশকে ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগ ও পরিবেশ না থাকায়, এবারের ভোটাররা কেমন আচরণ করবে তা আগেই বলা যাচ্ছে না। ২০০১ সালের পর প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া প্রজন্মসহ সর্বসাম্প্রতিক ভোটারদের মনোভাব সম্পর্কেও আমাদের তেমন কোনো ধারণা নেই।

ধরা যাক, কোনো প্রার্থী বা দল নির্বাচন জিততে ইশতেহার বা ভোটারদের একগাদা প্রতিশ্রুতি দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করল না, তাতে সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে নতুন প্রজন্ম কি বিনা প্রত্যাশা ও আশ্বাসে ভোট দিয়ে দেবেন? আপনি বা আপনারা সরকারি দলে গেলে বিরোধী পক্ষ নিজস্ব রাজনীতির তাগিদেই কি জন-আকাঙ্ক্ষা তুলে ধরে মাঠে নামবে না?

আরও পড়ুনপ্রধান উপদেষ্টার ঘোষণায় নির্বাচনের সময়সীমা নিয়ে বিএনপির কেন ‘না’০৭ জুন ২০২৫

একটি দেশের মানুষ যেমন ধরনের নেতা বেছে নেয়, তেমনি নির্বাচনের আগের পরিবেশও অনেক কিছু বলে দেয়—এই নির্বাচন কতটা ভালো বা খারাপ হতে যাচ্ছে। ভোট মানে শুধু ভোটের দিন নয়—এর মধ্যে পড়ে প্রার্থী কে হবেন, জনগণ কেমন করে অংশ নেবে, প্রচার চালানো হবে কেমন করে, ভোট দেওয়ার প্রক্রিয়া কী হবে এবং শেষ পর্যন্ত কেমন প্রতিনিধিরা নির্বাচিত হচ্ছেন। পুরো এই প্রক্রিয়াই সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হওয়ার নাম ভোট।

১৯৯০ সালের গণ–অভ্যুত্থানের পর অনুষ্ঠিত ১৯৯১ সালের নির্বাচনে জন-আকাঙ্ক্ষা ও তিন জোটের রূপরেখার চাপ ছিল প্রধান দুই প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি ও আওয়ামী লীগের ওপর। সেটি ছিল ইতিহাসের অন্যতম গ্রহণযোগ্য নির্বাচন এবং সংসদও ছিল প্রাণবন্ত।

নেতিবাচক দৃষ্টান্তও আছে। ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ জোটের নির্বাচনী সংগীত এতটাই কর্কশ ও বিরক্তিকর ছিল যে মনে হচ্ছিল, জনগণকে বার্তা দেওয়া হচ্ছে যেন তারা ভোটকেন্দ্রেই না যায়। আগের রাতে ব্যালট বাক্স বোঝাই করায় সেই নৈশকালীন নির্বাচনে সত্যিই মানুষের ভোটের প্রয়োজন পড়েনি।

এবার ভালো একটি নির্বাচন করতে হলে অবশ্যই অন্তর্বর্তী সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বৃহত্তর জাতীয় ইস্যুতে ঐকমত্য থাকতে হবে।

তাই বলে নির্বাচকমণ্ডলীকে বাদ দিয়ে কোনো আয়োজন করা হলে তা টেকসই বা গ্রহণযোগ্য হবে ভাবাটা বরং হবে পতিত শেখ হাসিনার পরাজিত চিন্তা।

অধ্যাপক ইউনূস সরকারের উদ্যোগে নেওয়া সংস্কার কার্যক্রমে জন-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন আছে, কিন্তু সংস্কারের প্রতিশ্রুতি রাজনৈতিক দলের ইশতেহারে স্থান না পেলে সেগুলো কার্যকর হওয়ার সম্ভাবনা কমে যাবে।

জন-আকাঙ্ক্ষাকে পাশ কাটিয়ে দলও চূড়ান্তভাবে ভালো ফল পাবে, সে নিশ্চয়তা কম। কারণ, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় জনগণ ভোটের দিন বা ৫ আগস্টের মতো পরিস্থিতিতে চূড়ান্ত খেলোয়াড় হিসেবে আবির্ভূত হয়।

অধ্যাপক ইউনূস তাঁর ভাষণে জনগণকে আহ্বান জানিয়েছেন যাতে তারা বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক দলের প্রতিশ্রুতি নিশ্চিত করে। যেমন তিনি বলেন, ‘আপনারা তাঁদের কাছে অঙ্গীকার আদায় করে নেবেন যে তাঁরা সম্পূর্ণ সততা ও স্বচ্ছতার সঙ্গে দেশ পরিচালনা করবেন এবং সকল প্রকার দুর্নীতি, দলীয়করণ, টেন্ডারবাজি, সিন্ডিকেটবাজি, চাঁদাবাজি, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ইত্যাদি গণবিরোধী কাজ থেকে নিজেদের সম্পূর্ণভাবে মুক্ত রাখবেন।’

অবশ্য আমাদের দেশে জনগণের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ মতামত গ্রহণের কোনো প্রাতিষ্ঠানিক আয়োজন নেই বললেই চলে—রাজনৈতিক দল, এমনকি সরকারেরও না।
আসলে পশ্চিমের প্রতিনিধিত্বশীল গণতন্ত্রেও জনগণ নিজেরা সরাসরি শাসন করে না; শাসন করে একদল মানুষ—জনগণের নামে, জনগণের পক্ষে।

তাই জনগণের প্রতিনিধিদের সুশাসক বা রাষ্ট্র পরিচালনার সুব্যবস্থাপক হয়ে উঠতে রপ্ত করতে হয় গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি। শখ করে হলেও জনগণের বোঝা মাথায় নিতে হয়, পরার্থপরতায়।

এবারের বাংলাদেশে সংস্কার ও ঐকমত্য এবং গণমানুষের রাজনৈতিক এজেন্ডা মানাই হচ্ছে সেই বোঝা।

পুরো জনগণ পল্টন ময়দানে বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লাইভে এসে সমবেত কণ্ঠে বলবে না যে এই ১০০টি তাদের দাবি, যদিও শত আকাঙ্ক্ষা রয়েছে তাদের।
তবে যেকোনো দল চাইলে জনগণের দ্বারে দ্বারে গিয়ে তাদের কথা শুনতে ও তালিকাভুক্ত করতে পারে, তাদের কল্যাণে কর্মসূচি নেওয়ার স্বার্থে। ২০২৬ সালের নির্বাচন সেই সুযোগ তৈরি করেছে।

আগামী জুলাই–আগস্ট মাসে যখন বিপ্লবের বর্ষপূর্তি পালন করা হবে, তখন সরকার, রাজনৈতিক দল এবং অন্যান্য গোষ্ঠী জনগণের সঙ্গে যৌথ সংলাপের আয়োজন করতে পারে। তাতে নির্বাচন নিয়ে, নির্বাচনের আগেই জনগণের চিন্তাভাবনা ও প্রত্যাশা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যেতে পারে।

আজকের নতুন বাস্তবতায় নতুন করে নিজেদের মনে করিয়ে দেওয়া জরুরি যে গণতান্ত্রিক সমাজে লেকচার দেওয়া নয়, গণমুখী রাজনৈতিক দলের কাজ হচ্ছে জাতীয় ইস্যু ও জনমত বুঝে জনকল্যাণের প্রতিশ্রুতি নিয়ে জনগণের দরবারে হাজির হওয়া।

খাজা মাঈন উদ্দিন সাংবাদিক

(মতামত লেখকের নিজস্ব)

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: গণত ন ত র ক সরক র র ব যবস থ জনগণ র প রক র র জন য পর ব শ ইউন স

এছাড়াও পড়ুন:

জুলাই সনদে আমাদের যে সম্মতি সেটি আইনের ঊর্ধ্বে: সালাহউদ্দিন

জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি চায় জামায়াতে ইসলামী, এনসিপি, ইসলামী আন্দোলনসহ বেশির ভাগ রাজনৈতিক দল। তবে এটিকে আইনি ভিত্তি দেওয়ার বিষয়ে একমত নয় বিএনপি। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘জনগণের সার্বভৌম এখতিয়ারের ভিত্তিতেই আমরা এই ঘোষণাপত্রকে বাস্তবায়নের অঙ্গীকার করছি। সেটা আমরা প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি, অঙ্গীকারবদ্ধ হয়েছি। এর চেয়ে বড় জাতীয় সম্মতি আর নেই। এটা আইনের ঊর্ধ্বে। এটা জনগণের অভিপ্রায়। এটা সার্বভৌম ব্যাপারের কাছাকাছি হয়ে গেছে।’

আজ বৃহস্পতিবার ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের দ্বিতীয় ধাপের সংলাপের ২৩তম দিনের বিরতিতে সাংবাদিকদের এ কথাগুলো জানান সালাহউদ্দিন।

জাতীয় ঐকমত্য কমিশন কর্তৃক জুলাই জাতীয় সনদ-২০২৫ নামে যে খসড়া বিএনপির কাছে পাঠানো হয়েছে, সেখানে বাক্যগত কিছু অসামঞ্জস্যতা ছিল বলে জানান সালাহউদ্দিন আহমদ। তিনি বলেন, ‘সেগুলো আমরা সংশোধন করেছি। সনদে প্রস্তাব আছে সরকার গঠনের দুই বছরের মধ্যে এই অঙ্গীকার ও প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করার জন্য। আমরা এটার সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত। তারা বলেছিল এই প্রতিশ্রুতিগুলো পালনের জন্য, সংবিধানে এবং বিভিন্ন আইনে, বিধিবিধানে। সেখানে যা পরিবর্তন করতে হবে, সে বিষয়ে প্রতিশ্রুতি দিতে হবে। আমরা প্রতিশ্রুতিও দিয়েছি।’

সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘এই সনদে শুধু কমিশন নয়, সব রাজনৈতিক দল সই করবে। এটি একটি জাতীয় ঐকমত্য। এটি জনগণের সার্বভৌম অভিপ্রায়। এটি আইনের চেয়েও বড়, এটি একধরনের “লেজিটিমেট এক্সপেকটেশন অব দ্য পিপল”। জনগণের এই প্রত্যাশা সংবিধানের চতুর্থ তফসিলে যুক্ত করার জন্য আমরা অঙ্গীকার করেছি।’ তিনি বলেন, ‘গণ–অভ্যুত্থান ও ছাত্র আন্দোলনের পথ ধরে এই ঘোষণাপত্র এসেছে। সেটার বৈধতা আমরা সাংবিধানিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি দেব। এটাকে যদি আমরা আইনে ভিত্তি না বলি তাহলে কোনটাকে বলব?’

সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘আমরা প্রস্তাব করেছি উচ্চকক্ষ আইন পর্যালোচনা ও সুপারিশের কাজ করবে, কিন্তু কোনোভাবেই তারা সংবিধান সংশোধনের এখতিয়ার পাবে না।’ তিনি বলেন, ‘উচ্চকক্ষের সদস্যরা সরাসরি নির্বাচিত না হওয়ায় তাঁদের মাধ্যমে সংবিধান সংশোধনের চিন্তা গণতান্ত্রিক চেতনাবিরোধী। সংবিধান সংশোধনের এখতিয়ার কেবল সার্বভৌম জনগণের দ্বারা নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের হাতে থাকা উচিত।’

উচ্চকক্ষ ও নিম্নকক্ষের যৌথভাবে পাস হওয়া আইনের মধ্য দিয়ে একটি শেয়ারড লেজিসলেটিভ প্রসেস গড়ে ওঠার প্রস্তাব দলের পক্ষ থেকে দেওয়া হয়েছে বলে বিএনপির এই নেতা জানান। তিনি আরও বলেন, ‘উচ্চকক্ষ আইন পর্যালোচনা করবে, সুপারিশ করতে পারবে, কিন্তু চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হবে নিম্নকক্ষে। তবে আমরা উচ্চকক্ষের মাধ্যমে সংবিধান সংশোধনের বিষয়টি দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করছি।’

বিএনপির এই নেতা বলেন, ‘আমরা দেখছি কিছু পক্ষ সংবিধান সংশোধনকে কঠিনতর করতে পিআর পদ্ধতির মাধ্যমে অনির্বাচিত বা পরোক্ষভাবে নির্বাচিত সদস্যদের নিয়ে উচ্চকক্ষে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করতে চাইছে। এটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।’

৭০ অনুচ্ছেদ বিষয়ে সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘আমরা আগেই প্রস্তাব করেছিলাম, ৭০ অনুচ্ছেদে কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া সংসদ সদস্যদের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে স্বাধীনভাবে ভোট দেওয়ার অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। সেই প্রস্তাব আজ গৃহীত হয়েছে। ফলে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে এমপিরা দলীয় চাপে থাকবেন না, গোপন ব্যালটে স্বাধীনভাবে ভোট দেবেন। যদি উচ্চ ও নিম্নকক্ষ দুটিই থাকে, তাহলে উভয় কক্ষের সদস্যরা যৌথভাবে গোপন ব্যালটে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন করবেন।’

সালাহউদ্দিন আহমদ জানান, সংবিধানের ৪৮(৩) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, রাষ্ট্রপতি বর্তমানে শুধু প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান বিচারপতিকে স্বাধীনভাবে নিয়োগ দিতে পারেন। তবে এ ক্ষমতার বাইরে রাষ্ট্রপতির আরও কিছু দায়িত্ব থাকা উচিত বলে বিএনপি প্রস্তাব দিয়েছে। আলোচনার পর তা প্রকাশ করা হবে।

সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুতে সংসদে একটি মধ্যবর্তী বিধান অন্তর্ভুক্ত করা যায় কি না, তা নিয়ে আলোচনা চলছে এবং কমিশন এ বিষয়ে একটি সিদ্ধান্ত দেবে।

এ ছাড়া মৌলিক অধিকার–সংক্রান্ত আলোচনাও এখনো চলছে। তিনি বলেন, ‘আমরা চিন্তা করছি বিদ্যমান মৌলিক অধিকারের সঙ্গে আধুনিক সময়ের আলোকে কিছু অধিকার যেমন ইন্টারনেটের অধিকার যুক্ত করা যায় কি না। তবে মৌলিক অধিকার একবার সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হলে তা বাস্তবায়নের দায়িত্ব রাষ্ট্রের। কারণ, সংবিধানের ২৬ থেকে ৪৭ অনুচ্ছেদে থাকা অধিকারগুলো সেলফ এনফোর্সেবল এবং ৪৪ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী নাগরিকেরা তা প্রয়োগে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে মামলা করতে পারেন। তাই অত্যন্ত সচেতনভাবে নতুন কোনো অধিকার সংযোজন করতে হবে।’

সালাহউদ্দিন বলেন, ‘পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে গৃহীত রাষ্ট্রের মূলনীতিগুলোর সঙ্গে ঐকমত্য কমিশনের প্রস্তাবিত বাক্যটি যুক্ত করার ক্ষেত্রে আমরা একমত। এতে বলা হয়েছে—সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক ন্যায়বিচার, গণতন্ত্র, ধর্মীয় স্বাধীনতা ও সম্প্রীতি বজায় রাখা। তবে কিছু দলের আপত্তি থাকায় এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত পরে আসবে।’

আজকের আলোচনায় অংশ নিয়েছে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, এনসিপি, ইসলামী আন্দোলন, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), গণসংহতি আন্দোলনসহ ৩০টি রাজনৈতিক দল।

প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী (জাতীয় ঐকমত্য কমিশন) মনির হায়দারের সঞ্চালনায় বৈঠকে উপস্থিত আছেন কমিশনের সদস্য সফর রাজ হোসেন, বিচারপতি এমদাদুল হক, বদিউল আলম মজুমদার, ইফতেখারুজ্জামান ও আইয়ুব মিয়া।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • জুলাই সনদে আমাদের যে সম্মতি সেটি আইনের ঊর্ধ্বে: সালাহউদ্দিন
  • জুলাই আন্দোলনকে মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে জড়াবেন না: টুকু
  • সবাই অপেক্ষা করছে একটা নির্বাচনের জন্য
  • সরকারের ভুল সিদ্ধান্তে দেশে ফ্যাসিবাদ, উগ্রবাদ মাথাচাড়া দিতে পারে: তারেক রহমান
  • সরকারের একটি অংশ অপকৌশলের আশ্রয় নিচ্ছে: তারেক রহমান
  • ট্রাম্পের প্রতি মার্কিন জনগণের সমর্থন ৪০ শতাংশে ঠেকেছে
  • ফিলিস্তিনি জনগণকে গণহত্যা থেকে রক্ষায় পররাষ্ট্র উপদেষ্টার আহ্বান
  • জাতিসংঘে সম্মেলনের ফাঁকে বাংলাদেশ-পাকিস্তান বৈঠক, ফিলিস্তিন ইস্যুতে উদ্বেগ
  • ফিলিস্তিনি জনগণকে গণহত্যা থেকে রক্ষা করতে পররাষ্ট্র উপদেষ্টার আহ্বান
  • বাঘ রক্ষায় সুন্দরবনের চারপাশে হবে সুরক্ষাবলয়: পরিবেশ উপদেষ্টা