ঝুঁকিতে এলএনজি আমদানি, বাড়তে পারে গ্যাস–সংকট
Published: 21st, June 2025 GMT
দেশে গ্যাসের উৎপাদন টানা কমছে। তাই ভরসা বাড়ছে আমদানি করা তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) ওপর। বর্তমানে বিদ্যমান গ্যাসের চাহিদার ৩০ শতাংশের বেশি পূরণ করছে এলএনজি। এলএনজির দাম বাড়ছে বিশ্ববাজারে। ইরান-ইসরায়েল সংঘাতের কারণে মধ্যপ্রাচ্যে অস্থিরতা বিরাজ করছে। এতে এলএনজি আমদানি ব্যাহত হতে পারে। এটি হলে দেশে গ্যাসের সংকট বেড়ে যাবে।
বাংলাদেশ তেল, গ্যাস, খনিজ সম্পদ করপোরেশন (পেট্রোবাংলা) সূত্র বলছে, দিনে গ্যাসের চাহিদা ৩৮০ কোটি ঘনফুট। ৩০০ কোটি ঘনফুট সরবরাহ পেলে রেশনিং করে (এক খাতে কমিয়ে, আরেক খাতে বাড়ানো) পরিস্থিতি সামাল দেওয়া হয়। দিনে এখন সরবরাহ হচ্ছে ২৭০ থেকে ২৮০ কোটি ঘনফুট। ২৯০ কোটি ঘনফুট সরবরাহের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। দেশে শিগগিরই উৎপাদন বৃদ্ধির সম্ভাবনা নেই। এর মধ্যে এলএনজি কমলে ভুগতে হবে বিদ্যুৎ, আবাসিক ও শিল্প খাতকে।
বিরূপ আবহাওয়ায় সমুদ্র উত্তাল থাকায় নতুন জাহাজ থেকে এলএনজি নেওয়া যায়নি। এতে এলএনজি সরবরাহ কমতে থাকে গত বুধবার থেকে। বুধ ও বৃহস্পতিবার ঢাকা ও চট্টগ্রামের গ্রাহকেরা ভয়াবহ গ্যাস-সংকটে ভুগেছেন। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় এলএনজি সরবরাহ বৃদ্ধির পর পরিস্থিতির উন্নতি হতে থাকে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এলএনজি ছাড়া চাহিদার কাছাকাছি গ্যাস সরবরাহ ধরে রাখা যাবে না। তাই মধ্যপ্রাচ্যের সংঘাত বিবেচনায় নিয়ে এলএনজির নতুন উৎস খুঁজে বের করা উচিত।
চলতি বছর মোটামুটি চাহিদামতো গ্যাস সরবরাহের পরিকল্পনা নিয়ে কাজ শুরু করেছে পেট্রোবাংলা। সংস্থাটির দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা বলছেন, দেশে আসা এলএনজির প্রায় পুরোটাই আসে মধ্যপ্রাচ্য থেকে। এর মধ্যে বেশির ভাগ আসে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির আওতায়। তাই চাইলেই বিকল্প উৎস তৈরি করা সম্ভব নয়। এ ছাড়া দাম কিছুটা বাড়লেও খোলাবাজার থেকে এলএনজি কেনা হচ্ছে পরিকল্পনা অনুসারে। সংঘাত দীর্ঘ হলে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন কঠিন হয়ে যাবে। ইরানের হরমুজ প্রণালি বন্ধ হলে এলএনজি সরবরাহ ধরে রাখা কঠিন হবে। মধ্যপ্রাচ্যের সংঘাত দ্রুত থেমে যাওয়ার আশায় আছেন তাঁরা।
বাংলাদেশ তেল, গ্যাস, খনিজ সম্পদ করপোরেশন (পেট্রোবাংলা) সূত্র বলছে, দিনে গ্যাসের চাহিদা ৩৮০ কোটি ঘনফুট। ৩০০ কোটি ঘনফুট সরবরাহ পেলে রেশনিং করে (এক খাতে কমিয়ে, আরেক খাতে বাড়ানো) পরিস্থিতি সামাল দেওয়া হয়। দিনে এখন সরবরাহ হচ্ছে ২৭০ থেকে ২৮০ কোটি ঘনফুট।পেট্রোবাংলার এক প্রতিবেদন বলছে, জুন থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে দেশীয় গ্যাসক্ষেত্রগুলো থেকে দিনে ১৮৫ কোটি ঘনফুট গ্যাস উৎপাদন করা হবে। কিন্তু জুনেই এটি নেমে এসেছে ১৮২ কোটি ঘনফুটে। দেশের সবচেয়ে বড় গ্যাসক্ষেত্র তিতাস, বিবিয়ানা থেকে উৎপাদন কমছে নিয়মিত। মৌলভীবাজার, জালালাবাদসহ বেশ কিছু গ্যাসক্ষেত্র থেকেও সক্ষমতার চেয়ে অনেক কমে গেছে উৎপাদন।
পেট্রোবাংলার কর্মকর্তারা বলছেন, দেশে একসময় দিনে ২৭০ কোটি ঘনফুট গ্যাস উৎপাদন হতো। গ্যাসের মজুত কমে আসায় উৎপাদন ধরে রাখা যাচ্ছে না। সামনের দিনগুলোতে এটি আরও কমতে পারে। নতুন কূপ করে যতটুকু উৎপাদন বাড়ানো হচ্ছে, তার চেয়ে বেশি কমে যাচ্ছে পুরোনো কূপের উৎপাদন।
জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের সচিব মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, প্রস্তাবিত বাজেটে এলএনজির আমদানি শুল্ক প্রত্যাহার করায় সাত হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় হতে পারে। তাই বাড়তি এলএনজি আমদানির পরিকল্পনা নেওয়া হয়। ইরান–ইসরায়েল সংঘাত উদ্বেগ তৈরি করেছে, দাম বেশি বেড়ে গেলে কিছুটা কমতে পারে আমদানি। তবে ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া থেকে আনার চিন্তা করা হচ্ছে। বাহরাইনের সঙ্গে আলোচনা চলছে।
দেশের সবচেয়ে বড় গ্যাসক্ষেত্র তিতাস, বিবিয়ানা থেকে উৎপাদন কমছে নিয়মিত। মৌলভীবাজার, জালালাবাদসহ বেশ কিছু গ্যাসক্ষেত্র থেকেও সক্ষমতার চেয়ে অনেক কমে গেছে উৎপাদন।দাম বাড়ছে এলএনজির
২০১৮ সাল থেকেই গ্যাসের উৎপাদন কমতে থাকে। ঘাটতি পূরণে এলএনজি আমদানির দিকে ঝুঁকে যায় গত আওয়ামী লীগ সরকার। কক্সবাজারের মহেশখালীতে ভাসমান দুটি টার্মিনালের মাধ্যমে এলএনজি সরবরাহ করা হয় গ্যাসের পাইপলাইনে। পেট্রোবাংলার নির্দেশে নিয়মিত এলএনজি আমদানি করে রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস কোম্পানি লিমিটেড (আরপিজিসিএল)। দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির আওতায় কাতারের রাস গ্যাস ও ওমান ট্রেডিং ইন্টারন্যাশনাল থেকে এলএনজি আনছে আরপিজিসিএল। ২০১৮ সালের এপ্রিলে দেশে প্রথম এলএনজি কার্গো (জাহাজ) আসে কাতার থেকে। আর ওমান থেকে প্রথম সরবরাহ আসে ২০১৯ সালে। এর বাইরে চাহিদা বুঝে দরপত্রের মাধ্যমে খোলাবাজার থেকে এলএনজি কেনা হয়।
পেট্রোবাংলার প্রতিবেদন বলছে, চলতি বছর মোট ১১৫টি এলএনজি কার্গো জাহাজ আনার অনুমোদন দিয়েছে জ্বালানি বিভাগ। তবে আবহাওয়া ও টার্মিনালের রক্ষণাবেক্ষণ বিবেচনায় ১০৯টি জাহাজ আনার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। চুক্তির আওতায় ওমান ও কাতার থেকে ৫৬টি এলএনজি কার্গো আসার কথা রয়েছে। এর মধ্যে ২৩টি জাহাজ এসেছে। বছরের বাকি সময়ে ৩৩টি জাহাজ আসার কথা। ১২ জুন থেকে আগস্টের মধ্যেই আসার কথা ১৬টি। হরমুজ প্রণালি বন্ধ হলে আবুধাবি হয়ে বিকল্প পথে এ জাহাজ আনতে হবে। এতে পরিবহন খরচ বেড়ে যাবে। তবে সংঘাত মধ্যপ্রাচ্যে ছড়িয়ে পড়লে ওমান ও কাতার থেকে এলএনজি আসাটা কঠিন হয়ে যাবে। বিশ্ববাজারে তেলের দাম বাড়তে থাকায় চুক্তিতে থাকা সূত্র অনুসারে এ দুটি দেশে থেকে আনা এলএনজির দামও বাড়ছে।
পেট্রোবাংলার পরিকল্পনা অনুসারে খোলাবাজার থেকে এ বছর কেনা হবে ৫৩টি এলএনজি কার্গো। এর মধ্যে ২২টি কার্গো চলে এসেছে। বাকি সময়ে ৩১টি কার্গো আনার কথা। পেট্রোবাংলার একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, গত এপ্রিলে বকেয়া বিলের পুরোটা শোধ করে এবার খুবই ভালো প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। প্রয়োজনে অবস্থা বুঝে আরও ৬টি কার্গো বাড়তি আনারও পরিকল্পনা আছে। গত মে মাসে একটি এলএনজি কার্গো কেনা হয়েছে প্রতি ইউনিট ১১ ডলার ১৭ সেন্টে। আর সবশেষ চলতি সপ্তাহে একটি এলএনজি কার্গো চূড়ান্ত করা হয়েছে প্রতি ইউনিট ১৪ ডলার ৬৫ সেন্টে। মধ্যপ্রাচ্যে সংঘাতের কারণে বিশ্ববাজারে দাম বাড়তে থাকলে চড়া দামে এলএনজি কিনতে হতে পারে।
এর আগে ২০২২ সালে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর সর্বোচ্চ ৩৬ ডলারে এলএনজি কিনেছিল বাংলাদেশ। ওই বছর বিশ্ববাজারে এলএনজির দাম ৬০ ডলারে উঠে যায়। ডলার-সংকটে পড়ে ওই বছরের জুলাই থেকে টানা সাত মাস খোলাবাজারের এলএনজি কেনা বন্ধ রাখে গত আওয়ামী লীগ সরকার। এতে গ্যাসের সংকট তৈরি হয়, কমে যায় বিদ্যুৎ উৎপাদন। ঘোষণা দিয়ে লোডশেডিং করা হয় ওই বছর।
বিকল্প উৎসে বাড়বে প্রতিযোগিতা
গ্যাস-সংকটে দীর্ঘদিন ধরে কারখানায় উৎপাদন ধরে রাখতে হিমশিম খাচ্ছেন শিল্পমালিকেরা। তাঁদের গ্যাস সরবরাহ দিতেই আমদানি বাড়ানোর পরিকল্পনা নেয় সরকার। জুন থেকে আগস্ট পর্যন্ত সময়ে দিনে এলএনজি থেকে ১০৫ কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহের পরিকল্পনা করে পেট্রোবাংলা। এখন সংঘাতের কারণে আমদানি ব্যাহত হলে চাহিদার তুলনায় সরবরাহ অনেক কমে যাবে।
বৈশ্বিক বিভিন্ন গবেষণা সংস্থার তথ্য বলছে, মিসরে পাইপলাইনে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ রেখেছে ইসরায়েল, এতে দেশটিতে সংকট তৈরি হয়েছে। তারা এখন পূর্ণ সক্ষমতায় এলএলজি আমদানি করছে। নতুন করে আরও টার্মিনাল নির্মাণের কাজ চলছে। ইসরায়েলের সরবরাহ বন্ধ থাকলে মিসর এলএনজি আমদানি বাড়াবে। হরমুজ প্রণালি দিয়ে বিশ্বের ২০ শতাংশ এলএনজি পরিবহন করা হয়। এ পথে সবচেয়ে বেশি এলএনজি নেয় চীন। এ প্রণালি বন্ধ হলে নতুন উৎসের দিকে ঝুঁকবে চীনসহ বেশ কিছু দেশ। এ ক্ষেত্রে অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাষ্ট্র উৎপাদন বাড়ালে এলএনজির সরবরাহ বাড়তে পারে। তবে বাজারে প্রতিযোগিতা বেড়ে যাওয়ায় এলএনজির দাম বেড়ে যাবে।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার জ্বালানিবিষয়ক বিশেষ সহকারী ম তামিম প্রথম আলোকে বলেন, গ্যাস-সংকট এড়াতে বিকল্প উৎসের সন্ধান করা উচিত সরকারের। অস্ট্রেলিয়া, ইন্দোনেশিয়া বিকল্প উৎস হতে পারে।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: গ য স সরবর হ এলএনজ র দ ম ব শ বব জ র সরবর হ ব ইসর য় ল সরক র প রথম আমদ ন ঘনফ ট
এছাড়াও পড়ুন:
শাহজীবাজার তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্রে আবার অগ্নিকাণ্ড
হবিগঞ্জের মাধবপুর উপজেলার শাহজীবাজার তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্রে আবার আগুন লেগেছে। এতে জেলার বিভিন্ন স্থানে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রয়েছে।
সোমবার (৪ আগস্ট) দুপুর সোয়া ১টার দিকে জাতীয় গ্রিডের ‘টি আর-টু’ ব্রেকারে আগুন লাগে। বিষয়টি নিশ্চিত করেন বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) উপসহকারী প্রকৌশলী চয়ন কান্তি সেন।
চয়ন কান্তি সেন জানান, দুদিন আগের আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত যন্ত্রাংশ সোমবার (৪ আগস্ট) সকালে পুরোপুরি মেরামত করা হয়েছিল। দুপুরে আবার আগুন লাগে। এতে জেলার বিভিন্ন এলাকায় বিদ্যুৎ বন্ধ রয়েছে।
৩১ জুলাই সন্ধ্যায় সুইচিং উপকেন্দ্রে বিস্ফোরণের পর আগুন ছড়িয়ে পড়ে দুটি সার্কিট ব্রেকার ও তিনটি ট্রান্সফরমারে। রাত সাড়ে ৮টার মধ্যে আগুন নিয়ন্ত্রণে এলেও মেরামতে সময় লাগে প্রায় দুই দিন। এতে জেলার পাঁচ লাখ গ্রাহকের মধ্যে মাত্র ২৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ করা সম্ভব হয়, যেখানে প্রতিদিন প্রয়োজন ১২০ মেগাওয়াট। শহরে বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক হয় ২ আগস্ট রাত সাড়ে ৯টার দিকে। ঘটনার তদন্তে বিদ্যুৎকেন্দ্রের ব্যবস্থাপক মফিজুল ইসলামকে প্রধান করে একটি কমিটি করা হয়েছে।
নতুন অগ্নিকাণ্ড প্রসঙ্গে বিদ্যুৎকেন্দ্রের উপসহকারী প্রকৌশলী খাইরুল ইসলাম জানান, দমকল বাহিনী আগুন নিয়ন্ত্রণে এনেছে। বিস্তারিত পরে জানানো হবে।
ঢাকা/মামুন/বকুল