বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর বন্দরনগরী চট্টগ্রাম পাহাড়, নদী আর সমুদ্রবেষ্টিত এই নগরী যেমন প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে সমৃদ্ধ, তেমনি দিনে দিনে সেই সৌন্দর্য আজ হুমকির মুখে। পরিবেশের অন্যতম প্রধান শত্রু হয়ে উঠেছে প্লাস্টিকদূষণ।
প্লাস্টিক এখন আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ– খাবার প্যাকেট, পানির বোতল, বাজারের ব্যাগ সব কিছুর মধ্যেই রয়েছে প্লাস্টিকের অবাধ ব্যবহার। সাগর, নদী, খাল প্রকৃতির প্রতিটি অংশেই এখন প্লাস্টিকের আবর্জনার স্তূপ। চট্টগ্রামও এর ব্যতিক্রম নয়। জাতিসংঘ পরিবেশ কর্মসূচি (ইউএনইপি)-এর তথ্যমতে, প্রতিবছর বিশ্বে প্রায় ১৯ মিলিয়ন থেকে ২৩ মিলিয়ন টন প্লাস্টিক বর্জ্য জলজ পরিবেশে প্রবেশ করে, যা নদী, হ্রদ ও সমুদ্রকে ভয়াবহভাবে দূষিত করছে। এটি শুধু বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্যই নষ্ট করছে না; বরং জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর প্রকৃতির সক্ষমতাকেও দুর্বল করছে। এ দূষণ লাখো মানুষের জীবিকা, খাদ্যনিরাপত্তা ও সামাজিক স্থিতিশীলতাকে হুমকির মুখে ফেলছে। চট্টগ্রাম শহরের বাস্তবতা আরও উদ্বেগজনক। বহদ্দারহাট থেকে নিউমার্কেট, ফিরিঙ্গি বাজার থেকে পতেঙ্গা– সবখানেই চোখে পড়ে ফেলে রাখা প্লাস্টিক বোতল, শপিং ব্যাগ, চিপসের প্যাকেটসহ সিঙ্গেল ইউজড প্লাস্টিক।
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (চসিক) তথ্যমতে, প্রতিদিন এ শহরে গড়ে প্রায় তিন হাজার টন কঠিন বর্জ্য উৎপন্ন হয়। চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণা অনুসারে, এর মধ্যে প্রতিদিন প্রায় ২৪৯ টন প্লাস্টিক বর্জ্য তৈরি হয়, যার মধ্যে প্রায় ১৪০ টন সরাসরি ড্রেন, খাল ও নদীতে মিশে যায়। এর ফলে শহরে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হচ্ছে এবং কর্ণফুলী নদীর পলিথিন ও প্লাস্টিক স্তর ড্রেজিংয়ের ক্ষেত্রে বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে।
২০০২ সালের ১ মার্চ বাংলাদেশ সরকার পলিথিন উৎপাদন, বিপণন ও ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা জারি করে। এরপর ২০১০ সালে আরেকটি আইন করা হলেও বাস্তব প্রয়োগ ছিল দুর্বল। কিছু অভিযানে প্লাস্টিকের বিকল্প ব্যবহারে উৎসাহ দেওয়া হলেও, বেশির ভাগ উদ্যোগই ছিল ক্ষণস্থায়ী ও অসংগঠিত। চসিকও বিভিন্ন ওয়ার্ডে সচেতনতামূলক প্রচারণা চালিয়েছে, যা দীর্ঘমেয়াদি পরিবর্তন গঠনে সফল হয়নি। বিশেষজ্ঞদের মতে, পরিকল্পনা ও নাগরিক অংশগ্রহণের অভাবেই এসব উদ্যোগ টিকছে না।
এ হতাশার মধ্যেও কিছু আশাব্যঞ্জক উদ্যোগ দেখা দিয়েছে। ২০২২ সালে চসিক, ইউনিলিভার বাংলাদেশ ও ইপসার মধ্যে গঠিত ত্রিপক্ষীয় অংশীদারিত্বের মাধ্যমে শুরু হয় একটি উদ্ভাবনী প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা উদ্যোগ। চট্টগ্রামের ৪১টি ওয়ার্ডে এ উদ্যোগ ইতোমধ্যে উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলেছে।
এ পর্যন্ত শহরের মোট বর্জ্যের প্রায় ১০ শতাংশের সমান বর্জ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। পাঁচ হাজারেরও বেশি পরিচ্ছন্নতাকর্মী ও সংগ্রাহক এই উদ্যোগের মাধ্যমে সুরক্ষা, প্রশিক্ষণ ও অর্থনৈতিক অন্তর্ভুক্তির আওতায় এসেছেন। এক হাজার ৮২৭ জন কর্মীর জন্য চালু করা হয়েছে গ্রুপ ইন্স্যুরেন্স প্রোগ্রাম, যার আওতায় দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যুতে সর্বোচ্চ ৩ লাখ টাকা এবং চিকিৎসা, ডাক্তার ফি ও ওষুধ খরচের সুবিধাও যুক্ত করা হয়েছে। এ ছাড়া সচেতনতা তৈরিতে নেওয়া হয়েছে নানা উদ্যোগ। ১৫ হাজার পরিবার এবং ৭১টি স্কুলের সাত হাজার শিক্ষার্থীর মধ্যে উৎসস্থলেই বর্জ্য আলাদা করার বিষয়ে প্রচার চালানো হয়েছে।
ইউএনইপি-এর নির্বাহী পরিচালক ইনগার অ্যান্ডারসেন বলেন, ‘শুধু পুনর্ব্যবহারযোগ্য করলেই চলবে না; আমাদের দরকার কাঠামোগত ও প্রাতিষ্ঠানিক রূপান্তর।’ চসিক, ইউনিলিভার ও ইপসা এই দৃষ্টিভঙ্গিতেই কাজ করছে– একটি সার্কুলার ইকোনমি মডেল গড়ে তুলতে, যেখানে পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের জন্য তৈরি হচ্ছে নতুন সম্ভাবনা, সম্মান এবং জীবিকার সুযোগ। প্লাস্টিকদূষণ মোকাবিলায় শুধু সরকার বা সিটি করপোরেশন নয়, সমাজের প্রতিটি স্তরের একযোগে কাজ জরুরি। সুতরাং প্রশ্নটা শুধু স্বপ্নের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়– চট্টগ্রামকে প্লাস্টিকমুক্ত করা সম্ভব, যদি নাগরিক, প্রশাসন ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে সমন্বয় থাকে। সঠিক পরিকল্পনা, সদিচ্ছা ও ধারাবাহিক প্রয়োগ থাকলে এই স্বপ্ন একদিন বাস্তবে ধরা দেবে।
একটি প্লাস্টিকমুক্ত, পরিচ্ছন্ন, পরিবেশবান্ধব চট্টগ্রাম শুধু শহরবাসীর গর্ব নয়, বরং সমগ্র জাতিরই অহংকার হয়ে উঠতে পারে। প্রশ্ন হলো– আমরা কি সবাই মিলে সেই পরিবর্তনের অংশ হতে প্রস্তুত?
শেষ বর্ষ
সাংবাদিকতা বিভাগ
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ব যবহ র পর ব শ বর জ য
এছাড়াও পড়ুন:
হালনাগাদ ভোটার তালিকার খসড়া প্রকাশ: মোট ভোটার ১২ কোটি ৬১ লাখের বেশি
হালনাগাদ কার্যক্রম শেষে ২০২৫ সালের ভোটার তালিকার খসড়া প্রকাশ করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)।
হালনাগাদ কার্যক্রমের মাধ্যমে তালিকায় নতুন যুক্ত হচ্ছেন ৪৫ লাখ ৭১ হাজার ২১৬ জন ভোটার (২০০৭ সালের ১ জানুয়ারি বা তার আগে যাঁদের জন্ম)। পাশাপাশি তালিকা থেকে ২১ লাখ ৩২ হাজার ৫৯০ জন মৃত ভোটারের নাম বাদ দেওয়া হয়েছে। সব মিলিয়ে খসড়া তালিকা অনুযায়ী, এখন (৩০ জুন পর্যন্ত) দেশে মোট ভোটার ১২ কোটি ৬১ লাখ ৭০ হাজার ৯০০ জন।
আজ রোববার দুপুরে নির্বাচন কমিশন (ইসি) সচিবালয়ের সচিব আখতার আহমেদ খসড়া ভোটার তালিকার এ তথ্য সাংবাদিকদের সামনে তুলে ধরেন। হালনাগাদ কার্যক্রমের তথ্য একটি সম্পূরক তালিকায় সংশ্লিষ্ট সব উপজেলা/থানা নির্বাচন কমিশন কার্যালয়ে প্রকাশ করা হয়েছে।
খসড়া তালিকা নিয়ে কারও কোনো দাবি বা আপত্তি থাকলে তা আগামী ১২ দিনের মধ্যে জানাতে হবে। দাবি–আপত্তি নিষ্পত্তি শেষে ৩১ আগস্ট চূড়ান্ত ভোটার তালিকা প্রকাশ করা হবে।
হালনাগাদ কার্যক্রমে যেসব ভোটার অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে, তার মধ্যে পুরুষের চেয়ে নারীর সংখ্যা বেশি। এবার ২৭ লাখ ৭৬২ জন নারী ভোটারের নাম খসড়ায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। আর পুরুষ ভোটার অন্তর্ভুক্ত হচ্ছেন ১৮ লাখ ৭০ হাজার ২০৩ জন। হিজড়া পরিচয়ে অন্তর্ভুক্ত হচ্ছেন ২৫১ জন।
নির্বাচন কমিশন ইতিমধ্যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত সময়ের মধ্যে যাঁদের বয়স ১৮ বছর পূর্ণ হবে, তাঁদেরও ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হবে। তাঁরাও আগামী নির্বাচনে ভোট দিতে পারবেন। আগামী ৩১ অক্টোবর বা তারপরে তরুণ ভোটারদের সম্পূরক তালিকা প্রকাশ করা হবে। সব মিলিয়ে আগামী জাতীয় নির্বাচনে সারা দেশে ভোটারের সংখ্যা আরও বাড়বে।
আরও পড়ুনডিসেম্বরের প্রথমার্ধে ভোটের তফসিল, প্রবাসীদের জন্য পোস্টাল ভোট০৭ আগস্ট ২০২৫আরও পড়ুনভোটের প্রস্তুতি এগিয়ে নিচ্ছে নির্বাচন কমিশন০৬ আগস্ট ২০২৫