আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ অন্তর্বর্তী সরকারের নিষ্ক্রিয় ভূমিকায় দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা এবং সব মানুষের মানবাধিকার ও মর্যাদা সুরক্ষিত রাখার অঙ্গীকার প্রতিনিয়ত উদ্বেগজনকভাবে লঙ্ঘিত হচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন ৩০ জন নাগরিক। তাঁরা বলেছেন, ৮ থেকে ১০ মাস ধরেই ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলা ও এলাকায় মব ভায়োলেন্স বা উচ্ছৃঙ্খল জনতার সহিংসতার ঘটনা ঘটে চলেছে। কিন্তু এসব ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কঠোর কোনো আইনানুগ পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, এমন দৃষ্টান্ত প্রায় অনুপস্থিত। জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলাসহ যথাযথ আইনানুগ পন্থা অবলম্বন করা হলে হয়তো একটার পর একটা মব সহিংসতার ঘটনা ঘটত না।

আজ মঙ্গলবার গণমাধ্যমে যৌথ বিবৃতি পাঠিয়েছেন ওই ৩০ জন নাগরিক। বিবৃতিতে সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নূরুল হুদাকে মব ভায়োলেন্সের (উচ্ছৃঙ্খল জনতার সহিংসতা) দ্বারা শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করার নিন্দা এবং এ ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের দ্রুত শনাক্ত করে আইন অনুযায়ী কঠোর শাস্তি দেওয়ার দাবি জানানো হয়েছে। পাশাপাশি নূরুল হুদার বিরুদ্ধে অভিযোগেরও সুষ্ঠু তদন্ত ও দৃষ্টান্তমূলক জবাবদিহিসহ ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছেন ওই নাগরিকেরা।

বিবৃতিতে বলা হয়, সংবাদমাধ্যমে প্রচারিত সংবাদ থেকে জানা যায়, গত রোববার রাজধানীর উত্তরায় সাবেক সিইসি কে এম নূরুল হুদার বাসায় ঢুকে একদল লোক তাঁকে বের করে আনেন এবং জুতার মালা পরিয়ে দেন। এর আগে একটি রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে তাঁর বিরুদ্ধে একটি মামলা করা হয়। ঘটনাটির ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। পরে তাঁকে পুলিশ হেফাজতে নেওয়া হয় এবং দায়েরকৃত মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উপস্থিতিতে একদল উচ্ছৃঙ্খল লোক এই উন্মত্ত সহিংসতার ঘটনা ঘটিয়েছে। উল্লিখিত উন্মত্ত সহিংসতার অপরাধ এবং পূর্বাপর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ অপরাধীদের প্রতি সরকারের নমনীয় ভূমিকায় আমরা তীব্র ক্ষোভ ও ধিক্কার জানাই। এই সহিংসতায় জড়িত ব্যক্তিদের শাস্তি দেওয়ার পাশাপাশি সাবেক সিইসির বিরুদ্ধে অভিযোগের সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে দৃষ্টান্তমূলক জবাবদিহিসহ ন্যায়বিচার নিশ্চিতের দাবি জানাই।

৩০ জন নাগরিক বলেছেন, ‘সরকার যদিও একটি বিবৃতি দিয়ে ঘটনার নিন্দা জানিয়েছে এবং বলেছে যে দায়ীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কিন্তু হামলাকারী ও হেনস্তাকারীদের ছবি ও ভিডিও প্রকাশিত হওয়া সত্ত্বেও এখন পর্যন্ত দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ আমরা দেখছি না। মব ভায়োলেন্স বা উন্মত্ত সহিংসতার এই ঘটনা ৮ থেকে ১০ মাস ধরেই রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলা ও এলাকায় ঘটে চলেছে। কিন্তু এসব ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কঠোর কোনো আইনানুগ পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, এমন দৃষ্টান্ত প্রায় অনুপস্থিত। জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলাসহ যথাযথ আইনানুগ পন্থা অবলম্বন করা হলে হয়তো একটার পর একটা মব সহিংসতার ঘটনা ঘটত না। বেশির ভাগ মব সহিংসতার সঙ্গে ব্যক্তি বা গোষ্ঠীগত আক্রোশ ছাড়াও কোনো না কোনো রাজনৈতিক দল বা মতাদর্শের অনুসারীদের সম্পৃক্ততা থাকে। বড় ও প্রভাবশালী দলগুলোসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের দায়িত্বশীল নেতৃত্বের পক্ষ থেকে এমন অমানবিক ও মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী ঘটনার বিরুদ্ধে সোচ্চার ও বলিষ্ঠ ভূমিকা মানুষের প্রত্যাশা থাকলেও তারা সেই ভূমিকা না নেওয়ায় আমরা গভীরভাবে মর্মাহত ও ক্ষুব্ধ।’

একজন গুরুতর অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তিরও আইনি প্রক্রিয়ায় বিচার সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত মৌলিক মানবাধিকার এবং মানবিক মর্যাদার সুরক্ষা পাওয়ার পূর্ণ অধিকার বাংলাদেশের সংবিধান, জাতিসংঘের মানবাধিকারের ঘোষণাসহ সব আন্তর্জাতিক আইনে যে স্বীকৃত, সে বিষয়টিও স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়েছে বিবৃতিতে। বলা হয়েছে, কারও বিরুদ্ধে অপরাধ সংঘটনের অভিযোগ থাকলে আইনানুগ প্রক্রিয়া অনুসরণ করেই তাঁর বিচার করতে হবে। মব জাস্টিসের নামে মব সহিংসতা চালিয়ে কাউকে অসম্মানিত, ব্যক্তিগতভাবে অপমান করা জননিরাপত্তার জন্য হুমকিই শুধু নয়, তা একই সঙ্গে বিশ্বজনীনভাবে নাগরিক অধিকারের চরম লঙ্ঘন। চব্বিশের জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের অঙ্গীকার ছিল দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, ধর্ম-বর্ণ–শ্রেণি-পেশা-লিঙ্গনির্বিশেষে সব মানুষের মানবাধিকার ও মর্যাদা সুরক্ষিত রাখা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ সরকারের নিষ্ক্রিয় ভূমিকায় সেই অঙ্গীকার প্রতিনিয়ত উদ্বেগজনকভাবে লঙ্ঘিত হচ্ছে।

বিবৃতির শেষাংশে সরকার, প্রশাসন ও দেশের সব দায়িত্বশীল রাজনৈতিক দলের কাছে তিনটি দাবি তুলে ধরেছেন ৩০ জন নাগরিক। দাবিগুলোর একটি হলো সাবেক সিইসি কে এম নূরুল হুদাকে যারা শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত ও অসম্মান করেছে, ভিডিও ফুটেজ দেখে তাদের শনাক্ত করে যথাযথ ফৌজদারি আইনে তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নিয়ে আইন অনুযায়ী বিচার ও কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করা। এ ছাড়া সাবেক সিইসিসহ যাঁদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আছে বা ভবিষ্যতে থাকবে, তাঁদের আইনি বিধান মেনে যথাযথ প্রক্রিয়ায় ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা এবং শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করা, মানবিক মর্যাদা ক্ষুণ্ন করার বর্বর আচরণ রোধ করতে কঠোর আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি করা হয়। এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে সংবাদমাধ্যম, ছোট–বড় সব রাজনৈতিক দল, নাগরিক ও বুদ্ধিজীবী সমাজ, শ্রমিক ও পেশাজীবী সংগঠনসহ সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে সক্রিয় ও সোচ্চার হওয়া এবং মব সহিংসতার বিরুদ্ধে দেশব্যাপী সামাজিক সাংস্কৃতিক কর্মসূচি, কাউন্সেলিং ও ব্যাপক জনমত গঠনের জন্য জনসচেতনতামূলক উদ্যোগ নেওয়ার দাবি করা হয়।

বিবৃতিতে স্বাক্ষরকারীদের মধ্যে আছেন মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারপারসন সুলতানা কামাল, নিজেরা করির সমন্বয়ক খুশী কবির, টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান, নারীপক্ষের সদস্য শিরীন পারভীন হক, গণস্বাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধূরী, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম, সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জেড আই খান পান্না, আলোকচিত্রী শহিদুল আলম, ডা.

নায়লা জামান খান, লেখক ও গবেষক রেহনুমা আহমেদ, এএলআরডির নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা, বাংলাদেশ উইমেন্স লইয়ার্স এসোসিয়েশনের (বিএনডব্লিউএলএ) নির্বাহী পরিচালক সালমা আলী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সামিনা লুৎফা, জোবাইদা নাসরীন, সুমাইয়া খায়ের, রোবায়েত ফেরদৌস ও তাসনীম সিরাজ মাহবুব, খায়রুল চৌধুরী, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ফিরদৌস আজীম, কোস্ট ট্রাস্টের নির্বাহী পরিচালক রেজাউল করিম চৌধুরী, আইনজীবী সুব্রত চৌধুরী, নাগরিক উদ্যোগের প্রধান নির্বাহী জাকির হোসেন, মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান, মানবাধিকার কর্মী সাঈদ আহমেদ, গবেষক রেজানুর রহমান লেনিন, মানবাধিকার কর্মী দীপায়ন খীসা, বারসিকের পরিচালক পাভেল পার্থ, বেলা’র প্রধান নির্বাহী (ভারপ্রাপ্ত) তাসলিমা ইসলাম এবং কানাডার ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি গবেষক হানা শামস আহমেদ।

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: আইন ন গ প সরক র র ন রক ষ ক র অপর ধ ঘটন র

এছাড়াও পড়ুন:

তিন মাসের মধ্যে নির্বাচন সম্ভব, কারণ জনগণ এটি চায়: ফখরুল 

রাজনৈতিক সংকট সমাধানে তিন মাসের মধ্যে নির্বাচন সম্ভব বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।

তিনি বলেন, “জনগণই এখন নির্বাচন চায় এবং তারাই আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় সবচেয়ে বড় প্রহরীর ভূমিকা পালন করবে।” 

বুধবার (৬ আগস্ট) সকালে বিএনপি চেয়ারপারসনের গুলশান কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব কথা বলেন।

বিএনপির মহাসচিব বলেন, “১৯৯১ সালে একটি ছাত্র গণঅভ্যুত্থানের পরে নির্বাচন হয়েছিলো। তখন তিন মাসের মধ্যে নির্বাচন হয়েছে। এখন এই নির্বাচন আরো সম্ভব, কারণ জনগণ এটি চায়।” 

দেশের বর্তমান আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিতে নির্বাচন সম্ভব কি না, সাংবাদিকদের এমন এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “জনগণই আইনশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য সবচেয়ে বড় প্রহরী হয়ে দাঁড়াবে।”

তিনি বলেন, “আমরা ও পুরো জাতি মনে করে, দ্রুত নির্বাচনই একমাত্র পথ, যা দিয়ে আমরা বর্তমানে রাজনৈতিক সংকট থেকে উত্তরণ করে গণতান্ত্রিক উত্তরণ ঘটাতে পারি।” 

তিনি আরো বলেন, “প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মোহাম্মদ ইউনূস এখন পর্যন্ত যতগুলো কাজ করেছেন, তাতে তিনি প্রমাণ করেছেন, নির্বাচনকে সুষ্ঠু ও অবাধ করার জন্য উনি এমন কিছু করবেন না, যাতে করে নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হবে।” 

সংবাদ সম্মেলনে আরো উপস্থিত ছিলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ।

সংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, “গতকালের ঘোষণাপত্রে বলা হয়েছে পরবর্তী নির্বাচিত সংসদ সংবিধানের যাবতীয় সংস্কার-সংশোধনী বাস্তবায়ন করবে। এটিই বৈধ, আইনি ও সাংবিধানিক প্রক্রিয়া।”

ঢাকা/কেএন/ইভা 

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ২দিনে ৫ হত্যা, সরকার দায় এড়াতে পারে না: গণসংহতি আন্দোলন 
  • এক সপ্তাহে দেশজুড়ে যৌথ বাহিনীর অভিযানে আটক ১৩১
  • শেখ হাসিনা একদিন বিচারের মুখোমুখি হবেন: প্রেস সচিব
  • সরকারের চেষ্টা থাকবে সবচেয়ে ভালো নির্বাচন উপহার দেওয়া: প্রেস সচিব
  • নির্বাচনে ৪৭ হাজার কেন্দ্রে দেওয়া হবে বডি ক্যামেরা
  • নির্বাচনের আগে লটারির মাধ্যমে এসপি-ওসির পদায়ন হবে: স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা
  • ভোটের প্রস্তুতি এগিয়ে নিচ্ছে ইসি: সিইসি
  • তিন মাসের মধ্যে নির্বাচন সম্ভব, কারণ জনগণ এটি চায়: ফখরুল