সরকারের নিষ্ক্রিয়তায় মানবাধিকার লঙ্ঘন, ৩০ নাগরিকের বিবৃতি
Published: 24th, June 2025 GMT
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ অন্তর্বর্তী সরকারের নিষ্ক্রিয় ভূমিকায় দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা এবং সব মানুষের মানবাধিকার ও মর্যাদা সুরক্ষিত রাখার অঙ্গীকার প্রতিনিয়ত উদ্বেগজনকভাবে লঙ্ঘিত হচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন ৩০ জন নাগরিক।
মঙ্গলবার গণমাধ্যমে যৌথ বিবৃতি পাঠিয়েছেন ওই ৩০ জন নাগরিক। বিবৃতিতে সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নূরুল হুদাকে মব ভায়োলেন্সের (উচ্ছৃঙ্খল জনতার সহিংসতা) দ্বারা শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করার নিন্দা এবং এ ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের দ্রুত শনাক্ত করে আইন অনুযায়ী কঠোর শাস্তি দেওয়ার দাবি জানানো হয়েছে। পাশাপাশি নূরুল হুদার বিরুদ্ধে অভিযোগেরও সুষ্ঠু তদন্ত ও দৃষ্টান্তমূলক জবাবদিহিসহ ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছেন ওই নাগরিকেরা।
তাঁরা বলেছেন, ৮ থেকে ১০ মাস ধরেই ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলা ও এলাকায় মব ভায়োলেন্স বা উচ্ছৃঙ্খল জনতার সহিংসতার ঘটনা ঘটে চলেছে। কিন্তু এসব ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কঠোর কোনো আইনানুগ পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, এমন দৃষ্টান্ত প্রায় অনুপস্থিত। জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলাসহ যথাযথ আইনানুগ পন্থা অবলম্বন করা হলে হয়তো একটার পর একটা মব সহিংসতার ঘটনা ঘটত না।
বিবৃতিতে বলা হয়, সংবাদমাধ্যমে প্রচারিত সংবাদ থেকে জানা যায়, গত রোববার রাজধানীর উত্তরায় সাবেক সিইসি কে এম নূরুল হুদার বাসায় ঢুকে একদল লোক তাঁকে বের করে আনেন এবং জুতার মালা পরিয়ে দেন। এর আগে একটি রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে তাঁর বিরুদ্ধে একটি মামলা করা হয়। ঘটনাটির ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। পরে তাঁকে পুলিশ হেফাজতে নেওয়া হয় এবং দায়েরকৃত মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উপস্থিতিতে একদল উচ্ছৃঙ্খল লোক এই উন্মত্ত সহিংসতার ঘটনা ঘটিয়েছে। উল্লিখিত উন্মত্ত সহিংসতার অপরাধ এবং পূর্বাপর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ অপরাধীদের প্রতি সরকারের নমনীয় ভূমিকায় আমরা তীব্র ক্ষোভ ও ধিক্কার জানাই। এই সহিংসতায় জড়িত ব্যক্তিদের শাস্তি দেওয়ার পাশাপাশি সাবেক সিইসির বিরুদ্ধে অভিযোগের সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে দৃষ্টান্তমূলক জবাবদিহিসহ ন্যায়বিচার নিশ্চিতের দাবি জানাই।
৩০ জন নাগরিক বলেছেন, ‘সরকার যদিও একটি বিবৃতি দিয়ে ঘটনার নিন্দা জানিয়েছে এবং বলেছে যে দায়ীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কিন্তু হামলাকারী ও হেনস্তাকারীদের ছবি ও ভিডিও প্রকাশিত হওয়া সত্ত্বেও এখন পর্যন্ত দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ আমরা দেখছি না। মব ভায়োলেন্স বা উন্মত্ত সহিংসতার এই ঘটনা ৮ থেকে ১০ মাস ধরেই রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলা ও এলাকায় ঘটে চলেছে। কিন্তু এসব ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কঠোর কোনো আইনানুগ পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, এমন দৃষ্টান্ত প্রায় অনুপস্থিত। জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলাসহ যথাযথ আইনানুগ পন্থা অবলম্বন করা হলে হয়তো একটার পর একটা মব সহিংসতার ঘটনা ঘটত না। বেশির ভাগ মব সহিংসতার সঙ্গে ব্যক্তি বা গোষ্ঠীগত আক্রোশ ছাড়াও কোনো না কোনো রাজনৈতিক দল বা মতাদর্শের অনুসারীদের সম্পৃক্ততা থাকে। বড় ও প্রভাবশালী দলগুলোসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের দায়িত্বশীল নেতৃত্বের পক্ষ থেকে এমন অমানবিক ও মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী ঘটনার বিরুদ্ধে সোচ্চার ও বলিষ্ঠ ভূমিকা মানুষের প্রত্যাশা থাকলেও তারা সেই ভূমিকা না নেওয়ায় আমরা গভীরভাবে মর্মাহত ও ক্ষুব্ধ।’
একজন গুরুতর অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তিরও আইনি প্রক্রিয়ায় বিচার সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত মৌলিক মানবাধিকার এবং মানবিক মর্যাদার সুরক্ষা পাওয়ার পূর্ণ অধিকার বাংলাদেশের সংবিধান, জাতিসংঘের মানবাধিকারের ঘোষণাসহ সব আন্তর্জাতিক আইনে যে স্বীকৃত, সে বিষয়টিও স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়েছে বিবৃতিতে। বলা হয়েছে, কারও বিরুদ্ধে অপরাধ সংঘটনের অভিযোগ থাকলে আইনানুগ প্রক্রিয়া অনুসরণ করেই তাঁর বিচার করতে হবে। মব জাস্টিসের নামে মব সহিংসতা চালিয়ে কাউকে অসম্মানিত, ব্যক্তিগতভাবে অপমান করা জননিরাপত্তার জন্য হুমকিই শুধু নয়, তা একই সঙ্গে বিশ্বজনীনভাবে নাগরিক অধিকারের চরম লঙ্ঘন। চব্বিশের জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের অঙ্গীকার ছিল দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, ধর্ম-বর্ণ–শ্রেণি-পেশা-লিঙ্গনির্বিশেষে সব মানুষের মানবাধিকার ও মর্যাদা সুরক্ষিত রাখা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ সরকারের নিষ্ক্রিয় ভূমিকায় সেই অঙ্গীকার প্রতিনিয়ত উদ্বেগজনকভাবে লঙ্ঘিত হচ্ছে।
বিবৃতির শেষাংশে সরকার, প্রশাসন ও দেশের সব দায়িত্বশীল রাজনৈতিক দলের কাছে তিনটি দাবি তুলে ধরেছেন ৩০ জন নাগরিক। দাবিগুলোর একটি হলো সাবেক সিইসি কে এম নূরুল হুদাকে যারা শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত ও অসম্মান করেছে, ভিডিও ফুটেজ দেখে তাদের শনাক্ত করে যথাযথ ফৌজদারি আইনে তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নিয়ে আইন অনুযায়ী বিচার ও কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করা। এ ছাড়া সাবেক সিইসিসহ যাঁদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আছে বা ভবিষ্যতে থাকবে, তাঁদের আইনি বিধান মেনে যথাযথ প্রক্রিয়ায় ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা এবং শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করা, মানবিক মর্যাদা ক্ষুণ্ন করার বর্বর আচরণ রোধ করতে কঠোর আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি করা হয়। এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে সংবাদমাধ্যম, ছোট–বড় সব রাজনৈতিক দল, নাগরিক ও বুদ্ধিজীবী সমাজ, শ্রমিক ও পেশাজীবী সংগঠনসহ সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে সক্রিয় ও সোচ্চার হওয়া এবং মব সহিংসতার বিরুদ্ধে দেশব্যাপী সামাজিক সাংস্কৃতিক কর্মসূচি, কাউন্সেলিং ও ব্যাপক জনমত গঠনের জন্য জনসচেতনতামূলক উদ্যোগ নেওয়ার দাবি করা হয়।
বিবৃতিতে স্বাক্ষরকারীদের মধ্যে আছেন মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারপারসন সুলতানা কামাল, নিজেরা করির সমন্বয়ক খুশী কবির, টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান, নারীপক্ষের সদস্য শিরীন পারভীন হক, গণস্বাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধূরী, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম, সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জেড আই খান পান্না, আলোকচিত্রী শহিদুল আলম, ডা.
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: সরক র র ন আইন ন গ প রক ষ ক র অপর ধ ঘটন র
এছাড়াও পড়ুন:
ডাকাত-মহাজনদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিন
সুন্দরবনে দস্যুতা ফিরে আসা শুধু জীবিকার জন্য বনের ওপর নির্ভরশীল লোকদের জন্য হুমকি নয়, ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে উপকূলীয় অঞ্চলের ত্রাতা হিসেবে দাঁড়িয়ে যাওয়া মহাপ্রাণ বনটির প্রাণ-প্রকৃতি-পরিবেশের জন্যও অশনিসংকেত। ডাঙার মহাজন কোম্পানি ও বনের ডাকাতদের যৌথ চক্র এক বছরের মধ্যে যেভাবে বন ও বনজীবীদের অশেষ দুর্দশার কারণ হয়ে উঠেছে, তা আমাদের আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থার চরম ব্যর্থতা ও ভঙ্গুরতার মূর্ত প্রতীক।
প্রথম আলোর অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, গত বছরের ৫ আগস্ট হাসিনা সরকারের পতনের পর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিতে যে শূন্যতা তৈরি হয়েছিল, তার সুযোগে সুন্দরবনে দস্যুতার প্রত্যাবর্তন হয়েছে। ২০১৮ সালে ৩২টি বনদস্যু বাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে সুন্দরবন ডাকাতমুক্ত হয়েছিল। ফলে অপহরণ, মুক্তিপণ, চাঁদাবাজি, মাছ লুট, জোর করে শ্রম দিতে বাধ্য করার মতো অপরাধের কবল থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন বনের ওপর নির্ভরশীল মানুষেরা। বর্তমানে ছোট–বড় অন্তত ১৪টি বাহিনী আবার সক্রিয় হয়ে উঠেছে। সুন্দরবনের নদীতে তাদের ভাসমান আস্তানা গড়ে উঠেছে। জেলে, মৌয়াল, কাঁকড়া সংগ্রহকারীসহ বনজীবীরা তাদের হাতে অসহায়ভাবে জিম্মি হয়ে পড়েছেন। চাঁদা আর মুক্তিপণ দিতে গিয়ে ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ছে অসংখ্য পরিবার।
সুন্দরবনে কার্যত এখন প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ শূন্যের কোঠায়। কেননা বনদস্যুদের কাছে যে ধরনের অস্ত্র রয়েছে, তাদের প্রতিরোধ করার মতো সক্ষমতা বনরক্ষীদের নেই। কোস্টগার্ডসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষার কাজে নিয়োজিত বাহিনীগুলোর টহল ও নজরদারিও অপ্রতুল। ফলে সুন্দরবনে এখন বনদস্যুদের সমান্তরাল নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। আর লোকালয় থেকে এ কাজে তাদের সহায়তা করছেন ‘মহাজন কোম্পানি’ হিসেবে পরিচিত মহাজনেরা। তাঁরাই নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকার বিনিময়ে ডাকাতদের সঙ্গে বনজীবীদের বন্দোবস্ত করে দেন। আবার তাঁরাই দর-কষাকষি করে জিম্মি বনজীবীদের মুক্তিপণের টাকা পাঠান। কিন্তু এই ‘উপকারে’ বনজীবীরা ঋণের ফাঁদে আটকা পড়ছেন। এর মধ্য দিয়ে সুন্দরবনে একধরনের আধুনিক দাসতন্ত্রই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বলে মনে করি।
দস্যু ও ‘মহাজন কোম্পানির’ যে সমান্তরাল প্রশাসন প্রতিষ্ঠা পেয়েছে, তাতে সুন্দরবনের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যও মারাত্মকভাবে হুমকির মুখে পড়েছে। এবার অবৈধ জাল ব্যবহার করে ও নির্বিচার বিষ ছিটিয়ে মাছ শিকার কয়েক গুণ বেড়েছে। ফলে নদী-খালে মাছ, কাঁকড়া আগের মতো মিলছে না। জলজ প্রাণী দেদার মারা পড়ায় সুন্দরবনের বাস্তুসংস্থানে স্থায়ী ক্ষতি হচ্ছে। আবার বিষে মারা যাওয়া মাছ, কাঁকড়া খেয়ে নাগরিকেরাও স্থায়ী স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ছেন। বনদস্যুরা অবাধ হরিণ নিধন করেও সুন্দরবনের বাস্তুতন্ত্রকেও হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছে।
বনদস্যুমুক্ত সুন্দরবন আবারও ডাকাতদের অভয়াশ্রমে পরিণত হওয়া যারপরনাই উদ্বেগজনক। আত্মসমর্পণকারী ডাকাতদের একটা অংশ আবার অপরাধে জড়িয়ে পড়ার অর্থ হচ্ছে সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে তাদের পুনর্বাসন করা যায়নি। তারা যেন দস্যুবৃত্তিতে ফিরে না আসতে পারে, তার জন্য যে প্রশাসনিক ও সমাজভিত্তিক নজরদারি দরকার ছিল, সেটাও যে নেই, তারও প্রমাণ এ ঘটনা। ফলে শুধু ঘটা করে আত্মসমর্পণ করানোই যে যথেষ্ট নয়, এই শিক্ষাটাও নেওয়া প্রয়োজন।
সুন্দরবনের প্রাণ-প্রকৃতি রক্ষায় এবং বনের ওপর নির্ভরশীল লোকদের জীবন ও জীবিকা সুরক্ষিত করতে বনদস্যু মুক্ত করার বিকল্প নেই। আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে, বনরক্ষীরাও আক্রান্ত হচ্ছেন ডাকাতদের হাতে। সুন্দরবনের বনদস্যু ও মহাজনদের বিরুদ্ধে শিগগিরই কঠোর অভিযান চালানো প্রয়োজন।