২০৩০ সালের মধ্যেই রোবোটিক এক্সোস্কেলেটন, এআইচালিত বিভিন্ন পরিধেয় যন্ত্র, ন্যানো রোবট, উন্নত কন্টাক্ট লেন্স ও মস্তিষ্কের সঙ্গে যুক্ত কম্পিউটার প্রযুক্তি ব্যবহারের সুযোগ মিলবে। এসব প্রযুক্তি ও পণ্য ব্যবহারের মাধ্যমে বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনির মতো ‘সুপার হিউম্যান’ হয়ে উঠবে মানুষ। বিজ্ঞানীদের তথ্যমতে, এরই মধ্যে বেশ কিছু প্রযুক্তি ও পণ্য পরীক্ষামূলক পর্যায়ে রয়েছে, কোথাও কোথাও বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে।

রোবোটিক এক্সোস্কেলেটনের মাধ্যমে মানুষের শারীরিক ক্ষমতা বহুগুণ বাড়িয়ে তোলার প্রযুক্তি এখন আর পরীক্ষাগারে সীমাবদ্ধ নয়। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রতিষ্ঠান সারকোস রোবোটিকস তৈরি করেছে এমন একটি এক্সোস্কেলেটন, যার ‘স্ট্রেন্থ গেইন রেশিও’ ২০:১। এর অর্থ, একজন ব্যক্তি তাঁর নিজের শক্তির তুলনায় ২০ গুণ বেশি ওজন বহন করতে পারবেন। প্রতিষ্ঠানটির দাবি, এই স্যুট ব্যবহার করে কেউ চাইলে দীর্ঘ সময় ধরে ২০০ পাউন্ড ওজনও বহন করতে পারেন। এদিকে জার্মানির একটি প্রতিষ্ঠান ‘জার্মান বায়োনিক’ তৈরি করেছে ‘এক্সিয়া’ নামের বুদ্ধিমান এক্সোস্কেলেটন, যা ব্যবহারকারীর চলাফেরার ধরন বুঝে নেওয়ার মাধ্যমে ভার তোলার কাজে সহায়তা করে। ইতিমধ্যে এটি জার্মানির কয়েকটি হাসপাতালে ব্যবহার করা হচ্ছে।

আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে মানুষের রক্তনালিতে চলাচলকারী ক্ষুদ্র রোবট বা ন্যানোবট স্বাস্থ্যের সুরক্ষায় বড় ভূমিকা রাখতে পারে বলে আশা করছেন বিজ্ঞানীরা। এই ন্যানো রোবটগুলো শরীরের ভেতর কোষ মেরামত, সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ এবং এমনকি ক্যানসারের মতো জটিল রোগ নিরাময়ের কাজও করতে পারবে। বিশ্বখ্যাত প্রযুক্তিবিদ রে কুরজওয়েইলের দাবি, ২০২৯ সালের মধ্যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এমন মাত্রায় পৌঁছাবে, যেখানে প্রযুক্তিটি মানুষের চেয়েও অধিক কার্যক্ষম হয়ে উঠবে।

চীনের ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির বিজ্ঞানীরা সম্প্রতি এমন একটি কন্টাক্ট লেন্স তৈরি করেছেন, যা ইনফ্রারেড আলো দেখতে সক্ষম। ফলে এটি ব্যবহারে ব্যবহারকারীরা অন্ধকারেও দেখার সুযোগ পাবেন। যেটি এখনকার নাইট ভিশন প্রযুক্তির বিকল্প হতে পারে।

প্রযুক্তির অগ্রগতির আরেকটি বড় ক্ষেত্র হচ্ছে মানবিক অনুভূতি, বিশেষত স্পর্শ ও ভারসাম্য। সুইডেনভিত্তিক প্রতিষ্ঠান এরিকসনের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, ভবিষ্যতের স্মার্ট ডিভাইস বা রিস্টব্যান্ড ব্যবহার করে মানুষ ডিজিটাল বা ভার্চ্যুয়াল বস্তুকে স্পর্শ করার অনুভবও পেতে পারে। এমন প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করছেন একদল ‘সাইবর্গ ডিজাইনার’। ট্রান্সহিউম্যানিস্ট লিভিউ বাবিটজ তৈরি করেছে ‘নর্থসেন্স’ নামের একটি ছোট যন্ত্র, যা তার শরীরকে পৃথিবীর উত্তরমুখী দিক শনাক্ত করতে সাহায্য করে।
প্রযুক্তির পরবর্তী ধাপে রয়েছে মানুষের চিন্তা ও তথ্য গ্রহণের প্রক্রিয়ায় রূপান্তর।

বিজ্ঞানীদের মতে, ২০৩০ সালের মধ্যেই এআইচালিত পরিধেয় যন্ত্র যেমন স্মার্ট চশমা ও কানের ইয়ারবাড এমন পর্যায়ে পৌঁছাবে, যেখানে ব্যবহারকারী তাঁর চারপাশের প্রয়োজনীয় তথ্য তৎক্ষণাৎ পেয়ে যাবেন। এ বিষয়ে বিজ্ঞানী লুইস রোজেনবার্গ বলেন, ‘এই স্মার্ট যন্ত্রগুলো আমাদের চোখে যা পড়ে, কানে যা আসে, এমনকি আমরা যা অনুভব করি সবকিছুর সঙ্গেই যুক্ত থাকবে। এরপর সে তথ্য বিশ্লেষণ করে আমাদের বুঝতে ও সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করবে।’

সূত্র: ডেইলি মেইল

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: এক স স ক ল টন ব যবহ র কর

এছাড়াও পড়ুন:

কাশ্মীরের কান্না ও একজন বাবার আত্মাহুতির গল্প

১৫ নভেম্বরের কথা, শ্রীনগরে বিলাল আহমেদ বিলালের বাড়িতে অভিযান চালায় জম্মু ও কাশ্মীর পুলিশ। তারা তুলে নিয়ে যায় বিলালের ছেলে জাসির বিলাল ও ভাই নবীল আহমদকে। দিল্লিতে সাম্প্রতিক বোমা বিস্ফোরণে ১৩ জন নিহত হওয়ার ঘটনার সঙ্গে কয়েকজন কাশ্মীরির সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে কাশ্মীরে ধারাবাহিক অভিযান চলছে। তাদের গ্রেপ্তার সেই অভিযানেরই অংশ। পুলিশ কাশ্মীরজুড়ে প্রায় দেড় হাজার মানুষকে নির্বিচার আটক করেছে। যা উপত্যকাজুড়ে ছড়িয়ে দিয়েছে আতঙ্ক।

ছেলে ও ভাই আটক হওয়ার খবর শুনে ৫০ বছর বয়সী বিলাল থানায় যান; কিন্তু তাঁকে তাদের সঙ্গে দেখা করতে দেওয়া হয়নি। এ ঘটনা তাঁকে ভীষণভাবে নাড়িয়ে দেয়। বাড়ি ফিরে তিনি প্রচণ্ড উদ্বেগে ভুগছিলেন। পরিবার জানায়, তিনি ঠিকমতো হাঁটতেও পারছিলেন না। গত রোববার তিনি নিজের শরীরে আগুন ধরিয়ে দেন। তাঁকে শ্রীনগরের শ্রী মহারাজা হরি সিং হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে চিকিৎসকেরা সোমবার তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন।

বেশির ভাগ বিবরণ অনুযায়ী, বিলালের আত্মাহুতি ভারত অধিকৃত কাশ্মীরে এ ধরনের প্রথম ঘটনা। তবে এ ঘটনা ভারতের জনমনে তেমন কোনো প্রভাব ফেলেনি।

এর আগে দুঃশাসনের দমবন্ধ পরিবেশে নিজের শরীরে আগুন ধরিয়ে আত্মহুতি দিয়েছিলেন তিউনিসিয়ার বুয়াজিজি। বুয়াজিজির আত্মাহুতি দিয়েছিল আরব বসন্তের। বুয়াজিজির মতো বিলালও ফল বিক্রেতা ছিলেন। বুয়াজিজির মতো তিনিও এমন এক দমবন্ধ শাসনে বাস করতেন। বুয়াজিজির মতোই ধারাবাহিক অবমাননা ও নির্যাতনের পর বিলালও চরম সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হন। তবে তিউনিসিয়ায় বুয়াজিজির আত্মাহুতি যেখানে আরব বসন্তের জন্ম দিয়েছিল, কাশ্মীরে বিলালের গল্প সেখানে প্রায় চাপা পড়ে গেছে।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির শাসনামলে, বিশেষ করে ২০১৯ সালে দিল্লি কাশ্মীরের স্বায়ত্তশাসনের অবসান ঘটানোর পর থেকে কাশ্মীরে কথা বলা, একত্র হওয়া বা বিতর্ক করার ক্ষমতাই যেন হারিয়ে গেছে। ভারত সরকার শুধু ‘উন্নয়ন’কে হাতিয়ার বানিয়ে রাজ্যের ওপর নিয়ন্ত্রণই জোরদার করছে না, তারা জমির আইন পুনর্লিখন করছে, হাজার হাজার ভারতীয় সেটেলার আনছে, মানুষের জীবিকা নষ্ট করছে এবং রাজ্যের জনসংখ্যাগত কাঠামো বদলে ফেলছে। দিন দিন বাড়তে থাকা নজরদারির জালে মানুষ যে শ্বাসরুদ্ধ পরিবেশে বাস করছে, তা কল্পনাতীত।

কাশ্মীরি চিকিৎসকদের ‘হোয়াইট কলার টেরর মডিউল’-এর সদস্য হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে। এতে করে হাসপাতালগুলোতে অভিযান চালানোকে ন্যায়সংগত দেখানো যায়, এমনকি চিকিৎসকদের দেওয়া সাক্ষ্য–প্রমাণকেও অগ্রাহ্য করা যায়। গবেষক-শিক্ষকেরা চাকরি হারাচ্ছেন বা হুমকির মুখে পড়ছেন; সাংবাদিকদের পুলিশ ডেকে পাঠিয়ে তাঁদের প্রতিবেদন ব্যাখ্যা করতে বলছে। বেতনের রসিদ দেখাতে বাধ্য করা হচ্ছে, এমনকি রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য প্রমাণ করতে বলা হচ্ছে।

গত ছয় বছরে ভারত নানা ঔপনিবেশিক কৌশল ব্যবহার করে কাশ্মীরের ওপর তার দখল আরও কঠোর করেছে। এর মধ্যে রয়েছে অর্থনৈতিক স্থবিরতা সৃষ্টি, জমি দখল এবং সমষ্টিগত শাস্তি দেওয়া।

ফসল তোলায় বাধা আর ‘উন্নয়ন’-এর নামে জমি বাজেয়াপ্ত হওয়ায় আপেলচাষিদের জীবিকা তলানিতে ঠেকেছে। এসব পদক্ষেপ সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনকে ভয় ও অনিশ্চয়তার মানচিত্রে পরিণত করেছে। ভয় ও অনিশ্চয়তার উদ্দেশ্য কাশ্মীরিদের রাজনৈতিক শক্তিকে দুর্বল করা এবং অঞ্চলটিকে ভারতের শর্তে পুনর্গঠিত করা।

বিলাল বুঝেছিলেন, তাঁর ছেলে ও ভাই ভারতের কারাগারের অন্ধকার গহ্বরে হারিয়ে যেতে পারেন। সেখানে ন্যায়বিচার নেই, নেই সুষ্ঠু বিচারপ্রক্রিয়ার নিশ্চয়তা। হাজার হাজার কাশ্মীরিকে ভিত্তিহীন অভিযোগে আটক করে রেখেছে ভারত। তাঁদের মধ্যে আছেন সাংবাদিক ইরফান মেহরাজ, যিনি আড়াই বছরের বেশি সময় ধরে বন্দি; আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত মানবাধিকারকর্মী খুররম পারভেজ, চার বছর ধরে আটক; আরও আছেন গবেষক শফাত বিলাল এবং আইনজীবী মিয়ান আবদুল কাইয়ুম, যাদের কারাবাস সাত মাস ও দেড় বছর ছাড়িয়েছে।

রাষ্ট্র যাদের বিদ্রোহীদের পরিবার বা সন্দেহভাজন বলে মনে করে, তাদের পরিবারগুলোকে নিয়মিত অপমানিত করা হয়, তাদের বাড়িঘর ভেঙে ফেলা হয়। লিগ্যাল ফোরাম ফর কাশ্মীর (এলএফকে)-এর তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে ভারতীয় বাহিনী কমপক্ষে ১ হাজার ১৭২টি বেসামরিক বাড়ি আংশিক বা সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করেছে। চলতি বছরের শুরুতে পেহেলগামে ভারতীয় পর্যটকদের ওপর হামলার পর, সন্দেহভাজন বিদ্রোহীদের পরিবারের অন্তত ১০টি বাড়ি ধ্বংস করা হয়।

পাবলিক সেফটি অ্যাক্ট (পিএসএ) এবং আর্মড ফোর্সেস স্পেশাল পাওয়ার্স অ্যাক্টের (এএফএসপিএ) মাধ্যমে কাশ্মীরে আইনের শাসনহীনতার মাত্রা এত গভীর যে দায়মুক্তিই সেখানে একমাত্র স্থায়ী নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এখন আবার চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে ‘জাতীয় স্বার্থের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র’ করার অভিযোগ তুলছে ভারত সরকার। এর মাধ্যমে ভারত সরকার মূলত ডানপন্থীরা বহু বছরের বয়ান, তথাকথিত ‘হোয়াইট কলার সন্ত্রাসী’ আতঙ্ক সামনে নিয়ে আসছে। এতে বোঝানো হচ্ছে, গরিব শ্রমজীবী পাথর নিক্ষেপকারী থেকে শুরু করে পেশাদার চিকিৎসক, লেখক, গবেষক—পুরো সমাজই নাকি ভারত রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সহিংসতার পরিকল্পনা করছে।

কাশ্মীরি চিকিৎসকদের ‘হোয়াইট কলার টেরর মডিউল’-এর সদস্য হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে। এতে করে হাসপাতালগুলোতে অভিযান চালানোকে ন্যায়সংগত দেখানো যায়, এমনকি চিকিৎসকদের দেওয়া সাক্ষ্য–প্রমাণকেও অগ্রাহ্য করা যায়। গবেষক-শিক্ষকেরা চাকরি হারাচ্ছেন বা হুমকির মুখে পড়ছেন; সাংবাদিকদের পুলিশ ডেকে পাঠিয়ে তাঁদের প্রতিবেদন ব্যাখ্যা করতে বলছে। বেতনের রসিদ দেখাতে বাধ্য করা হচ্ছে, এমনকি রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য প্রমাণ করতে বলা হচ্ছে।

অন্যদের ভ্রমণ স্বাধীনতা বজায় রাখতে বন্ডে সই করতে বাধ্য করা হচ্ছে। বিদেশে থাকা কাশ্মীরিরা যদি রাষ্ট্রীয় বয়ান অমান্য করেন, কাশ্মীরে থাকা তাঁদের পরিবারকে উদ্বেগজনক বার্তা পাঠানো হচ্ছে।

তাঁদের সতর্ক করা হচ্ছে, যেন তাঁরা কোনোভাবেই ‘জাতীয় স্বার্থের বিরুদ্ধে’ কোনো লেখা বা কনটেন্ট তৈরি না করে। আর অবাধ্যতার মূল্য যে কত কঠিন, তা স্পষ্টভাবে দেখা যায় সেসব কাশ্মীরি সাংবাদিকদের মধ্যে, যাঁরা আর লিখতে পারেন না বা যাঁদের পাসপোর্ট বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে।

বিলাল আগুন ধরানোর মুহূর্তে ঠিক কী ভাবছিলেন, তা কেউ নিশ্চিতভাবে বলতে না পারলেও যে পরিস্থিতি তাঁকে এই হতাশার দিকে ঠেলে দিয়েছে, তা স্পষ্ট।

কাশ্মীরে বিলালের মৃত্যু কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এটি সেই বাস্তবতার ফল, যা ভারত তৈরি করেছে। ওটা এমন এক জগৎ, যেখানে ন্যায়বিচারের ক্ষীণতম আশা থেকেও হতাশা অনেক বেশি।

আজাদ ঈসা, সাংবাদিক ও বৈদেশিক নীতি, আরব সম্প্রদায়, ভারত ও হিন্দু জাতীয়তাবাদ বিশ্লেষক

• মিডিল ইস্ট আই থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্তাকারে অনূদিত

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ভূমিকম্প যেভাবে পৃথিবী পাল্টে দিতে পারে
  • বৈদ্যুতিক গাড়ি বিক্রিতে বড় বাধা নিবন্ধন ফি ও অগ্রিম কর
  • মামদানির হাত চাপড়ে, মজার ছলে ঘুষি দিয়ে কী বোঝালেন ট্রাম্প
  • কাশ্মীরের কান্না ও একজন বাবার আত্মাহুতির গল্প