Prothomalo:
2025-06-28@21:40:46 GMT

বাংলা সাহিত্য বীক্ষণ

Published: 28th, June 2025 GMT

‘দেখা’ ক্রিয়াপদটার আলোচনায় ফিরে গেলে: এক অর্থে দক্ষিণ এশীয় ভাষায় ‘বাংলা সাহিত্য দেখা’ বলতে বোঝাতে পারে সেই সাহিত্যের দর্শনলাভ করা, অর্থাৎ কারও ওপর দর্শন লাভের সহজাত উপকার কিংবা আনুকূল্য বর্ষিত হতে দেওয়া। আমাদের যাঁরা বাংলা সাহিত্য পড়েন, সে হিসেবে বলা যায়, তাঁরা সেটির দর্শন লাভ করছেন। যা-ই হোক, ‘দেখা’ বলতে নিশ্চিত করে ‘দর্শনলাভ’ বোঝায় না। ইংরেজি ভাষ্যে ‘to view as’ কিংবা ‘to view in a positive light’ অথবা ‘to view with a jaundiced eye’ বলতে সাধারণ অর্থে বোঝায় ‘বিশেষ দৃষ্টিতে’ কিংবা ‘ইতিবাচকভাবে’ অথবা ‘অস্পষ্ট দৃষ্টিতে দেখা’। অথচ ‘দর্শনলাভ করা’ বললে দৃষ্ট বিষয় তার অখণ্ডতা ধরে রাখে, অন্যদিকে দ্রষ্টার মধ্যে ঘটে পরিবর্তন (লাভবান হয়)। কারও ‘দৃষ্টিতে’ বললে হয় তার উল্টোটা। শেষোক্ত ক্ষেত্রে দৃষ্ট বিষয় সম্পর্কে নিজের সৃষ্ট মত অনুযায়ী ব্যাখ্যা দেন দ্রষ্টা।

আমরা সবাই জানি, দেখার কাজটি সরল বিশ্বাসে করা হলেও কখনোই সম্পূর্ণ, বিশদ ও নিখুঁত হয় না। আমাদের স্মরণ করিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন নেই যে রুডইয়ার্ড কিপলিংয়ের ‘কিম’ উপন্যাসের নামচরিত্র কিমকে শিখিয়ে দিতে হয়েছিল, যাতে সে সিমলায় লারগ্যান সাহেবের কিউরিও শপের জিনিসপত্র আরও বেশি করে লক্ষ করে, কারণ ব্রিটিশদের হয়ে গোয়েন্দাগিরি করার জন্য প্রশিক্ষণ নিচ্ছিল সে, যেটাকে বলা হতো ঔপনিবেশিক সম্প্রসারণ ও সংহত করার বড় খেলা। কিউরিও শপটা কলকাতার আশপাশে নয়, হিমালয়ের একটা হিল স্টেশন সিমলায়। একইভাবে আমাদের স্মরণ করানোর দরকার নেই যে কিপলিংয়ের উপন্যাসটা রবীন্দ্রনাথের ‘গোরা’ উপন্যাসে আমরা যে রকম দেখি, তার চেয়ে ভিন্নদৃষ্টিতে দেখা ভারতকে উপস্থাপন করে। একমাত্র মিল উভয় উপন্যাসের নামীয় নায়কদের মধ্যে: দুজনই গত শতাব্দীতে আইরিশ মা-বাবার এতিম সন্তান। ‘ভিন্নদৃষ্টিতে দেখা ভারত’ বলতে স্বভাবতই আমরা বুঝি, কিপলিংয়ের ভারত (কেবল ভারত সম্পর্কে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি নয়) রবীন্দ্রনাথের ভারতের চেয়ে আলাদা, কারণ, এই উভয় ক্ষেত্রের দ্রষ্টারা দর্শন লাভকারী মানুষের বিপরীতে প্রকৃতপক্ষে দৃষ্ট বিষয়কে সৃষ্টি করে সুবিধামতো ব্যবহার করেন।

দৃষ্ট বিষয়কে ‘সুবিধামতো ব্যবহার’ করার বিষয়টা খোলাসা করি। প্রায় সংজ্ঞাগতভাবে সাহিত্য সৃষ্ট হয় লেখকদের দ্বারা সুবিধামতো ব্যবহার করা নির্মিত বয়ানে, নিজের বাস্তবতাকে সৃষ্টি করেন তাঁরা। শামসুর রাহমানের ‘ক্ষয়কাশ’ কবিতায় তাঁর দেখা ঢাকার কথা উল্লেখ করতে পারি আমরা:

কে যেন উঠলো কেশে কলোনির ফ্ল্যাটে খক্খকিয়ে,

যে মোটর কিছুতে নেয়না স্টার্ট ঠিক তারই মতো

শব্দ করে ঠান্ডা রাতে কাশছে লোকটা অবিরত।

গলিপথে অন্য কেউ কেশে ওঠে, প্রাণক্ষয়ী কাশ—

পাশের দালানে কেউ, কেউ বা মাটির ভাঙা ঘরে

বস্তিতে বাজারে আর অভিজাত পাড়ার অন্দরে,

ভয়াবহ শব্দে সেই ছেয়ে গেল সমস্ত আকাশ।

ন্যূনতম নব্বুই হাজার বাসগৃহে নিদ্রাহর

শব্দের ধমকে নড়ে সংখ্যাহীন বুকের পাঁজর

এবং আমার বুক পূর্ব বাংলার মতোই হু হু, তীব্রতর

কাশির দমকে বড্ড দুমড়ে যাই, কুঞ্চিত চাদর

গোধূলি-তরল রক্তে বারংবার ওঠে ঝক্ঝকিয়ে।

দৃশ্যের এ রকম জীবন্ত চিত্রায়ণ, পয়ার ছন্দের মসৃণ প্রবাহ এবং সমাপ্তিসূচক শক্তিশালী চিত্রকল্প সত্ত্বেও কবিতাটি পাঠকের চোখে তুলে ধরতে পারে কিছুটা হতাশাজনক, অসুস্থ ঢাকাকে। উপরন্তু এ রকম একটা ধারণা আমেরিকায় বরং সাধারণ দৃষ্টিতে দেখা বাংলাদেশ সম্পর্কে ধারণার একটা উদাহরণ। মরণাপন্ন মানুষদের জন্য কলকাতায় মাদার তেরেসার সেবা সদনটার কথা মনে পড়ে যায় তাৎক্ষণিক। এ বছর (১৯৯২-৯৩) শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাথমিক বাংলা পাঠ্যক্রমে ভর্তি হওয়া আটজন শিক্ষার্থীর মধ্যে ছয়জনই বাঙালি-আমেরিকান কিংবা দ্বিতীয় প্রজন্মের বাঙালি অথবা নিজেদের বহুজাতিক বলে পরিচয় দিতে পছন্দ করা বাঙালি, কিংবা ঘরে কিছু বাংলা বলে থাকেন এমন হাইফেনবর্জিত আমেরিকান, যেহেতু তাদের মধ্যে অন্যরা নিজেদের এভাবেই পরিচয় করান। অনেকের মধ্যে এসব তরুণের বাংলাদেশ সফরের একটা সাধারণ ধারণা হচ্ছে, এটা এমন একটা জায়গা, যেখানে গেলে অসুস্থ হয়ে পড়ে তারা। সেটা অবশ্য আমরা যা বাস্তব বলে ভাবি তার একটা অংশ, একটা নির্দিষ্ট দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা একটা অংশ কেবল।

ঢাকার সেই যক্ষ্মা রোগাক্রান্ত দৃশ্যের বিপরীতে শামসুর রাহমান অনেক বেশি ইতিবাচক, আকর্ষণীয় স্বস্তিকর জায়গা হিসেবে ইতিহাস-সমৃদ্ধ, স্মৃতিবাহী বাখরখানির সুঘ্রাণযুক্ত নগরীটির বহু বর্ণনা চিত্রিত করেছেন। কিশোরদের জন্য তাঁর স্মৃতির শহর এ রকমই একটা গদ্যের বই। উভয় রচনাই শামসুর রাহমানের দেখা ঢাকার দৃশ্য—এসব লেখায় ভিন্ন ভিন্ন আবহ আনার জন্য নিজের মতো করে ব্যবহার করা হয়েছে আপন সৃষ্ট ঢাকাকে।

ক্লিনটন বি সিলি.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ব যবহ র উপন য স র জন য র একট

এছাড়াও পড়ুন:

বাংলা সাহিত্য বীক্ষণ

‘দেখা’ ক্রিয়াপদটার আলোচনায় ফিরে গেলে: এক অর্থে দক্ষিণ এশীয় ভাষায় ‘বাংলা সাহিত্য দেখা’ বলতে বোঝাতে পারে সেই সাহিত্যের দর্শনলাভ করা, অর্থাৎ কারও ওপর দর্শন লাভের সহজাত উপকার কিংবা আনুকূল্য বর্ষিত হতে দেওয়া। আমাদের যাঁরা বাংলা সাহিত্য পড়েন, সে হিসেবে বলা যায়, তাঁরা সেটির দর্শন লাভ করছেন। যা-ই হোক, ‘দেখা’ বলতে নিশ্চিত করে ‘দর্শনলাভ’ বোঝায় না। ইংরেজি ভাষ্যে ‘to view as’ কিংবা ‘to view in a positive light’ অথবা ‘to view with a jaundiced eye’ বলতে সাধারণ অর্থে বোঝায় ‘বিশেষ দৃষ্টিতে’ কিংবা ‘ইতিবাচকভাবে’ অথবা ‘অস্পষ্ট দৃষ্টিতে দেখা’। অথচ ‘দর্শনলাভ করা’ বললে দৃষ্ট বিষয় তার অখণ্ডতা ধরে রাখে, অন্যদিকে দ্রষ্টার মধ্যে ঘটে পরিবর্তন (লাভবান হয়)। কারও ‘দৃষ্টিতে’ বললে হয় তার উল্টোটা। শেষোক্ত ক্ষেত্রে দৃষ্ট বিষয় সম্পর্কে নিজের সৃষ্ট মত অনুযায়ী ব্যাখ্যা দেন দ্রষ্টা।

আমরা সবাই জানি, দেখার কাজটি সরল বিশ্বাসে করা হলেও কখনোই সম্পূর্ণ, বিশদ ও নিখুঁত হয় না। আমাদের স্মরণ করিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন নেই যে রুডইয়ার্ড কিপলিংয়ের ‘কিম’ উপন্যাসের নামচরিত্র কিমকে শিখিয়ে দিতে হয়েছিল, যাতে সে সিমলায় লারগ্যান সাহেবের কিউরিও শপের জিনিসপত্র আরও বেশি করে লক্ষ করে, কারণ ব্রিটিশদের হয়ে গোয়েন্দাগিরি করার জন্য প্রশিক্ষণ নিচ্ছিল সে, যেটাকে বলা হতো ঔপনিবেশিক সম্প্রসারণ ও সংহত করার বড় খেলা। কিউরিও শপটা কলকাতার আশপাশে নয়, হিমালয়ের একটা হিল স্টেশন সিমলায়। একইভাবে আমাদের স্মরণ করানোর দরকার নেই যে কিপলিংয়ের উপন্যাসটা রবীন্দ্রনাথের ‘গোরা’ উপন্যাসে আমরা যে রকম দেখি, তার চেয়ে ভিন্নদৃষ্টিতে দেখা ভারতকে উপস্থাপন করে। একমাত্র মিল উভয় উপন্যাসের নামীয় নায়কদের মধ্যে: দুজনই গত শতাব্দীতে আইরিশ মা-বাবার এতিম সন্তান। ‘ভিন্নদৃষ্টিতে দেখা ভারত’ বলতে স্বভাবতই আমরা বুঝি, কিপলিংয়ের ভারত (কেবল ভারত সম্পর্কে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি নয়) রবীন্দ্রনাথের ভারতের চেয়ে আলাদা, কারণ, এই উভয় ক্ষেত্রের দ্রষ্টারা দর্শন লাভকারী মানুষের বিপরীতে প্রকৃতপক্ষে দৃষ্ট বিষয়কে সৃষ্টি করে সুবিধামতো ব্যবহার করেন।

দৃষ্ট বিষয়কে ‘সুবিধামতো ব্যবহার’ করার বিষয়টা খোলাসা করি। প্রায় সংজ্ঞাগতভাবে সাহিত্য সৃষ্ট হয় লেখকদের দ্বারা সুবিধামতো ব্যবহার করা নির্মিত বয়ানে, নিজের বাস্তবতাকে সৃষ্টি করেন তাঁরা। শামসুর রাহমানের ‘ক্ষয়কাশ’ কবিতায় তাঁর দেখা ঢাকার কথা উল্লেখ করতে পারি আমরা:

কে যেন উঠলো কেশে কলোনির ফ্ল্যাটে খক্খকিয়ে,

যে মোটর কিছুতে নেয়না স্টার্ট ঠিক তারই মতো

শব্দ করে ঠান্ডা রাতে কাশছে লোকটা অবিরত।

গলিপথে অন্য কেউ কেশে ওঠে, প্রাণক্ষয়ী কাশ—

পাশের দালানে কেউ, কেউ বা মাটির ভাঙা ঘরে

বস্তিতে বাজারে আর অভিজাত পাড়ার অন্দরে,

ভয়াবহ শব্দে সেই ছেয়ে গেল সমস্ত আকাশ।

ন্যূনতম নব্বুই হাজার বাসগৃহে নিদ্রাহর

শব্দের ধমকে নড়ে সংখ্যাহীন বুকের পাঁজর

এবং আমার বুক পূর্ব বাংলার মতোই হু হু, তীব্রতর

কাশির দমকে বড্ড দুমড়ে যাই, কুঞ্চিত চাদর

গোধূলি-তরল রক্তে বারংবার ওঠে ঝক্ঝকিয়ে।

দৃশ্যের এ রকম জীবন্ত চিত্রায়ণ, পয়ার ছন্দের মসৃণ প্রবাহ এবং সমাপ্তিসূচক শক্তিশালী চিত্রকল্প সত্ত্বেও কবিতাটি পাঠকের চোখে তুলে ধরতে পারে কিছুটা হতাশাজনক, অসুস্থ ঢাকাকে। উপরন্তু এ রকম একটা ধারণা আমেরিকায় বরং সাধারণ দৃষ্টিতে দেখা বাংলাদেশ সম্পর্কে ধারণার একটা উদাহরণ। মরণাপন্ন মানুষদের জন্য কলকাতায় মাদার তেরেসার সেবা সদনটার কথা মনে পড়ে যায় তাৎক্ষণিক। এ বছর (১৯৯২-৯৩) শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাথমিক বাংলা পাঠ্যক্রমে ভর্তি হওয়া আটজন শিক্ষার্থীর মধ্যে ছয়জনই বাঙালি-আমেরিকান কিংবা দ্বিতীয় প্রজন্মের বাঙালি অথবা নিজেদের বহুজাতিক বলে পরিচয় দিতে পছন্দ করা বাঙালি, কিংবা ঘরে কিছু বাংলা বলে থাকেন এমন হাইফেনবর্জিত আমেরিকান, যেহেতু তাদের মধ্যে অন্যরা নিজেদের এভাবেই পরিচয় করান। অনেকের মধ্যে এসব তরুণের বাংলাদেশ সফরের একটা সাধারণ ধারণা হচ্ছে, এটা এমন একটা জায়গা, যেখানে গেলে অসুস্থ হয়ে পড়ে তারা। সেটা অবশ্য আমরা যা বাস্তব বলে ভাবি তার একটা অংশ, একটা নির্দিষ্ট দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা একটা অংশ কেবল।

ঢাকার সেই যক্ষ্মা রোগাক্রান্ত দৃশ্যের বিপরীতে শামসুর রাহমান অনেক বেশি ইতিবাচক, আকর্ষণীয় স্বস্তিকর জায়গা হিসেবে ইতিহাস-সমৃদ্ধ, স্মৃতিবাহী বাখরখানির সুঘ্রাণযুক্ত নগরীটির বহু বর্ণনা চিত্রিত করেছেন। কিশোরদের জন্য তাঁর স্মৃতির শহর এ রকমই একটা গদ্যের বই। উভয় রচনাই শামসুর রাহমানের দেখা ঢাকার দৃশ্য—এসব লেখায় ভিন্ন ভিন্ন আবহ আনার জন্য নিজের মতো করে ব্যবহার করা হয়েছে আপন সৃষ্ট ঢাকাকে।

ক্লিনটন বি সিলি

সম্পর্কিত নিবন্ধ