সালাহ উদ্দিন আহমেদ, ছোট কিছু স্মৃতি
Published: 23rd, September 2025 GMT
১৯৭৩ সালে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে প্রথম বর্ষের ছাত্র হিসেবে ভর্তি হই। অর্থনীতি বিভাগে যাওয়ার কিছুদিনের মধ্যে জানলাম যে সালাহ উদ্দিন আহমেদ নামের একজন তরুণ প্রভাষক আছেন। লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকস অ্যান্ড পলিটিক্যাল সায়েন্স থেকে অর্থনীতিতে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী ব্যক্তি। তিনি দ্বিতীয় বা তৃতীয় বর্ষের ক্লাস নিতেন আর বিশ্ববিদ্যালয়ে গেলে অর্থনীতি বিভাগ থেকে যতটা সম্ভব দূরে থাকতাম, যাতে কোনো শিক্ষকের পাল্লায় না পড়তে হয়। কয়েক মাসের মধ্যে মস্কোয় পাড়ি জমিয়েছিলাম, তাই সালাহ উদ্দিন ভাইয়ের সঙ্গে সরাসরি পরিচয় হয়নি।
যত দূর মনে পড়ে, আশির দশকের প্রথম দিকে সালাহ উদ্দিন ভাইয়ের ওয়ারীর বাসায় গিয়েছিলাম। ঘরভর্তি ভারী কাঠের বিরাট বিরাট ফার্নিচার। এ রকম জিনিস তার আগে আর দেখিনি। তিনি জানালেন, ‘বাবা পাকিস্তান আমলে কিছুদিন বার্মায় রাষ্ট্রদূত ছিলেন। বার্মার দায়িত্ব শেষে ঢাকায় ফিরে আসার সময় এসব গাবদা গাবদা ফার্নিচার নিয়ে এসেছিলেন।’
সালাহ উদ্দিন ভাই ১৯৭০ থেকে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে শিক্ষকতা করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে ঢাকায় ইউএনডিপিতে যোগদান করেন। এরপর সালাহ উদ্দিন ভাইয়ের সঙ্গে দেখা কামাল স্যারের (ড.
সিগারেটের কেচ্ছা আরেকটু বলি। বছর পাঁচেক আগের কথা, আমি ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিকে একটি সাবজেক্ট পড়াই। একদিন আইন বিভাগের চেয়ারম্যানের রুম থেকে হুংকার ‘রুমে আসো’। বিশ্ববিদ্যালয় বিল্ডিংটিও ‘নো স্মোকিং জোন’। তবে এখানেও সালাহ উদ্দিন ভাইয়ের রুম ব্যতিক্রম, তাঁর রুমে সিগারেট চলে! পরে জেনেছিলাম আশির দশকের পরের দিকে তিনি ঢাকায় এলএলবি পাস করেন। এরপর ১৯৮৪ সালে নিউইয়র্কের কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এলএলএম ডিগ্রি লাভ করেন। আমার জানামতে, বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় দুই শিক্ষাপীঠ থেকে দুটি ভিন্ন বিষয়ে (অর্থনীতি ও আইন) উচ্চতর ডিগ্রিধারী একমাত্র ব্যক্তি সালাহ উদ্দিন আহমেদ।
ফার্স্ট ফরওয়ার্ড, ২০১২ সালের ঘটনা। আগারগাঁওয়ের এডিবি ভবনে ইউএনডিপি অফিসে গিয়েছি। ইউএনডিপিকে টাকার বিনিময়ে আইনি পরামর্শ দিতাম। লিফটে সালাহ উদ্দিন ভাইয়ের সঙ্গে দেখা। ফরমান জারি করলেন, ‘১২ তলায় আমার অফিস ঘুরে যেয়ো।’ ইউএনডিপি অফিস থেকে জানলাম, ১২ তলায় কাফকোর অফিস। ১৯ তলায় ইউএনডিপির বড় সাহেবের অফিসে মিটিং করে ১২ তলায় নেমেছিলাম। সালাহ উদ্দিন ভাইয়ের অফিস ইউএনডিপির বড় সাহেবের অফিস থেকেও বড়। বুঝলাম, তিনি কাফকোর বড় সাহেব।
চা খেতে খেতে সালাহ উদ্দিন ভাই যা বলেছিলেন, তার সারমর্ম ছিল অনেকটা এ রকম, ‘ওকালতি না করেই অ্যাটর্নি জেনারেল তো বনে গিয়েছিলাম, অতএব এই পেশা থেকে আমার আর পাওয়ার কিছুই নেই।’ একটু স্মৃতিচারণা করে বলেছিলেন, তাঁর বাবার কাছের এক আইনজীবী বন্ধুর সঙ্গে কিছুদিন আগে চট্টগ্রামের আদালতে দেখা হয়েছিল। সেই চাচা এককালে চট্টগ্রামের সবচেয়ে ডাকসাইটে একজন আইনজীবী; কিন্তু এখন বৃদ্ধ বা অতিবৃদ্ধ। আদালতে আইনজীবীদের হলরুমের এক কোনায় একলা একলা জড়সড় হয়ে বসে ছিলেন। আগের প্রভাব–প্রতিপত্তি, জৌলুশ ও দাপটের একবিন্দুও ছিল না। সালাহ উদ্দিন ভাই বলেছিলেন, আমারও যাতে সেই বৃদ্ধ চাচার অবস্থা না হয়, সে জন্য অ্যাটর্নি জেনারেলের পদ ছাড়ার পর আইন পেশায় আর ফিরে যাননি।
পাঁচ-ছয় বছর আগের কথা। আমার বাসার চেম্বার থেকে সালাহ উদ্দিন ভাইয়ের বাসা ২০০ থেকে ৩০০ গজ দূরে। একদিন চেম্বারে এসে ঘোষণা দিলেন যে আবার ওকালতি শুরু করবেন। তার জন্য একটি বসার জায়গার ব্যবস্থা করতে হবে। ব্যবস্থা করে তাঁকে খবর দিতে। পরে দু–তিন দিন তিনি সুপ্রিম কোর্টে গিয়েছিলেন। যত দূর মনে পড়ে, আবার ওকালতি করার বিরাট সংকল্পের স্থায়িত্ব ছিল সম্ভবত এক সপ্তাহের কম।
ওয়ারীর বাড়ির পরে বোধ হয় বছর বিশেক আগে তাঁর সেগুনবাগিচার বাড়িতে গিয়েছিলাম। চোখের আন্দাজে বলছি, দেড় বিঘার প্লটের ওপর অর্ধবৃত্তাকার দোতলা বিশাল বাড়ি। সম্ভবত বাড়িটির এক–তৃতীয়াংশ ব্যবহৃত হতো আর দুই-তৃতীয়াংশ থাকত তালাবদ্ধ। পরে এশিয়া প্যাসিফিক ইউনিভার্সিটিতে থাকাকালে একবার সেগুনবাগিচার সে বাড়ির কথা জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ‘কী জানি, ছেলেরা নাকি ওই বাড়িতে একটি কমিউনিটি সেন্টার খুলেছে’—এই ছিল তাঁর উত্তর।
এশিয়া প্যাসিফিক ইউনিভার্সিটিতে মাঝেমধে৵ দু-চারটা মামলা নিয়ে আলোচনা হতো। মামলার মূল যুক্তি আর আইন বুঝতে তাঁর দুই-তিন মিনিটের বেশি সময় কখনো লাগত না।
পদপদবি, অর্থবিত্ত, বাড়ি-গাড়ি কোনো কিছুরই কোনো মোহ ছিল না। কোনো পেশাই তাঁকে বেশি দিন ধরে রাখতে পারেনি। পারেনি, কারণ সম্ভবত অল্প কয়েক বছরেই সে পেশা তাঁর কাছে বিদ্যাবুদ্ধির মাপকাঠিতে আর আকর্ষণীয় মনে হতো না। সালাহ উদ্দিন ভাই ছিলেন নিভৃতচারী। নিজেকে নিয়ে ঘুণাক্ষরেও ঢাকঢোল পেটাননি। এ জন্যই হয়তো এই গুণী মানুষটি অনেকের কাছেই রয়ে গেলেন অজানা। কমবেশি হলেও তাঁর কিছু সান্নিধ্য পেয়েছিলাম—এটি আমার পরম সৌভাগ্য।
● ড. শাহদীন মালিক জ্যেষ্ঠ আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: স ল হ উদ দ ন ভ ই ইউএনড প আইনজ ব র অফ স
এছাড়াও পড়ুন:
৩৭ রানে ৮ উইকেট হারিয়ে পাকিস্তানের কাছে সিরিজ হারল দ. আফ্রিকা
ফয়সালাবাদে দক্ষিণ আফ্রিকার ব্যাটিং শুরু দেখে কেউ কি ঘুনাক্ষরেও ধারণা করতে পেরেছিল ম্যাচের পরিণতি এমন হবে! সিরিজ নির্ধারণী ম্যাচে আগে ব্যাটিং করতে নেমে উদ্বোধনী জুটিতে ৭২ রান তুলে নেয় প্রোটিয়ারা। পাকিস্তানের চোখে-মুখে তখন ছিল উৎকণ্ঠা, বড় রানের শঙ্কা।
অথচ উদ্বোধনী জুটি ভাঙার পর তাসের ঘরের মতো ভেঙে গেল দক্ষিণ আফ্রিকার সাজানো সংসার! নাটকীয় ব্যাটিং ধসে ১৪৩ রানে অলআউট তারা। সেটাও মাত্র ৩৭.৫ ওভারে। ৫৬ রানে শেষ ৯ এবং ৩৭ রানে শেষ ৮ উইকেট হারিয়ে ম্যাচের রোমাঞ্চ, উত্তেজনা সব নষ্ট করে দেন ব্যাটসম্যানরা।
আরো পড়ুন:
অভিষেকের বিশ্ব রেকর্ড গড়া ম্যাচও বৃষ্টির পেটে, সিরিজ ভারতের
শ্রীলঙ্কা দলে প্রথমবার ডাক পেলেন এসহান, টি-টোয়েন্টিতে ফিরলেন রাজাপাকসে
সহজ লক্ষ্য তাড়া করতে নেমে ২৫.১ ওভারে ম্যাচ জিতে নেয় পাকিস্তান। ৭ উইকেটের জয়ে ২-১ ব্যবধানে সিরিজ জিতল পাকিস্তান। এর আগে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজ জিতলেও ঘরের মাঠে এটি তাদের প্রথম সিরিজ জয়।
আহমরি বোলিংয়ে দক্ষিণ আফ্রিকার ব্যাটিংয়ে নাটকীয় ধস নেমেছিল। ইনিংসের মধ্যভাগে ব্যাটসম্যানরা কেউ প্রতিরোধই করতে পারছিলেন না। ওপেনিংয়ে লুহান ড্রি প্রিটোরিয়াস ৩৯ ও ডি কক সর্বোচ্চ ৫৩ রান করেন। এরপর তাদের দুই ব্যাটসম্যান কেবল দুই অঙ্কের ঘর পেরোতে পারে। অধিনায়ক ব্রিটজি ও পেটার ১৬ রানের দুটি ইনিংস খেলেন। বাকিরা ক্রিজে এসেছেন আর ফিরেছেন।
১০ ওভারে ১ মেডেনে ২৭ রানে ৪ উইকেট নিয়ে লেগ স্পিনার আবরার আহমেদ ছিলেন তাদের সেরা বোলার। ২টি করে উইকেট নেন পেসার শাহীন শাহ আফ্রিদি, স্পিনার সালমান আগা ও মোহাম্মদ নওয়াজ।
সহজ লক্ষ্য তাড়া করতে নেমে কোনো রান জমা না করতেই ফখর জামান সাজঘরে ফেরেন। এরপর ক্রিজে এসে বাবর ৫ বাউন্ডারিতে নিজের ছায়া থেকে বেরিয়ে আসেন। মনে হচ্ছিল, আজ তার ব্যাট থেকে ভালো একটি ইনিংস আসবে। কিন্তু রান আউটে কাটা পড়ে তার ইনিংস থেমে যায় ২৭ রানে।
সেখান থেকে সায়েম আইয়ুবের ৭০ বলে ১১ চার ও ১ ছক্কায় সাজানো ৭৭ রানের ইনিংস ও মোহাম্মদ রিজওয়ানের ৩২ রানে সহজেই জয়ের বন্দরে পৌঁছে যায় স্বাগতিকরা।
আববার দারুণ বোলিংয়ে ম্যাচ সেরা নির্বাচিত হন। কুইন্টন ডি কক ২৩৯ রান করে হন সিরিজ সেরা। এই সিরিজ দিয়ে পাকিস্তানের ওয়ানডে অধিনায়ক হিসেবে যাত্রা শুরু হলো আফ্রিদির। জয়ে সিরিজ শুরু করে নিশ্চিতভাবেই আত্মবিশ্বাস পেলেন।
ঢাকা/ইয়াসিন/বকুল