জুলাই সনদ বাস্তবায়নে গণভোটের বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলো একমত: আলী রীয়াজ
Published: 5th, October 2025 GMT
জাতীয় জুলাই সনদ বাস্তবায়নপ্রক্রিয়া নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে এবং গণভোট অনুষ্ঠানের বিষয়ে দলগুলোর মধ্যে মতৈক্য হয়েছে বলে জানিয়েছেন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ।
আজ রোববার রাজধানীর বেইলি রোডে ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে জুলাই জাতীয় সনদের সংবিধান–সম্পর্কিত প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়নের পদ্ধতি নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে চতুর্থ দিনের আলোচনার শেষে এ কথা বলেন আলী রীয়াজ।
জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের জন্য জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা জরুরি উল্লেখ করে অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, ‘তাদের সম্মতির জন্য একটি গণভোট অনুষ্ঠানের ব্যাপারে সব রাজনৈতিক দল একমত হয়েছে। আমরা এটিকে বাস্তবায়নপ্রক্রিয়ার প্রথম বড় পদক্ষেপ হিসেবে দেখছি।’
অধ্যাপক আলী রীয়াজ জানান, এর আগে ১১, ১৪ ও ১৭ সেপ্টেম্বর তিনটি বৈঠকের পর দলগুলোর পারস্পরিক আলাপ-আলোচনার জন্য কিছু সময় দেওয়া হয়েছিল। সেই সময় শেষে আজকের বৈঠকে এসে গণভোট ও সাংবিধানিক সংস্কার নিয়ে দলগুলোর মধ্যে একটি অভিন্ন অবস্থান তৈরি হয়েছে।
সংসদ নির্বাচনের পর গঠিত নতুন আইনসভার কাঠামো সম্পর্কেও কমিশনের পক্ষ থেকে প্রস্তাব এসেছে। আলী রীয়াজ বলেন, ‘ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের মাধ্যমে যে আইনসভা গঠিত হবে, সেটিকে এমন বৈশিষ্ট্য দিতে হবে, যাতে জুলাই সনদের ভিত্তিতে প্রস্তাবিত সাংবিধানিক সংশোধনগুলো সহজে সম্পন্ন করা যায়। এ বিষয়েও কার্যত রাজনৈতিক দলগুলো একমত।’
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি জানান, আগে দলগুলোর একাংশ সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদের মাধ্যমে সুপ্রিম কোর্টের মতামত নেওয়ার কথা বললেও বর্তমানে অধিকাংশ দলই মনে করছে, এর আর প্রয়োজন না–ও হতে পারে।
রাজনৈতিক দলগুলোর ‘সহনশীলতা’ ও ‘অবস্থান পরিবর্তনের সাহসিকতা’কে কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করে আলী রীয়াজ বলেন, ‘তারা দলীয় অবস্থান থেকে সরে এসে জাতীয় ঐক্য তৈরিতে ভূমিকা রেখেছে। জুলাই সনদ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে এটা বড় ধরনের অগ্রগতি।’
অগ্রগতির দিকটি সকালেই প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসকে অবহিত করা হয়েছে বলে জানান অধ্যাপক আলী রীয়াজ। প্রধান উপদেষ্টা দ্রুততার সঙ্গে সুপারিশ চূড়ান্ত করার তাগিদ দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন তিনি।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ। আজ রোববার রাজধানীর বেইলি রোডে ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: জ ল ই সনদ দলগ ল র গণভ ট
এছাড়াও পড়ুন:
অন্তর্বর্তী সরকার কেন জবাবদিহির সংস্কৃতি চালু করতে পারল না
গণ-অভ্যুত্থানের পটভূমিতে দায়িত্ব নেওয়া অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতি সাধারণ মানুষের ছিল পাহাড়সম প্রত্যাশা। তবে গত ১৫ মাসে তাদের কার্যক্রম নিয়ে নানা সমালোচনায় সেই আশা অনেকটাই ফিকে হতে শুরু করেছে। এই সরকারের হিসাব খাতায় সবচেয়ে উচ্চারিত শব্দটি সম্ভবত ‘সংস্কার’ হবে। গণমাধ্যমে ছাপানো শব্দগুলোর মধ্যেও ‘সংস্কার’ শব্দটি শীর্ষে থাকবে।
কিন্তু সংস্কার কার্যক্রমের দৃশ্যমান পদধ্বনি সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায় না পৌঁছায় সরকারের নানা প্রতিশ্রুতি নিয়ে যেমন ধূম্রজাল তৈরি হচ্ছে, তেমনি এই সরকারের বিরুদ্ধে ওঠা ‘গুজব’বিষয়ক সংবাদগুলোকে সরকার মোকাবিলা করতে হিমশিম খাচ্ছে।
কোনো কোনো ক্ষেত্রে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, অনলাইন মিডিয়া কিংবা সংবাদপত্রে নানা ধরনের তথ্য–অপতথ্য প্রচারের পর সরকারের ঘুম ভাঙছে। পরবর্তী সময় সেই খবরগুলোকে ‘মিসলিডিং’ সিল মেরে সরকার নিজেদের ভাবমূর্তি রক্ষা করার চেষ্টা করছে। তাদের আবার ফ্যাক্টচেকিং করতে হচ্ছে।
প্রশ্ন হলো, গণ-অভ্যুত্থানের জনপ্রিয়তাকে পুঁজি করে ক্ষমতায় আসার পর এই সরকারের প্রতি কেন অনেক মানুষের ‘অবিশ্বাস’ তৈরি হচ্ছে? সরকারের বিরুদ্ধে চলা আওয়ামী লীগ শিবিরের বিভিন্ন প্রচারণা–অপ্রচার বিশ্বাস করছে অনেক মানুষ?প্রশ্ন হলো, গণ-অভ্যুত্থানের জনপ্রিয়তাকে পুঁজি করে ক্ষমতায় আসার পর এই সরকারের প্রতি কেন অনেক মানুষের ‘অবিশ্বাস’ তৈরি হচ্ছে? সরকারের বিরুদ্ধে চলা আওয়ামী লীগ শিবিরের বিভিন্ন প্রচারণা–অপ্রচার বিশ্বাস করছে অনেক মানুষ?
এর সহজ উত্তর হলো, রাষ্ট্র পরিচালনায় এই সরকার অনেকাংশে অতীতের সরকারের রূপরেখাকে অনুসরণ করায় তাদের ভেতর মৌলিক পার্থক্য তৈরি হয়নি। মূলত ‘জবাবদিহি’ সংস্কৃতিকে ধারণ না করার খেসারত হিসেবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার তার স্বীয় শক্তি ক্ষয়প্রাপ্ত হচ্ছে। সাধারণ মানুষের মুখোমুখি না হওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে হঠাৎ কেউ কোনো অভিযোগ তুললে তা অনেক মানুষ ‘বিশ্বাস’ করছে।
সর্বশেষ একটি ঘটনাকে উদাহরণ হিসেবে ধরা যাক। সম্প্রতি এক রাজনৈতিক নেতা টেলিভিশন টক শোতে ঐকমত্য কমিশনের ব্যয় নিয়ে একটি মনগড়া তথ্য প্রকাশ করলেন। সেই তথ্য আবার বর্তমানে কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের প্রচারমাধ্যমগুলোতে ফলাও করে প্রচার করা হলো। এরপর সরকারের পক্ষ থেকে ওই ঐকমত্য কমিশনের ব্যয় নিয়ে বিস্তারিত তথ্য প্রচার করে বলা হলো ‘ওই ৮৩ কোটি টাকা ব্যয়ের’ খবর একেবারে মিথ্যা।
আরও পড়ুনসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর জবাবদিহি ও দায়িত্ব২৬ মার্চ ২০২৫আবার গত সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘের অধিবেশনে প্রধান উপদেষ্টার সফরসঙ্গী হিসেবে শতাধিক দলের সফর নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সরকারের একটি দপ্তরের চিঠি প্রচার করা হলো, তারপর সরকারের পক্ষ থেকে একটি সংখ্যার কথা বলা হলো।
এর আগে প্রধান উপদেষ্টার লন্ডনে সফর ও ব্যয় নিয়ে যখন সরকারের বিরুদ্ধে প্রশ্ন উঠল, এরপর সরকারের পক্ষ থেকে একটি ব্যাখ্যা দেওয়া হলো। যদিও এই ব্যাখ্যা দেওয়ার আগে মানুষ বুঝে নিয়েছে, এই সরকার তাদের কাছে সেই তথ্য দেয়নি কিংবা প্রয়োজনীয়তাবোধ করেনি।
করিডর ইস্যু, চট্টগ্রাম বন্দর শুরু করে নানা বিষয় পত্রপত্রিকায় আলোচিত হওয়ার পর সরকারকে কথা বলতে হয়েছে। একই সঙ্গে আগামী জাতীয় নির্বাচন নিয়ে সরকার জোর দিয়ে বারবার আশ্বস্ত করলেও সুনির্দিষ্ট দিন–তারিখ ঘোষণা না করায় সাধারণ মানুষের ভেতর নির্বাচনের আয়োজন নিয়ে এখনো শঙ্কা আছে। ফলে সরকারকে মাঝেমধ্যে জরুরি বৈঠক ডেকে ‘ঐকমত্য’ তৈরির চেষ্টা করতে হচ্ছে। শুধু সাধারণ মানুষ নয়, এই সরকারের ঘোষণার সঙ্গে নিজেদের শক্ত অবস্থান না থাকায় খোদ রাজনৈতিক শিবিরে একধরনের অস্থিরতা কাজ করছে।
আরও পড়ুনতাঁরা ক্ষমতা চান কিন্তু জবাবদিহি করতে রাজি নন০১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫এখন প্রশ্ন হলো, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কিংবা টেলিভিশন টক শোতে ‘ঐকমত্য’ কমিশনের ব্যয়ের বিষয়টি আলোচিত না হলে ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকার’ সেই ব্যয় দেখানোর প্রয়োজনীয়তা অনুভব করত? কিংবা জাতিসংঘে সফরসঙ্গী নিয়ে আলোচনা না হলে সরকারের প্রেস উইং কি সফরসঙ্গীদের প্রয়োজনীয়তা ও প্রকৃত সংখ্যার বিষয়ে কথা বলত?
না, বলত না। কারণ, জবাবদিহির সংস্কৃতি এই সরকার শুরু থেকে চর্চা করতে পারেনি। ফলে এই সরকারের নানা কর্মকাণ্ড নিয়ে যখন আলোচনা হয়, তখন সাধারণ মানুষের মনে একধরনের সন্দেহপ্রবণতা কাজ করে। সরকার না করলেও ‘প্রোপাগান্ডার’ তথ্য অনেক সময় সরকারকে সত্যের মুখোমুখি করছে। আর করছে বলেই সরকার অনেকটাই বাধ্য হয়ে ‘তথ্য’ দিচ্ছে।
অথচ তা হওয়ার কথা ছিল না। নিজেদের কাজের ভেতর স্বচ্ছতা থাকার পূর্বশর্ত হলো আপনি যা করতে যাচ্ছেন বা চান, তার মালিক জনগণ, তার কাছে পরিষ্কার থাকা। আপনার মনিবের কাছে যদি আস্থাশীলতা তৈরি করতে পারতেন, তাহলে আপনাদের বিষয়ে যতই সমালোচনা ও নেতিবাচক প্রচার থাকুক না কেন, তা সাধারণ মানুষ গিলবে না। কিন্তু সরকার সেটি করতে অনেকাংশে ব্যর্থ হয়েছে।
আরও পড়ুনসবখানেই যখন রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ, জবাবদিহি থাকবে কোথায়২১ জুন ২০২৪এই যে আয়-ব্যয়ের হিসাবের কথাই ধরুন। সরকারের সবাই আয়কর দিচ্ছেন। কিন্তু এ নিয়েও প্রশ্ন ওঠে। কারণ, সরকারের সব সদস্যের আয়-ব্যয়ের হিসাব জনগণের কাছে উপস্থাপন করার কথা বলা হলেও আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কথা বলে এখন পর্যন্ত প্রকাশই করা যায়নি। হ্যাঁ, আপনারা হয়তো অতীতের সরকারের মতো দুর্নীতিতে জড়িয়ে যাননি, কিন্তু আপনারা কেন ‘উদাহরণ’ হতে পারলেন না?
আয়-ব্যয়ের তথ্য প্রকাশ না করলে সম্পদ নিয়ে ‘কানাঘুষা’ হওয়াই তো স্বাভাবিক। এ বিষয়ে পরবর্তী শাসকগোষ্ঠীদের জন্য একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করে যেতে পারেন আপনারা। নিজেদের আর্থিক স্বচ্ছতার হিসাব দিতে পারলে কেউ আপনাদের ‘নিরাপদ প্রস্থান’ নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারবে না।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নিজেরাই নিজেদের দুর্বলতা প্রকাশ করছে। সাধারণ মানুষের কাছ থেকে নিজেরাই নিজেদের গুটিয়ে রাখছে। ফলে তাদের বিরুদ্ধে ভবিষ্যতে কেউ যদি নানা দুর্নীতির অভিযোগ তোলে, তাহলে সেটাকে মোকাবিলা করতে বেগ পেতে হবে। আর আমরা তো জানিই, এ দেশে যারাই ক্ষমতা ছেড়েছে, তারাই পরবর্তী সময় টার্গেটে পরিণত হয়েছে।
● ড. নাদিম মাহমুদ, গবেষক, ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]
* মতামত লেখকের নিজস্ব