রাজশাহীর নওহাটা পৌরসভার ৮ নম্বর ওয়ার্ডের এক বাবা (২৬) এ বছরের এপ্রিল মাসে সন্তানের জন্মনিবন্ধনের জন্য আবেদন করেছিলেন।

কিন্তু তাঁর স্ত্রীর বয়স ১৮ বছরের কম হওয়ায় প্রক্রিয়াটি আটকে যায়। এই দম্পতিকে জানানো হয়, মায়ের বয়স ১৮ বছর পূর্ণ না হওয়ায় সন্তানের জন্মনিবন্ধন হবে না।

শিশুটির বাবা প্রথম আলোকে জানান, শেষ পর্যন্ত তাঁর স্ত্রীর বয়স ১৮ পূর্ণ হওয়ার পর সন্তানের জন্মনিবন্ধন হয়েছে। তবে তাঁর আত্মীয়দের মধ্যে ১৮ বছরের কম বয়সী মায়ের সন্তানের জন্মনিবন্ধন হতে তিনি দেখেছেন।

এই দম্পতির মতো আরও অনেকের সন্তানের ক্ষেত্রে গত কয়েক মাসে এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে। এ বিষয়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত এপ্রিল থেকে ১৮ বছরের কম বয়সী মা ও ২১ বছরের কম বয়সী বাবার সন্তানদের জন্মনিবন্ধন করা যাচ্ছে না।

বাল্যবিবাহের শিকার মা–বাবার সন্তানদের জন্মনিবন্ধন গত এপ্রিল থেকে বন্ধ। টাইফয়েডের টিকার জন্য আপাতত ছাড়।

জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন কার্যালয় কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, বাল্যবিবাহ নিরোধ আইনের সঙ্গে মিল রেখে জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধনের সফটওয়্যার ‘বিডিআরআইএস’ সিস্টেমে বয়স নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। ফলে মায়ের বয়স ১৮ বছরের কম ও বাবার বয়স ২১ বছরের কম হলে সন্তানের জন্মনিবন্ধন করা যাচ্ছিল না। এর মধ্যে টাইফয়েডের টিকার জন্য নিবন্ধন শুরু হলে বিষয়টি নিয়ে জটিলতা দেখা দেয়। বিশেষ করে মেয়েদের বাল্যবিবাহের হার বেশি হওয়ায় মায়ের বয়স নিয়েই সমস্যা বেশি হয়। ফলে কিছু সময়ের জন্য সিস্টেমে পরিবর্তন আনা হয়েছে।

এক ডোজ টিকা নিয়ে টাইফয়েড জ্বর প্রতিরোধে সরকার ১২ অক্টোবর থেকে ৯ মাস থেকে ১৫ বছর বয়সী শিশুদের জন্য বিনা মূল্যে টাইফয়েড টিকাদান কর্মসূচি শুরু করতে যাচ্ছে।

বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন ২০১৭ অনুসারে, ১৮ বছরের নিচের বয়সী মেয়ে এবং ২১ বছরের নিচের বয়সী ছেলের বিয়ে হলে তা বাল্যবিবাহ।

জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন আইন ও বিধিমালা অনুসারে সবার জন্মনিবন্ধন হতে হবে। কাউকে বাদ দেওয়া যাবে না। বাল্যবিবাহের প্রসঙ্গ তুলে কোনো মা–বাবার সন্তানের জন্মনিবন্ধন না করলে তা হবে আইনের লঙ্ঘন। বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে অন্য পন্থা অবলম্বন করতে হবে।জনস্বাস্থ্যবিষয়ক বৈশ্বিক সংস্থা ভাইটাল স্ট্র্যাটেজিসের কান্ট্রি কো–অর্ডিনেটর মো.

নজরুল ইসলাম

বাংলাদেশ জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপ (বিডিএইচএস) ২০২২ প্রতিবেদন অনুসারে, দেশে ১৮ বছরের কম বয়সী মেয়েদের বাল্যবিবাহের হার ৫০ শতাংশ। ছেলেদের বাল্যবিবাহের তথ্য সেভাবে নেই। বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস ২০২৩–এর প্রতিবেদন থেকে পাওয়া যায়, শহরাঞ্চলে প্রতি হাজারে ৭৩ জন মেয়ে ও ১৪ জন ছেলে ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সের মধ্যে বিয়ে করছে। জনসংখ্যাবিষয়ক সংস্থা ইউএনএফপিএর ‘বৈশ্বিক জনসংখ্যা পরিস্থিতি ২০২৫’ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সী ১ হাজার মেয়ের মধ্যে ৭১ জন এক বা একাধিক সন্তানের মা।

বাল্যবিবাহ হওয়া মায়ের সন্তানের জন্মনিবন্ধন বিষয়ে জানতে চাইলে রেজিস্ট্রার জেনারেল (জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন) মো. যাহিদ হোসেন গতকাল রোববার তাঁর কার্যালয়ে প্রথম আলোকে বলেন, টাইফয়েড টিকা পাবে প্রায় ৫ কোটি শিশু। সিস্টেম অনুসারে, মায়ের বয়স ১৮ বছর পূর্ণ না হলে সন্তানের জন্মনিবন্ধনের আবেদন করা যাবে না। আর জন্মনিবন্ধন না হলে ওই শিশুদের টাইফয়েডের টিকার জন্য নিবন্ধন করা যাবে না। এ কারণে সিস্টেমে মায়ের বয়স ১৬ বছর করে অক্টোবর মাস পর্যন্ত ছাড় দেওয়া হয়েছে। ফলে ১৬ বছর বা এর বেশি বয়সী মায়ের সন্তানদের এখন জন্মনিবন্ধন করা যাচ্ছে।

‘রেজিস্ট্রার জেনারেল কার্যালয়, জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন’ থেকে জানা গেছে, এ বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৯ মাসে দেশজুড়ে ৭৭ লাখ ৮১ হাজার ৩৯০টি জন্মনিবন্ধন হয়েছে। মৃত্যুনিবন্ধন হয়েছে ৬ লাখ ৮৯ হাজার ১৫টি। ২০৩০ সালের মধ্যে শতভাগ জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধনের লক্ষ্য নিয়ে আজ ৬ অক্টোবর পালিত হচ্ছে জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন দিবস। এ বছর দিবসটির নির্দিষ্ট কোনো প্রতিপাদ্য নেই। নিবন্ধনের অগ্রগতি, করণীয় ও চ্যালেঞ্জ নিয়ে ১৮ অক্টোবর আলোচনা সভার আয়োজন করবে স্থানীয় সরকার বিভাগ।

সিস্টেমে ‘বাল্যবিবাহ জটিলতা’ থাকবে কি থাকবে না

গত ১৮ আগস্ট খাগড়াছড়ি পাবর্ত্য জেলা প্রশাসক এ বি এম ইফতেখারুল ইসলাম খন্দকার রেজিস্ট্রার জেনারেল বরাবর এক চিঠি পাঠান। চিঠিতে তিনি বয়সজনিত জটিলতার বিষয়ে দিকনির্দেশনা চেয়ে লেখেন, জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন আইন ২০০৪ এবং জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন বিধিমালা ২০১৮ অনুযায়ী, জন্মনিবন্ধন করার জন্য আইনি বাধ্যবাধকতা আছে এবং এটি নাগরিকের অধিকার। তবে সাম্প্রতিক কালে শিশুর জন্মনিবন্ধনের ক্ষেত্রে মায়ের বয়স ১৮ বছর এবং বাবার বয়স ২১ বছরের কম হলে বিডিআরআইএস সিস্টেমে আবেদন করা যায় না। অন্যদিকে বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন ২০১৭ অনুসারে, বিবাহের ক্ষেত্রে নারীর বয়স ১৮ বছর এবং পুরুষের বয়স ২১ বছরের কম হলে তা দণ্ডনীয় অপরাধ হিসেবে গণ্য হয়। ফলে বিপুলসংখ্যক শিশুকে জন্মনিবন্ধনের আওতায় আনা সম্ভব হচ্ছে না। এ কারণে জেলার সামগ্রিক জন্মনিবন্ধনের সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে কমে যাচ্ছে।

জেলা প্রশাসকের এই চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে ২৪ আগস্ট মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে জ্যেষ্ঠ সহকারী সচিব এস এম মুনিম লিংকনের সই করা এক চিঠিতে সন্তানের জন্মনিবন্ধনের ক্ষেত্রে বাবা–মায়ের বয়স–সংক্রান্ত বাধা সরাতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ করা হয়। এরপর ১০ সেপ্টেম্বর স্থানীয় সরকার বিভাগ থেকে আরেকটি চিঠিতে বাবা-মায়ের বয়স–সংক্রান্ত বাধা সরাতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেওয়া হয়। এরপরই সিস্টেমে বয়সের ক্ষেত্রে আপাতত পরিবর্তন আনে রেজিস্ট্রার জেনারেল কার্যালয়।

অক্টোবরের পর বয়স–সংক্রান্ত এ জটিলতা তুলে নেওয়া হবে কি না, জানতে চাইলে রেজিস্ট্রার জেনারেল যাহিদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, আপাতত অক্টোবর পর্যন্ত করা হয়েছে। এরপর বয়সের বাধা সরিয়ে দেওয়া হবে কি না, তা নিয়ে আলোচনার পর সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। তিনি বলেন, দেশের আইন অনুসারে বাল্যবিবাহ বেআইনি। বাল্যবিবাহের নিবন্ধন হয় না। ভবিষ্যতে জটিলতা এড়াতে সব বিয়ের অনলাইন নিবন্ধন করা এবং কাজিদের মাধ্যমে যেসব বিয়ে হচ্ছে, তা ইলেকট্রনিক ফরমেটে স্থানান্তর করা দরকার।

এ বিষয়ে জনস্বাস্থ্যবিষয়ক বৈশ্বিক সংস্থা ভাইটাল স্ট্র্যাটেজিসের কান্ট্রি কো–অর্ডিনেটর মো. নজরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন আইন ও বিধিমালা অনুসারে সবার জন্মনিবন্ধন হতে হবে। কাউকে বাদ দেওয়া যাবে না। বাল্যবিবাহের প্রসঙ্গ তুলে কোনো মা–বাবার সন্তানের জন্মনিবন্ধন না করলে তা হবে আইনের লঙ্ঘন। বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে অন্য পন্থা অবলম্বন করতে হবে।

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ম য় র বয়স ১৮ বছর বছর র কম বয়স ব ব র সন ত ন প রথম আল ক ট ইফয় ড দ র জন র জন য অন স র বছর ব ম বয়স

এছাড়াও পড়ুন:

সবুজ পাতায় আলোর খেলা

২ / ৭পাতার কিনারে আটকে থাকা আলোর রেখা কুঁড়ি কোমলতাকে আরও স্পষ্ট করে তোলে

সম্পর্কিত নিবন্ধ