ইসলামি ফিকহের চারটি প্রধান মাজহাব—হানাফি, মালিকি, শাফেয়ি এবং হাম্বলি—সাহাবিদের ফিকহ ও জ্ঞানের গর্ভে জন্ম নিয়েছে। এদের শিকড় সাহাবিদের পদ্ধতির সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত, যারা ধর্মীয় জ্ঞান অর্জন, শরীয়া বিধান বোঝা এবং নাসের ব্যাখ্যা ও বাস্তবায়নে ইজতিহাদ করতেন।

সাহাবিরা ঘটনাগুলোকে তাদের অনুরূপ ঘটনার সঙ্গে তুলনা করতেন, সাদৃশ্য খুঁজতেন এবং বিধান নির্ধারণে একটিকে অপরটির সঙ্গে যুক্ত করতেন। এভাবে তারা ইজতিহাদের পথ প্রশস্ত করেন এবং উলামাদের জন্য পথ নির্দেশ করেন।

তাবিয়িনের যুগে এই পদ্ধতি আরও সুসংগঠিত হয়। চার মাজহাবের ইমামগণ সাহাবিদের শিষ্যদের শিষ্য ছিলেন। তারা সাহাবিদের জ্ঞান ও পদ্ধতি গ্রহণ করে তা প্রসারিত করেন। ইবনে কাইয়্যিম উল্লেখ করেন, ইসলামি জ্ঞান ও ফিকহের বিস্তার মূলত চারজন সাহাবির শিক্ষার মাধ্যমে হয়েছে: আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ, জায়েদ ইবনে সাবিত, আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর এবং আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.

)।

মদিনার জ্ঞান এসেছে জায়েদ ও ইবনে ওমরের শিক্ষা থেকে, মক্কার জ্ঞান ইবনে আব্বাসের শিক্ষা থেকে এবং ইরাকের জ্ঞান ইবনে মাসউদের শিক্ষা থেকে। (ইবনে কাইয়্যিম জাওযি, ই‘লাম আল-মুওয়াক্কিঈন, ১/১৭, দারুল কুতুব আল-ইলমিয়্যাহ, বৈরুত, ১৯৯১)

আহলে হাদিসগণ সমালোচনা করতেন যে আহলে রায় অতিরিক্ত কিয়াস করেন, আর আহলে রায় মনে করতেন যে আহলে হাদিস কোরআন-হাদিসের মূলপাঠের (নস) আক্ষরিক ব্যাখ্যায় আটকে থাকেন।সাহাবিদের জ্ঞান প্রসার ও নগরায়ণ

খলিফা ওসমানের সময় সাহাবিরা বিভিন্ন ইসলামি নগরীতে ছড়িয়ে পড়েন। কেউ হেজাজে থেকে যান, বিশেষত মদিনায়, কেউ ইরাকের কুফায় বা অন্যান্য নগরে যান। এই সময় নতুন ইসলামি শহর গড়ে ওঠে, যেখানে সাহাবিরা রাসুল (সা.) কাছ থেকে পাওয়া জ্ঞান ও ফিকহ নিয়ে যান।

ইরাক, বিশেষ করে কুফা, তিন শতাধিক সাহাবির আগমনের কারণে ফিকহের কেন্দ্র হয়ে ওঠে। ইবনে মাসউদ, সাদ ইবনে আবু ওয়াক্কাস, আম্মার ইবনে ইয়াসির, আবু মুসা আশআরি, মুগিরা ইবনে শুবা, আনাস ইবনে মালিক, হুজাইফা, ইমরান ইবনে হুসাইন এবং আলী ইবনে আবু তালিবের সময়ে ইবনে আব্বাসের মতো সাহাবিরা সেখানে বসবাস করেন বা ভ্রমণ করেন।

এ কারণে ইরাক ফিকহ ও সুন্নাহর ক্ষেত্রে মদিনার সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে।

আরও পড়ুনসাহাবিদের যুগে ইসলামি ফিকহের বিকাশ২০ ঘণ্টা আগে

এই বিস্তারের ফলে ফিকহের দুটি প্রধান ধারা গড়ে ওঠে: হেজাজের আহলে হাদিস বা মদিনার চিন্তাধারা (স্কুল) এবং ইরাকের আহলে রায় বা কুফার চিন্তাধারা (স্কুল)।

মদিনার স্কুল, যার নেতৃত্বে ছিলেন সাইদ ইবনে মুসাইয়্যিব, পরবর্তীতে মালিকি, শাফেয়ি এবং হাম্বলি মাজহাবে রূপান্তরিত হয়। তারা সাহাবিদের বর্ণনার (আসার) ওপর নির্ভর করতেন এবং কিয়াসের ব্যবহার কম করতেন।

অন্যদিকে, কুফার স্কুল, যার নেতৃত্বে ছিলেন ইবরাহিম নাখয়ি, ইবনে মাসউদের শিষ্য, তারা রায় ও কিয়াসের ওপর বেশি নির্ভর করত। পরবর্তী সময়ে এটিই হানাফি মাজহাব হিসেবে পরিচিত হয়। (জাহাবি, আল-ফিকরুস সামি, ১/৩৮৩, দারুল কুতুব আল-ইলমিয়্যাহ, বৈরুত, ১৯৯৫)

ওমর (রা.) ছিলেন সাহাবিদের মধ্যে ‘নস’ বোঝায় ও ইজতিহাদে অগ্রগণ্য। তিনি জটিল সমস্যায় সাহাবিদের সঙ্গে পরামর্শ করতেন এবং কখনো কখনো এক মাস ধরে বিষয়টি বিবেচনা করতেন।মদিনা ও কুফার স্কুলের মধ্যে পার্থক্য

তাবিয়িনের যুগে এই দুই স্কুলের মধ্যে পার্থক্য আরও স্পষ্ট হয়, বিশেষ করে উমাইয়া খিলাফতের শেষের দিকে। ফিকহের সংকলন ও বিদয়াতি দলের উত্থানের কারণে এই পার্থক্য গভীর হয়।

আহলে হাদিসগণ সমালোচনা করতেন যে আহলে রায় অতিরিক্ত কিয়াস করেন, আর আহলে রায় মনে করতেন যে আহলে হাদিস কোরআন-হাদিসের মূলপাঠের (নস) আক্ষরিক ব্যাখ্যায় আটকে থাকেন।

যদিও রায় গ্রহণ কোনো সমস্যা নয়, বরং যে রায় ব্যক্তিগত অভিলাষের ওপর ভিত্তি করে হয় এবং শরীয়তের উদ্দেশ্যের বিরোধিতা করে দেওয়া হয়, তা নিন্দনীয়। এই সমালোচনা মূলত বিদয়াতি দলগুলোর প্রতি প্রযোজ্য, যারা সাহাবিদের পদ্ধতি অনুসরণ করতেন না। ইরাকের আহলে রায় সাহাবিদের সঙ্গে সংযুক্ত ছিলেন এবং তাদের জ্ঞানের উত্তরাধিকারী ছিলেন।

সাহাবিদের মধ্যে ‘নস’ বোঝার দুটি ধারা ছিল। একটি দল আক্ষরিক অর্থ গ্রহণ করতেন, এর উদ্দেশ্য বা প্রেক্ষাপট বিবেচনা না করেই। অন্য দল উদ্দেশ্য ও হিকমত বোঝার চেষ্টা করতেন শরীয়তের সাধারণ উদ্দেশ্যের আলোকে।

প্রথম দলটি রাসুলের নির্দেশের ভুল প্রয়োগের ভয়ে সতর্ক ছিলেন, আর দ্বিতীয় দলটি, বিশেষ করে দায়িত্বশীল সাহাবিরা, রায় প্রয়োগে বেশি সক্রিয় ছিলেন। (মুস্তফা আয-যারকা, আল-মাদখাল আল-ফিকহি আল-আম, পৃষ্ঠা: ১৮৬, দারুল কালাম, দামেস্ক, ১৯৬৮)

আরও পড়ুনফরজে কিফায়া: একের পালন, সবার মুক্তি১০ জুলাই ২০২৫ওমর ইবনে খাত্তাব ও আহলে রায়ের মাজহাব

ইরাকের আহলে রায়ের শিকড় ওমর ইবনে খাত্তাবের (রা.) ফিকহের সঙ্গে যুক্ত। ওমর ছিলেন সাহাবিদের মধ্যে ‘নস’ বোঝায় ও ইজতিহাদে অগ্রগণ্য। তিনি জটিল সমস্যায় সাহাবিদের সঙ্গে পরামর্শ করতেন এবং কখনো কখনো এক মাস ধরে বিষয়টি বিবেচনা করতেন। (মানা‘ আল-কাত্তান, তারিখুত তাশরি‘ইল ইসলামি, পৃষ্ঠা: ২৮৯, দারুল ফিকর, বৈরুত, ২০০১)

আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) ওমরের পদ্ধতি অনুসরণ করতেন এবং বলতেন, “ওমর নয়-দশাংশ জ্ঞান নিয়ে গেছেন।” তিনি ওমরের (রা.) মতামতের সঙ্গে খুব কমই ভিন্নমত পোষণ করতেন এবং বলতেন, “মানুষ যদি একটি পথে যায় আর ওমর অন্য পথে যান, আমি ওমরের পথে যাব।” (ইবনে কাইয়্যিম, ই‘লাম আল-মুওয়াক্কিঈন, ১/১৭)।

ইবনে মাসউদের ফিকহ গ্রহণ করেন কুফার প্রধান ফকিহ ইবরাহিম নাখয়ি। তিনি ওমর ও ইবনে মাসউদের মতামতকে প্রাধান্য দিতেন। তাঁর শিষ্যদের মাধ্যমে এই জ্ঞান ইবনে আবু লায়লা, ইবনে শুবরুমা, শারিক আল-কাজি এবং ইমাম আবু হানিফার কাছে পৌঁছায়।

আবু হানিফার শিষ্য মুহাম্মদ ইবনে হাসান মদিনায় গিয়ে ইমাম মালিকের মুওয়াত্তা পড়েন। ইমাম শাফেয়ি আহলে রায়ের ফিকহ শেখেন হানাফি ফকিহ ইমাম মুহাম্মদের কাছ থেকে।আহলে হাদিস ও আহলে রায়ের মেলবন্ধন

তাবিয়িনের যুগে দুই স্কুলের মধ্যে পার্থক্য ছিল সীমিত সময়ের জন্য। ফিকহের প্রাথমিক পর্যায়ে ঘটে যাওয়া দ্রুত ঘটনাবলি ও ফকিহদের মধ্যে মতভেদ তা তীব্র করে তোলে। তবে হাদিসের প্রচার বাড়লে এবং ফকিহদের ফতোয়া বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়লে এই পার্থক্য কমে যায়। কিয়াস ফিকহের একটি গৃহীত উৎস হিসেবে স্বীকৃত হয় তখন।

পরবর্তী প্রজন্মে এই দুই স্কুলের শিষ্যরা একে অপরের কাছ থেকে শিখেছেন। আবু হানিফার শিষ্য মুহাম্মদ ইবনে হাসান মদিনায় গিয়ে ইমাম মালিকের মুওয়াত্তা পড়েন। ইমাম শাফেয়ি আহলে রায়ের ফিকহ শেখেন হানাফি ফকিহ ইমাম মুহাম্মদের কাছ থেকে। ইমাম আবু ইউসুফ হাদিস দিয়ে আহলে রায়ের মত সমর্থন করেন। ফলে ফিকহের বইগুলো হাদিস ও রায় উভয়ের সমন্বয়ে সমৃদ্ধ হয়। (মুহাম্মদ আবু যাহরা, আল-মিলকিয়্যাহ ওয়া নাযারিয়্যাতুল আকদ, পৃষ্ঠা: ৩১, দারুল ফিকর আল-আরাবি, কায়রো, ১৯৭৮)।

দ্বিতীয় শতক থেকে চতুর্থ শতকের মাঝামাঝি ফিকহের সংকলন ত্বরান্বিত হয়। আবু ইউসুফ, আবু হানিফার প্রধান শিষ্য, নামাজ, যাকাত, খারাজ ইত্যাদি বিষয়ে বই লিখেন। (মুহাম্মদ ইবনে আহমাদ ইবনেন নাদিম, আল-ফিহরিস্ত, পৃষ্ঠা: ২৫৩, দারুল মা‘রিফাহ, বৈরুত, ১৯৭৮)

মুহাম্মদ ইবনে হাসান আবু হানিফার মতামত লিখেন, মালিক মুওয়াত্তা রচনা করেন, শাফেয়ি কিতাব আল-উম্ম রচনা করেন।

এভাবে চার মাজহাবের ভিত্তি গড়ে ওঠে এবং তাদের মতামত সুসংগঠিতভাবে লিপিবদ্ধ হয়।

আরও পড়ুনফকিহদের দৃষ্টিতে নারী-পুরুষের মধ্যকার প্রেম–ভালোবাসা২৬ জুলাই ২০২৫

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: উদ দ শ য করত ন য ইজত হ দ ম সউদ র গ রহণ ক মদ ন র র আহল ন ইবন ওমর র মত মত ইসল ম দ ইবন

এছাড়াও পড়ুন:

চার মাজহাবের উৎপত্তি কীভাবে হল

ইসলামি ফিকহের চারটি প্রধান মাজহাব—হানাফি, মালিকি, শাফেয়ি এবং হাম্বলি—সাহাবিদের ফিকহ ও জ্ঞানের গর্ভে জন্ম নিয়েছে। এদের শিকড় সাহাবিদের পদ্ধতির সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত, যারা ধর্মীয় জ্ঞান অর্জন, শরীয়া বিধান বোঝা এবং নাসের ব্যাখ্যা ও বাস্তবায়নে ইজতিহাদ করতেন।

সাহাবিরা ঘটনাগুলোকে তাদের অনুরূপ ঘটনার সঙ্গে তুলনা করতেন, সাদৃশ্য খুঁজতেন এবং বিধান নির্ধারণে একটিকে অপরটির সঙ্গে যুক্ত করতেন। এভাবে তারা ইজতিহাদের পথ প্রশস্ত করেন এবং উলামাদের জন্য পথ নির্দেশ করেন।

তাবিয়িনের যুগে এই পদ্ধতি আরও সুসংগঠিত হয়। চার মাজহাবের ইমামগণ সাহাবিদের শিষ্যদের শিষ্য ছিলেন। তারা সাহাবিদের জ্ঞান ও পদ্ধতি গ্রহণ করে তা প্রসারিত করেন। ইবনে কাইয়্যিম উল্লেখ করেন, ইসলামি জ্ঞান ও ফিকহের বিস্তার মূলত চারজন সাহাবির শিক্ষার মাধ্যমে হয়েছে: আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ, জায়েদ ইবনে সাবিত, আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর এবং আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.)।

মদিনার জ্ঞান এসেছে জায়েদ ও ইবনে ওমরের শিক্ষা থেকে, মক্কার জ্ঞান ইবনে আব্বাসের শিক্ষা থেকে এবং ইরাকের জ্ঞান ইবনে মাসউদের শিক্ষা থেকে। (ইবনে কাইয়্যিম জাওযি, ই‘লাম আল-মুওয়াক্কিঈন, ১/১৭, দারুল কুতুব আল-ইলমিয়্যাহ, বৈরুত, ১৯৯১)

আহলে হাদিসগণ সমালোচনা করতেন যে আহলে রায় অতিরিক্ত কিয়াস করেন, আর আহলে রায় মনে করতেন যে আহলে হাদিস কোরআন-হাদিসের মূলপাঠের (নস) আক্ষরিক ব্যাখ্যায় আটকে থাকেন।সাহাবিদের জ্ঞান প্রসার ও নগরায়ণ

খলিফা ওসমানের সময় সাহাবিরা বিভিন্ন ইসলামি নগরীতে ছড়িয়ে পড়েন। কেউ হেজাজে থেকে যান, বিশেষত মদিনায়, কেউ ইরাকের কুফায় বা অন্যান্য নগরে যান। এই সময় নতুন ইসলামি শহর গড়ে ওঠে, যেখানে সাহাবিরা রাসুল (সা.) কাছ থেকে পাওয়া জ্ঞান ও ফিকহ নিয়ে যান।

ইরাক, বিশেষ করে কুফা, তিন শতাধিক সাহাবির আগমনের কারণে ফিকহের কেন্দ্র হয়ে ওঠে। ইবনে মাসউদ, সাদ ইবনে আবু ওয়াক্কাস, আম্মার ইবনে ইয়াসির, আবু মুসা আশআরি, মুগিরা ইবনে শুবা, আনাস ইবনে মালিক, হুজাইফা, ইমরান ইবনে হুসাইন এবং আলী ইবনে আবু তালিবের সময়ে ইবনে আব্বাসের মতো সাহাবিরা সেখানে বসবাস করেন বা ভ্রমণ করেন।

এ কারণে ইরাক ফিকহ ও সুন্নাহর ক্ষেত্রে মদিনার সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে।

আরও পড়ুনসাহাবিদের যুগে ইসলামি ফিকহের বিকাশ২০ ঘণ্টা আগে

এই বিস্তারের ফলে ফিকহের দুটি প্রধান ধারা গড়ে ওঠে: হেজাজের আহলে হাদিস বা মদিনার চিন্তাধারা (স্কুল) এবং ইরাকের আহলে রায় বা কুফার চিন্তাধারা (স্কুল)।

মদিনার স্কুল, যার নেতৃত্বে ছিলেন সাইদ ইবনে মুসাইয়্যিব, পরবর্তীতে মালিকি, শাফেয়ি এবং হাম্বলি মাজহাবে রূপান্তরিত হয়। তারা সাহাবিদের বর্ণনার (আসার) ওপর নির্ভর করতেন এবং কিয়াসের ব্যবহার কম করতেন।

অন্যদিকে, কুফার স্কুল, যার নেতৃত্বে ছিলেন ইবরাহিম নাখয়ি, ইবনে মাসউদের শিষ্য, তারা রায় ও কিয়াসের ওপর বেশি নির্ভর করত। পরবর্তী সময়ে এটিই হানাফি মাজহাব হিসেবে পরিচিত হয়। (জাহাবি, আল-ফিকরুস সামি, ১/৩৮৩, দারুল কুতুব আল-ইলমিয়্যাহ, বৈরুত, ১৯৯৫)

ওমর (রা.) ছিলেন সাহাবিদের মধ্যে ‘নস’ বোঝায় ও ইজতিহাদে অগ্রগণ্য। তিনি জটিল সমস্যায় সাহাবিদের সঙ্গে পরামর্শ করতেন এবং কখনো কখনো এক মাস ধরে বিষয়টি বিবেচনা করতেন।মদিনা ও কুফার স্কুলের মধ্যে পার্থক্য

তাবিয়িনের যুগে এই দুই স্কুলের মধ্যে পার্থক্য আরও স্পষ্ট হয়, বিশেষ করে উমাইয়া খিলাফতের শেষের দিকে। ফিকহের সংকলন ও বিদয়াতি দলের উত্থানের কারণে এই পার্থক্য গভীর হয়।

আহলে হাদিসগণ সমালোচনা করতেন যে আহলে রায় অতিরিক্ত কিয়াস করেন, আর আহলে রায় মনে করতেন যে আহলে হাদিস কোরআন-হাদিসের মূলপাঠের (নস) আক্ষরিক ব্যাখ্যায় আটকে থাকেন।

যদিও রায় গ্রহণ কোনো সমস্যা নয়, বরং যে রায় ব্যক্তিগত অভিলাষের ওপর ভিত্তি করে হয় এবং শরীয়তের উদ্দেশ্যের বিরোধিতা করে দেওয়া হয়, তা নিন্দনীয়। এই সমালোচনা মূলত বিদয়াতি দলগুলোর প্রতি প্রযোজ্য, যারা সাহাবিদের পদ্ধতি অনুসরণ করতেন না। ইরাকের আহলে রায় সাহাবিদের সঙ্গে সংযুক্ত ছিলেন এবং তাদের জ্ঞানের উত্তরাধিকারী ছিলেন।

সাহাবিদের মধ্যে ‘নস’ বোঝার দুটি ধারা ছিল। একটি দল আক্ষরিক অর্থ গ্রহণ করতেন, এর উদ্দেশ্য বা প্রেক্ষাপট বিবেচনা না করেই। অন্য দল উদ্দেশ্য ও হিকমত বোঝার চেষ্টা করতেন শরীয়তের সাধারণ উদ্দেশ্যের আলোকে।

প্রথম দলটি রাসুলের নির্দেশের ভুল প্রয়োগের ভয়ে সতর্ক ছিলেন, আর দ্বিতীয় দলটি, বিশেষ করে দায়িত্বশীল সাহাবিরা, রায় প্রয়োগে বেশি সক্রিয় ছিলেন। (মুস্তফা আয-যারকা, আল-মাদখাল আল-ফিকহি আল-আম, পৃষ্ঠা: ১৮৬, দারুল কালাম, দামেস্ক, ১৯৬৮)

আরও পড়ুনফরজে কিফায়া: একের পালন, সবার মুক্তি১০ জুলাই ২০২৫ওমর ইবনে খাত্তাব ও আহলে রায়ের মাজহাব

ইরাকের আহলে রায়ের শিকড় ওমর ইবনে খাত্তাবের (রা.) ফিকহের সঙ্গে যুক্ত। ওমর ছিলেন সাহাবিদের মধ্যে ‘নস’ বোঝায় ও ইজতিহাদে অগ্রগণ্য। তিনি জটিল সমস্যায় সাহাবিদের সঙ্গে পরামর্শ করতেন এবং কখনো কখনো এক মাস ধরে বিষয়টি বিবেচনা করতেন। (মানা‘ আল-কাত্তান, তারিখুত তাশরি‘ইল ইসলামি, পৃষ্ঠা: ২৮৯, দারুল ফিকর, বৈরুত, ২০০১)

আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) ওমরের পদ্ধতি অনুসরণ করতেন এবং বলতেন, “ওমর নয়-দশাংশ জ্ঞান নিয়ে গেছেন।” তিনি ওমরের (রা.) মতামতের সঙ্গে খুব কমই ভিন্নমত পোষণ করতেন এবং বলতেন, “মানুষ যদি একটি পথে যায় আর ওমর অন্য পথে যান, আমি ওমরের পথে যাব।” (ইবনে কাইয়্যিম, ই‘লাম আল-মুওয়াক্কিঈন, ১/১৭)।

ইবনে মাসউদের ফিকহ গ্রহণ করেন কুফার প্রধান ফকিহ ইবরাহিম নাখয়ি। তিনি ওমর ও ইবনে মাসউদের মতামতকে প্রাধান্য দিতেন। তাঁর শিষ্যদের মাধ্যমে এই জ্ঞান ইবনে আবু লায়লা, ইবনে শুবরুমা, শারিক আল-কাজি এবং ইমাম আবু হানিফার কাছে পৌঁছায়।

আবু হানিফার শিষ্য মুহাম্মদ ইবনে হাসান মদিনায় গিয়ে ইমাম মালিকের মুওয়াত্তা পড়েন। ইমাম শাফেয়ি আহলে রায়ের ফিকহ শেখেন হানাফি ফকিহ ইমাম মুহাম্মদের কাছ থেকে।আহলে হাদিস ও আহলে রায়ের মেলবন্ধন

তাবিয়িনের যুগে দুই স্কুলের মধ্যে পার্থক্য ছিল সীমিত সময়ের জন্য। ফিকহের প্রাথমিক পর্যায়ে ঘটে যাওয়া দ্রুত ঘটনাবলি ও ফকিহদের মধ্যে মতভেদ তা তীব্র করে তোলে। তবে হাদিসের প্রচার বাড়লে এবং ফকিহদের ফতোয়া বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়লে এই পার্থক্য কমে যায়। কিয়াস ফিকহের একটি গৃহীত উৎস হিসেবে স্বীকৃত হয় তখন।

পরবর্তী প্রজন্মে এই দুই স্কুলের শিষ্যরা একে অপরের কাছ থেকে শিখেছেন। আবু হানিফার শিষ্য মুহাম্মদ ইবনে হাসান মদিনায় গিয়ে ইমাম মালিকের মুওয়াত্তা পড়েন। ইমাম শাফেয়ি আহলে রায়ের ফিকহ শেখেন হানাফি ফকিহ ইমাম মুহাম্মদের কাছ থেকে। ইমাম আবু ইউসুফ হাদিস দিয়ে আহলে রায়ের মত সমর্থন করেন। ফলে ফিকহের বইগুলো হাদিস ও রায় উভয়ের সমন্বয়ে সমৃদ্ধ হয়। (মুহাম্মদ আবু যাহরা, আল-মিলকিয়্যাহ ওয়া নাযারিয়্যাতুল আকদ, পৃষ্ঠা: ৩১, দারুল ফিকর আল-আরাবি, কায়রো, ১৯৭৮)।

দ্বিতীয় শতক থেকে চতুর্থ শতকের মাঝামাঝি ফিকহের সংকলন ত্বরান্বিত হয়। আবু ইউসুফ, আবু হানিফার প্রধান শিষ্য, নামাজ, যাকাত, খারাজ ইত্যাদি বিষয়ে বই লিখেন। (মুহাম্মদ ইবনে আহমাদ ইবনেন নাদিম, আল-ফিহরিস্ত, পৃষ্ঠা: ২৫৩, দারুল মা‘রিফাহ, বৈরুত, ১৯৭৮)

মুহাম্মদ ইবনে হাসান আবু হানিফার মতামত লিখেন, মালিক মুওয়াত্তা রচনা করেন, শাফেয়ি কিতাব আল-উম্ম রচনা করেন।

এভাবে চার মাজহাবের ভিত্তি গড়ে ওঠে এবং তাদের মতামত সুসংগঠিতভাবে লিপিবদ্ধ হয়।

আরও পড়ুনফকিহদের দৃষ্টিতে নারী-পুরুষের মধ্যকার প্রেম–ভালোবাসা২৬ জুলাই ২০২৫

সম্পর্কিত নিবন্ধ