গণমানুষের কাছে পৌঁছানোর ভাষা কেমন হবে
Published: 6th, November 2025 GMT
ছোটবেলায় আমার প্রায় নিরক্ষর পিতামহ শীতের সকালে বারান্দায় বসে আমাদের সঙ্গে চা-মুড়ি খাচ্ছিলেন। আমার আইনজীবী পিতাও সেখানে ছিলেন, যাঁর সামাজিক প্রজ্ঞা ও আদবকেতা যথেষ্ট আধুনিক ছিল। সেই মুহূর্তে পাড়ার এক কলেজপড়ুয়া আমাদের দূরসম্পর্কের ভাই তাঁর এক বন্ধুকে নিয়ে হাজির।
পিতামহ জিজ্ঞাসা করলেন, ‘হ্যাঁরে, তোর সাথের ছেলেটা কে?’ ভাই কায়দা করে জবাব দিলেন, ‘হি ইজ মাই ফ্রেন্ড’। পিতামহ বুঝতে না পারা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলেন। পিতা আরক্ত চোখে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে গম্ভীর গলায় জিজ্ঞাসা করলেন ‘ফ্রেন্ড মানে কী?’ কেতাদুরস্ত ভাই থতমত খেয়ে মিনমিন করলেন, ‘না, মানে, আমার বন্ধু।’
‘তো সেটাই বলবে। যাকে বলেছ, তিনি কি ইংরেজি বোঝেন?’ পিতার রীতিমতো হুংকার।
এ ঘটনার অবতারণার কারণ বলছি। তার আগে আরও দু–একটা ঘটনা বলি। মুক্তিযুদ্ধের পর গ্রামে-গঞ্জে সবার বাড়িতে রেডিও ছিল না। গ্রামের একটি দোকানে হয়তো রেডিও বাজত। যেদিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিতেন, সেদিন দোকানে উপচে পড়া ভিড় থাকত। একদিন ভাষণ শেষ হলে এক বাচাল সহজ-সরল যুবক বাড়ি বাড়ি ঢুকে বলে বেড়াতে লাগল, ‘এখন থেকে মেয়েদের সবাইকে কপালে টিপ দিতে হবে, হিন্দু-মুসলমান সবাইকে, বঙ্গবন্ধুর আদেশ।’
তা শুনে মুসলমান বউঝিরা দাঁতে ঘোমটা কেটে রা কাড়ে না—বঙ্গবন্ধুর আদেশ বলে কথা! কেউ আবার বলে বসে, ‘ওই দেখো, লোকে কি আর এমনিই বলেছিল, নৌকায় ভোট দিলে এ দেশ হিন্দুস্তান হয়ে যাবে?’
আসলে বিষয়টা হচ্ছে শেখ মুজিব ভাষণে এ রকম বলেছিলেন, ‘এখন থেকে গ্রামে গ্রামে কপারেটিভ করতে হবে।’ ‘কো–অপারেটিভ’কে না বুঝে সেই যুবক ‘কপালে টিপ’ ভেবেছিল। বঙ্গবন্ধু সমবায় সমিতি বললেই ল্যাঠা চুকে যেত।
যা বলতে চাচ্ছিলাম তা হলো, এ ঘটনার অবতারণার কারণ হলো, ইদানীং জুলাই জাতীয় সনদ বা জুলাই ঘোষণাপত্রের ওপর কোনো কোনো রাজনৈতিক দল ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দিচ্ছে। প্রায় প্রতিটা টক শো, সংবাদপত্র ও বক্তৃতা–বিবৃতিতে এই ইংরেজি শব্দগুচ্ছ ব্যবহার করা হচ্ছে, যেন এটার বাংলা বললে এর গুরুত্ব কমে যাবে।
জাতীয় নির্বাচন আসন্ন। রাজনৈতিক নেতা–কর্মীরা এলাকায় এলাকায় প্রচারে নামছেন। সাধারণ অক্ষরজ্ঞানহীন মানুষের কাছে পৌঁছাতে গেলে ইংরেজি পরিহার করাই ভালো, পারলে কঠিন বাংলা শব্দও।আমাদের দেশের শিক্ষিত ধনী মধ্যবিত্ত ছাড়াও গরিব নিরক্ষর মুটে-মজুর সবাই রাজনীতিসচেতন। তাঁদের রাজনৈতিক প্রজ্ঞা কোনো কোনো ক্ষেত্রে টক শোর সাংবাদিকদের চেয়ে কম নয়। পাড়ার দোকানে এটা–ওটা কিনতে গিয়ে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ কী জিনিস, জিজ্ঞাসা করেছিলাম প্রান্তিক মানুষজনকে। তঁারা এর মানে জানেন না বলছিলেন। গ্রামের বাড়ি বেড়াতে গিয়ে অটোওয়ালাকে জিজ্ঞাসা করলে তিনি দ্বিধাহীনভাবে জবাব দিয়েছিলেন, ‘নো টোপ দিছেন’-এর কথা বলছেন? এর মানে হলো কোনো টোপ দেওয়া যাবে না।’
বুঝুন! এই মানুষজনের কাছে জুলাই জাতীয় সনদের ৮৪ ধারা তুলে ধরবেন, তারপর গণভোটের দিন ব্যালট পেপারে প্রশ্ন রাখবেন, ‘আপনি কি জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ, ২০২৫ ইহার তফসিল ১-এ সন্নিবেশিত সংবিধান সংস্কার–সম্পর্কিত খসড়া বিলের প্রস্তাবসমূহের প্রতি আপনার সম্মতি জ্ঞাপন করিতেছেন?’
আমাদের অক্ষরজ্ঞানহীন মানুষজন ‘হ্যাঁ’, ‘না’ শব্দ দুটিও পড়তে জানেন না, তাঁরা কিসের ওপর সিল মারবেন? তাঁদের কাছে ব্যালট পেপার মানেই মার্কা। গণভোটের ব্যালট পেপারে এত বড় চোথা যাঁরা সংযুক্ত করতে চান, তাঁরা বাস্তবিকই পিএইচডি ডিগ্রিধারী। তাঁদের মাথায় অভিসন্দর্ভের সুদীর্ঘ শিরোনাম খেলা করে।
উদাহরণস্বরূপ একটি অভিসন্দর্ভের নাতিদীর্ঘ শিরোনাম এ রকম, ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উপন্যাসে নারী চরিত্রের সামাজিক ও মানসিক অবস্থান: ঊনবিংশ শতাব্দীর বাংলা সমাজের প্রেক্ষাপটে একটি বিশ্লেষণ’।
অনেক শিক্ষিত মানুষেরও ‘নোট অব ডিসেন্ট’ বুঝতে সময় লেগেছে। এ তো আর ক্রিকেটের ‘বেনিফিট অব ডাউট’ নয় যে দেখে শেখা যাবে। অসম্মতি, অমত, ভিন্নমত, বিরোধী মত, আপত্তি ইত্যাদি এত বাংলা প্রতিশব্দ থাকতে কেন ‘নোট অব ডিসেন্ট’ বলে পাণ্ডিত্য জাহির করা?
এ যেন সেই কৌতুকের মতো, ‘সামথিং ইজ বেটার দ্যান নাথিং’–এর মানে কী, জিজ্ঞাসা করলে যেমন উত্তর আসে, ‘সামসুদ্দিনের বেটার ঘরের নাতি’। ‘মব’ শব্দটিও একালীন। আগে সঙ্গে ‘কালচার’ ছিল। পরে ‘মব সন্ত্রাস’ হলো কিন্তু গ্রামগঞ্জে মানুষ এখন উচ্ছৃঙ্খল জনতা দেখলেই বলে ‘মগ আসছে, মগ আসছে’।
জাতীয় নির্বাচন আসন্ন। রাজনৈতিক নেতা–কর্মীরা এলাকায় এলাকায় প্রচারে নামছেন। সাধারণ অক্ষরজ্ঞানহীন মানুষের কাছে পৌঁছাতে গেলে ইংরেজি পরিহার করাই ভালো, পারলে কঠিন বাংলা শব্দও।
মনে আছে, স্বাধীনতার পর রেডিওর খবরে শোনা গেল, ‘চীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছে’। গ্রামের একজন প্রবীণ মানুষ এক সহজ–সরল যুবককে স্বীকৃতির অর্থ জিজ্ঞাসা করেছিলেন। যুবক জবাবে বলেছিলেন, ‘ওটা আসলে হবে সেগ্রেটি। মানে চীন বাংলাদেশকে প্রচুর সিগারেট দেবে।’
উম্মে মুসলিমা কথাসাহিত্যিক
[email protected]
মতামত লেখকের নিজস্ব
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ন ট অব ড স ন ট র জন ত ক এল ক য় হ র কর আম দ র
এছাড়াও পড়ুন:
ডেঙ্গুতে আরও ৫ জনের মৃত্যু
দেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু থামছে না। সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে আরও পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে তিনজনের মৃত্যু হয়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকার হাসপাতালে। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন এলাকা ও ময়মনসিংহ বিভাগের হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় অপর দুজনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে চলতি মাসের প্রথম ছয় দিনে ডেঙ্গুতে ২৯ জনের মৃত্যু হলো।
আজ বৃহস্পতিবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ডেঙ্গুবিষয়ক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে। এতে বলা হয়, গত বুধবার সকাল আটটা থেকে আজ সকাল আটটা পর্যন্ত ১ হাজার ৩৪ জন রোগী দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ডেঙ্গু নিয়ে ভর্তি হয়েছেন। এর মধ্যে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের হাসপাতালগুলোতে ডেঙ্গু নিয়ে ভর্তি হয়েছেন ৩৭১ জন। দুই সিটির বাইরে ঢাকা বিভাগে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ব্যক্তির সংখ্যা ১৮৮। ঢাকার বাইরে বরিশাল বিভাগে সবচেয়ে বেশি ১৩৪ জন রোগী ভর্তি হয়েছেন। সব মিলিয়ে এবার এখন পর্যন্ত ডেঙ্গু নিয়ে ৭৬ হাজার ২৬ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। আর হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েছেন ৭২ হাজার ৩৮৮ জন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, দেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে চলতি বছর এখন পর্যন্ত ৩০৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে গত মাসে মারা গেছেন ৮০ জন, যা চলতি বছর এখন পর্যন্ত কোনো এক মাসে ডেঙ্গুতে সর্বোচ্চ মৃত্যু। গত মাসে ডেঙ্গু নিয়ে সর্বোচ্চ ২২ হাজার ৫২০ জন দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এর আগে সেপ্টেম্বর মাসে ডেঙ্গুতে ৭৬ জনের মৃত্যু হয়েছিল। হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন ১৫ হাজার ৮৬৬ জন।
চলতি বছরের জুনে ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়তে শুরু করে। ওই সময় অনেক বিশেষজ্ঞ বলেছিলেন, এবার ডেঙ্গুর প্রকোপ বড় আকারের হতে পারে। কিন্তু সরকার ডেঙ্গু প্রকোপ কমাতে তেমন কোনো জোরালো পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। গত জুলাই মাসে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা জুনের দ্বিগুণ হয়ে যায়। আগস্টে মৃত্যু ও সংক্রমণ সামান্য কমে। কিন্তু সেপ্টেম্বরে তা আবার বেড়ে যায়। সেপ্টেম্বরে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিলেন ১৫ হাজার ৮৬৬ জন। অক্টোবরে প্রায় সাত হাজার রোগী বেড়েছে।
২০০০ সালে ঢাকায় বড় আকারে ডেঙ্গুর প্রকোপ দেখা দেয়। ওই বছর ৫ হাজার ৫৫১ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিলেন। এর মধ্যে মারা যান ৯৩ জন। ঘটনাটি সাধারণ মানুষের কাছে নতুন ছিল। ডেঙ্গুতে সবচেয়ে বেশি মানুষ আক্রান্ত ও মারা যান ২০২৩ সালে। সে বছর আক্রান্ত হয়েছিলেন তিন লাখের বেশি মানুষ। মারা যান ১ হাজার ৭০৫ জন।