দিল্লিতে সেদিন বিতর্কের ঝড় উঠেছিল অ্যাঞ্জেলো ম্যাথিউসের টাইমড আউটে। আইনসিদ্ধভাবে আউট করে সেদিন প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছিলেন সাকিব আল হাসান। ‘স্পিরিট অব স্পোর্টস’ নিয়ে জ্ঞানগর্ভ আলোচনা হলেও ক্রিকেটের পণ্ডিতরা সাকিবের পক্ষেই ছিলেন। বিশ্বকাপে ম্যাথিউসকে টাইমড আউট করা ম্যাচটি জিতে নেওয়ার নায়কও ছিলেন সাকিব। অধিনায়কের কৃতিত্বে লঙ্কানদের বিপক্ষে ম্যাচ জিতে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে খেলা নিশ্চিত করেছিল বাংলাদেশ। দেশের স্বার্থে ২০২৩ সালের ৬ নভেম্বর বিতর্ক মাথা পেতে নেওয়া সেই সাকিবই এবার ‘টাইমড আউট’।
যে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি খেলার জন্য মরিয়া ছিলেন, তাতে আর খেলা হবে না তাঁর। গতকাল ঘোষিত চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির ১৫ জনের দলে রাখা হয়নি তাঁকে। অথচ তিনি চেয়েছিলেন চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি খেলে ছেড়ে দেবেন ওয়ানডে ক্রিকেট। সে সুযোগ যেহেতু দেওয়া হচ্ছে না, তখন ধরেই নিতে পারেন আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকেই টাইমড আউট সাকিব।
বাংলাদেশের জান, বাংলাদেশের প্রাণ সাকিব আল হাসান। ছেলে-বুড়ো সবার মুখেই একসময় এ স্লোগান শোনা গেছে। আসলে দেশের ক্রিকেটে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। বিশ্বের কাছে দেশের দূত হয়ে ওঠা বাঁহাতি এ অলরাউন্ডার দেশেই এখন অপাঙক্তেয়। তিনি আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে সর্বজন থেকে হয়ে হয়ে গেছেন একাংশের। তাই তো আওয়ামী লীগের পতনে দেশে ফেরার পথ বন্ধ হয়ে গেছে। পাকিস্তান ও ভারতে সিরিজ খেলার সুযোগ পেলেও দেশে ফেরার অনুমতি দেওয়া হয়নি তাঁকে। মাঠ থেকে বিদায় জানাতে পারেননি টেস্ট ক্রিকেটকে। টি২০ ছেড়েছেন বিশ্বকাপের মাঠে। চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি খেলে ছাড়তে চেয়েছিলেন ওয়ানডে ক্রিকেট। পেছনে অদৃশ্য শক্তি লেগে থাকায় তাঁকে সে সুযোগ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না বিসিবির পক্ষেও।
প্রধান নির্বাচক গাজী আশরাফ হোসেন লিপু তাই দল ঘোষণার সংবাদ সম্মেলনে পাশ কাটিয়ে যেতে চাইলেন সাকিব ইস্যু। তিনি শুধু বললেন, ‘বোলিং অ্যাকশন নিয়ে সমস্যার পরীক্ষায় নেগেটিভ, তাই শুধু ব্যাটার হিসেবে খেলতে পারবে। আমরা তাকে দল গঠনে ব্যাটার হিসেবে বিবেচনা করেছি। কিন্তু কম্বিনেশনে শুধু ব্যাটার হিসেবে তাকে জায়গা দেওয়া যায়নি।’ অথচ শেষ ১০ ওয়ানডেতে তিনটি ফিফটি তাঁর। চল্লিশছোঁয়া ইনিংস দুটি। তাঁর মতো একজনের ব্যাটারেরও এখন দলে জায়গা হয় না।
রাজনীতি নির্বাসন দিয়েছে সাকিবকে। মাথার ওপর ঝুলছে হত্যা মামলা। ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ করা হয়েছে অবৈধ লেনদেন ক্ষতিয়ে দেখার প্রয়োজনে। শেয়ার কেলেঙ্কারিতে জরিমানা হয়েছে। চেক জালিয়াতির মামলায় তলব করেছেন আদালত। অবস্থাদৃষ্টে নায়ক সাকিব পরিণত হয়েছেন খলনায়কে। দেশে ফেরার পথ বন্ধ, জাতীয় দল থেকে ছুড়ে ফেলা হয়েছে, খেলা হবে না দেশের লিগে।
নিয়তির কী নির্মম পরিহাস, বোলিং অ্যাকশনে ত্রুটি ধরা পড়ায় বিদেশের লিগেও খেলতে পারছেন না অলরাউন্ডার হিসেবে। কোচ, মাঠ ঠিক না থাকায় বোলিং অ্যাকশন নিয়ে কাজও করতে পারছেন না। সবকিছু বিবেচনায় নিলে আশার জায়গা দেখেন না সাকিবের ঘনিষ্ঠরাও। তবে কি ৩৬ বছর বয়সী অলরাউন্ডারের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার শেষ হয়ে গেল?
আফগানিস্তানের বিপক্ষে শেষ টি২০, শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে শেষ ওয়ানডে (বিশ্বকাপ) এবং ভারতের বিপক্ষে খেলা কানপুর টেস্টটি হয়তো তাঁর শেষ। এখন পাকাপাকি ফুরিয়ে যেতে দেখার অপেক্ষা। বোলিং ত্রুটিমুক্ত হতে না পারলে লিপুর মতো বিদেশিরাও বলবেন ব্যাটার সাকিবকে চাই না, চাই সব্যসাচী সাকিবকে।
.উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
অধ্যাপক ইউনূসের সংস্কারের অঙ্গীকারের এক বছর পরেও কারাগারে সাংবাদিকেরা: সিপিজে
সাংবাদিক ফারজানা রুপা চলতি বছরের ৫ মার্চ ঢাকার একটি জনাকীর্ণ আদালতে আইনজীবী ছাড়াই দাঁড়িয়েছিলেন। বিচারক তাঁর বিরুদ্ধে আরেকটি হত্যা মামলা নথিভুক্ত করার প্রক্রিয়া শুরু করছিলেন। ইতিমধ্যে অন্য মামলায় কারাগারে থাকা এই সাংবাদিক শান্তভাবে জামিনের আবেদন জানান। ফারজানা বলেন, ‘ইতিমধ্যে আমার বিরুদ্ধে এক ডজন মামলা দেওয়া হয়েছে। আমি একজন সাংবাদিক। আমাকে ফাঁসানোর জন্য একটি মামলাই যথেষ্ট।’
বিশ্বজুড়ে সাংবাদিকদের অধিকার রক্ষায় কাজ করা আন্তর্জাতিক সংগঠন কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টসের (সিপিজে) এক নিবন্ধে এসব কথা বলা হয়েছে। এতে বলা হয়, বেসরকারি একাত্তর টেলিভিশনের সাবেক প্রধান প্রতিবেদক ফারজানা রুপার বিরুদ্ধে ৯টি হত্যা মামলা রয়েছে। আর তাঁর স্বামী চ্যানেলটির সাবেক বার্তাপ্রধান শাকিল আহমেদের নামে রয়েছে আটটি হত্যা মামলা।
এক বছর আগে ছাত্রদের নেতৃত্বে কয়েক সপ্তাহের বিক্ষোভের পর পদত্যাগ করে দেশ থেকে পালিয়ে যান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ওই বিক্ষোভ চলাকালে দুজন সাংবাদিক নিহত হন। শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও দেশ ছাড়ার পর বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নেন নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস।
অধ্যাপক ইউনূস গণমাধ্যম সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। শেখ হাসিনা সরকারের অধীন সাংবাদিকদের লক্ষ্যবস্তু করতে ব্যবহৃত সাইবার নিরাপত্তা আইন বাতিল করা হয়েছে। কিন্তু ২০২৪ সালের নভেম্বরে ডেইলি স্টার পত্রিকাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে অধ্যাপক ইউনূস বলেছিলেন, সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে তাড়াহুড়ো করে হত্যার অভিযোগ আনা হচ্ছে। তিনি আরও বলেছিলেন, সরকার তখন থেকে এ ধরনের পদক্ষেপ বন্ধ করে দিয়েছে। মামলাগুলো পর্যালোচনা করার জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে।
কিন্তু প্রায় এক বছর পর এখনো সাংবাদিক ফারজানা রুপা, শাকিল আহমেদ, শ্যামল দত্ত ও মোজাম্মেল হক বাবু কারাগারে আছেন। হত্যায় উসকানি দেওয়ার অভিযোগে পৃথক মামলায় তাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। বিগত সরকারের প্রতি সহানুভূতিশীল হিসেবে ব্যাপকভাবে পরিচিত সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগের বারবার ব্যবহারকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত সেন্সরশিপ বলেই মনে হচ্ছে।
এ ধরনের আইনি অভিযোগ ছাড়াও সিপিজে সাংবাদিকদের ওপর শারীরিক হামলা, রাজনৈতিক কর্মীদের কাছ থেকে হুমকি এবং নির্বাসনের ঘটনা নথিভুক্ত করেছে। বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল কমপক্ষে ২৫ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগে তদন্ত করছে। এই অভিযোগ সাবেক শেখ হাসিনা সরকারের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের লক্ষ্যবস্তু করতে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।
সিপিজের আঞ্চলিক পরিচালক বেহ লিহ ই বলেন, ‘চারজন সাংবাদিককে বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ ছাড়াই এক বছর ধরে কারাগারে আটকে রাখা অন্তর্বর্তী সরকারের সংবাদপত্রের স্বাধীনতা রক্ষার ঘোষিত প্রতিশ্রুতিকে দুর্বল করে।’ তিনি আরও বলেন, ‘প্রকৃত সংস্কার মানে অতীত থেকে বেরিয়ে আসা, এর অপব্যবহারের পুনরাবৃত্তি নয়। যেহেতু আগামী মাসগুলোতে দেশে নির্বাচন হতে চলেছে, তাই সব রাজনৈতিক দলকে সাংবাদিকদের খবর প্রকাশের অধিকারকে অবশ্যই সম্মান জানাতে হবে।’
আইনি নথি ও প্রতিবেদন নিয়ে সিপিজের এক পর্যালোচনায় দেখা গেছে, এফআইআর নথিভুক্ত হওয়ার অনেক পর সাংবাদিকদের নাম প্রায়ই এতে যুক্ত করা হয়। মে মাসে জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, গত বছরের বিক্ষোভের পর ১৪০ জনের বেশি সাংবাদিকের বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগ আনা হয়েছে।
শ্যামল দত্তের মেয়ে শশী সিপিজেকে বলেন, তাঁর বাবার বিরুদ্ধে এখন কতগুলো মামলা চলছে, পরিবার তার হিসাব রাখতে পারেনি। তাঁরা অন্তত ছয়টি হত্যা মামলার কথা জানেন, যেখানে শ্যামল দত্তের নাম আছে। মোজাম্মেল বাবুর পরিবার ১০টি মামলার কথা জানে। ফারজানা রুপা ও শাকিল আহমেদের পরিবার সিপিজেকে জানিয়েছে, তারা পাঁচটি মামলার এফআইআর পাননি, যেখানে একজন বা অন্য সাংবাদিকের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। এর মানে হলো তাঁদের কেউই জামিনের আবেদন করতে পারছেন না।
এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে প্রধান উপদেষ্টার প্রেসসচিব শফিকুল আলম ও পুলিশের মুখপাত্র এনামুল হক সাগরকে ই–মেইল করে সিপিজে। তবে তাঁরা সাড়া দেননি বলে সিপিজের নিবন্ধে উল্লেখ করা হয়।