খালেদা এখনো যেভাবে বিএনপির ঐক্য ও সংহতির প্রতীক
Published: 13th, January 2025 GMT
লেখক ও গবেষক মহিউদ্দিন আহমদ খালেদা জিয়াকে নিয়ে যে রাজনৈতিক উপাখ্যান লিখেছেন, তার নাম খালেদা। এ বিষয়ে তাঁর মন্তব্য, ‘আমাদের রাজনীতির মাঠে অনেক খেলোয়াড়। তাঁরা একেকজন একেকটি জানালা, যার মধ্য দিয়ে নির্দিষ্ট একটি সময়কে দেখা ও বোঝা যায়। মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, শেখ মুজিবুর রহমান, সিরাজুল আলম খান, সিরাজ সিকদার, তাজউদ্দীন আহমদের পর আমার এবারের বিষয় খালেদা জিয়া।’
রাজনীতিকেরা যখন ক্ষমতায় থাকেন, তখন তাঁদের প্রকৃত জনপ্রিয়তা বোঝা যায় না। রাষ্ট্রীয় প্রচারমাধ্যম ও অনুগত প্রচারকর্মীরা নেতা–নেত্রীদের দেবতার আসনে বসান। প্রতিমুহূর্তে তাঁদের মহিমা প্রচার করেন। নেতা-নেত্রীরা নানা কৌশলে নিজ দলের নেতা-কর্মী-সমর্থকদের কাছ থেকে ‘বাধ্যতামূলক’ সমীহ আদায় করে থাকেন। আর পদ ধরে রাখার জন্য নেতা-নেত্রীকে বন্দনা করা কর্মীদের অপরিহার্য কর্তব্য হয়ে দাঁড়ায়। আবার ক্ষমতা থেকে বিতাড়িত হওয়ার পর আমরা সেই মহিমা বুদ্বুদের মতো উবে যেতেও দেখি।
যেসব রাজনীতিক ক্ষমতার বাইরে থেকেও ব্যাপকসংখ্যক মানুষের শ্রদ্ধা ও সমীহ পেয়েছেন, নিঃসন্দেহে খালেদা জিয়া তাঁদের একজন। এমন বহু মানুষ পাওয়া যাবে, যাঁরা বিএনপির রাজনীতি করেন না, বিএনপির নীতি-আদর্শেরও সমর্থক নন, তাঁরাও রাজনীতিক হিসেবে খালেদা জিয়াকে পছন্দ করেন। এটি তিনি অর্জন করেছেন ব্যক্তিগত শিষ্টাচার ও সৌজন্যবোধের মাধ্যমে। তিনি কম কথা বলেন, এটাও তাঁর গুণ হিসেবে ধরে নেওয়া যায়। সমকালীন বাংলাদেশে তাঁর সমতুল্য জনপ্রিয় রাজনীতিক কেউ আছেন বলে মনে হয় না। ১৯৯১ সাল থেকে খালেদা জিয়া কোনো নির্বাচনে হারেননি। এমনকি যেসব নির্বাচনে বিএনপি হেরে গেছে, সেসব নির্বাচনেও তিনি সব কটি আসনে রেকর্ডসংখ্যক ভোট পেয়েছেন।
২০০৭ সালে সেনাসমর্থিত সরকার ক্ষমতায় আসার পর দুই নেত্রীর বিরুদ্ধে ডজনখানেক মামলা করে এবং একপর্যায়ে তাঁদের গ্রেপ্তারও করা হয়। পরে ঘরে ও বাইরে পরিস্থিতি সামাল দিতে না পেরে তাঁদের ছেড়ে দিতেও বাধ্য হয় তারা। ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির কোয়ালিশন ইয়ার্স বইয়ে এ বিষয়ে চমকপ্রদ কিছু তথ্য আছে। সেনাসমর্থিত সরকারের টার্গেট ছিলেন দুই নেত্রী ও দুই দল। কিন্তু ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে করা সব মামলার দ্রুত নিষ্পত্তি হলেও খালেদা জিয়ার মামলাগুলো থেকে যায়। ২০১৮ সালে দুটি ‘বিতর্কিত’ মামলায় তাঁকে শাস্তি দিয়ে জেলে পাঠানো হয়।
সেই থেকে থমকে যায় খালেদা জিয়ার প্রকাশ্যে রাজনৈতিক কার্যক্রম। ২৫ মাস কারাদণ্ড ভোগ করার পর আওয়ামী লীগ সরকার নির্বাহী আদেশে তাঁর শাস্তি স্থগিত করলেও চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাওয়ার অনুমতি দেয়নি। যদিও এর আগে দুর্নীতির মামলায় দণ্ডিত হয়ে প্রয়াত রাষ্ট্রপতি এইচ এম এরশাদ, সাবেক মন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়াসহ অনেকে জামিন পেয়েছেন। ওই সময় থেকে লন্ডনপ্রবাসী তারেক রহমান ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে দল পরিচালনা করে আসছেন।
খালেদা জিয়া প্রকাশ্যে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত না থাকলেও তাঁকেই বিএনপির প্রধান শক্তি ও ভরসা ভাবা হয়। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর খালেদা জিয়ার বিদেশে যাওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা উঠে যায়। এরপর কয়েক মাস ধরে প্রস্তুতি নিয়ে তিনি ৭ জানুয়ারি কাতারের আমিরের দেওয়া একটি এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে ঢাকা থেকে লন্ডন যান। বর্তমানে দ্য লন্ডন ক্লিনিকে তাঁর চিকিৎসা চলছে।
খালেদা জিয়ার লন্ডনযাত্রা নিয়ে রাজনৈতিক মহলে যেসব জল্পনা আছে, তার ভিত্তি আছে বলে মনে হয় না। ২০০৭ সাল আর ২০২৫ সাল এক নয়। ২০০৭ সালে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের মধ্যকার সংঘাত দেশকে ভয়াবহ পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দিয়েছিল। এক–এগারোর ক্ষমতার পালাবদলের অন্যতম কারিগর মইন ইউ আহমেদ তাঁর শান্তির স্বপ্ন ও সময়ের স্মৃতিচারণ বইয়ে এর পটভূমি ব্যাখ্যা করেছেন।
১৭ বছরের ব্যবধানে সংগঠিত দুই রাজনৈতিক পালাবদলের মধ্যে বিরাট পার্থক্য আছে। এক–এগারো ঘটেছিল সেনাবাহিনীর একক ইচ্ছায়। রাজনীতিকদের সক্রিয় কোনো ভূমিকা ছিল না। আর চব্বিশে আওয়ামী লীগ সরকার বিতাড়িত হয়েছে ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানের মাধ্যমে। সেখানে সেনাবাহিনী জনগণের বিপক্ষে অবস্থান নেয়নি। বরং তারা পরিবর্তনকে স্বাগত জানিয়েছে এবং অন্তর্বর্তী সরকার গঠনেও ভূমিকা রেখেছে। সম্প্রতি সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান প্রথম আলোর সঙ্গে সাক্ষাৎকারে স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, রাজনীতিতে আসার কোনো ইচ্ছা সেনাবাহিনীর নেই। বরং তারা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় অন্তর্বর্তী সরকারকে সমর্থন করছে।
খালেদা জিয়া লন্ডন যাওয়ার আগে তাঁর সঙ্গে সেনাপ্রধানের সাক্ষাৎ নিয়ে রাজনৈতিক মহলে আলোচনা আছে, সেটাও অনেকটা কল্পনাপ্রসূত। বিএনপির স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য প্রথম আলোকে বলেন, ‘তিনি (খালেদা জিয়া) চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে যাচ্ছেন। সে জন্য তাঁর স্বাস্থ্যের খোঁজ নিতে সেনাপ্রধান সস্ত্রীক এসেছিলেন। যতটুকু জেনেছি, সাক্ষাতে ম্যাডামের স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা নিয়েই কথাবার্তা হয়েছে, রাজনীতি বা অন্য কোনো বিষয়ে আলোচনা হয়নি।’ (প্রথম আলো, ৫ জানুয়ারি ২০২৫)
বিবিসির খবরে বলা হয়, বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া চিকিৎসার জন্য লন্ডন গেছেন, তবে দলের ভেতরে ও বাইরে তাঁর বিদেশ যাওয়া নিয়ে ‘স্বস্তির’ পাশাপাশি ‘উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা’ও আছে। দুই শীর্ষ নেতার ‘অনুপস্থিতি’ কেমন পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে, সেটি নিয়ে নানা বিচার-বিশ্লেষণ চলছে দলটির নেতা, কর্মী ও সমর্থকদের মধ্যে। এর অর্থ খালেদা জিয়ার উপস্থিতি যেমন দলের জন্য, তেমনি গণতন্ত্রের জন্যও অপরিহার্য।
ডিসেম্বরের শেষ দিকে খালেদা জিয়ার বিদেশযাত্রার বিলম্ব সম্পর্কে জানতে চাইলে বিএনপির একজন কেন্দ্রীয় নেতা বলেছিলেন, ‘ম্যাডামের এখন যে শারীরিক অবস্থা, তাতে বিদেশে যেতে কোনো বাধা নেই। তবে দেশে তাঁর উপস্থিতি থাকা না-থাকার ওপর অনেক কিছু নির্ভর করে।’ তিনি খোলাসা করে না বললেও বিএনপি নেতৃত্বে যে উতোর-চাপান আছে, সেটা স্বীকার করলেন। ইতিমধ্যে নির্বাচনের সম্ভাব্য প্রার্থিতা নিয়ে বিভিন্ন স্থানে সংঘাত–সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটেছে। কেন্দ্রীয় নেতাসহ অনেকের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিয়েও পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যাচ্ছে না পুরোপুরি।
এ মুহূর্তে দলের প্রধান ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের বিদেশে থাকা নিয়ে বিএনপির নেতা-কর্মীরা কিছুটা চিন্তিতও। তাঁদের সঙ্গে দেশবাসীও আশা করেন, খালেদা জিয়া চিকিৎসা শেষে সুস্থ হয়ে দেশে ফিরে ফের দলের হাল ধরবেন। নেতা-কর্মীরা তাঁকেই দলের ঐক্য ও সংহতির প্রতীক মনে করেন।
প্রশ্ন উঠেছে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের দেশে আসার দিনক্ষণ নিয়েও। কয়েক দিন আগে বিএনপির স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য বলেছেন, তারেক রহমানের দেশে ফিরে আসার পরিবেশ এখনো হয়নি। এর মধ্য দিয়ে তিনি কি তাঁর বিরুদ্ধে মামলার ইঙ্গিত করেছেন না অন্য কিছু? মামলার ইঙ্গিত করলে হয়তো তেমন চিন্তা নেই। খালেদা ও তারেকের বিরুদ্ধে দায়ের করা প্রায় সব মামলা চূড়ান্ত নিষ্পত্তির পথে।
তারেক রহমানের দেশে ফিরে আসার ‘পরিবেশ’ কখন তৈরি হবে, সেটা নিশ্চিত করে না বলা গেলেও, খালেদা জিয়ার লন্ডনযাত্রা কোনোভাবেই প্রস্থান নয়; এটা রাজনীতিতে পুনরাগমনের পূর্বাভাসই বলে ধারণা করি।
● সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
[email protected]
.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
সংগীতশিল্পী দীপ মারা গেছেন
রাস্টফ ব্যান্ডের ভোকাল আহরার মাসুদ মারা গেছেন। সেমাবার (১৫ সেপ্টেম্বর) দিবাগত রাতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। ভক্তদের কাছে দীপ নামে পরিচিত ছিলেন আহরার মাসুদ।
মঙ্গলবার (১৬ সেপ্টেম্বর) সকাল ৮টায় ব্যান্ডের অফিশিয়াল ফেসবুক পেজে এ তথ্য জানানো হয়। তবে এ শিল্পীর মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে কিছু জানা যায়নি।
আরো পড়ুন:
৫০ শয্যার থানচি হাসপাতাল চলছে একজন চিকিৎসকে
সিজেএফবি পারফরম্যান্স অ্যাওয়ার্ড ঘোষণা
রাস্টফ ব্যান্ডের ফেসবুক পেজে দীপের মৃত্যুর খবর জানিয়ে লেখা হয়, “এমন এক বেদনাদায়ক মুহূর্তে সঠিক শব্দ খুঁজে পাওয়া বা কোনো শব্দ খুঁজে পাওয়া—প্রায় অসম্ভব। প্রিয় ভোকালিস্ট, বন্ধু ও সহযাত্রী আহারার ‘দীপ’ মাসুদের মৃত্যুসংবাদ আমাদের স্তম্ভিত করেছে। আমরা শোকে ভেঙে পড়েছি, এখনো অবিশ্বাসের ভেতর ডুবে আছি। গত রাতেই তিনি আমাদের ছেড়ে চিরবিদায় নিয়েছেন।”
দীপের শূন্যতা ব্যাখ্যা করে লেখা হয়, “তার পরিবার, বন্ধু ও প্রিয়জনদের প্রতি আমাদের অন্তরের সমবেদনা ও প্রার্থনা। আপনাদের মতো আমরাও এই অপূরণীয় ক্ষতি বোঝার চেষ্টা করছি, চেষ্টা করছি দীপের অসাধারণ প্রতিভাকে সম্মান জানাতে এবং তার চেয়েও বড় কথা—মানুষ হিসেবে তিনি আমাদের কাছে যে অমূল্য ছিলেন, তাকে স্মরণ করতে। এই কঠিন সময়ে সবার কাছে অনুরোধ, দয়া করে পরিবার ও কাছের মানুষদের ব্যক্তিগত পরিসরকে সম্মান করুন এবং তার আত্মার শান্তির জন্য প্রার্থনা করুন। শান্তিতে ঘুমাও, দীপ। তোমার শূন্যতা চিরকাল বেদনাময় হয়ে থাকবে।”
তরুণদের কাছে জনপ্রিয় আরেকটি ব্যান্ড পাওয়ারসার্চও দীপের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছে। ব্যান্ডের অফিশিয়াল ফেসবুক পেজে লেখা হয়েছে, “স্মরণ করছি আহরার মাসুদ দীপকে। কিছুক্ষণ আগে আমরা হারিয়েছি আমাদের প্রিয় ভাই, ঘনিষ্ঠ বন্ধু এবং এক সত্যিকারের শিল্পীকে। এক্লিপস, কার্ল, ক্যালিপসো ও সবশেষ রাস্টফ ব্যান্ডের অবিস্মরণীয় কণ্ঠ আহরার মাসুদ দীপ আমাদের মাঝে আর নেই। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।”
পাওয়ারসার্চ আরো লেখেন, “আহরার মাসুদ দীপ শুধু একজন ভোকালিস্টই ছিলেন না, তিনি ছিলেন শক্তি, সৃজনশীলতা আর আবেগের প্রতীক, যিনি তার চারপাশের সবাইকে অনুপ্রাণিত করেছেন; একই সাথে তার অত্যন্ত নমনীয় ব্যবহার, যা সবাইকে তাঁর শুভাকাঙ্ক্ষীই করে ফেলত! শান্তিতে থাকো ভাই, তুমি সব সময় আমাদের গল্পের অংশ হয়ে থাকবে।”
ঢাকা/শান্ত