দিল্লি, বেইজিং ও ওয়াশিংটনের সঙ্গে ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখবে ঢাকা। কাউকেই অসন্তুষ্ট না করে নিজ স্বার্থ রক্ষা করে তিন দেশের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক বজায় রাখা হবে। আগামী ২০ জানুয়ারি চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর আমন্ত্রণে বেইজিং যাচ্ছেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন। এ বিষয়ে গতকাল বুধবার বিকেলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সাংবাদিকদের ব্রিফ করে এসব কথা বলেন তিনি।

চীনের সঙ্গে সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে প্রতিবেশীর উদ্বেগ বিবেচনায় নেওয়া হবে কিনা– উত্তরে উপদেষ্টা বলেন, বাংলাদেশের জন্য ভারত, চীন ও যুক্তরাষ্ট্র অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দেশ। আমরা অবশ্যই একটা ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখব। কাউকেই অসন্তুষ্ট করতে চাই না। তবে অবশ্যই নিজ স্বার্থ রক্ষা করে তাদের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক বজায় রাখব।

মার্কিন নতুন প্রশাসনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক কেমন হবে– জানতে চাইলে তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বা এ রকম বড় দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের যে সম্পর্ক সেটা কিন্তু দেশটির সরকার দিয়ে হয় না। নতুন সরকার এলে তাদের কিছু বক্তব্য থাকতে পারে, সেটা আমরা দেখব। আমি মনে করি না, যুক্তরাষ্ট্রে সরকার পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কে কোনো হোঁচট খাবে।

নবনির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প আগামী ২০ জানুয়ারি শপথ নেবেন। তৌহিদ হোসেন বলেন, সম্পর্কে পারস্পরিক চাওয়া-পাওয়ার হিসেবে সব সময় একটু-আধটু পরিবর্তন হয়। এ রকম যখন হবে তখন আমরা সেই অনুযায়ী আমাদের পদক্ষেপ নেব। আমি কবে গেলাম চীনে সেটা কোনো বিষয় না।

তিনি আরও বলেন, চীনের সঙ্গে আমাদের অর্থনৈতিক সম্পর্ক খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের অনেক প্রকল্পে চীনের ঋণ রয়েছে। তার মধ্যে কিছু প্রকল্প চলমান। এ ছাড়া আরও অর্থনৈতিক আলোচনা আছে– যেমন আমরা ঋণের শর্তাবলি নিয়ে কথা বলব। এর মধ্যে সুদহার কমানো বা ঋণ পরিশোধের সময়সীমা বাড়ানো। আলোচনার মধ্যে প্রথমে ব্যবসায়িক বিষয়গুলো আসবে। চীনের সঙ্গে আমাদের প্রধানত আমদানির সম্পর্ক এবং এগুলো আমাদের জন্য খুবই প্রয়োজনীয়। কারণ আমাদের অনেক রপ্তানি সেই আমদানি পণ্যগুলোর ওপর নির্ভরশীল। কাজেই চীনের সঙ্গে আমাদের যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক রয়েছে, তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

উপদেষ্টা বলেন, চীনের কাছে চাইব– যেন আমরা স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের পরও ইউরোপের মতো আমাদের জন্য তিন বছর শুল্কমুক্ত সুবিধা বহাল রাখে। এখনও চীন আমাদের অধিকাংশ পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা দিচ্ছে। কিন্তু উত্তরণের পরে এটা পরিবর্তন হতে পারে, তাই এটি আমাদের আলোচনার মাধ্যমে আগেই ঠিক করে নিতে হবে।

তিনি জানান, এ ছাড়া কিছু সাংস্কৃতিক বিষয় আলোচনায় রয়েছে। চীনের সঙ্গে সম্পর্কের ৫০ বছর পূর্ণ হচ্ছে। এ উপলক্ষে দুই দেশেই কিছু উৎসব আছে। সেগুলো নিয়েও আমরা আলোচনা করব।

বাংলাদেশে চীনের ঋণে সুদের পরিমাণ জানতে চাইলে তৌহিদ হোসেন বলেন, প্রতিটি ঋণের সুদের হার এক না। আমরা মোটা দাগে সুদের হার কমানোর কথা বলব। ঋণ পরিশোধ সীমা চেষ্টা করব ৩০ বছরে নিয়ে যেতে; যেন আমাদের অর্থনীতির ওপর চাপ কম আসে এবং পরিশোধ করতে সহজ হয়। পরিশোধের সময় বাড়ানোর কথা বলব। সফরে নদী ব্যবস্থাপনা নিয়ে চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের করা সমঝোতা স্মারকের নবায়ন হবে।  

রোহিঙ্গা ইস্যুতে সহায়তা চাওয়া নিয়ে তিনি বলেন, আমরা চাইব চীন আমাদের সহায়তা করুক। তাদের ওখানে যথেষ্ট প্রভাব আছে। আমরা চাইব রাখাইনে একটা স্থিতিশীল অবস্থা তৈরি হোক।

বিগত সরকারের সময়ে ৫ বিলিয়ন ডলারের সহায়তা ও বাজেট সহায়তা নিয়ে সরকারের অবস্থানের বিষয়ে উপদেষ্টা বলেন, আমরা কোনো কিছু বাদ রাখব না, সবকিছু নিয়ে আলোচনা করব। বাজেট সহায়তা নিয়ে কথা বলব। 

সীমান্তে সমস্যা মোকাবিলা করা হবে

ভারতীয় কূটনীতিকরা বলছেন, আন্তর্জাতিক আইন মেনে সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া দেওয়া হয়েছে। এ নিয়ে তৌহিদ হোসেন বলেন, আমরা যখন বলছি, তখন বুঝেই বলছি। তখন আলোচনার প্রশ্ন আসে, সেই আলোচনায় আমরা যাব।

তিনি বলেন, তবে সাধারণ হিসাব হচ্ছে, জিরো লাইন থেকে ১৫০ গজ দূরে প্রাচীর থাকবে। তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে ব্যত্যয় ঘটতে পারে, যেমন তামাবিল সীমান্ত, ওখানে তো ঘর তোলার  জায়গায় নেই। ক্ষেত্র বিশেষে এমন জায়গা নিয়ে আলোচনা হতে পারে। সীমান্ত ইস্যু আমরা এক দিনে সমস্যার সমাধান করতে পারব না, আবার কখনও যে হবে না, এ নিশ্চয়তাও দিতে পারব না। সীমান্তে এ ধরনের সমস্যা হতে থাকবে, আর আমরা মোকাবিলা করতে থাকব। এ ধরনের সমস্যা এর আগেও হয়েছে, ভবিষ্যতেও হবে।

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: উপদ ষ ট পর শ ধ সমস য সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

ছুটিতে পানিতে ডুবে মৃত্যুর লম্বা মিছিল

তিন দিন পর অবশেষে শুক্রবার ১৩ জুন দুই বোনের লাশ মেহেন্দীগঞ্জের গজারিয়া নদীতে ভেসে ওঠে। রাইসা ও জান্নাত মামাতো-ফুফাতো বোন। তারা আর হাসবে না। বই–খাতা, স্কুলড্রেস সব আছে, শুধু তারা তারা হয়ে গেছে দূর আকাশে। ১৩ বছরের জান্নাত ঢাকার গেন্ডারিয়া থেকে বরিশালের মেহেন্দীগঞ্জ গিয়েছিল ঈদের ছুটিতে। তার এক বছরের ছোট মামাতো বোন রাইসার সঙ্গে খুব খাতির। ঈদ উপলক্ষে একসঙ্গে হাতে মেহেদিও দিয়েছিল দুজন। নানার বাড়ির কাছেই গজারিয়া নদী। সেখানে তারা বুধবার ১১ জুন যায় গোসল করতে। বলা হচ্ছে স্রোতের টানে ভেসে গিয়ে তারা নিখোঁজ হয়। ঈদের ছুটির আগে-পরে (৫ জুন-১৪ জুন) এ রকম প্রায় ৬৬টি ঘটনায় ৭৮ জন ডুবে মারা যাওয়ার খবর পাওয়া গেছে। মর্মান্তিক সব মৃত্যুর খবর এখনো আসছে।

যেকোনো বড় ছুটিতে ‘বাড়ির’ জন্য রওনা দিলেই সবাই পৌঁছাতে পারে না, আবার পৌঁছালেও সবার আর ফেরা হয় না কর্মস্থলে, স্কুলে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, খেলার মাঠে বন্ধুদের কাছে। সড়ক দুর্ঘটনায় অনেক প্রাণহানি ঘটে। শিশুরা এ সময় বেশি মারা যায় পানিতে ডুবে। এবার সড়ক দুর্ঘটনার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বড় হয়েছে পানিতে ডুবে মৃত্যুর মিছিল। গণমাধ্যমের প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, এ পর্যন্ত উল্লিখিত ৭৮ জনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেছে স্থানীয় হাসপাতাল আর পুলিশ কর্তৃপক্ষ।

৭৮টি মৃতদেহের মধ্যে মাত্র ১২টি হচ্ছে প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের। বাকি ৬৬ জনই শিশু–কিশোর। এদের বয়স ১০ মাস থেকে ১৭ বছর। ৬৬ জনের মধ্যে অর্ধেকের বয়স ৫ বছরের নিচে। বাংলাদেশে এখন ৫ বছরের কম বয়সী শিশুর মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ (দ্বিতীয় সর্বোচ্চ) হচ্ছে পানিতে ডুবে মৃত্যু।

ভারতের জাতীয় অপরাধ রেকর্ড ব্যুরোর (এনসিআরবি) তথ্য অনুসারে, দেশটিতে প্রতিবছর ৩৮ হাজারের বেশি মানুষ ডুবে মারা যায়। এটি সে দেশের মোট দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যুর প্রায় ৯ শতাংশ। অন্যদিকে গত বছর ইউনিসেফের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতিবছর ১৪ হাজারের বেশি শিশু ডুবে মারা যায়। অর্থাৎ দিনে মারা যায় প্রায় ৪০ জন।

এটা জনসংখ্যার আনুপাতিক হারে বাংলাদেশে ডুবে মারা যাওয়ার ঘটনা ভারতের চেয়ে বেশি।

বেসরকারি সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ড্রাউনিং রিসার্চ সেন্টার (আইডিআরসি) বাংলাদেশের ডিরেক্টর ড. আমিনুর রহমান মনে করেন, সবাই বলে নিউমোনিয়া, ডায়রিয়ায় বেশি শিশু মারা যায়। আসলে বেশি শিশু মারা যায় পানিতে ডুবে।

টিকা দিয়ে বা সময়মতো চিকিৎসায় ৫ বছরের কম বয়সী শিশুদের অকালমৃত্যু ঠেকানো গেলেও ‘লাভের গুড় পিঁপড়ে’ মানে পানিতে খেয়ে যাচ্ছে। শিশুরা ডুবে মারা যাচ্ছে পানির বালতিতে, ডোবায়, পুকুরে, খালে, নদীতে।

একে অপরকে বাঁচাতে গিয়ে মৃত্যু

রাইসা আর জান্নাতের মতো কমপক্ষে ১৬ জন মারা গেছে, যারা একে অপরের বোন বা ভাই। মেহেন্দিগঞ্জে রাইসা ও জান্নাতের ক্ষেত্রে ঠিক কী ঘটেছিল, তা জানা না গেলেও ফরিদপুরের সালথায় তানহা নিজের ভাই তালহাকে বাঁচাতে পানিতে ঝাঁপ দিয়েছিল। তখন তানহা নিজেও পানিতে ডুবে যায়। যে কজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ ডুবে মারা গেছেন, তাঁদের অনেকেই প্রিয়জনদের বাঁচাতে গিয়ে মারা গেছেন। যাঁরা সাঁতার জানেন, তাঁদের বিশ্বাস, তাঁরা ডুবন্ত মানুষকে উদ্ধার করতে পারবেন। আসলে ডুবন্ত মানুষকে উদ্ধারের কৌশল জানা না থাকলে শুধু সাঁতারের জ্ঞান দিয়ে উদ্ধারে ঝাঁপিয়ে পড়া প্রাণঘাতী প্রচেষ্টার নামান্তরমাত্র। একইভাবে আমি সাঁতার জানি বলেই আরেকজনকে সাঁতার শেখাতে পারব, এমন ভাবনার কোনো মানে নেই। সব খেলোয়াড় যেমন কোচ হতে পারেন না, তেমনি সব সাঁতারুই সাঁতারের প্রশিক্ষক হওয়ার উপযুক্ত নন। এবার যে চারজন অভিভাবক ডুবে মারা গেছেন, তাঁরা সবাই সাঁতার শেখাতে গিয়ে দুর্ঘটনার শিকার হন। সাঁতার শেখানো কোনো তামাশা বা ফান নয়। এটা আমাদের অনুধাবন করতে হবে।

এত মৃত্যুর কারণ কী

এই প্রশ্নের বিজ্ঞানভিত্তিক উত্তর পেতে হলে আমাদের ধারাবাহিক গবেষণা দরকার।

যেসব কারণ কথিত বিশেষজ্ঞরা উল্লেখ করে থাকেন, তা নিতান্তই অনুমাননির্ভর। গত শুক্রবার (১৩ জুন) দ্বীপ উপজেলা কুতুবদিয়ায় তিন শিশু (রাফা (২), তাসিব (২) ও তুহিন (৫) ডুবে মারা গেলে সংবাদকর্মীরা স্থানীয় পুলিশ কর্মকর্তার কাছে জানতে চাইলে তিনি অনুমাননির্ভর ধারণা থেকে জানান, শিশুর মৃত্যুর জন্য মূলত অভিভাবকেরাই অনেকটা দায়ী। পরিবারের সদস্যসংখ্যা বেশি হওয়ায় অভিভাবকেরা শিশুদের প্রতি তেমন নজর দিতে পারেন না। এ ছাড়া প্রতিটি ঘরের পাশেই পুকুর বা ডোবা রয়েছে। শিশুদের প্রতি অভিভাবকদের নজরদারির অভাবে প্রায় পুকুরে ডুবে মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে।

এবারের মৃত্যুতালিকা দেখলে জানা যাবে অনেকেই তাঁদের একমাত্র সন্তানকে হারিয়েছেন। কাজেই ছেলেমেয়ে বেশি, তাই নজরদারি নেই, এমন সরলীকরণ করা ঠিক হবে না। প্রতিটি মৃত্যুর ঘটনা তদন্ত হওয়া উচিত। ময়নাতদন্ত হওয়া উচিত। ওয়ারিশজনিত জটিলতা নিরসনের লক্ষ্যে খুনখারাবি, শিশুহত্যা এ দেশে নতুন কিছু নয়। বড় ছুটির সুযোগ কেউ নিচ্ছে না তো?

পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যুর নানা কারণ আমাদের প্রকল্পনির্ভর গবেষকেরা খুঁজে বের করেছেন। মা ও অভিভাবকদের গাফিলতি আর সাঁতার না জানাকেই মূল কারণ হিসেবে শনাক্ত করে ব্যবস্থাপত্র জারি হয়েছে। পানিতে ডুবে মৃত্যু ঠেকাতে গ্রামে গ্রামে ৫ বছরের কম বয়সী শিশুদের জন্য দিবাযত্ন কেন্দ্র চালু করা, ছয় বছর বা তার চেয়ে বড় শিশুদের জন্য সাঁতার শিক্ষার ব্যবস্থার কথাও বলা হচ্ছে। দিবাযত্ন কেন্দ্রগুলো কি বড় ছুটিতে খোলা থাকবে? ছুটিতে যখন গ্রামে শিশুর সংখ্যা বেড়ে যাবে তখন কি তাদের দিবাযত্ন কেন্দ্রে ঢুকতে দেওয়া হবে? এসব প্রশ্নের কেউ জবাব দেওয়ার নেই।

গত কয়েক বছরের পানিতে ডোবার ঘটনাগুলো একটু খতিয়ে দেখলে অন্য একটা কারণ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। দুঃখজনকভাবে সেই কারণটি আমাদের নজর এড়িয়ে গেছে। বেসরকারি সংস্থা দুর্যোগ ফোরাম জানাচ্ছে, হঠাৎ খিঁচুনি দিয়ে অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার ঝোঁক আছে, এমন শিশুদের পানিতে ডুবে মারা যাওয়ার ঘটনা একেবারেই কম নয়। খিঁচুনির নানা ধরন থাকলেও আমাদের দেশে সাধারণভাবে এটা মৃগীরোগ নামে পরিচিত। বেসরকারি সংস্থা দুর্যোগ ফোরাম ২০২০ সালে পানিতে ডুবে মৃত ২২ জনের বিস্তারিত খোঁজখবর করতে গিয়ে দেখে এদের মধ্যে কমপক্ষে পাঁচজনের খিঁচুনি বা মৃগীরোগের প্রভাব ছিল।

গত মে মাসে বড় জোয়ারের সময় মহেশখালীতে যে তিনজন (জামাল মিয়া, দানু মিয়া, ঝুমু) পানিতে ডুবে মারা যান, তাঁদের প্রত্যেকের মৃগীরোগের প্রভাব ছিল বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন।

যুক্তরাজ্যের ইনস্টিটিউট অব নিউরোলজির বিখ্যাত নিউরোলজিস্ট ড. লে সানডার এ বিষয়ে শতভাগ নিশ্চিত যে মৃগীরোগের উপসর্গ থাকলে শিশুদের পানিতে ডুবে মারা যাওয়ার আশঙ্কা অনেক বেড়ে যায়। ২০১৪ সালে তিনি ও তাঁর দল ৮৮টি পানিতে ডোবার ঘটনা বিশ্লেষণ করে দেখেছেন, পাঁচজন ছাড়া বাকি সবাই মৃগী বা মৃগীরোগ-সংক্রান্ত কোনো না কোনো জটিলতায় ভুগছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক স্বাস্থ্যবিষয়ক অনলাইন পত্রিকা মেডপেজ টুডে লে সানডার–এর গবেষণার সূত্র ধরে জানিয়েছে, অন্যদের চেয়ে মৃগীরোগীদের পানিতে ডোবার আশঙ্কা ২০ গুণ বেশি। আবার বিশেষ ধরনের মৃগীরোগীর ক্ষেত্রে এটা বেড়ে দাঁড়ায় ৯৭ গুণ।

মৃগীরোগীর সংখ্যা কম নয়

বাংলাদেশে বিভিন্ন ধরনের মৃগীরোগের উপসর্গ নিয়ে অনেক শিশু আমাদের পরিবারে, পাড়ায়, সমাজে অবহেলায় বেঁচে আছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, কম বয়সের শিশু থেকে শুরু করে বয়স্ক মানুষ—সবাই মৃগীরোগে আক্রান্ত হতে পারে। তবে শিশুদের মধ্যে এই রোগের প্রভাব বেশি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আগ্রহে এবং আর্থিক সহায়তায় বাংলাদেশে ২০১৭ সালের জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত একটি জরিপ চালানো হয়। এটাই ছিল মৃগীরোগীর সংখ্যা নিরূপণের প্রথম জরিপ। কাকতালীয়ভাবে এই জরিপের ফলাফলের সঙ্গে শ্রীলঙ্কার মৃগীরোগীর তথ্য হুবহু মিলে যায়। শ্রীলঙ্কার মতো আমাদের দেশেও প্রতি হাজারে ৯ জন মৃগীরোগী আছে বলে এই জরিপে জানা যায়। সেই হিসাবে বাংলাদেশে মোট মৃগীরোগীর সংখ্যা কমপক্ষে ২০ লাখের মতো। বলে রাখা ভালো, আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে মৃগীরোগীর গড় সংখ্যার ব্যাপক তারতম্য আছে।

শিশুর মধ্যে কী কী আলামত দেখলে প্রাথমিকভাবে মৃগীরোগের সন্দেহ করা করা যায়:

এক. হঠাৎ করে কোনো শিশু চোখ-মুখ উল্টিয়ে অজ্ঞান হয়ে গেলে আর তার সঙ্গে সারা শরীরে ঝাঁকুনি বা খিঁচুনি শুরু হলে।

দুই. কোনো শিশু যদি চোখের পলক না ফেলে হঠাৎ একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলে বা অন্যমনস্ক হয়ে গেলে। অনেক ক্ষেত্রে হাতে কিছু থাকলে হঠাৎ করেই পড়ে যায়। (অভিভাবকেরা অনেক সময় ভাবেন, এটা শিশুর কাব্যিক ভাব। সন্তান তার কবি হয়ে উঠছে।)

তিন. আপাতদৃষ্টে মানসিকভাবে সম্পূর্ণ সুস্থ এক শিশু যদি হঠাৎ করে অস্বাভাবিক ব্যবহার শুরু করে। মুখভঙ্গির পরিবর্তনসহ অস্বাভাবিক হাঁটাচলা করে। আবোলতাবোল কথা বলতে শুরু করে। আবার কয়েক মিনিট পর আগের মতো সুস্থ হয়ে যায়।

চার. পানি বা আগুনের কাছে গেলেই হঠাৎ খিঁচুনি ওঠে।

পাঁচ. শিশু চোখেমুখে অন্ধকার দেখার কথা বলে। চোখে আলোর ঝিলিক দেখে, তারপর আর কিছু বলতে পারে না।

এসবের কোনোটাই আমাদের উপেক্ষা করা ঠিক হবে না। মনে রাখতে হবে, মৃগী কোনো অভিশাপ নয় বা দৈব কোনো রোগ নয়। মৃগীরোগ মস্তিষ্কের একটি অসুখ, যা মাথায় কিছু নিউরোট্রান্সমিটারের তারতম্যের কারণে হয়। কোলের শিশু থেকে শুরু করে যেকোনো বয়সের শিশু এমনকি বয়স্ক মানুষেরও এটা হতে পারে।

পানিতে নামতে না দেওয়া ছাড়াও এ ধরনের শিশুদের গাছে চড়তে দেওয়া ঠিক নয়। যেসব শিশু চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ খাচ্ছে, তাদের নিয়ে বেড়াতে যাওয়ার সময় ওষুধ সঙ্গে রাখতে হবে।

পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যুর স্রোত নিয়ন্ত্রণ সম্ভব কি

নিয়ত ঠিক থাকলে অবশ্যই সম্ভব। ২০১৯ সালে জনস হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণা বলছে, পানিতে ডুবে মৃত্যু প্রতিরোধ করা সম্ভব। ৮৮ শতাংশের বেশি কমিয়ে আনা কোনো কঠিন কাজ নয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০১৪ সালের প্রতিবেদনে পানিতে ডুবে মৃত্যু রোধে তিনটি কৌশল সবচেয়ে কার্যকর বলে উল্লেখ করা হয়। এগুলো হচ্ছে, ৫ বছরের কম বয়সী শিশুদের জন্য নিরাপদ ও সাশ্রয়ী শিশুযত্নের সুযোগ সৃষ্টি করা। পানিতে সুরক্ষা ও নিরাপদ উদ্ধারের ওপর জোর দিয়ে ৬ থেকে ১০ বছরের শিশুদের সাঁতার শেখার সুযোগ বৃদ্ধি করা। শিশুদের নিরাপত্তাঝুঁকি এবং তা হ্রাস করার পদ্ধতি সম্পর্কে জনসাধারণ ও মা-বাবাদের সচেতনতা বাড়ানো।

গ্রামে আগে শিশুদের কোমরে পিতলের একটা ছোট্ট ঘণ্টি বেঁধে দেওয়া হতো। এটা কোনো অলংকার ছিল না। কর্মব্যস্ত মায়ের কান থাকত সেই ঘণ্টির দিকে। সচেতন অভিভাবকেরা বাড়ির আশপাশের পুকুরে বাঁশের বা টিনের ঘেরা দিতে পারেন। এতে একটা প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়, যেটা পেরিয়ে শিশু পুকুরে যেতে পারবে না।

পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যুর হার কমাতে বাংলাদেশ শিশু একাডেমি ২০২২ সালে ২৭১ কোটি ৮২ লাখ ৫৭ হাজার টাকার একটি প্রকল্প গ্রহণ করে। একই বছরের ২২ ফেব্রুয়ারি ‘সমাজভিত্তিক সমন্বিত শিশুযত্ন কেন্দ্রের মাধ্যমে শিশুদের প্রারম্ভিক বিকাশ ও সুরক্ষা এবং শিশুর সাঁতার সুবিধা প্রদান’ শীর্ষক প্রকল্পটি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় অনুমোদিত হয়। জানুয়ারি ২০২২ থেকে ডিসেম্বর ২০২৪ পর্যন্ত তিন বছর মেয়াদি প্রকল্পের আওতায় ২ লাখ শিশুকে সেবা দেওয়ার লক্ষ্যে শিশুযত্ন কেন্দ্র স্থাপন এবং পরিচালনা, ৬ থেকে ১০ বছরের শিশুদের জন্য ১ হাজার ৬০০টি ভেন্যুতে সাঁতার প্রশিক্ষণ সুবিধার ব্যবস্থা এবং সুইমসেফ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে ৩ লাখ ৬০ হাজার শিশুকে সাঁতার শেখানোর কথা। দেশের ৮টি বিভাগের ১৬টি জেলাকে এ প্রকল্পে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এখন প্রয়োজন এসব প্রকল্পের স্বচ্ছতা এবং কার্যকারিতা মূল্যায়ন করে স্থানীয় অভিভাবক ও তরুণদের সম্পৃক্ত করে তাদের নেতৃত্বে একটি টেকসই ব্যবস্থা গড়ে তোলা।

লেখক গবেষক: [email protected]

সম্পর্কিত নিবন্ধ