‘আশপাশে কাজ করে খাওয়ার মতো ব্যবস্থা নেই। ছেলেমেয়ের লেখাপড়া করার মতো প্রতিষ্ঠানও নেই। বাড়ি-জমিওয়ালারা অনিয়ম করে ঘর বরাদ্দ নিয়েছেন। তাদের অনেকে এখানে থাকছেন না।’ কথাগুলো ময়মনসিংহের নান্দাইল উপজেলার চর ভেলামারী আশ্রয়ণ প্রকল্পে বসবাসকারী তাহের মোড়লের (৭০)। অন্য বাসিন্দা আছির উদ্দিনের ভাষ্য, তাঁর নামে কোনো ঘর নেই। বিউটি নামে একজনের নামে বরাদ্দ ঘরে থাকেন। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘যারা থাহে না, তারা ঘর পাইছে। আমি থাহি, আমার নামে ঘর নাই।’
এ ধরনের নানা সংকটে চর ভেলামারী আশ্রয়ণ প্রকল্পের দুই-তৃতীয়াংশ ঘর তালাবদ্ধ অবস্থায় পড়ে আছে বলে জানা গেছে। বাসিন্দারা বলছেন, রক্ষণাবেক্ষণের অভাব ও কাজের ব্যবস্থা না থাকায় প্রকল্পটিতে এখন অনেকে বসবাস করছেন না। বরাদ্দে অনিয়মের কারণে অনেক ঘর শুরু থেকেই 
তালাবদ্ধ রয়েছে। যারা থাকছেন, তাদের অনেকের নামে বরাদ্দ নেই।
উপজেলার চর বেতাগৈর ইউনিয়নের ব্রহ্মপুত্র নদের পূর্ব পাড়ে এসব ঘর নির্মাণ করে দিয়েছে সরকার। আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের তৃতীয় পর্যায়ের দ্বিতীয় ধাপে নির্মিত এ প্রকল্পে ঘর রয়েছে ৭৩টি। প্রতিটি তৈরিতে ব্যয় হয়েছে ২ লাখ ৫৯ হাজার টাকা। এসব ঘরে গৃহহীন, বিধবা, স্বামী পরিত্যক্তা, প্রতিবন্ধী ও অসহায় পরিবারের বসবাস করার কথা। ২০২২ সালের ২১ জুলাই ভার্চুয়ালি এর উদ্বোধন করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

একই দিন প্রকল্পের আঙিনায় জেলা এবং বিভাগীয় পর্যায়ের শীর্ষ কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে বরাদ্দপ্রাপ্তদের হাতে ঘরের দলিল ও চাবি তুলে দেওয়া হয়। কিন্তু তদারকির অভাবে প্রকল্পের বাসিন্দারা নানা দুর্ভোগের শিকার হচ্ছেন বলে অভিযোগ করেছেন। উপজেলা সদর থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরে আশ্রয়ণে গিয়ে দেখা যায়, ৭৩টি ঘরের মধ্যে মাত্র ২৩টির মতো ঘরে লোকজন বসবাস করছেন। বাকি ঘরগুলোয় তালা দেওয়া। যেসব ঘরে বসবাস আছে, সেগুলোর কয়েকটির বরাদ্দ অন্যদের নামে। যাদের নামে বরাদ্দ, তারা শুরু থেকেই থাকেন না।
প্রকল্পটি ঘুরে ৪০টির বেশি ঘর তালাবদ্ধ পাওয়া যায়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন জানান, এসব ঘরের প্রকৃত মালিক বসবাস করেন না। তাদের মধ্যে অনেকের অবস্থা ভালো। গ্রামে তাদের নিজস্ব ঘরবাড়ি ও জমিজমা রয়েছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ৭৩ নম্বর ঘরের বরাদ্দ কামাল হোসেনের নামে। কিন্তু গ্রামে তাঁর জমাজমি ও পাকা বাড়ি রয়েছে। আবু হানিফার নামে বরাদ্দ ৪৩ নম্বর ঘর। অথচ গ্রামে তাঁর বাড়িসহ দুই একর জমি রয়েছে।
আবু হানিফা বলেন, ‘সুযোগ পেয়েছি তাই নিয়েছি। প্রকল্পের খাস জায়গা আমাদেরও কিছু জায়গা ছিল। হয়তো এ কারণে দিয়েছে।’ কামাল হোসেনের মোবাইল ফোনে কল দিলেও তিনি রিসিভ না করায় বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি। আশ্রয়ণে আব্দুল কদ্দুসের নামে ঘর বরাদ্দ নেই। তিনি শাকিল নামে একজনের ঘরে থাকেন। শাহিনুর নামে একজন বলেন, তিনি জসিম উদ্দিনের ৬ নম্বর ঘরে থাকছেন। কিন্তু যার নামে বরাদ্দ, তাঁকে তারা কখনও দেখেননি।

আশ্রয়ণের বাসিন্দারা জানান, প্রকল্পের শুরুতে ১১টি নলকূপ বসানো হয়েছিল। সেগুলো অকেজো পড়ে আছে। নিজেদের চেষ্টায় দু-একটি নলকূপ চালু রাখলেও তা দিয়ে ঘোলা পানি ওঠে। রাতে চারটি বৈদ্যুতিক বাতির ব্যবস্থা থাকলেও একটিও জ্বলে না। এ কারণে সন্ধ্যার পর সেখানে ভূতুড়ে পরিবেশের সৃষ্টি হয়। বয়স্ক ও বিধবা ভাতা, ১৫ টাকা কেজির চাল বা টিসিবির পণ্য তাদের ভাগ্যে জোটে না। মন চাইলেই তাদের উদ্বাস্তু বলে তাড়িয়ে দেওয়া হয়।
প্রকল্পের সভাপতি নাসির উদ্দিন বলেন, একটি নালা নির্মাণ ও নলকূপগুলো সচল করার জন্য উপজেলা প্রশাসনের কাছে বারবার লিখিত আবেদন করা হয়েছে। কিন্তু কাজ হয়নি। চর বেতাগৈর ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান ফরিদ উদ্দিনের ভাষ্য, প্রকৃত অসহায় মানুষ বরাদ্দ পায়নি বলেই ঘরগুলো তালাবদ্ধ থাকে। আশ্রয়ণে থাকা বেশির ভাগ ব্যক্তির স্থায়ী ঠিকানা এখানে নয়। নিয়ম অনুযায়ী, তারা সরকারি সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার যোগ্য না।
নান্দাইলে সদ্য যোগদান করা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সারমিনা সাত্তার বলেন, এ বিষয়ে খোঁজ নিয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: প রকল প র উপজ ল

এছাড়াও পড়ুন:

৫০ শয্যার থানচি হাসপাতাল চলছে একজন চিকিৎসকে

বান্দরবানের থানচি উপজেলার প্রায় ৩০ হাজার মানুষের একমাত্র ভরসার জায়গা ৫০ শয্যার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। দীর্ঘদিন ধরে চিকিৎসক, নার্স ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির সংকটে এই হাসপাতাল কার্যত অচল হয়ে পড়েছে। বর্তমানে পুরো হাসপাতাল চালাচ্ছেন মাত্র একজন চিকিৎসক। গত পাঁচবছরে চিকিৎসাধীন ও রেফার্ড করা ২৪ জন রোগী মারা গেছেন।

হাসপাতাল সূত্র জানায়, ১৯৯৫ সালে ৩১ শয্যার থানচি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স যাত্রা শুরু করে। পরে এটি ৫০ শয্যায় উন্নীত হয়। এই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ১২ জন চিকিৎসক থাকার কথা থাকলেও কর্মরত আছেন মাত্র দুইজন। তাদের মধ্যে একজন ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘদিন চিকিৎসাধীন। এ কারণে রোগীদের সেবা দিতে পারছেন না। ১৮ জন নার্স পদে রয়েছেন মাত্র চারজন। চারজন মিডওয়াইফ থাকার কথা, নেই একজনও।

আরো পড়ুন:

ফরিদপুরে পাগলা ঘোড়ার কামড়ে আহত ২০

বক্তব্য দেওয়ার সময় অসুস্থ হয়ে পড়লেন কাদের সিদ্দিকী

প্রাথমিক থেকে শুরু করে জরুরি চিকিৎসার জন্য এই হাসপাতালে ছুটে যান পাহাড়ি ও বাঙালিরা। তাদের অভিযোগ, হাসপাতালটি ৫০ শয্যায় উন্নীত হলেও আধুনিক চিকিৎসা সুবিধা যোগ হয়নি। প্রয়োজনীয় সংখ্যক চিকিৎসক না থাকায় গর্ভবতী নারী, শিশু ও বৃদ্ধ রোগীরা সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে পড়ছেন। 

দুর্গম এলাকার রোগীরা অনেক সময় নদীপথ কিংবা পাহাড়ি রাস্তা পাড়ি দিয়ে হাসপাতালে এলেও কাঙ্ক্ষিত চিকিৎসা সেবা পান না। বরং তাদের বান্দরবান সদর হাসপাতালে রেফার্ড করা হয়। অনেক সময় বান্দরবানে যাওয়ার পথে রোগীরা মারা যান। এ কারণে জরুরি ভিত্তিতে চিকিৎসক, নার্স ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি সরবরাহের দাবি জানিয়েছেন তারা।

হাসপাতালের পরিসংখ্যানবীদ পঙ্কজ বড়ুয়া জানান, ২০২০ থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত এখানে ভর্তি হয়েছেন ৫ হাজার ১৯৮ জন রোগী। এর মধ্যে ৪৫৬ জনকে রেফার্ড করা হয় বান্দরবান সদর হাসপাতালে। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন ১৭ জন রোগী। 

থানচি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের অ্যাম্বুলেন্স চালক মংক্যসিং মারমা বলেন, “২০১৯ সালে চাকরিতে যোগদান করার পর থেকে অন্তত সাতজন রেফার্ড করা রোগী মাঝপথে আমার গাড়িতেই মারা গেছেন।”

 

শৈসাই মং মারমা তিন বছর আগে বিনা চিকিৎসায় তার মাকে মারা যেতে দেখেছেন। তিনি জানান, তার মা শৈমেপ্রু মারমা (৩৪) অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। ২০২২ সালের ১৪ নভেম্বর হঠাৎ তিনি অচেতন হয়ে পড়েন। রেমাক্রী বাজার থেকে নদীপথে থানচি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যান মাকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই তাকে জেলা সদর হাসপাতালে রেফার্ড করা হয়। ভাড়া গাড়িতে জেলা হাসপাতালে যাওয়ার সময় চিম্বুক বারো মাইল এলাকায় তার মা মারা যান।

লেংরু ম্রো নামে চার সন্তানের মা হারিয়েছেন স্বামীকে। তিনি জানান, তার স্বামী রেং য়ুং ম্রো (৪৫) কিডনি জটিলতা নিয়ে থানচি হাসপাতালে যান। সঙ্গে সঙ্গে সেখান থেকে তাকে বান্দরবান সদর হাসপাতালে রেফার্ড করা হয়। থানচি থেকে বান্দরবান যাওয়ার মাঝপথে মারা যান তার স্বামী।

স্থানীয় বাসিন্দা মংমে মারমা বলেন, ‍“হাসপাতালে চিকিৎসক, ওষুধ ও যন্ত্রপাতির সংকট দীর্ঘদিন ধরেই চলছে। বিশেষজ্ঞ ডাক্তার বদলি হলেও অনেকেই থানচিতে যোগ দেন না, ডিপুটেশনে থেকে যান সদর হাসপাতালে। ফলে এ অঞ্চলের পাহাড়ি ও বাঙালি প্রায় ৩০ হাজার মানুষ স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।”

রিয়েং ম্রো নামে অপর বাসিন্দা বলেন, “পাহাড়ে বসবাসকারীদের অধিকাংশ গরিব। জেলা সদর হাসপাতালে রোগী নিয়ে যাওয়া ব্যয়বহুল ও কষ্টকর। রেমাক্রি, বড় মোদক, তিন্দু থেকে থানচি সদরে রোগী আনতেই অনেক টাকা খরচ হয়ে যায়। এরপর আবার বান্দরবান সদর হাসপাতালে রেফার্ড করলে সাধারণ মানুষ কীভাবে চিকিৎসা করাবে?” 

থানচি উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা (ইউএইচএফপিও) ডা. মো. ওয়াহিদুজ্জামান মুরাদ বলেন, “বর্তমানে হাসপাতালে আমিসহ দুইজন চিকিৎসক রয়েছেন। একজন ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘদিন ধরে চিকিৎসাধীন। তিন রোগীদের সেবা দিতে পারছেন না। ফলে পুরো হাসপাতাল পরিচালনার দায়িত্ব আমাকে একাই সামলাতে হচ্ছে।”

তিনি আরো বলেন, “জনবল ও সরঞ্জাম সংকটের কারণে গুরুতর রোগীদের রেফার্ড করা ছাড়া উপায় থাকে না। দীর্ঘ পথের কারণে অনেকেই জীবিত অবস্থায় সদর হাসপাতালে পৌঁছাতে পারেন না।”

বান্দরবান জেলা সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ শাহীন হোসাইন চৌধুরী বলেন, “শুধু বান্দরবান নয়, পুরো তিন পার্বত্য জেলাতেই চিকিৎসক সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে। নতুন করে ৪৮তম বিসিএসের ডাক্তার পদায়ন না হওয়া পর্যন্ত এই সংকট পুরোপুরি সমাধান করা সম্ভব হচ্ছে না। তারপরও বিভাগীয় প্রধানকে বিষয়টি চিঠির মাধ্যমে জানানো হয়েছে। ইতোমধ্যে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজের আট-দশজন চিকিৎসককে বান্দরবানে বদলি করার জন্য প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।”

ঢাকা/মাসুদ

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • গাজায় ২৬ হাজার শিশু তীব্র অপুষ্টির শিকার: জাতিসংঘ
  • গ্রাহকের কাছে পেয়ারা খেতে চায় জনতা ব্যাংকের কর্মকর্তা
  • গল্পটা এই ক্লাসরুম থেকেই শুরু: ইরফান সাজ্জাদ
  • রাশিয়ায় এক বাঙালি বিপ্লবীর খোঁজে
  • আপনার এত সাহস হয় কী করে, সাংবাদিককে নায়িকা
  • দুবাইয়ে বিকৃত যৌন ব্যবসা চক্রের প্রধানকে চিহ্নিত করল বিবিসির এক অনুসন্ধান
  • মহানবী (সা.)–এর ইন্তেকালের পরে শাসন নিয়ে যা ঘটেছে
  • কুবিতে নতুন ১৮ বিভাগ ও ৪ ইনস্টিটিউট চালুর সুপারিশ
  • সংগীতশিল্পী দীপ মারা গেছেন
  • ৫০ শয্যার থানচি হাসপাতাল চলছে একজন চিকিৎসকে