মধ্যপ্রাচ্যে রাজনৈতিক গতিধারা পাল্টে যেতে পারে
Published: 19th, January 2025 GMT
আজই ডোনাল্ড ট্রাম্প বর্তমান মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের কাছ থেকে ক্ষমতার ব্যাটন নেবেন। সারাবিশ্বের চোখ এখন ওয়াশিংটনের দিকে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের সঙ্গে পশ্চিম এশিয়ার ফিলিস্তিন ও লেবাননে ইসরায়েলের আগ্রাসন সম্পর্কে ট্রাম্পের অবস্থান নিয়ে বিশ্বব্যাপী কৌতূহল ব্যাপক।
প্রকৃতপক্ষে ট্রাম্পের রাষ্ট্রপতিত্ব একটি বৈদেশিক ও সামরিক নীতির চোরাবালিতে আটকে যেতে পারে পশ্চিম এশিয়াতেই। ইউরেশিয়া বা এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে নয়, যদিও এ দুটি ক্ষেত্রে ঝুঁকি একেবারে কম নয়। কারণ ইসরায়েলের নিরাপত্তা মার্কিন অভ্যন্তরীণ রাজনীতিরই একটি বিষয়!
এ পর্যন্ত ট্রাম্প বেশ ঠান্ডা মাথায় খেলেছেন এবং পশ্চিম এশিয়া নিয়ে তাঁর চিন্তাভাবনা নিজের কাছেই রেখেছেন। পশ্চিম এশিয়ার জন্য তাঁর বিশেষ দূত হিসেবে ধর্মে ইহুদি স্টিভ উইটকফকে ট্রাম্প বেছে নিয়েছেন। বিষয়টি তুলনামূলক অলক্ষ্যে ঘটেছে। উইটকফ ট্রাম্পের আসন্ন দলে একজন অজ্ঞাত ও রাজনৈতিকভাবে নবাগত। তবে এটি ট্রাম্পের বড় জামাতা জ্যারেড কুশনারের প্রান্তিকীকরণ এবং আব্রাহাম চুক্তির সমাধিস্থল হতে পারে।
নিশ্চিতভাবেই স্ব-নির্মিত বিলিয়নেয়ার (নিউইয়র্ক সিটির একজন মহিলা কোট প্রস্তুতকারকের ছেলে) উইটকফ একটি আকর্ষণীয় পছন্দ। ট্রাম্প আলোচনায় উইটকফের দক্ষতা, কংক্রিটের দেয়াল ভেঙে চুক্তি সম্পাদন এবং কঠিন পরিস্থিতিতে উদ্ভাবনী নকশা তৈরি করার দৃঢ়তা সম্পর্কে জানেন। নেতানিয়াহুকে ট্রাম্পের সঙ্গে হাঁটতে বাধ্য করার ক্ষমতা উইটকফই রাখেন বলে ট্রাম্প মনে করেছেন। বাইডেন পশ্চিম এশিয়ায় যে বিপর্যয়কর অচলাবস্থা রেখে যাচ্ছেন, নেতানিয়াহুর সঙ্গে জোট বেঁধে ট্রাম্প তা টেনে নেবেন না বলে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন। কারণ তাতে আঞ্চলিকভাবে মার্কিন প্রভাব, মর্যাদা এবং আন্তর্জাতিকভাবে ইসরায়েলের সুনাম অপূরণীয়ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
উইটকফ তেল আবিবে উড়ে এসে নেতানিয়াহুকে এই আশ্চর্যজনক বার্তা পৌঁছে দেন যে, ট্রাম্প তাঁর ক্ষমতা গ্রহণের সময় গাজায় একটি চুক্তি করতে চান। গত সপ্তাহে ইসরায়েলের চ্যানেল ১২-তে দ্রুত খবর প্রচার হয়, ট্রাম্প তেল আবিবের কর্মকর্তাদের কাছে একটি বার্তা পাঠিয়েছেন, যেখানে ইসরায়েলকে ‘অপ্রয়োজনীয়’ উত্তেজনা এড়াতে এবং আঞ্চলিক সংঘাতের দিকে পরিচালিত করতে পারে– এমন বিবৃতি থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানানো হয়েছে, বিশেষ করে ট্রাম্প প্রশাসন শুরু হওয়ার আগে ক্রান্তিকালে।
চ্যানেল ১২ আরও জানিয়েছে, ‘ট্রাম্পের সহযোগীরা ইসরায়েলি কর্মকর্তাদের জানিয়েছেন, আসন্ন মার্কিন প্রশাসন মধ্যপ্রাচ্যে স্থিতিশীলতা অর্জনের লক্ষ্যে কাজ করছে। ইসরায়েল ও লেবাননের মধ্যে ‘শান্তি’ প্রতিষ্ঠা এবং চলমান যুদ্ধবিরতি বজায় রাখার ওপর মনোযোগ দিচ্ছে।’
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ‘ইসরায়েলি কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনায় ট্রাম্প জোর দিয়ে বলেছিলেন, তাঁর রাষ্ট্রপতিত্বের প্রথম দিনগুলোতে নতুন যুদ্ধে জড়ানোর কোনো ইচ্ছা তাঁর ছিল না। কারণ তিনি যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ সমস্যা সমাধানে অগ্রাধিকার দিতে চান।’
স্পষ্টতই ট্রাম্প বুঝতে পেরেছিলেন, নেতানিয়াহু এমন এক সময়ে জোর করে একটি কেয়ামতের পরিস্থিতি তৈরি করছেন, যখন তেহরান বারবার ইঙ্গিত দিয়ে আসছিল, তাদের পারমাণবিক অস্ত্র কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার কোনো ইচ্ছা নেই। ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান নিজেই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনার প্রস্তাবের পাশাপাশি এ প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
স্যাক্স আঞ্চলিক যুদ্ধের সূত্রপাতের ক্ষেত্রে ইসরায়েলের প্রচুর উস্কানি আছে বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি আসন্ন মার্কিন প্রশাসনকে এ বিষয়ে সতর্ক করেছেন, নেতানিয়াহু আবারও এগিয়ে আসছেন। এবার ইরানের সঙ্গে যুদ্ধ শুরু করার জন্য এবং ট্রাম্পের সেই ফাঁদে পা দেওয়া উচিত নয়।
নিঃসন্দেহে সর্বশেষ গাজা চুক্তিটি উইটকফ নেতানিয়াহুর গলা টিপে চাপিয়ে দিয়েছেন। ইসরায়েলি প্রতিবেদন অনুসারে, গত সপ্তাহান্তে দোহা থেকে নেতানিয়াহুর অফিসে ফোন করে উইটকফ জানান, শুক্রবার ইহুদিদের বিশ্রামের সময়। এর পর উইটকফ একটি অশ্লীল বাক্য ব্যবহার করেন এবং নেতানিয়াহুকে একটি বৈঠকে ডেকে পাঠান। নেতানিয়াহু তা মেনে চলেন।
ট্রাম্পের অনুমোদনের সঙ্গে সঙ্গে উইটকফ অবশ্যই ‘চুক্তিটির ভেঙে পড়া ঠেকাতে এ অঞ্চলে তাঁর প্রায় স্থায়ী উপস্থিতি নিশ্চিত করার পরিকল্পনা করছেন’ এবং যুদ্ধবিরতি প্রক্রিয়া সম্পর্কে সরাসরি জ্ঞান থাকা একজন অন্তর্বর্তীকালীন কর্মকর্তার মতে, ‘ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তি সঠিক পথে রাখার প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে গাজা উপত্যকা সফরের কথা বিবেচনা করছেন।’
ট্রাম্প হয়তো গাজা চুক্তির বাইরেও তাকাচ্ছেন। তেহরান ও আরব রাজধানীগুলোর ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া (সেই সঙ্গে অপ্রতিরোধ্য আন্তর্জাতিক সমর্থন) ট্রাম্পকে এগিয়ে যাওয়ার জন্য একটি অনুপ্রেরণা জোগায়। ট্রাম্প বুঝতে পারছেন, তিনি ক্ষমতা ছাড়ার পর পশ্চিম এশিয়া ধারণার বাইরে পরিবর্তিত হয়েছে এবং ইরান-সৌদি সম্পর্ক; এর ফলে সৌদি কৌশলে ঐতিহাসিক পরিবর্তন একটি গুরুত্বপূর্ণ নমুনা।
বড় প্রশ্ন হলো, ইতিহাসের ধারা বদলে দেওয়ার জন্য ট্রাম্প কতদূর যাবেন? বিশেষ করে তিনি কি তেহরানের সঙ্গে আলোচনায় জড়াবেন? নিঃসন্দেহে পেছনের চ্যানেলগুলো কাজ করছে। যেমন ১১ নভেম্বর ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ উপদেষ্টা ইলন মাস্ক এবং জাতিসংঘে ইরানের রাষ্ট্রদূতের মধ্যে বৈঠকের খবর পাওয়া গেছে। সব ধরনের সম্ভাবনা বিদ্যমান।
এম কে ভদ্রকুমার: ভারতীয় সাবেক কূটনীতিক, ভূরাজনীতি
বিশ্লেষক; ইংরেজি থেকে ভাষান্তরিত
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: র জন য র জন ত ইসর য ক ষমত
এছাড়াও পড়ুন:
৫০ শয্যার থানচি হাসপাতাল চলছে একজন চিকিৎসকে
বান্দরবানের থানচি উপজেলার প্রায় ৩০ হাজার মানুষের একমাত্র ভরসার জায়গা ৫০ শয্যার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। দীর্ঘদিন ধরে চিকিৎসক, নার্স ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির সংকটে এই হাসপাতাল কার্যত অচল হয়ে পড়েছে। বর্তমানে পুরো হাসপাতাল চালাচ্ছেন মাত্র একজন চিকিৎসক। গত পাঁচবছরে চিকিৎসাধীন ও রেফার্ড করা ২৪ জন রোগী মারা গেছেন।
হাসপাতাল সূত্র জানায়, ১৯৯৫ সালে ৩১ শয্যার থানচি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স যাত্রা শুরু করে। পরে এটি ৫০ শয্যায় উন্নীত হয়। এই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ১২ জন চিকিৎসক থাকার কথা থাকলেও কর্মরত আছেন মাত্র দুইজন। তাদের মধ্যে একজন ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘদিন চিকিৎসাধীন। এ কারণে রোগীদের সেবা দিতে পারছেন না। ১৮ জন নার্স পদে রয়েছেন মাত্র চারজন। চারজন মিডওয়াইফ থাকার কথা, নেই একজনও।
আরো পড়ুন:
ফরিদপুরে পাগলা ঘোড়ার কামড়ে আহত ২০
বক্তব্য দেওয়ার সময় অসুস্থ হয়ে পড়লেন কাদের সিদ্দিকী
প্রাথমিক থেকে শুরু করে জরুরি চিকিৎসার জন্য এই হাসপাতালে ছুটে যান পাহাড়ি ও বাঙালিরা। তাদের অভিযোগ, হাসপাতালটি ৫০ শয্যায় উন্নীত হলেও আধুনিক চিকিৎসা সুবিধা যোগ হয়নি। প্রয়োজনীয় সংখ্যক চিকিৎসক না থাকায় গর্ভবতী নারী, শিশু ও বৃদ্ধ রোগীরা সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে পড়ছেন।
দুর্গম এলাকার রোগীরা অনেক সময় নদীপথ কিংবা পাহাড়ি রাস্তা পাড়ি দিয়ে হাসপাতালে এলেও কাঙ্ক্ষিত চিকিৎসা সেবা পান না। বরং তাদের বান্দরবান সদর হাসপাতালে রেফার্ড করা হয়। অনেক সময় বান্দরবানে যাওয়ার পথে রোগীরা মারা যান। এ কারণে জরুরি ভিত্তিতে চিকিৎসক, নার্স ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি সরবরাহের দাবি জানিয়েছেন তারা।
হাসপাতালের পরিসংখ্যানবীদ পঙ্কজ বড়ুয়া জানান, ২০২০ থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত এখানে ভর্তি হয়েছেন ৫ হাজার ১৯৮ জন রোগী। এর মধ্যে ৪৫৬ জনকে রেফার্ড করা হয় বান্দরবান সদর হাসপাতালে। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন ১৭ জন রোগী।
থানচি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের অ্যাম্বুলেন্স চালক মংক্যসিং মারমা বলেন, “২০১৯ সালে চাকরিতে যোগদান করার পর থেকে অন্তত সাতজন রেফার্ড করা রোগী মাঝপথে আমার গাড়িতেই মারা গেছেন।”
শৈসাই মং মারমা তিন বছর আগে বিনা চিকিৎসায় তার মাকে মারা যেতে দেখেছেন। তিনি জানান, তার মা শৈমেপ্রু মারমা (৩৪) অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। ২০২২ সালের ১৪ নভেম্বর হঠাৎ তিনি অচেতন হয়ে পড়েন। রেমাক্রী বাজার থেকে নদীপথে থানচি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যান মাকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই তাকে জেলা সদর হাসপাতালে রেফার্ড করা হয়। ভাড়া গাড়িতে জেলা হাসপাতালে যাওয়ার সময় চিম্বুক বারো মাইল এলাকায় তার মা মারা যান।
লেংরু ম্রো নামে চার সন্তানের মা হারিয়েছেন স্বামীকে। তিনি জানান, তার স্বামী রেং য়ুং ম্রো (৪৫) কিডনি জটিলতা নিয়ে থানচি হাসপাতালে যান। সঙ্গে সঙ্গে সেখান থেকে তাকে বান্দরবান সদর হাসপাতালে রেফার্ড করা হয়। থানচি থেকে বান্দরবান যাওয়ার মাঝপথে মারা যান তার স্বামী।
স্থানীয় বাসিন্দা মংমে মারমা বলেন, “হাসপাতালে চিকিৎসক, ওষুধ ও যন্ত্রপাতির সংকট দীর্ঘদিন ধরেই চলছে। বিশেষজ্ঞ ডাক্তার বদলি হলেও অনেকেই থানচিতে যোগ দেন না, ডিপুটেশনে থেকে যান সদর হাসপাতালে। ফলে এ অঞ্চলের পাহাড়ি ও বাঙালি প্রায় ৩০ হাজার মানুষ স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।”
রিয়েং ম্রো নামে অপর বাসিন্দা বলেন, “পাহাড়ে বসবাসকারীদের অধিকাংশ গরিব। জেলা সদর হাসপাতালে রোগী নিয়ে যাওয়া ব্যয়বহুল ও কষ্টকর। রেমাক্রি, বড় মোদক, তিন্দু থেকে থানচি সদরে রোগী আনতেই অনেক টাকা খরচ হয়ে যায়। এরপর আবার বান্দরবান সদর হাসপাতালে রেফার্ড করলে সাধারণ মানুষ কীভাবে চিকিৎসা করাবে?”
থানচি উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা (ইউএইচএফপিও) ডা. মো. ওয়াহিদুজ্জামান মুরাদ বলেন, “বর্তমানে হাসপাতালে আমিসহ দুইজন চিকিৎসক রয়েছেন। একজন ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘদিন ধরে চিকিৎসাধীন। তিন রোগীদের সেবা দিতে পারছেন না। ফলে পুরো হাসপাতাল পরিচালনার দায়িত্ব আমাকে একাই সামলাতে হচ্ছে।”
তিনি আরো বলেন, “জনবল ও সরঞ্জাম সংকটের কারণে গুরুতর রোগীদের রেফার্ড করা ছাড়া উপায় থাকে না। দীর্ঘ পথের কারণে অনেকেই জীবিত অবস্থায় সদর হাসপাতালে পৌঁছাতে পারেন না।”
বান্দরবান জেলা সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ শাহীন হোসাইন চৌধুরী বলেন, “শুধু বান্দরবান নয়, পুরো তিন পার্বত্য জেলাতেই চিকিৎসক সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে। নতুন করে ৪৮তম বিসিএসের ডাক্তার পদায়ন না হওয়া পর্যন্ত এই সংকট পুরোপুরি সমাধান করা সম্ভব হচ্ছে না। তারপরও বিভাগীয় প্রধানকে বিষয়টি চিঠির মাধ্যমে জানানো হয়েছে। ইতোমধ্যে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজের আট-দশজন চিকিৎসককে বান্দরবানে বদলি করার জন্য প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।”
ঢাকা/মাসুদ