শীতকালীন বিভিন্ন সবজির দাম কৃষক পর্যায়ে প্রান্তদেশ স্পর্শ করিয়াছে বলিয়া মঙ্গলবার সমকাল যেই সংবাদ দিয়াছে, উহা প্রধানত দুইটি কারণে উদ্বেগজনক বলিয়া আমরা মনে করি। ইহাতে শুধু উৎপাদকগণই চরম ক্ষতির শিকার হইতেছেন না; জাতীয় খাদ্য নিরাপত্তাও হুমকির মুখোমুখি। প্রতিবেদন অনুযায়ী, বর্তমানে নাটোরে উৎপাদক পর্যায়ে প্রতি কেজি মুলার দর ২ বা ৩ টাকা, প্রতিটি লাউ ৫-৭ টাকা, শসার কেজি ৮-১০ টাকা, লালশাকের আঁটি ১ টাকা, ধনিয়া পাতার কেজি ৫-১০ টাকা, যেইগুলির অধিকাংশের উৎপাদন ব্যয় উক্ত বিক্রয় দর অপেক্ষা অধিক। উদাহরণস্বরূপ, কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের তথ্য অনুসারে, প্রতিটি লাউ উৎপাদনে ব্যয় হয় অন্তত ১৩ টাকা ২০ পয়সা। ফলে অধিক মুনাফার আশায় শীতের সবজি চাষ করিয়া উৎপাদকদের এখন পুঁজিই বিপন্ন হইবার পরিস্থিতি মোকাবিলা করিতে হইতেছে। উৎপাদকগণের এহেন দুর্দশা শুধু নাটোরেই নহে; বগুড়া, ঠাকুরগাঁওসহ সবজি উৎপাদনের জন্য পরিচিত প্রায় সকল জেলাতেই বিরাজমান। এমন পরিস্থিতি জাতীয় খাদ্য নিরাপত্তাকেও হুমকির সম্মুখীন করিতেছে। কারণ পুঁজি হারাইয়া সংশ্লিষ্ট উৎপাদকগণ যদি ভবিষ্যতে উক্ত সবজিসমূহ উৎপাদনে উৎসাহ হারাইয়া ফেলেন, তাহা হইলে মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় করিয়া এই সকল সবজি আমদানি করিতে হইতে পারে। এইরূপ আশঙ্কা ফুৎকারে উৎক্ষেপ করা যায় না এই কারণেও; সাম্প্রতিক বৎসরগুলিতে এমনকি কাঁচামরিচের ন্যায় সাধারণ খাদ্যপণ্যও আমাদের প্রায়শ আমদানি করিতে হয়। ফলে আজিকে বিভিন্ন সবজির মূল্য ভোক্তাদের নাগালের মধ্যে থাকিলেও কৃষকের দুর্দশা অব্যাহত থাকিলে শেষ পর্যন্ত ভোক্তার হরিষে বিষাদে পরিণত হইতে পারে।
বলা বাহুল্য, বাম্পার ফলনের কারণে সবজি চাষিদের এহেন দুর্দশা নূতন নহে, বরং বৎসরের পর বৎসর তাহাদের বিশেষত শীত মৌসুমে এই অবস্থার সম্মুখীন হইতে হয়। শুধু উহাই নহে, প্রায় সকল প্রকার ফসলের ক্ষেত্রেই কৃষকের ন্যায্য দর না পাইবার ঘটনা ঘটে। এমনকি ধান ও আলুর ন্যায় প্রধান খাদ্যশস্য এবং সবজি এই চক্রের বাহিরে নাই। বিদ্যমান বিপণন ব্যবস্থার ত্রুটি এই অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির জন্য অনেকাংশে দায়ী, ইহা অনস্বীকার্য। বাজার ব্যবস্থাপনায় নীতিমালার অভাবকেও তজ্জন্য দায়ী করা যায়। বিশ্লেষকগণ এই পরিস্থিতির দায় কৃষি মন্ত্রণালয়ের সঠিক দিকনির্দেশনার অভাবে চাহিদার সহিত উৎপাদনের সমন্বয় না থাকা, সিন্ডিকেটের কারসাজি, প্রক্রিয়াজাতকরণ ব্যবস্থার অনুপস্থিতি, সংরক্ষণের অপ্রতুল ব্যবস্থা ইত্যাদির উপর দিয়া থাকেন, উহাও গুরুত্বপূর্ণ। আমরা জানি, প্রতিবেশী ভারতসহ বিশ্বের বহু উন্নয়নশীল দেশ কৃষিপণ্য রপ্তানিতে ইতোমধ্যে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি অর্জন করিয়াছে। উপযুক্ত নীতিমালা ও কার্যক্রম গৃহীত হইলে তাহা আমাদের পক্ষেও অসম্ভব নহে। অন্তত বিশ্বে ব্যাপৃত এক কোটির অধিক বাংলাদেশিকে লক্ষ্য করিয়া আমরা কৃষিপণ্য রপ্তানির উদ্যোগ গ্রহণ করিতে পারিতাম। কিন্তু গত কয়েক দশকে এই বিষয়ে কথার যত ফুলঝুরি ছুটিয়াছে, কার্যে তত পরিণত হয় নাই।
অনেকেরই জানা থাকিবার কথা, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের বাংলাদেশে ‘ফাইটোস্যানিটারি’ তথা কৃষিপণ্যের স্বাস্থ্যহানিকর উপাদান মুক্তকরণ প্রক্রিয়া শক্তিশালীকরণ প্রকল্পের অধীনে ঢাকার শ্যামপুরে কেন্দ্রীয় প্রক্রিয়াজাতকরণ ব্যবস্থা বহু বৎসর হইল স্থাপিত। মূলত আম্রসহ বিদেশে কদর আছে এমন উদ্বৃত্ত কৃষিপণ্য রপ্তানিতে গতি আনয়নই ছিল ইহার লক্ষ্য। কিন্তু পরিকল্পনা ও উদ্যমহীনতার কারণে উহা তেমন কার্য দিতেছে না। উদ্যোক্তাদের মতে, শ্যামপুর হইতে বিমানবন্দরে যাইতে যানজটের কারণে পাঁচ-ছয় ঘণ্টা পর্যন্ত সময় লাগিয়া যায়। ইহার ফলে জনগণের বিপুল অর্থ ব্যয় করিয়া স্থাপিত উক্ত অবকাঠামো অনেকাংশেই অব্যবহৃত।
উৎপাদক পর্যায়ে কৃষিপণ্যের মূল্যধসের বিষয়টি লইয়া অলস বসিয়া থাকিবার কোনো অবকাশ নাই। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, দেশে কৃষক পরিবারের সংখ্যা ১ কোটি ৬৫ লক্ষ, যাহার প্রায় ৮৪ শতাংশ প্রান্তিক, ক্ষুদ্র ও মধ্যমানের কৃষক। ফসলের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করিয়া এই অসংগঠিত কৃষকদের যে কোনো প্রকারে বাঁচাইতে হইবে। আমাদের প্রত্যাশা, সরকার দ্রুত এই বিষয়ে তৎপর হইবে।
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: সবজ র দ ম পর স থ ত ব যবস থ
এছাড়াও পড়ুন:
সিআইডিতে বিচারবহির্ভূত হত্যার তদন্ত বিষয়ে আন্তর্জাতিক কর্মশালা
বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের নিরপেক্ষ তদন্ত নিশ্চিত করতে ‘সম্ভাব্য অবৈধ মৃত্যুর তদন্তসংক্রান্ত মিনেসোটা নীতিমালা’ শীর্ষক দুই দিনব্যাপী আন্তর্জাতিক কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়েছে। জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারীর (ইউএনআরসি) কার্যালয় এবং বাংলাদেশ পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) যৌথ আয়োজনে ৩০ ও ৩১ জুলাই ঢাকার সিআইডি সদর দপ্তরে এই কর্মশালার আয়োজন করা হয়। বৃহস্পতিবার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানায় সিআইডি।
কর্মশালায় সভাপতিত্ব করেন সিআইডির প্রধান ও বাংলাদেশ পুলিশের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক মো. ছিবগাত উল্লাহ। উদ্বোধনী বক্তব্যে তিনি বলেন, ‘সিআইডি এখন একটি আধুনিক, তথ্যভিত্তিক ও প্রযুক্তিনির্ভর তদন্ত সংস্থা হিসেবে গড়ে উঠছে। মানবাধিকার রক্ষা ও বিচারপ্রাপ্তি নিশ্চিত করতে প্রমাণনির্ভর নিরপেক্ষ তদন্ত অপরিহার্য এবং এ ধরনের আন্তর্জাতিক কর্মশালা আমাদের সে লক্ষ্যে পৌঁছাতে সহায়তা করে।’
মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন জাতিসংঘের বিচারবহির্ভূত, সংক্ষিপ্ত বা ইচ্ছামতো মৃত্যুবিষয়ক বিশেষ প্রতিবেদক মরিস টিডবল-বিন্জ। তিনি বলেন, মিনেসোটা নীতিমালা একটি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত মানদণ্ড, যা সন্দেহজনক মৃত্যুর নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে বিচারব্যবস্থার প্রতি আস্থা সৃষ্টি করে। উপস্থাপনায় তিনি লিবিয়া ও ফকল্যান্ড দ্বীপপুঞ্জে আইনবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের তদন্তের উদাহরণ তুলে ধরেন।
কর্মশালার শুরুতে সিআইডির ফরেনসিক বিভাগের বিশেষ পুলিশ সুপার শম্পা ইয়াসমীন দেশের ডিএনএ ও ফরেনসিক সক্ষমতা নিয়ে আলোচনা করেন। দুই দিনব্যাপী এই কর্মশালায় অংশ নেন দেশের বিভিন্ন পুলিশ ইউনিটের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, বিচারক, চিকিৎসক ও ফরেনসিক সংক্রান্ত বিশেষজ্ঞ, মানবাধিকার সংস্থার প্রতিনিধি এবং প্রযুক্তি ও অনুসন্ধান-সংশ্লিষ্ট পেশাজীবীরা।
আলোচনার মূল বিষয়গুলোর মধ্যে ছিল, আন্তর্জাতিক নীতিমালা অনুযায়ী মৃতদেহ শনাক্তকরণ (দুর্যোগে নিহত ব্যক্তি শনাক্তকরণ), নিরপেক্ষ ফরেনসিক প্রতিবেদন তৈরির কৌশল, মানবাধিকার সংরক্ষণে তদন্তকারীদের নৈতিক ও পেশাগত দিকনির্দেশনা এবং বাস্তব ক্ষেত্রভিত্তিক কেস স্টাডি উপস্থাপন।
বিশেষ অধিবেশন পরিচালনা করেন ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মমতাজ আরা, পুলিশ সদর দপ্তরের অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক জান্নাতুল হাসান এবং সিআইডির ডিএনএ বিশ্লেষক আহমেদ ফেরদৌস। তাঁদের আলোচনায় জুলাই আন্দোলনে সংঘটিত অপরাধের তদন্তের অগ্রগতি, সীমাবদ্ধতা ও চ্যালেঞ্জও উঠে আসে।
সমাপনী দিনে বক্তারা বলেন, প্রযুক্তি, প্রশিক্ষণ এবং আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে দেশের তদন্তপ্রক্রিয়াকে আরও মানবিক, কার্যকর ও স্বচ্ছ করা সম্ভব। সিআইডির প্রধান ভবিষ্যতে ফরেনসিক সক্ষমতা সম্প্রসারণ এবং অবকাঠামোগত উন্নয়নে আন্তর্জাতিক সহযোগিতার ওপর গুরুত্বারোপ করেন।
সমাপনী বক্তব্যে মরিস টিডবল-বিন্জ বলেন, আইনবহির্ভূত মৃত্যুর তদন্তে প্রযুক্তির ব্যবহার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভ্রাম্যমাণ ডিএনএ পরীক্ষাগার, ঘটনাস্থলে মরদেহ শনাক্তকরণ পদ্ধতি ও অন্যান্য প্রযুক্তিনির্ভর উদ্যোগে জাতিসংঘ প্রয়োজনীয় সহায়তা দিতে প্রস্তুত।