সহযোগীসহ ফেঁসে যাচ্ছেন সাবেক মেয়র খালেক
Published: 23rd, January 2025 GMT
ফেঁসে যাচ্ছেন খুলনা সিটি করপোরেশনের (কেসিসি) অপসারিত মেয়র ও মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি তালুকদার আবদুল খালেক ও তাঁর সহযোগীরা। মেয়র পদে থেকে আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে বেনামে কোটি কোটি টাকার ঠিকাদারি কাজ করার অভিযোগ উঠেছে খালেকের বিরুদ্ধে।
দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) খালেকের অনিয়ম-দুর্নীতি তদন্ত করতে গিয়ে তাঁর অন্যতম সহযোগী মেসার্স হোসেন ট্রেডার্স, তাজুল এন্টারপ্রাইজ ও আজাদ ইঞ্জিনিয়ার্সের ঠিকাদারি কাজের তথ্য চেয়েছে। বিশেষ করে মেয়রের ব্যবসায়িক অংশীদার এইচ এম সেলিম ওরফে সেলিম হুজুরের যাবতীয় ঠিকাদারি কাজের তথ্য সরবরাহ করতে কেসিসিকে চিঠি দিয়েছে সংস্থাটি। পাশাপাশি মেয়র হিসেবে তালুকদার খালেকের ব্যবহৃত সব গাড়ির লগবইও সরবরাহ করতে কেসিসি প্রশাসককে চিঠি দেওয়া হয়েছে।
কর্মকর্তা-কর্মচারীরা জানান, সভা-সমাবেশে বক্তৃতায় দুর্নীতির বিরুদ্ধে ঝড় তুলতেন তালুকদার খালেক। সততার মুখোশের আড়ালে গত সাড়ে ১৫ বছরে তিনি অনিয়ম-দুর্নীতি করে বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন। এর বড় অংশই করেছেন মেয়র পদকে কাজে লাগিয়ে।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, আইন লঙ্ঘন করে অন্যের লাইসেন্সে নিজেই ঠিকাদারি করতেন খালেক। মেসার্স হোসেন ট্রেডার্স, আজাদ ইঞ্জিনিয়ার্স ও মেসার্স তাজুল ইসলাম নামের তিন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের নামে প্রায় ৬০ কোটি টাকার কাজ করেছেন গত কয়েক বছরে। ঠিকাদার এইচ এম সেলিম (সেলিম হুজুর) এসব কাজ দেখাশোনা করতেন। এর বাইরে ৫ শতাংশ কমিশনের ভিত্তিতে আরও প্রায় শতকোটি টাকার উন্নয়ন কাজ বড় ঠিকাদারের কাছে বিক্রি করেছেন।
বাগেরহাট-৩ আসনে চারবার সংসদ সদস্য ছিলেন তালুকদার খালেক। কেসিসি মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর আসনটিতে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন তাঁর স্ত্রী হাবিবুন নাহার। তিনিও উপমন্ত্রী হন। কিন্তু খালেকই রামপাল ও মোংলা উপজেলার সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করতেন। সভা-সমাবেশের জন্য রামপালে গেলে ব্যবহার করতেন কেসিসির গাড়ি ও তেল। উপমন্ত্রী স্ত্রী এবং প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদার মেয়র হওয়ায় তাঁর বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস করেননি কেউ।
গত ২৭ আগস্ট ‘সামনে সততার মুখোশ, পেছনে খালেকের বিপুল লুটপাট’ শিরোনামে দৈনিক সমকালে সংবাদ প্রকাশিত হয়। এর পর নড়েচড়ে বসে দুদক। গত ২৪ ডিসেম্বর তালুকদার খালেকের দুর্নীতি তদন্তের সিদ্ধান্ত নেয় দুদক। এর পর গত মঙ্গলবার দুদকের খুলনার উপপরিচালক আবদুল ওয়াদুদকে প্রধান করে অনুসন্ধান টিম গঠন করা হয়। গতকাল বৃহস্পতিবার থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে কাজ শুরু করেছে অনুসন্ধান টিম।
দুদকের উপপরিচালক আবদুল ওয়াদুদ জানান, প্রধান কার্যালয় থেকে বৃহস্পতিবার চিঠি পেয়েই তারা অনুসন্ধান শুরু করেছেন। সাবেক মেয়রের দুর্নীতি অনুসন্ধানে তাঁর সহযোগীদের তথ্য প্রয়োজন। এ জন্য সহযোগীদের তথ্য চাওয়া হয়েছে। এ ছাড়া মেয়র হয়ে রামপাল-মোংলার জন্য কেসিসির গাড়ি ব্যবহার, নর্থ ওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটির অর্থ আত্মসাতের বিষয়টি খুঁজে বের করতে চিঠি দেওয়া হয়েছে।
গতকাল তালুকদার খালেক ও তাঁর স্ত্রী হাবিবুন নাহারের আয়কর রিটার্ন, কর নির্ধারণী আদেশসহ সংশ্লিষ্ট রেকর্ডপত্রে ছাপালিপি চেয়ে খুলনা কর অঞ্চলের উপকর কমিশনার সার্কেল-৩ এর কাছে চিঠি দেওয়া হয়েছে।
উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
গ্যাস অপচয়ে বছরে ক্ষতি ৩ হাজার কোটি টাকার বেশি: পেট্রোবাংলা
কারিগরি ক্ষতির (সিস্টেম লস) নামে গ্যাস অপচয় বাড়ছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে গ্যাস বিতরণ লাইনে অপচয় হয়েছে গড়ে ৬ দশমিক ২৮ শতাংশ গ্যাস। এতে আর্থিক ক্ষতি হয়েছে ৩ হাজার ৭৯০ কোটি টাকা। আর গত অর্থবছরের (২০২৪-২৫) মার্চ পর্যন্ত অপচয় হয়েছে ৭ দশমিক ৪৪ শতাংশ। এতে আর্থিক ক্ষতি ৩ হাজার ২৮৬ কোটি টাকা। এর বাইরে সঞ্চালন লাইনে অপচয় হয়েছে ২ শতাংশ।
‘দেশের জ্বালানিনিরাপত্তা: চ্যালেঞ্জ ও করণীয়; গণমাধ্যমের ভূমিকা’ শীর্ষক এক সেমিনারে এসব তথ্য উপস্থাপন করেছে বাংলাদেশ তেল, গ্যাস, খনিজ সম্পদ করপোরেশন (পেট্রোবাংলা)। এতে বলা হয়, ২ শতাংশ অপচয় গ্রহণযোগ্য, তাই ওইটুকু সমন্বয় করেই আর্থিক ক্ষতির হিসাব করা হয়েছে। গ্যাসের অপচয় রোধে নিয়মিত অভিযান চালাচ্ছে ছয়টি গ্যাস বিতরণ সংস্থা।
পেট্রোবাংলা বলছে, গ্যাস অপচয়ের জন্য দায়ী হচ্ছে পুরোনো, জরাজীর্ণ পাইপলাইন; গ্যাস সরবরাহ লাইনের গ্যাসস্টেশন রাইজারে লিকেজ (ছিদ্র); তৃতীয় পক্ষের উন্নয়নকাজে পাইপলাইন ছিদ্র হওয়া এবং আবাসিক খাতে প্রচুর অবৈধ সংযোগ। তবে এসব অপচয় রোধে বেশ কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে জানায় পেট্রোবাংলা। এর মধ্যে রয়েছে গ্যাস সরবরাহব্যবস্থায় মিটারিং/ মনিটরিং ব্যবস্থাপনা কার্যকর করা; লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে কারিগরি ক্ষতি নিয়ন্ত্রণে রাখা; অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন ও উচ্ছেদ কার্যক্রম জোরদার করা এবং আবাসিক গ্রাহকদের প্রিপেইড মিটারের আওতায় আনা।
দেশের গ্যাস খাতের চিত্র তুলে ধরে সেমিনারে মূল নিবন্ধ উপস্থাপন করেন বুয়েটের সাবেক অধ্যাপক ইজাজ হোসেন। তিনি বলেন, দেশে গ্যাসের উৎপাদন কমতে কমতে ১৫ বছর আগের জায়গায় চলে গেছে। গ্যাস অনুসন্ধান জোরদারের কোনো বিকল্প নেই। গ্যাস চুরি ও অপচয় কমাতে হবে। সঞ্চালন ও বিতরণ মিলে কারিগরি ক্ষতি প্রায় ১০ শতাংশ, যা অনেক বেশি। সঞ্চালন লাইনে কারিগরি ক্ষতি কোনোভাবেই ২ শতাংশ হওয়ার কথা নয়। এটা ভালো করে দেখা উচিত।
শিল্পে নতুন সংযোগে গ্যাসের সরবরাহ নিশ্চিত করা হবে
পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান মো. রেজানুর রহমান বলেন, সঞ্চালন লাইনে কারিগরি ক্ষতির বিষয়টি গভীরভাবে দেখা হচ্ছে। অবৈধ সংযোগ বন্ধে পেট্রোবাংলা তৎপর আছে, খোঁজ পেলেই বিচ্ছিন্ন করা হবে। সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, শিল্পে নতুন সংযোগের ক্ষেত্রে গ্যাসের সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে, যেহেতু তারা বেশি দাম দেবে। তাই অগ্রাধিকার বিবেচনা করে তিনটি তালিকা তৈরি করা হচ্ছে। প্রথম ধাপের তালিকায় থাকছে, যেসব কারখানায় এখনই সংযোগ দেওয়া যাবে। এগুলো পরিদর্শন প্রায় শেষের দিকে, আগামী সপ্তাহে শেষ হয়ে যাবে।
সাংবাদিকদের অন্য এক প্রশ্নের জবাবে পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান বলেন, আমদানি করা তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) রূপান্তর করে পাইপলাইনে সরবরাহ করতে নতুন টার্মিনাল নির্মাণে অগ্রাধিকার পাচ্ছে স্থলভাগের টার্মিনাল। মহেশখালীর মাতারবাড়ী এলাকায় এটি করা হবে। এটি হলে কম দামের সময় বাড়তি এলএনজি কিনে মজুত করা যাবে। তবে এগুলো রাতারাতি করা যায় না, পাঁচ বছর সময় লাগতে পারে।
জাতীয় গ্রিডে নতুন করে দিনে ৭৮ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস যুক্ত হয়েছে
তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে উৎপাদন অংশীদারত্ব চুক্তি (পিএসসি) নিয়ে একটি নিবন্ধ উপস্থাপন করেন পেট্রোবাংলার পরিচালক (পিএসসি) মো. শোয়েব। তিনি বলেন, স্থলভাগে গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য তৈরি পিএসসির খসড়া জ্বালানি বিভাগে পাঠানো হয়েছে।
গ্যাস উৎপাদন ও সরবরাহ নিয়ে একটি নিবন্ধ উপস্থাপন করেন পরিচালক মো. রফিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, ৫০টি কূপ সংস্কার, উন্নয়ন ও খননের প্রকল্পে ইতিমধ্যে ১৮টির কাজ শেষ হয়েছে। জাতীয় গ্রিডে নতুন করে দিনে ৭৮ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস যুক্ত হয়েছে। ৪টি কূপের কাজ চলমান। এ ছাড়া পেট্রোবাংলার বিভিন্ন প্রকল্পের কার্যক্রম তুলে ধরেন সংস্থাটির পরিচালক (পরিকল্পনা) মো. আবদুল মান্নান পাটওয়ারী।
সবচেয়ে বেশি বকেয়া বিদ্যুৎ খাতে
পেট্রোবাংলার আর্থিক দিক তুলে ধরেন সংস্থাটির পরিচালক (অর্থ) এ কে এম মিজানুর রহমান। তিনি বলেন, গত অর্থবছরে পেট্রোবাংলার রাজস্ব আয় ৫৪ হাজার ১১৭ কোটি টাকা, এর মধ্যে অর্ধেক বকেয়া। গত মে পর্যন্ত গ্যাস বিল বকেয়া ২৭ হাজার ১৯৯ কোটি টাকা। এটি ধীরে ধীরে কমে আসছে। ১৩–১৫ হাজার কোটিতে বকেয়া নেমে এলে সন্তোষজনক। সবচেয়ে বেশি বকেয়া বিদ্যুৎ খাতে ১৬ হাজার ৫২৩ কোটি টাকা। এরপর সার কারখানায় বকেয়া আছে ৯৬৪ কোটি টাকা। তবে বিদেশি কোনো কোম্পানির কাছে বিল বকেয়া নেই পেট্রোবাংলার। সব বিল শোধ করা হয়ে গেছে।
গত অর্থবছরে প্রতি ইউনিটে লোকসান হয়েছে ৪ টাকা
পেট্রোবাংলা বলছে, এলএনজি আমদানি শুরুর পর থেকে লোকসান শুরু হয় সংস্থাটির। প্রতিবছর সরকারের কাছ থেকে ভর্তুকি নিচ্ছে পেট্রোবাংলা। ২০১৮-১৯ সালে এলএনজি আমদানি শুরু হয়, ওই বছর ভর্তুকি ছিল ২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। এরপর এলএনজি আমদানি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ভর্তুকিও বাড়তে থাকে। গত অর্থবছরে তারা ভর্তুকি নিয়েছে ৮ হাজার ৯০০ কোটি টাকা। এ পর্যন্ত পেট্রোবাংলা মোট ভর্তুকি নিয়েছে ৩৬ হাজার ৭১২ কোটি টাকা। পেট্রোবাংলার হিসাবে গত অর্থবছরে প্রতি ইউনিট গ্যাস সরবরাহে পেট্রোবাংলার খরচ হয়েছে ২৭ টাকা ৫৩ পয়সা। তারা বিক্রি করেছে ২২ টাকা ৯৩ পয়সায়। এর মানে প্রতি ইউনিটে লোকসান হয়েছে ৪ টাকা ৬০ পয়সা।