দুর্বল ছয়টি ব্যাংকের আমানতকারীর টাকা ফেরতের ব্যবস্থা করতে বিশেষ ধার হিসেবে ২২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ছাপিয়ে দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। মূল্যস্ফীতিতে এর প্রভাব এড়াতে বাংলাদেশ ব্যাংক বিলের মাধ্যমে ওই ধারের বিপরীতে সবল ব্যাংকের কাছ থেকে টাকা তুলে নেওয়ার উদ্যোগ নেয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উদ্যোগে আশানুরূপ সাড়া মিলছে না। দুই মাসে ১০টি নিলামে উত্তোলন হয়েছে মাত্র ৩ হাজার ১৫৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে চলতি মাসের ৪ নিলামের মধ্যে দু’দিনে এক টাকাও ধার নিতে পারেনি কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
সাধারণভাবে ব্যাংকের কাছে থাকা উদ্বৃত্ত ট্রেজারি বিল ও বন্ড বন্ধক রেখে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে টাকা ধার নেয় ব্যাংকগুলো। দীর্ঘদিন ধরে ছয়টি ব্যাংকের উদ্বৃত্ত বিল-বন্ড দূরে থাক, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে রক্ষিত চলতি হিসাবে বড় ঘাটতি নিয়ে চলছিল। সাধারণভাবে কোনো ব্যাংকের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে রক্ষিত চলতি হিসাবে টাকা না থাকলে লেনদেন করতে পারে না। ওই সময় এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে থাকা– ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী, এসআইবিএল, গ্লোবাল ইসলামী, ইউনিয়ন ও ন্যাশনাল ব্যাংকের চলতি হিসাবে ঋণাত্মক রেখেই লেনদেনের সুযোগ দেওয়া হয়। ড.
গত ২০ নভেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংক বিলের প্রথম নিলাম অনুষ্ঠিত হয়। নভেম্বরে দুটি নিলামে উত্তোলন করা হয় ৯৫৪ কোটি টাকা। এর সুদহার ছিল ১১ দশমিক ১০ শতাংশ। এর পর ডিসেম্বর মাসে ৪টি নিলামে উত্তোলন করা হয় ১ হাজার ৭৮০ কোটি টাকা, যার সুদহার ছিল ১১ দশমিক ৪৯ থেকে ১১ দশমিক ৭০ শতাংশ। জানুয়ারি মাসেও একই রকম সুদ দিয়ে টাকা তোলার চেষ্টা করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। যদিও আশানুরূপ সাড়া মিলছে না।
বছরের প্রথম দিন ১ জানুয়ারি গড়ে ১১ দশমিক ৪৯ শতাংশ সুদে ৪০০ কোটি টাকা উত্তোলন হয়েছে। ৯ জানুয়ারির নিলামে ১২ দশমিক ৬৫ থেকে ১৩ শতাংশ সুদে মাত্র ৪০ কোটি টাকা রাখার চেষ্টা করে দুটি ব্যাংক। এদিন এক টাকাও নেওয়া হয়নি। গত ১৫ জানুয়ারির নিলামে ১১ দশমিক ৩২ শতাংশ সুদে উত্তোলন হয়েছে মাত্র ২৫ কোটি টাকা। সর্বশেষ গত ২২ জানুয়ারির নিলামে ১৩ শতাংশ সুদে ২০ কোটি টাকা রাখার চেষ্টা করে একটি ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংক শেষ পর্যন্ত আর এই টাকা উত্তোলন করেনি। জানা গেছে, বর্তমানে সার্বিকভাবে ব্যাংক খাতে আমানত প্রবাহে গতি কম। এ কারণে নিয়মিত বিল ও বন্ডের নিলামের বাইরে বাংলাদেশ ব্যাংক বিলে আগ্রহ কম দেখাচ্ছে ব্যাংকগুলো।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সানেমের নির্বাহী পরিচালক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. সেলিম রায়হান মনে করেন, মূল্যস্ফীতি কমাতে মুদ্রানীতি, রাজস্বনীতি এবং বাজার ব্যবস্থাপনায় যে সমন্বয় দরকার সেখানে ঘাটতি আছে। তিনি বলেন, ঋণের সুদহার বৃদ্ধি সরাসরি ব্যবসায়িক খরচ বাড়াচ্ছে। আবার ব্যবসার নগদ প্রবাহের ওপর চাপ সৃষ্টি করে পরিচালনার খরচ বাড়াচ্ছে। ধারাবাহিকভাবে সুদহার বৃদ্ধি ঋণ গ্রহণের প্রবণতা কমে বিনিয়োগে বিরূপ প্রভাব ফেলবে। ব্যবসায়ীরা যদি উচ্চ সুদ পরিশোধ করতে না পারেন, তবে নতুন প্রকল্প বা সম্প্রসারণের জন্য ঋণ নিতে সংকুচিত হয়ে পড়বে। এর ফলে অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির গতি আরও স্লথ হবে। কর্মসংস্থানের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ব যবস
এছাড়াও পড়ুন:
মিরাজে দুর্দান্ত জয় বাংলাদেশের
এমন পারফরম্যান্সই তো চাওয়ার থাকে ভালো দলের কাছে। মেহেদী হাসান মিরাজের অলরাউন্ড নৈপুণ্য, সাদমান ইসলামের সেঞ্চুরি, তাইজুল ইসলামের ৯ উইকেট শিকারে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ইনিংস ও ১০৬ রানের বিশাল জয় এনে দেয় বাংলাদেশকে। প্রথম টেস্ট হারের পর যে সমালোচনা হয়েছিল, তার জবাবটা বোধ হয় দ্বিতীয় টেস্ট তিন দিনে জিতে দিয়ে দিলেন নাজমুল হোসেন শান্তরা। ‘বাউন্স ব্যাক’ করে সিরিজ ড্র ১-১-এ।
চট্টগ্রামের বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমান স্টেডিয়ামে বীরোচিত পারফরম্যান্স ছিল টাইগারদের। এটি সম্ভব হয়েছে পছন্দের উইকেটে খেলা হওয়ায়। স্পিন ভুবনে উইকেট উৎসব করেছেন তাইজুল, মিরাজ গাঁটছড়া বেঁধে। সিরিজ নির্ধারণী টেস্টে দুটি সেঞ্চুরি দারুণ অর্জন অধারাবাহিক ব্যাটিং লাইনআপের। এই টেস্টে ওপেনিং জুটি ভালো করেছে। লম্বা সময় পর টেস্ট খেলার সুযোগ পাওয়া এনামুল হক বিজয় ভালোই সঙ্গ দেন সাদমানকে। লোয়ার মিডলঅর্ডারে মিরাজের লড়াই ছিল দেখার মতো।
টেলএন্ডারদের নিয়ে রীতিমতো বাজিমাত করেছেন তিনি। শেষ ৩ উইকেটে তৃতীয় দিন ১৫৩ রান যোগ করেন। বাংলাদেশকে পৌঁছে দেন ৪৪৪ রানে। ২১৭ রানের লিড থাকায় ইনিংস ব্যবধানে জয়ের স্বপ্ন দেখায়। মিরাজের অলরাউন্ড পারফরম্যান্সে সে স্বপ্ন পূরণ হয়। সাকিব আল হাসান ও সোহাগ গাজীর পর তৃতীয় বাংলাদেশি ক্রিকেটার হিসেবে সেঞ্চুরি ও পাঁচ উইকেট শিকার তাঁর।
গত বছর দেশের মাটিতে টেস্টে ভালো করতে পারেনি বাংলাদেশ। শ্রীলঙ্কার পর দক্ষিণ আফ্রিকার কাছে হোয়াইটওয়াশ হয়েছে। ২০২৫ সালের শুরুটাও ভালো ছিল না। সিলেটে জিম্বাবুয়ের কাছে হেরেছে। সিরিজ বাঁচাতে চট্টগ্রামে জিততেই হতো। লক্ষ্যে পৌঁছাতে কন্ডিশনেও পরিবর্তন আনা হয়। চট্টগ্রামের উইকেটে খেলা হয় দ্বিতীয় টেস্ট। যেখানে শাসন ছিল স্পিনারদের। পছন্দের উইকেট পাওয়ায় তিন স্পিনার নিয়ে খেলে বাংলাদেশ। তিনজনই দারুণ বোলিং করেন প্রথম থেকে।
দীর্ঘ বিরতির পর টেস্ট খেলার সুযোগ পাওয়া অফস্পিনার নাঈম হাসান চ্যালেঞ্জ নিয়ে বোলিং করে গেছেন। বেশি উইকেট না পেলেও এক প্রান্তে ব্যাটারদের চাপে ফেলেছেন। যার সুফল তাইজুল ও মিরাজ পেয়েছেন অন্য প্রান্তে। প্রথম দিন শেষ সেশনে ব্রেক থ্রু দেন তিনি। বাঁহাতি স্পিনার পরে পিক করে ৬ উইকেট শিকার করেন। জিম্বাবুয়ে ৯ উইকেটে ২২৭ রানে প্রথম দিন শেষ করে। পরের দিন এক বল খেলে ওই রানেই অলআউট হয়। বাংলাদেশ ব্যাটিং শুরু করে বড় লক্ষ্য নিয়ে। সাদমান ইসলাম ও এনামুল হক বিজয় ১১৮ রানের ওপেনিং জুটি করায় প্রতিপক্ষকে ছাড়িয়ে যাওয়া সহজ হয়। সাদমানের সেঞ্চুরি ও মুমিনুল হক, মুশফিকুর রহিম কিছু রান করায় ৭ উইকেটে ২৯১ রানে দ্বিতীয় দিন শেষ করে বাংলাদেশ।
সেদিন সংবাদ সম্মেলনে সাদমান আশা প্রকাশ করেন, মিরাজ ও তাইজুল জুটি করবেন। অষ্টম উইকেটে ৬৪ রানের জুটি দু’জনের। বেশি ভালো করেছেন পেসার তানজিম হাসান সাকিব। মিরাজের সঙ্গে ১৫৬ বলে ৯৬ রানের জুটি। অভিষেক টেস্টে সাকিবের ব্যাটিং দারুণ লেগেছে অধিনায়ক শান্তর কাছে। ৮০ বলে ৪১ রান করেন তিনি। সবচেয়ে বড় কথা, মাথায় বল লাগার পরও বিচলিত হননি তিনি। মিরাজ ছাড়া চট্টগ্রাম টেস্টের প্রাপ্তি হিসেবে ওপেনিং জুটির ভালো খেলা, সাদমানের সেঞ্চুরি, তাইজুলের ৫ উইকেট শিকার ও সাকিবের রান করাকে মনে করেন শান্ত।
শেষের তিন উইকেটে তৃতীয় দিন প্রায় দুই সেশন ব্যাট করে বাংলাদেশ। তাইজুল, সাকিব ও হাসানকে নিয়ে ১৫৩ রান যোগ করে। মিরাজ ১০৪ রান করে ওয়েলিংটন মাসাকাদজাকে উইকেট দেন। নার্ভাস নাইটির ঘরে প্রবেশ করে কিছুটা ঝুঁকির মুখে ছিলেন মিরাজ। ৯৮ রানে পৌঁছানোর পর সেঞ্চুরি ছুঁতে দুই রান নিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ফিল্ডারের কাছে বল চলে যাওয়ায় এক রানে থামতে হয়। তখন স্ট্রাইকে হাসান থাকায় দুশ্চিন্তায় পড়ে গিয়েছিল সবাই। ড্রেসিংরুমে খেলোয়াড় ও কোচিং স্টাফের সবাই দাঁড়িয়ে গিয়েছিলেন। কখন হাসান আউট হয়ে যায়, সে ভয় কাজ করছিল হয়তো। কিন্তু হাসান ছিলেন দৃঢ়চেতা। মাসাকাদজাকে ডিফেন্স করে স্বস্তি দেন।
মিরাজ স্ট্রাইকে এসে মেদেভেরের প্রথম দুই বলে ঝুঁকি নেননি। তৃতীয় বলে এক রান নিয়ে ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় টেস্ট সেঞ্চুরির স্বাদ নেন। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে সিরিজ ও দ্বিতীয় টেস্টের সেরা খেলোয়াড় মিরাজ। প্রথম ম্যাচের উভয় ইনিংসে ৫ উইকেট করে ছিল তাঁর। চট্টগ্রামে অতীতের সব পারফরম্যান্স ছাড়িয়ে গেছেন। সেঞ্চুরির সঙ্গে ৫ উইকেটপ্রাপ্তি, দুই হাজার রানের মাইলফলক পেয়েছেন। ২০২১ সালে এই চট্টগ্রামেই ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে সেঞ্চুরি করেছিলেন তিনি। ২১৭ রানে পিছিয়ে থাকা জিম্বাবুয়ে দ্বিতীয় ইনিংসে অলআউট হয় ১১১ রানে। ফ্লাডলাইটের আলো জ্বেলে নির্ধারিত সময়ের বেশি খেলান আম্পায়াররা। প্রায় সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত খেলা হয়। জিম্বাবুয়ে ক্রিকেটাররা তাতে আপত্তি করেননি। তাইজুল ৩, নাঈম ১ ও মিরাজ ৫ উইকেট নিলে ম্যাচ শেষ হয়।
সিলেটে প্রথম টেস্ট হারের পর চট্টগ্রামে প্রভাব বিস্তার করে খেলে ম্যাচ জেতার পরও খুশি নন অধিনায়ক শান্ত, ‘আমি টেস্ট সিরিজ ড্র করে খুশি না। কারণ, প্রথম টেস্টে আমরা একেবারেই ভালো খেলিনি। এই টেস্টে একপেশে খেলে জিতলেও সিরিজে আরও ভালো খেলা উচিত ছিল। সিরিজটি জিততে হতো।’ টাইগার দলপতি জানান, এই পারফরম্যান্স শ্রীলঙ্কা সফরে কাজে দেবে। দেশের মাটিতে স্পোর্টিং উইকেট বানিয়ে বিদেশে খেলার পরিবেশ তৈরি করছিল বিসিবি। ২০২৩ সালে নিউজিল্যান্ড সিরিজ থেকে স্পোর্টিং উইকেটে খেলা হচ্ছে। কিউইদের বিপক্ষে সিলেটে ঐতিহাসিক জয় পেলেও মিরপুর থেকে হারতে শুরু করে। দেশের মাটিতে টানা ছয় হারের পর জয়ের দেখা পেল বাংলাদেশ।