সুরা লোকমান পবিত্র কোরআনের ৩১তম সুরা। সুরাটি মক্কায় অবতীর্ণ। এতে ৪ রুকু, ৩৪ আয়াত। যারা নামাজ পড়ে, জাকাত দেয় এবং পরলোকে বিশ্বাস করে, তাদের জন্য পবিত্র কোরআন একটি একক কিতাব ও পথনির্দেশক। লোকমান হাকিম একটি পরিচিত নাম।লোকমান স্বীয় পুত্রের প্রতি আল্লার একত্ব বা তার কৃতজ্ঞতা স্বীকার, মা-বাবার সেবা, নামাজ আদায়, জাকাত প্রদান ও বিপদে ধৈর্য ধারণ সম্পর্কে যেসব উপদেশ দিয়েছিলেন, তা উল্লেখ করা হয়েছে। অহংকার না করা, সংযতভাবে চলাফেরা এবং নম্রভাবে কথা বলার জন্য উপদেশ দিয়ে বলা হয়েছে, গলার আওয়াজের মধ্যে গর্দভের গলাই সবচেয়ে শ্রুতিকটু।
লোকমান তার ছেলেকে উপদেশ দিয়েছিলেন। উপদেশগুলো বদলে দিতে পারে জীবনে চলার ধরন।
উপদেশ–১: আল্লাহর কোনো শরিক কোরো না । আল্লাহর শরিক করা তো চরম সীমালঙ্ঘন।
আরও পড়ুনফজরের নামাজ পড়লে ১০ পুরস্কার পাওয়া যায়২২ নভেম্বর ২০২৩উপদেশ–২: নামাজে দাঁড়ালে অন্তরের হেফাজত করা। নামাজে দাঁড়ালে তখন মনকে স্থির রাখা কষ্ট হয়ে পড়ে। ধরা যাক কোনো একটা জিনিস হারিয়ে ফেলেছেন। অনেক খুঁজেও পাননি। দেখা যায়, নামাজে দাঁড়াতেই মনে পড়ে, জিনিসটা অমুক জায়গায় শয়তান মনকে স্থির থাকতে দেয় না। নামাজে দাঁড়ালেই সারা দিনের হিসাব কষে। নামাজে দাঁড়ালে কাজের রুটিন তৈরি করে। লোকমান হাকিম বলেন, নামাজের সময় অন্তরের হেফাজত কর।
উপদেশ–৩: খাবার ধীরেসুস্থে খাওয়া। তাড়াহুড়ো করে খাবার খেতে গিয়ে গলায় আটকে যায় অথবা খাবার ওপরে উঠে নাক জ্বালাপোড়া করে। একটু অসতর্কতায় বড় বিপদ ডেকে নিয়ে আসতে পারে। এজন্য লোকমান হাকিম খাওয়ার সময় তাড়াহুড়ো করতে নিষেধ করেছেন।
আরও পড়ুনসুরা ইয়াসিনে আছে এক কাঠমিস্ত্রির ঘটনা০৪ নভেম্বর ২০২৩উপদেশ–৪ : অন্যের ঘরে গিয়ে এদিক-ওদিক না তাকানো। এ অভ্যাস থাকলে দূর করা উচিত। লোকমান হাকিম বললেন, অন্যের ঘরে যেন চোখের হেফাজত করে। আপনার জন্য তারাও যেন লজ্জিত না হয় আপনিও যাতে লজ্জিত না হন।
উপদেশ–৫: কথা বলা বা ভাষণ দেওয়ার সময় নিজেকে সংযত রাখা। অসতর্কভাবে কথা বললে বিপদ হতে পারে। বেশি কথা বললে নিজের মর্যাদার হানী হয়।
উপদেশ–৬: মৃত্যুকে এক মুহূর্তের জন্যও না ভুলে যাওয়া। মৃত্যুর কথা স্মরণ রাখা। কারণ যে কোনো সময় মৃত্যু চলে আসতে পারে।
উপদেশ–৭: আল্লাহকে স্মরণ করা। আল্লাহ বলেন, তোমরা আমাকে স্মরণ কোরো, আমিও তোমাদের স্মরণ করব (সুরা বাকারা, আয়াত: ১৫২)। যার অন্তরে সব সময় আল্লাহর জিকির থাকবে, যার জিভ সব সময় আল্লাহর জিকিরে ব্যস্ত থাকবে, আল্লাহ তাঁকে প্রিয় বান্দাদের কাতারে শামিল করে নেবেন।
আরও পড়ুনরুমির ‘মসনভি’তে কোরআনের মর্মবাণী১৫ নভেম্বর ২০২৩উপদেশ–৮ : কারো উপকার করলে সেটা একেবারের জন্য ভুলে যাওয়া । কেউ কারও কাছে সহজে হাত পাতে না; অভাবে পড়ে কিংবা বিপদে পড়ে মানুষ সাহায্য চায়। উপকার করলে তা নিয়ে খোঁটা দেওয়া যাবে না।
উপদেশ–৯ : কেউ আঘাত দিয়ে থাকলে ভুলে যেতে হবে।
আরও পড়ুনআল্লাহর কাছে আশ্রয় চাওয়া হয় সুরা নাসে০৯ নভেম্বর ২০২৩.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ল কম ন হ ক ম র জন য আল ল হ উপদ শ স মরণ
এছাড়াও পড়ুন:
ক্ষণিকের অসতর্কতায় নিভছে প্রাণ
ঈদের ছুটিতে মায়ের সঙ্গে ফরিদপুরের নগরকান্দায় গ্রামের বাড়িতে গিয়েছিল ৫ বছর বয়সী নাজিবা ও ৩ বছরের নাফিজা। ঘরে কাজ করছিলেন মা, সামনের উঠানে খেলছিল দুই বোন। কিছুক্ষণ পর খোঁজাখুঁজি করে পুকুরে পাওয়া যায় তাদের নিথর দেহ। গত ৬ জুন দক্ষিণ কাইচাইল গ্রামের এ ঘটনা শুধু এই পরিবারকে নয়, কাঁদিয়েছে পুরো এলাকাবাসীকে।
গ্রামের মুক্ত পরিবেশে ছুটির উচ্ছ্বাস, আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে আড্ডা– সবই নিমেষে মাটি হয়ে গেছে অনেক পরিবারে। সমকালের প্রতিনিধিদের পাঠানো তথ্য অনুযায়ী, এবারের ঈদুল আজহার ছুটিতে ৫ থেকে ১৩ জুন পর্যন্ত পানিতে ডুবে মারা গেছে ৫৩ জন। তাদের বেশির ভাগই শিশু। প্রতি ঈদেই এমন মর্মান্তিক ঘটনা নাড়া দেয় সবাইকে। তবে মৃত্যু রোধে রাষ্ট্রীয়ভাবে নেওয়া হয় না কার্যকর উদ্যোগ। পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যুর ঘটনা ঘটলে প্রায়ই দায় চাপানো হয় মায়ের ওপর। কিন্তু গবেষকরা বলছেন, এটি সামগ্রিক সামাজিক ব্যর্থতা। একটু সচেতন হলে এ ধরনের দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব। এ জন্য প্রাতিষ্ঠানিক নজরদারি প্রয়োজন।
দ্য সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্চ বাংলাদেশ (সিআইপিআরবি) এবং আইসিডিডিআর,বির গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতিবছর প্রায় ১৪ হাজার শিশু পানিতে ডুবে মারা যায়। অর্থাৎ প্রতিদিন গড়ে ৪০টি শিশু প্রাণ হারায়। তাদের ৭৫ শতাংশের বয়স ৫ বছরের কম। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশে পানিতে ডুবে প্রতিবছর আহত হয় অন্তত এক লাখ শিশু, তাদের মধ্যে প্রায় ১৩ হাজার পঙ্গু হয়ে যায়।
একের পর এক ঘটনাঈদের ছুটির আগের ১০ দিনে (২৪ মে-৪ জুন) পানিতে ডুবে মৃত্যু হয়েছে ১৫ জনের, তাদের মধ্যে শিশু ১৩টি।
গত ২৬ মার্চ থেকে ৬ এপ্রিল পর্যন্ত ঈদুল ফিতরের ছুটিতে মোট ৪৯ জন পানিতে ডুবে মারা গেছে। এর মধ্যে শিশু ৪৭টি (ছেলে ৩০, মেয়ে ১৭)। তাদের বেশির ভাগই মারা গেছে বাড়ির কাছের পুকুরে।
ফাউন্ডেশন ফর ডিজাস্টার ফোরামের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে ঈদুল ফিতরে ৬২ জন ও ঈদুল আজহায় ৭৭ জন পানিতে ডুবে মারা গেছে। শূন্য থেকে ১৮ বছর বয়সীদের মধ্যে পানিতে ডুবে মৃত্যু দুই ঈদেই সবচেয়ে বেশি হয়। ঈদুল ফিতরে ৫৮ ও ঈদুল আজহায় ৬৫ শিশু মারা গিয়েছিল। এককভাবে ছেলেশিশুর মৃত্যুর হার বেশি, দুই ঈদে মোট ৭৮ জন মারা গেছে।
ঈদের ছুটিতে শহরের অনেক মানুষ ছুটে যায় গ্রামে। শিশুদের আকৃষ্ট করে গ্রামের প্রাকৃতিক পরিবেশ। কিন্তু পরিবার ও সমাজের নজরদারির অভাবেই তৈরি হয় মৃত্যুর ফাঁদ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শহর থেকে যাওয়া শিশুদের তৎপরতা গ্রামের পরিবেশে অনেক সময় ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ে। তারা পানির আশপাশে খেলার বিপদ সম্পর্কে সচেতন নয়। শহরের অনেক শিশু জানে না খাল-বিল, ডোবা-পুকুর খুবই বিপজ্জনক হতে পারে। আবার গ্রামে বিস্তৃত পরিবেশে শিশুদের তদারকির অভাবও প্রকট। মা-বাবা বা অভিভাবকরা অনেক সময় ঘরের কাজে ব্যস্ত থাকেন, কেউ খেয়াল রাখে না শিশুর গতিবিধির ওপর।
ফাইলেই বন্দি থাকে সরকারি সিদ্ধান্ত
২০১১ সালের জাতীয় স্বাস্থ্যনীতিতে পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যুকে জনস্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে উল্লেখ করা হয়। এরপর ২০২২ সালে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় ৮ হাজার কমিউনিটি বেইজড চাইল্ড কেয়ার সেন্টার স্থাপনের ঘোষণা দেয়। উদ্দেশ্য ছিল এক থেকে পাঁচ বছর বয়সী শিশুর জন্য নিরাপদ পরিবেশ ও সাঁতার শেখার সুযোগ তৈরি করা। কিন্তু বাস্তবে কয়েকটি প্রশিক্ষণ ছাড়া কিছুই হয়নি।
২০১৫ সালে স্কুল-কলেজে সাঁতার শেখানোর নির্দেশনা দেওয়া হলেও তা এখনও উপেক্ষিত। জেলা প্রশাসকদের ভূমিকা নির্ধারিত থাকলেও বাস্তবায়নের চিত্র শূন্যের কাছাকাছি।
শিশু রোগ বিশেষজ্ঞ ডা. শামীমা আক্তার বলেন, গ্রামে বাড়ির পাশেই থাকে পুকুর। শিশু যে কোনো সময় পানিতে পড়ে যেতে পারে। এ নিয়ে পরিবারগুলো এখনও সচেতন নয়।
গবেষক গওহার নঈম ওয়ারা বলেন, একটি শিশু মারা গেলে আমরা বলি– মা খেয়াল করেনি। প্রশ্ন হলো, কেন শুধু মা? বাবা, দাদা, দাদি, চাচা, ফুফু– কারও কি দায়িত্ব নেই? সমাজ এই দায়িত্ব অন্যদের ভাগে দেয় না বলেই এমন দুর্ঘটনা ঘটতে থাকে। তিনি আরও বলেন, যখন মৃত্যু হয়, তখন সবাই বলে দুর্ঘটনা। কিন্তু এটি এক ধরনের অবহেলাজনিত হত্যা। প্রতিটি মৃত্যুর বিচার হওয়া উচিত, অন্তত ময়নাতদন্তের মাধ্যমে মৃত্যুর প্রকৃত কারণ নিশ্চিত হওয়া উচিত।
রেকর্ড নেই, পদক্ষেপও নেই
পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যু নিয়ে সরকারি পর্যায়ে কোনো নিয়মিত রেকর্ড নেই। হাসপাতাল, থানা, ইউনিয়ন পরিষদ বা পৌরসভা কোথাও মৃত্যুর প্রকৃত কারণ উল্লেখ করা হয় না। অনেক পরিবার শিশুর ময়নাতদন্ত করায় না, ফলে মৃত্যুর কারণ থেকে যায় আড়ালে।
ইন্টারন্যাশনাল ড্রাউনিং রিসার্চ সেন্টার (আইডিআরসি) বাংলাদেশের ডিরেক্টর ড. আমিনুর রহমান শিশুস্বাস্থ্য, মানসিক বিকাশ ও অপমৃত্যু রোধে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন। তিনি বলেন, অপঘাতজনিত কারণে আমাদের দেশে প্রতিবছর যত শিশু মারা যাচ্ছে, তার দ্বিতীয় সর্বোচ্চ কারণ পানিতে ডুবে যাওয়া। সবাই বলে নিউমোনিয়া, ডায়রিয়ায় বেশি শিশু মারা যায়। কিন্তু বেশি শিশু মারা যায় পানিতে ডুবে। তিনি বলেন, এই মৃত্যু নিয়ে কোনো রিপোর্টিং সিস্টেম নেই। অথচ ইউনিয়ন পরিষদের মাধ্যমে রেকর্ড শুরু করা হলে বছর শেষে পরিকল্পনা করা যেত। এখন আমরা শুধু খবরের কাগজ পড়ে কষ্ট পাই, কিছুই করতে পারি না। পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যুর সবচেয়ে বেশি ঘটনা ঘটে সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১টার মধ্যে, যখন পরিবারের সদস্যরা ব্যস্ত থাকেন। এই সময়টাতে শিশুদের জন্য যত্নকেন্দ্র চালু করা অত্যন্ত জরুরি।
ইউনিসেফ বাংলাদেশের অফিসার ইনচার্জ ও চাইল্ড প্রটেকশন চিফ ড. এলিসা কল্পনা বলেন, প্রতিটি শিশুর প্রাণই মূল্যবান। একটি জীবন গেল মানেই হারিয়ে গেল একটি ভবিষ্যৎ, একটি সম্ভাবনা। পানিতে ডুবে মৃত্যু প্রতিরোধে ইউনিসেফ অগ্রণী ভূমিকা পালন করে আসছে। সুইমসেফ প্রোগ্রামের মাধ্যমে শিশু ও কিশোর-কিশোরীদের জীবন রক্ষায় করণীয় সম্পর্কে শেখানো হচ্ছে।